গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৬

সুবীর কুমার রায়

ইচ্ছা পুরণ

দীর্ঘদিন পরে আজ অভিষেকবাবুর বাড়িতে একটা কাজে আসতেই হ’ল। বৈঠকখানার নরম সোফায় আরাম করে বসে, ঘরের  চারদিকটা একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। অভিষেকবাবু পাশের সোফায় বসে। সোফার গদির মতোই নরম তুলতুলে কুকরটা কখনও চোখ বুঁজে শুয়ে, কখনও বা তার গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে বিকট চিৎকার করছে। এই কুকুরটার এই এক রোগ, কম দিন তো দেখছি না, কোন সময় ইনি একা থাকবেন না। বাধ্য হয়ে একে রাতে কারো না কারো ঘরে স্থান দিতে হয়। অভিষেকবাবুর স্ত্রী, মিতা সুদৃশ্য পেয়ালায় চা দিয়ে গেলেন। এই ভদ্রমহিলা চা টা বড় ভালো তৈরি করেন। এই চায়ের লোভে কতদিন তাঁর বাড়িতে এসেছি। আজ কিন্তু চায়ের পেয়ালায় প্রথম চুমুক দিয়েই, মুখটা কিরকম বিস্বাদ হয়ে গেল। মনে পড়ে গেল কত কথা।  

অভিষেকবাবুর জীবনে কামনা বাসনা তেমন বিশেষ কিছু ছিল না। তবে অল্প হোক বা বেশি, ন্যায়ই হোক বা অন্যায়, জীবনের প্রতিটি ইচ্ছা কিন্তু সময় নিলেও, শেষ পর্যন্ত তার পুরণ হয়েই এসেছে। স্কুল ও কলেজ জীবন সুস্ঠভাবে অতিক্রম করে চাকরির জন্য আর পাঁচজনের মতো হাঁ করে তীর্থের কাকের মতো বসে থাকতে হয় নি। ভালো চাকরি পাওয়ার পর নিজের পছন্দের বিবাহেও সেরকম বাধা, কোন পক্ষ থেকেই ভোগ করতে হয় নি। ঝাঁচকচকে মার্বেল মোড়া আট কামরার বাড়ি, দামি টিভি, দামি ফ্রিজ,  আদরের সৌখিন কুকুর, সব, একে একে সবই হয়েছে। কিন্তু যত বাধা, যত অপেক্ষা, সব যেন  তার এই প্রৌঢ় বয়সের জন্য অপেক্ষা করে বসে ছিল। 
  
অভাবের সংসারে খুব কষ্টেসৃষ্টে দিন কাটলেও, তার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে বাবা-মা কখনও কার্পণ্য করেন নি। অনিকেতবাবু তাঁর সল্প আয় থেকে বা ধার করেও, ছেলের সেইসব খরচ মুখ বুজে চালিয়ে গেছেন। ঘাটতি যেটা হ’ত, সেটা স্ত্রী রমলা যে কিভাবে সংসার খরচ কাটছাঁট করে যোগান দিতেন, কেউ জানতেও পারতো না। অনিকেতবাবুর সারাটা জীবন একান্নবর্তী সংসারের জোয়াল টানতে গিয়ে সখ-আহ্লাদ জিনিসটা যে কী, বুঝে উঠবার সুযোগ পান নি। চাকরি থেকে অবসর নিয়েও পেনশনের সামান্য টাকা সংসারের মঙ্গল, শেষ জীবনের শান্তি ও পুত্র অভিষেকের ঘাড় থেকে অর্থনৈতিক বোঝা লাঘব করতে, হাসিমুখে ব্যয় করে যান। সখ বলতে সামান্য বিড়ি, মাসের প্রথম কয়েকটা দিন দু-একটা সিগারেট ও জীবনের শেষপ্রান্তে এসে নাতির সান্নিধ্য, ও মাঝেমধ্যে বাজার থেকে ফেরার পথে একটা আলুর চপ্ বা বেগুনি কিনে এনে চায়ের সাথে খাওয়া। স্ত্রী রমলার জীবনে কিন্ত ছোটখাটো কোন সখ-আহ্লাদ মেটাবারও সুযোগ তেমন আসে নি।

সংসারটা সুখ স্বাচ্ছন্দ বা ভালোরকম স্বচ্ছলতার মুখ দেখার আগেই, অনিকেতবাবুর জীবনাবসান হ’ল। অনিকেতবাবুর পেনশন প্রায় অর্ধেক হয়ে যাওয়ায়, স্ত্রী রমলার জীবনে কালো মেঘের ছায়া দেখা দিল। আগের মতোই সংসার খরচের জন্য একটা থোক টাকা মা’র হাতে তুলে দিয়েই অভিষেকবাবু নিশ্চিন্ত। কিন্তু আগের থেকে সংসার খরচের পরিমান বিশেষ না কমলেও, সংসার খরচের টাকার যোগান যে অনেকটাই কমেছে, এটা একবার ভাবার প্রয়োজন বোধও তিনি করলেন না। রমলাকেই বেশিরভাগ দোকান বাজার করতে হয়, ফলে মাসের মাঝখানে অতিরিক্ত টাকা চাইলে, টাকার থেকে কথাই বেশি জোটে।
  
আরও অনেক বছর কেটে গেছে, রমলা বার্ধক্যজনিত রোগে কাহিল হয়ে অভিষেকের আট কামরার প্রাসাদের এক কোণে পড়ে থাকেন। বাড়িতে কোন অতিথি এলে, বা খুব একটা প্রয়োজন না হলে, সারাদিনে ঐ ঘরে কেউ ঢোকার প্রয়োজনও বোধ করেন না। অভিষেকবাবুর বড় শখ, ঐ ঘরটাকে ভালোভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে ঝাঁচকচকে একটা বৈঠকখানা করেন। বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন তাঁর মনোবাঞ্ছার কথা শুনে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছেন, আর কতদিনই বা বাঁচবে, একটু মানিয়ে নাও। উত্তরে অভিষেকবাবু বলেন “সে তো কতবছর ধরে শুনে আসছি— আর কতদিনই  বা বাঁচবে”। 

রমলার ঘরের পাশ দিয়ে ছেলে, বউমা, নাতি যাতায়াত করলেও, কেউ তার ঘরে ঢোকেন না। রমলার ডাকে অভিষেকবাবু স্পষ্ট জানিয়েও দিয়েছেন, যে যেদিন এই ঘর খালি হবে, সেদিনই তিনি আবার এই ঘরে ঢুকবেন, তার আগে নয়। বৃদ্ধা রমলা সারাদিন একা শুয়ে শুয়ে ভাবেন আয়াটা আছে বলে তবু মাঝেমধ্যে মানুষের মুখ দেখা যায়, দু’টো কথা বলা যায়, কিন্তু সে আর কতক্ষণ, আয়াটাও তো হয় পাশের ঘরে বসে টিভি সিরিয়াল দেখে, নাহয় বাড়ির ফাইফরমাশ খাটে। সিরিয়াল চলাকালীন বিজ্ঞাপনের বিরতি, বা পরের সিরিয়াল আরম্ভের মধ্যবর্তী অবস্থা ছাড়া তাকে ডেকেও পাওয়া যায় না। বাড়ির আর সবার সাথে বসে টিভি দেখলেও না। 

ছেলে বা বউমাকে একবারেই যে ঘরে ঢুকতে দেখা যায় না, তা কিন্তু নয়। বাইরের কেউ, বা আত্মীয় স্বজন এ বাড়িতে এসে যদি রমলার সাথে দেখা করতে তাঁর ঘরে ঢোকেন, তাহলেই হয় সকলে, নাহয় কোন একজন সঙ্গে করে নিয়ে ঘরে ঢোকেন। কারণ একটাই, পাছে রমলা বেফাঁশ কিছু বলে বসেন। আর বাড়ির লোক সঙ্গে না ঢুকলে, দর্শনার্থী দর্শন সেরে ঘর থেকে বার হওয়া পর্যন্ত  কেউ না কেউ আড়াল থেকে কথোপকথন শোনেন। দর্শনার্থী বিদায় নেওয়ার পরে কথোপকথনের বিষয় ও প্রশ্নোত্তরের উপর তাঁর বাকি দিনটার ব্যবহার প্রাপ্তি নির্ভর করে। পুত্র, পুত্রবধু, নাতি বা পরিচিত ও বিশ্বস্ত অন্য কেউ আড়াল থেকে পাহারা দিলে যত না বিপত্তি, সর্বক্ষণের আয়াটি এই ভুমিকায় অবতীর্ণ হলে বিপদ বাড়ে শতগুণ। রমলার সব কথা মিথ্যা প্রমানিত করে, তার পেশ করা রিপোর্টটি অভিষেকবাবু বেদবাক্য হিসাবে গ্রহণ করেন। আর করবেন নাই বা কেন? একদিকে দুষ্ট গরুটি তাঁর সাধের গোয়াল ঘরটি শুন্য না করে বছরের পর বছর বেদখল করে বসে আছেন, অপরদিকে বিশ্বস্ত সর্বক্ষণের আয়াটি মাস মাইনের বিনিময়ে ঘরের নানান কাজ, ফাইফরমাশ খাটা, হঠাৎ প্রয়োজনে ছুটে গিয়ে দোকান বাজার থেকে প্রয়োজনীয় দ্রব্যটি এনে দেওয়া, এমনকী রমলাদেবীর সারা দিনের কুকীর্তির পুঙ্খনাপুঙ্খ বিবরণ দেওয়ার কাজটি তো সেই করে। সংসারে কার প্রয়োজন বেশি? যেকোন বুদ্ধিমান লোক যা করতো, অভিষেকবাবুও তাই করেন, আয়াকে বেশি বিশ্বাস করেন। অভিষেকবাবুর ফ্রেন্ড, ফিলোজফার এন্ড গাইড বন্ধুটিও এই সিদ্ধান্তটি সঠিক বলেই বিবেচনা করেন।

অবশেষে অবস্থা এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়ালো, যে রমলাদেবীকে অন্য কোথাও স্থানান্তরিত করা ছাড়া আর কোন উপায় রইলো না। শেষ পর্যন্ত একটি আশ্রমে পাঠানোর ব্যাপারটা পাকা হওয়ায়, অভিষেকবাবু নিশ্চিন্ত হলেন। ঠিক হ’ল আশ্রম কতৃপক্ষ তাদের লোক পাঠাবে রমলা দেবীকে নিয়ে আসার জন্য। বাড়িতে যেন একটা উৎসব দেখা দিল। কালী পূজোর রাতে কুলোর বাতাস দিয়ে অলক্ষ্মী বিদায়ের পর লক্ষ্মীর আসন সাজাবার মতো এই ঘর থেকে রমলা বিদায়ের পর বৈঠকখানা সাজাবার আয়োজনের জন্য সব ব্যবস্থা পাকা, শুধু কিছু সময়ের অপেক্ষা।

গাড়ি এসে হাজির হ’ল, সঙ্গে তিনজন আশ্রমের লোক। বাড়িতে আর সবাইকে দেখা গেলেও, অভিষেকবাবু ও তাঁর প্রিয় কুকুরটিকে দেখা গেল না। সবার মুখে শরতের মেঘের মতো বিষাদের ছায়া, এই মেঘ বড় ক্ষণস্থায়ি, একটু পরেই মেঘ কেটে গিয়ে ঝলমলে রোদ দেখা দেবে। রমলা কতক্ষণ আগে খবরটা পেয়েছেন কে জানে, তবে নাড়ির সম্পর্কের মানুষটাকে ছেড়ে চির বিদায় কালেও দেখে বোঝা গেল না, এই বিদায় সত্যিই তাঁর কাছে কষ্টের, না শান্তি ও আনন্দের।

প্রায় পাঁজাকোলা করে গাড়িতে তোলার সময় তিনি শুধু বললেন, “সবাইকে দেখছি অভিকে দেখছিনা তো। তোমরা সাবধানে থেকো, ভালো থেকো”। জানা গেল অভিষেকবাবু নাকি বাজারে গেছেন। যে কুকুরটা এক মুহুর্তের জন্যও একা থাকলে চিৎকার করে পাড়া মাথায় করে, বন্ধ দরজার ওপারে সেও শোকে মুহ্যমান হয়ে ডাকতে ভুলে গেছে। হয়তো প্রভু-পোষ্য পাশাপাশি বন্ধ দরজার ওপারে নীরবে শোক পালন করছে। একটু পরে গাড়ি ছেড়ে দিল।

যে মানুষটা অন্যের আশার বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে বছরের পর বছর জিওল মাছের মতো বেঁচে থেকে ঘর দখল করে বসে ছিল, মাত্র তিন মাস পরেই আশ্রমের ঘরও খালি করে দিয়ে সবাইকে শান্তি দিয়ে চলে গেল।

অভিষেকবাবুর স্ত্রী ঘরে এসে বললেন, “চা তো ঠান্ডা হয়ে গেল, আর এক কাপ চা করে এনে দেব”? হাত তুলে তাঁকে বারণ করলাম। বুঝতে পারছি না ইচ্ছা পুরণ হওয়ায় এখন তারা সত্যিই সুখী কী না।