গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৬

নিবেদিতা পুণ্যি

ছায়া-মৃত্যু
                   
                                        

            বাসায় ফিরেই জানালাটির কাছে এসে দাঁড়ালো ঈমা। মোহাম্মদপুর তাজমহল রোডের মিনার মসজিদের কাছে এ ভাড়া বাসাটিতে তারা যেদিন এলো; ঈমার জানালাতে ঝুলানো হলো ভারী পর্দা। বাইরে থেকে তার ঘরের কিছুই দেখা যায় না, কিন্তু ইচ্ছে করলেই তার ঘরের ভেতর থেকে পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরের পৃথিবীটাকে দেখা যায়। এ বাসায় আসার প্রথম থেকেই পাশের বাসার দক্ষিণের ওই জানালাটিকে ঘিরে ঈমার ঔতসুক্য।

            পাশাপাশি দুটো বিল্ডিং।দুটো বিল্ডিং এর-ই প্রবেশ দ্বার পূর্বমুখী, আর এ দুটো বিল্ডিং এর মাঝখানের সরু রাস্তাটি এ অঞ্চলটিকে একটি সরু গলিতে পরিণত করেছে। ঈমার ঘরটি তিন তলায়।তার দক্ষিণের জানলার মুখোমুখী ও বাসার জানলাটির পর্দা তেমন ভারী-ও নয়; তাই অনায়াসেই ঈমার ঘর থেকে ও বাসারও ঘরের জানলা দিয়ে মানুষগুলোকে ছায়া-ছায়া দেখা যায়। যতটা সময় নিজ বাসায় থাকে, ঈমা তার ওই জানলার দিকে মুখ করে রাখা পড়ার টেবিলের সাথেকার চেয়ারটিতে বসে থাকে। রাতের অনেকটা সময়-ই ঈমা তার ঘর অন্ধকার করে ও বাসার জানলার পর্দায় চোখ রাখে।এভাবে দিনে-দিনে ঈমার স্মৃতিতে সঞ্চয় হলো কিছু ছায়া চিত্র আর কিছু ছায়া-চরিত্র।

            একটি ছায়া-যুগল আর তাদের একটি ছোট্ট বাচ্চা ছেলেকে ও ঘরটিতে প্রায়-ই দেখা যায়। ছায়া-ছায়া নড়া-চড়া দেখেই বুঝা যায় ও বাড়ির গৃহিণীর বয়স খুব একটা বেশী না।তবে মেয়েটির চলার গতিতে কেমন যেন ক্লান্তি আর অবসন্নতা। ছেলেটি তার মায়ের কাছে খুব কম-ই থাকে। একটা কাজের বুয়াকেও মাঝে- মাঝে ওই ঘরটিতে ঢুকতে দেখা যায়। রাতে ঘুমানোর সময় ছোট্ট ছেলেটিকে নিতে আসে বুয়া। ছেলেটি তার মায়ের কাছে ঘুমুতে চেয়ে কাঁদে কিন্তু ছেলেটিকে জোর করে টেনে নিয়ে যায় বুয়া। কাঁদতে-কাঁদতে পাশের কোন ঘরে বুয়ার সাথে চলে যায় ছেলেটি।

            প্রায় রাতেই ওই দম্পতিকে দেখা যায় ঝগড়া করতে। মহিলাটিকে পুরুষ গৃহকর্তাটি প্রায় রাতেই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় বিছানায়। কখনওবা দেখা যায় ঠাস ঠাস করে গালে চড় কষছে; আর মহিলাটি উচ্চস্বরে কথা বলছে। তর্ক করার সময় মহিলাটির খোঁপা খুলে গিয়ে তার লম্বা ঘন চুল নিজের মুখটাকে বার বার ঢেকে দেয়। খুব খারাপ লাগে ঈমার। জানতে ইচ্ছে করে মহিলাটির নাম। ছোট্ট বাচ্চা ছেলেটির নাম। স্বামীটি তার স্ত্রীকে প্রহার করে কেন; তার কারন। কেনইবা ওই ছোট্ট ছেলেটিকে তার বাবা মায়ের সাথে ঘুমুতে দেয়া হয় না। কাজের বুয়া ওই ছোট্ট ছেলেটিকে নিয়ে কোন ঘরে যায়? সে কি একাই এক ঘরে ঘুমায়, না কি ঐ কাজের বুয়াটির সাথে ঘুমায়? এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়ে ঈমা। পরদিন খুব সকালে উঠে চলে যায় ইউনিভার্সিটির বাস ধরতে।

          আজ নাসিম কোন টি-শার্টটি পড়েছে? নাসিম আজ ওকে দেখে কি করবে? আজও কি নাসিম বাস ভর্তি মানুষের ভীড়ের মাঝেও অপলক তাকিয়ে দেখবে ঈমাকে? ভাবনার জগতে এমন কল্পনা ভাঁজতে-ভাঁজতে ঠিক সময়ে চলে আসে মোহাম্মদপুর রোডে যাতায়াতকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস আনন্দ

          বিকেলে বাসায় ফিরে গোসল সেরে ভাত খেতে গিয়ে টেংরা মাছের কাঁটা বিঁধে ঈমার। কয়েক নলা সাদা ভাত গিলেও কাঁটাটি সরানো যায় না। বার কয়েক আঙ্গুল দিয়ে খোঁচা-খুঁচি করে ঈমা। উহু! তা-ও বেরুচ্ছে-না কাঁটাটা। এবার বাথরুমের আয়নায় হাকরে ঈমা দেখতে পেলো কাঁটাটি তার বাম পাশের টনসিলে আটকে আছে। টিউব লাইটের আলোতে গলায় বেঁধা কাঁটাটি চিক-চিক করে উঠলো। কেন যেন ঈমার মনে হলো ওর গলায় একটা ধারালো ছুরি আটকে আছে। চিন্তাটা মাথায় আসতেই নিজে ভয়ে শিওড়ে উঠলো। দ্রুত বাথরুম থেকে বেরিয়ে ঈমা তার ভাবীর কক্ষের দিকে পা বাড়ালো।

           ঈমার ভাবী- নিদা তখনও বাসায় ফেরেনি। একটা প্রাইভেট এডভারটাইজিং ফার্মে চাকরী করে নিদা।তার শৈশব কেটেছে পাকিস্তানের লাহোর শহরে।বেশ আধুনিক আর অতি মাত্রায় পরিপাটি স্বভাবের অহংকারী নিদার সাথে কথা বলতে ঠিক স্বস্তি বোধ করে-না ঈমা।নিদা ও পারতপক্ষে ঈমাকে এড়িয়েই চলে। দুএকটা টুকটাক কথা ছাড়া তাদের দুজনের মধ্যে তেমন কথা-ও হয় না।

          ঈমার বড় ভাইয়া ইমরান বেশ গম্ভীর প্রকৃতির।মোহাম্মদপুর তাজমহল রোডেই তার অফিস। একটি বিদেশী বায়িং হাউজে চাকরী করে।চার বছর হয়েছে নিদা আর ইমরানের বিয়ে হয়েছে, কিন্তু তাদের কোন সন্তান হয়নি।তাদের এই নিঃস্তরংগ জীবনে কিছুটা ছন্দের সংযোজন ঘটাতে ঈমার আগমণ। ঈমাকে উচ্চ-শিক্ষিতা করার লক্ষ্যে গ্রাম থেকে শহরে আনা।তাই ভাই এর উতসাহে ঈমা এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক-প্রশাসন বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী।

          প্রিয় জানালাটির কাছে এসে দাঁড়ায় ঈমা।ও বাসার বউটি এখন ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির কুচি ঠিক করছে।লম্বা চুলগুলো তার বারবার দুলছে।চুলের পেছনে ক্লিপ দিয়ে ফুলের মালার দুটো লর ঝুলিয়ে দিলো মহিলাটি।ঈমা ভাবছে, এটা কোন ফুল দিয়ে গাঁথা মালা হতে পারে!রঙটা তো সাদা-ই মনে হচ্ছে! ফুলগুলো আকারে খুব বড়-ও নয়। জুঁই ফুল? না কি বকুল? কি জানি? ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না! বউটিকে এখন নিশ্চই খুব সুন্দর লাগছে! ওর বর বাড়ি ফিরে নিশ্চই ওকে আজ খুব সোহাগ করবে! ছায়া-ছায়া দৃশ্য থেকে ঈমা বুঝে নেবে তাদের সোহাগের কারুকাজ।

          ঘড়ির দিকে তাকালো ঈমা। রাত পৌণে আট-টা।আরেকটু পর-ই ভাবী বাসায় ফিরবে।বড় ভাইয়া ইমরান প্রায় রাতেই বেশ দেরী করে বাসায় ফিরে।অফিসে ওভারটাইম, বাইয়ারদের সাথে কন্ট্রাক্ট আর অর্ডার নেয়া নিয়ে আলোচনা ইত্যাদি করে বাসায় ফিরতে-ফিরতে ইমরান ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পরে। সমস্ত বাসায় ঈমা আজ একা। কিছুক্ষন এ ঘর ও ঘর ঘুরাঘুরি শেষে নিজের ঘরে ফিরে এলো আবার। টনসিল থেকে মাছের কাঁটাটা বেরিয়েছে বটে কিন্তু তখনও কিনকিনে ব্যথাটা রয়েই গেছে। ঘুমে চোখ জড়িয়ে এলো ঈমার।ঈমা আজ আর পড়তে না বসে ঘুমিয়ে গেলো অসময়েই। রাতে ভাত খেতে ডেকে-ও ঈমাকে উঠানো গেলো না। ইমরান নিদাকে ডেকে বল্লঃ থাক! ওকে আর ডেকো-না! খুব ক্লান্ত বোধ হয় আজ। ঘুমাক!

           মধ্যরাতের দিকে অস্বাভাবিক শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো ঈমার। হাত বাড়িয়ে কি যেন খুঁজলো ঈমা। চোখ মেলে দেখলো ঘরের বাতি জ্বালানোই আছে। ঘরের দরজা-ও ভেতর দিক থেকে লাগাতে ভুলে গেছে আজ। ঈমা তার আকস্মিক ঘুম ভাংগার কারন খুঁজে পাচ্ছিলো না।

           টয়লেট সেরে বেরুতেই ঘড়ির দিকে নজর গেলো ঈমার। রাত ১২:৪৭ মিনিট। এত রাত অব্দী ঈমা কখনও জেগে থাকে না। ঘুমুতে যাবার আগে ও বাসার বউটিকে সাজ গোজ করতে দেখেছিলো ঈমা। তাই তার কৌতূহল হলো এ মধ্যরাতে ঐ জানালার ওপাশের ছায়া দম্পতিরা কি করে; তা দেখার। ১৯ বছরের যুবতী ঈমা তার তারুণ্যের স্বভাবজাত ঔতসুক্য নিয়ে দক্ষিণের সেই জানালাটির কাছে এসে দাঁড়ালো।
           আবছায়া দৃশ্যে ঈমা দেখলো ও বাসার ছায়া পুরুষটি ঢুলছে।টলো-মলো পায়ে ছায়া মহিলাটিকে কাছে টানতে চাইছে, আর মহিলাটি ঘৃনা ভরে বার-বার তার কাছ থেকে সরে যাচ্ছে। একটু এগিয়ে লোকটি হ্যাচকা টানে বউটিকে তার কাছে টেনে আনলো, তারপর লোকটি তার বউটির গলা টিপে ধরলো। মহিলাটি দুহাতে তার গলা থেকে লোকটির হাত দুটি সরানোর চেষ্টা করছে।পারছে না! লোকটি তার বউটির দেহটিকে এক টানে ঘুরিয়ে এনে দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরলো। এখন পুরুষ ছায়াটি দিয়ে মহিলাটি ঢেকে আছে বলে ঈমা আর মহিলাটিকে দেখতে পাচ্ছে না। তবে পুরুষটির দেহ প্রচন্ড ঝাঁকুনিসহ মহিলাটির গলাটি আরো জোরে চেপে দিচ্ছে তা বুঝা যাচ্ছে বেশ!

          জানালার ভারী পর্দাটা একটানে একপাশে সরিয়ে দিলো ঈমা। ভালো করে দেখতে চাচ্ছে সে কি হচ্ছে ওই দুটি ছায়া চরিত্রের মাঝে। লোকটি এক পাশে সরে যেতেই ছায়া নারীর দেহটি মেঝেতে লুটিয়ে যেতে দেখলো ঈমা। মহিলাটি কি মরে গেলো? না কি এখনও বেঁচে আছে? টেবিলের সামনের চেয়ারটায় পা দিয়ে টেবিলের উপড় দাঁড়িয়ে পা দুটো উঁচু করে দেখার আপ্রাণ চেষ্টা করলো ঈমা। নাহ! দেখা যাচ্ছে না! এবার টেবিলের উপর চেয়ার দিয়ে তার উপর দাঁড়ালো।

          নিঃসাড় দেহটি মাটিতে পড়ে আছে। ঈমার সমস্ত শরীরের রক্ত হীম হয়ে গেলো।সে কল্পনাও করেনি; কখনো এমন দৃশ্য সে চোখে দেখতে পাবে। তার বিশ্বাস হচ্ছে-না এ দৃশ্য কি সে বাস্তবে দেখছে; না কি দুঃস্বপ্নে!

          ঈমা এখন কি করবে? কি করা উচিত তার? ভাইয়া ভাবীকে ডেকে বলবে, ও বাসাটিতে ঢুকে খোঁজ নিতে; জেনে আসতে মহিলাটি বেঁচে আছে কি না? না কি পুলিশকে খবরটা দিবে? পুলিশকে জানালে তো আবার বাসায় পুলিশ আসবে; ঈমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে।পুলিশ যখন ওই পুরুষ আর মহিলার বর্ননা দিতে বলবে; তখন তো ঈমা কিছুই বলতে পারবেনা! কারন ঈমা তো ও বাসার মানুষগুলোকে স্বচক্ষে দেখেনি কোনদিন। শুধু দেখেছে তাদের ছায়াবয়ব। ছায়া-ছায়া মানুষগুলোকে দেখেই ঈমার মমত্ব জেগেছে ঐ ছোট্ট বাচ্চা ছেলেটির জন্য।চরম ঘৃণা ও রাগে ক্ষুব্ধ হয়েছে ও বাসার ছায়া পুরুষটির উপর। কষ্ট পেয়েছে ওই ছায়া নারীটির অসহায়ত্বে।

          আজ রাতে ঈমা তো কোনও মানুষের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেনি, সে শুধু একটি ছায়া চরিত্রের মৃত্যু দেখেছে। ঈমা শুধু এক ছায়া-মৃত্যুর প্রত্যক্ষ সাক্ষী!