গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৬

মৌমিতা ঘোষ

অসহিষ্ণু

কালিপুজোর আগের দিন। গোটা কলকাতা আলোয় সেজে উঠেছে। সন্ধ্যেবেলায় ফেরার সময় সুনেত্রার অসহ্য লাগছিল।আলোও অসহ্য হয়! প্রতি দুমিনিটে থেমে যাচ্ছে বাস। উদ্বোধনের জন্য সেজে উঠেছে মন্ডপ, সেজে উঠেছে রাস্তাঘাট। একটু আগে এলগিন পেরিয়ে হরিশ মুখার্জি তে পড়েছে গাড়ি।পি.সি.চন্দ্র, এম.পি জুয়েলার্সের ভিড় দেখলে কে বলবে কলকাতা য় গরীব মানুষ আছে?সুনেত্রা বাসের জানলা দিয়ে উৎসবের কলকাতা দেখে আর ভাবে, ও ই কি বিচ্ছিন্ন? শুধু ওর কাছে ই কি উৎসব মানে অন্ধকার? একটার পর একটা মন্ডপে দাঁড়িয়ে পড়ছে বাস। "শালা, মোচ্ছব হচ্ছে"-বলে উঠলেন এক বয়স্ক ভদ্রলোক।পাশে বসেছিল কালো মত একটি  কোঁকড়া চুলের একটি ছেলে। গায়ে নীল সাদা স্ট্রাইপ, স্কিন ফিট টী শার্ট, আর চুল গুলো উটকো করে কাটা।কানের উপরে প্রায় ন্যাড়া, অন্য দিকে বেশ লম্বা , পেতে আঁচড়ানো ।তারমধ্যে ব্লিচ করে সোনালী করে রাখা অর্ধেক। সে হঠাৎ বলে উঠল,"কেন দাদু, আপনার কি পবলেম ? আমরা এই একটা দিনে একটু মস্তি করব, আপনার এত ফাটছে কেন তাতে?" সুনেত্রা হতভম্ব হয়ে গেল। কি উত্তর দেবে বুঝতে পারছিল না। খুব ঠান্ডা গলায় বলল, "ক্ষমা চান"। ছেলেটি তেড়ে উঠে বলল, "চাইবনা, কি করবেন আপনি? এই বুড়োটা কে হয় আপনার? "বয়স্ক ভদ্রলোক বললেন, "ছেড়ে দাও মা। এদের সাথে মুখ লাগিওনা।" 
ঠিক বলেছেন দাদু, আমাদের সাথে মুখ না লাগাতে বলুন দিদিমণিকে", মুখ কথাটা কুৎসিত করে বলল ছেলেটা । সুনেত্রা আবার ও বলল, ক্ষমা চান। ছেলেটা রুখে উঠল, এই যে অনেক বাড়াবাড়ি কচ্ছেন , হ্যা...আমি কালিঘাটের ছেলে, জানেন কি করতে পারি?"

সুনেত্রা সকাল থেকেই বিব্রত ছিল ওর অভাব, ওর সংসারের অশান্তি, (যা টাকা না থাকলে খুব সহজে যে কোন সংসারে আছড়ে পড়ে), অফিসের চাপ আর এই বিরক্তিকর জ্যাম নিয়ে। কি হল জানেনা সুনেত্রা, সব না পাওয়াগুলো থেকেই কিনা জানেনা, সজোরে একটা থাপ্পড় কষিয়ে দিল ছেলেটির গালে । ওর থাপ্পড় মারা দেখে বাসের অনেক লোক বলে উঠল, "বেশ করেছেন দিদি, বড্ড বাড় বেড়েছে, যত্তসব হুলিগানস্। "একজন পিছনের সিট থেকে বলল"মালটাকে ক্যালানো উচিত ।" বলতে যতটুকু দেরী, দুজন এসে দুটো থাপ্পড় বসিয়ে দিল । এতক্ষণ এরাই চুপ করে বসেছিল । অন্য কেউ প্রতিবাদ করলে তবে জনতার ওস্তাদি বেড়ে যায় বরাবর । ছেলেটা চড় খেয়ে কেঁউ কেঁউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, "গরীব বলে আমাকে মারছেন তো, গরীব বলে ?" বলতে বলতে একলাফে নেমে গেল ।
বাকি বাসের লোকেরা বেশ কিছুক্ষণ ওটা নিয়ে বক্তব্যে মেতে থাকল। বাসের জানলায় মুখ ডোবাল সুনেত্রা । সুনেত্রার চোখে কলকাতার সব আলো পড়ে অন্ধ করে দিল যেন....