সুমন ও কমলার একমাত্র সন্তান তিথির বিয়ের আসরে কন্যাদান করতে গিয়ে
সুমনের চোখে জল এসে গেল। তিথির এখন তেইশ বছর বয়স, কত কষ্ট করে সে তাকে কোলে পিঠে
করে বড় করেছে, লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেছে। কাল সেই তিথি তাকে ছেড়ে স্বামীর হাত
ধরে শ্বশুর বাড়ি চলে গেলে, সে কাকে নিয়ে বাঁচবে? তিথির কথা ভাবতে ভাবতে সে কোন
অতীতে হারিয়ে যায়।
তার নিজের ইচ্ছা না থাকলেও বাড়ির সকলের ইচ্ছায় ও পছন্দে শেষ
পর্যন্ত তার কমলার সাথে বিয়েটার দিনক্ষণ স্থির হয়ে একবারে পাকা হয়ে গেল। ভালো সচ্ছল
পরিবারের শিক্ষিতা সুন্দরী একমাত্র মেয়ে, অপছন্দের কোন করণও থাকতে পারে না। সুমন
নিজেও তার বাবা মায়ের সাথে কমলাদের বাড়ি গিয়ে কমলাকে দেখে এসেছে। তার ইচ্ছা ছিল
কমলার সাথে একান্তে কিছু আলোচনা করে, কিন্তু তার বাড়িতে এই ব্যাপারে যথেষ্ট
গোঁড়ামি থাকায়, বাস্তবে দু’চারবার লজ্জার মাথা খেয়ে আড়চোখে তাকে দেখে ও একটা গান
শুনে তাকে বাবা মা’র সাথে ফিরে আসতে হয়েছে।
গত পরশু বিয়ে হয়ে গেছে, আজ বৌভাত ও ফুলশয্যা। সকাল থেকে সারা
বাড়িটায় হৈ চৈ কোলাহলে মুখরিত ছিল। শীতের রাত, রাত বাড়ার সাথে সাথে নিমন্ত্রিত
সকলেই প্রায় খাওয়া দাওয়া সেরে নিজ নিজ আস্তানায় ফিরে গেছে। এ বাড়ির লোকজন ছাড়া খুব
কাছের দু’চারজন আত্মীয়ই শুধু আজ রাতে এ বাড়িতে রয়ে গেছে। বাড়ির মেয়েরা স্ত্রী-আচার
শেষে নতুন বরবধুকে তাদের ঘরে ছেড়ে দিয়ে একটু ঠাট্টা তামাশা করে ফিরে এল।
গভীর রাত, দুজনের মধ্যে কিছু কথা হলেও ঘনিষ্ঠতা দুরে থাক, দুজনকেই কিরকম
আড়ষ্ট বলে মনে হয়। হঠাৎ কমলা কাঁদতে শুরু করে। সুমন তার কাঁধে হাত রেখে থামাতে
চেষ্টা করলে সে হাত সরিয়ে দিয়ে বলে, “আমায় ছুঁয়ো না, আমি তোমায় ঠকিয়েছি। বাড়ির
কাউকে বলতে পারি নি, আমি মা হতে যাচ্ছি। মইদুলের সাথে আমার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক।
আমার বাড়ির তীব্র আপত্তিতেও আমি তাকেই বিয়ে করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার এই অবস্থা
হওয়ায়, সে ভয়ে এড়িয়ে যায়। ব্যাপারটা একদম প্রাথমিক পর্যায়, আমার বাড়িতে আমার এই
অবস্থার কথা কেউ জানে না, ওদের বাড়ির কে কে জানে বলতে পারবো না। আমায় আপনি এখনই
তাড়িয়ে দিতেও পারেন, এই পোড়া মুখ নিয়ে আমার কোথাও যাবার নেই, তবু আমি কাল সকালেই চলে
যাব”।
প্রচন্ড রাগে, হতাশায়,
ঘৃণায় সুমন অনেক কথা বলতে গিয়েও সামলে নিয়ে শান্ত ভাবে শুধু বললো, “এসব কথা আমাকে
আগেই জানানো উচিৎ ছিল। তুমি চলে গেলেই কি আমার সমস্যা মিটে যাবে? সকলের প্রশ্নের
কি উত্তর দেব? সবাই জানলে আমার মান সম্মান সবই তো ধুলোয় মিশে যাবে। বরং এক কাজ করো,
কাউকে কিছু জানানোর দরকার নেই, যে আসছে সে আমাদের সন্তান হিসাবেই স্বীকৃতি পেয়ে বড়
হোক”।
কমলা সুমনকে একটা প্রণাম করে বললো, “তুমি সত্যিই মহান আমায় তুমি
ক্ষমা করতে পারবে তো, আমাকে ও আমার সন্তানকে করুণার চোখে দেখবে না তো”?
সুমন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবলো, ইচ্ছাকৃত অপরাধ
অকপটে স্বীকার করা, আর অনিচ্ছাকৃত অপরাধ
গোপন করা, দুটোই তো সমান অপরাধ, সে নিজেও তো সেই একই অপরাধে অপরাধী। বছর তিনেক
আগেই তো বাইক দুর্ঘটনায় তলপেটে ভীষণ রকম আঘাত পেয়ে অস্ত্রপচারের পর হাসপাতাল থেকে
ছাড়া পাওয়ার সময় সে ডাক্তারের রিপোর্ট থেকে জেনেছিল, যে তার পক্ষে কোনদিন আর কোন সন্তানের
জন্ম দেওয়া সম্ভব নয়। এই ভালো হ’ল, সেও তো আর সবার মতোই একটা সন্তান কামনা করেছিল।