কাদায়
পা টেনে টেনে কোনরকমে উঠে আসছিল সরল। এত শুনশান জায়গায় নিজের নিঃশ্বাসের শব্দে ভয়
হয়। সারা শরীরে পাঁকআর ঝাঁঝি লেপটে আছে
জলকাদা ঢুকে
লুঙ্গিটা ভারি হয়ে উঠেছে। হাতে প্লাস্টিকে মোড়া দুটো ছেঁড়া শাড়ি । আরও প্রায় আধ
মাইল হেঁটে পৌঁছবে মালোপাড়া । পিছনে কিছু একটা সরে যাওয়ার আওয়াজ। কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে
পরে সরল। কেউ কি পিছু নিল? চুপচাপ
দাঁড়িয়ে পরে সরল। যেমন করে হোক আড়ালে আড়ালে পৌঁছতেই হবে আজ
দুটো
ভাত পেঁয়াজ তেলে মেখে খেয়ে নে মা। সে আসবে ঠিক দেখিস। কাল মাঝরাতে তোকে পিঠে করে
টেনে এতটা জল বেয়ে এখানে এনে রেখে গেছে। তখনও গা পা দিয়ে রক্ত ঝরছিল। রাতে রাতে
ফিরে গেছে তোকে বেহুঁশ দেখে। এসে পড়বে ঠিক। তুই দুটো মুখে দে রে মা... একটানা
বলছিল বলাই মালো। ঘরে কোন মেয়েছেলে নেই। এ গাঁ সে গাঁ ঘুরে গান গেয়ে ভিক্ষে করে
চালায়।
মানুষ জেবন বড়
বালাই
ঘরটি না থাক ধম্ম
যে চাই
কারে ডাকি পরাণ
ভরে
মন্দির আছে
বিধাতা নাই ...
ক'দিন আগে বলাইকে ধরে কিছু লোকজন শাসিয়ে
গেছে এবার ভোটে নাম তুলতে হবে আর নাম তোলার আগে বাপুধম্মটি বলতে হবে । বলাই হেসে
হেসে মাথা নাড়ে আর গায়। শাসানি যে তার গায়ে তেমন লাগে তা মনে হয় না।সরল কি বুঝে ময়নাকে
এখানেই এনে তুলেছে কে জানে ।লোকজন যখন লাঠি সোটা নিয়ে ময়নার ভাঙা আস্তানার দিকে
দৌড়চ্ছিলতখন সরল আর কিছুই ভাবতে পারে নি।কিসের বুদ্ধিতে কে জানে চট করে নিজের
গামছায় খানিক কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে সেটামোড়ল বাড়ির খামার ঘরের চালে ছুঁড়ে
দিয়েছিল। মুহূর্তের মধ্যে ঘুরে গেছিল ভিড়টা। সেই ফাঁকে সরলময়নার নড়বড়ে ঘরের দরজা
ভেঙ্গে ওকে প্রায় বেহুঁশ অবস্থাতেই বার করে এনে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল।তারপর প্রায়
ঘন্টাখানেক পাড় ধরে ধরে টেনে এনেছে ময়নার জলে ভারি শরীরটাকে। পাড়ে উঠেওকে ফেলে
রেখেই দৌড়েছে বলাইকাকার কাছে। তারপর দুজনে মিলে কোনরকমে মেয়েটাকে তুলে এনে ফেলে
রেখেই নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে সরল। ভিজে গায়ে গাঁয়ে ফিরলে লোকে ভাববে রোজের মতইমাঝ
রাতেজাল নামিয়ে ফিরল বুঝি নদী থেকে।
এদিকে বলাই সেই
থেকে সেঁক তাপ দিয়ে দিয়ে হুঁশ ফিরিয়েছে মেয়েটার। কিন্তু এক্কেবারে সাদা চোখে
তাকিয়ে থাকা ছাড়া মেয়েটার মধ্যে বেঁচে থাকার কোন লক্ষনই নেই। এই চব্বিশঘন্টায়
একবারো বাথরুমেও ওঠেনি।
খুব
সাবধানে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিলসরল। কেউ পিছু নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। তবু নদীর ঢালে
ঢালে এগোনোই ভালো।বেঁচে আছে কি ময়না? এত টান লাগছে বুকে কিসের লেগে কে জানে।ওর তো কেউ হয়না মেয়েটা।
প্রানের বন্ধু ছিললখাই। সেই লখাইকে বাড়ির লোক ধরে করে বিয়ে দিল সাতগাঁর ময়নার
সাথে। ছোট ফুটফুটে ময়না বউ হয়ে এল, সাথে
এল লখাইয়ের ডিঙ্গি। ময়নার বাপ যৌতুকে আরও কিসব দিয়েছিল আর দিয়েছিল এই মাছধরার নতুন
চকচকে ডিঙিখানা।লখাইয়ের বাপ বলল বউয়ের পয়ে শহর বাজারে এবার নিজের মাছের দোকান
দেব।কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সেই নৌকায় বসে ভোরের ধরা মহাশোলের কষকষে ঝোল দিয়ে
ভাত খেতে খেতেই বনবিবির এক থাবার টানে চলে গেল লখাইয়ের বাপ। সেই থেকে লখাইয়ের মা
কথায় কথায়ময়নাকেদুষত । সরল ওদের বাড়িতে গিয়েও দেখেছে কারনে অকারণে ময়না মার
খাচ্ছে। এর মধ্যে বাপ হওয়ার সখ জাগল লখাইয়ের । ছোটখাট ময়না মাথা নিচু করে বাড়ির
কাজ করত গালমন্দ খেতে খেতেই।লখাই তবুকদিন ময়নাকে আগলে রাখছিল মায়ের থেকে । ছেলে হল
ময়নার। ফুটফুটে ছেলেকে মোটা করে কাজল পরিয়ে ময়না কোলে নিয়ে বের হত ।মাঝে মাঝে সরু
গলায় সুর টেনে টেনে আদর করত 'গোপাল
আমার , কানাই আমার... ' লখাই,
ময়না, কোলের
ছেলে সব দেখে সরলেরও মাঝে মাঝে ঘরবসতের ইচ্ছে হত বই কি!এর মধ্যেই লখাই বলল
মনিহারিরপলান ঘোষের দিঘীতে জাল মেরে মাছের শ্যাওলা ছাড়াতে হবে। সরলকেও ডেকেছিল
কিন্তু ক'দিনের জ্বরে
সরলের তখন বেহাল অবস্থা। গাঁয়ের আর দুজনকে নিয়ে লখাই গেল শ্যাওলা ছাড়াতে, ফিরে এল তিনদিন পর পচা ঢোল হয়ে। দিঘীর
দামে পা জড়িয়ে জলে পড়েছিল নাকি। কিন্তু জলে বাস করা লখাই জাল ছাড়িয়ে ঘাটে উঠতে কেন
পারেনি সেটাই আশ্চর্য। কেউ বলে জলের মধ্যে বুড়ো কালকেউটে ছিল। ছোবল দিয়ে শেষ করে
দিয়েছে। কেউ বলে গলায় দাম ঢুকে দম আটকে গেছিল হয়ত।
আছাড়
কাছাড় দিয়ে কাঁদছিল ময়না আর শাপ দিয়ে দিয়ে কাঁদছিল লখাইয়ের মা।কাঁদতে কাঁদতেই দৌড়ে
ঘরে গিয়ে ঘুমন্ত নাতিটাকে তুলে এনে নিজের ঘরে আটকে দিয়েছিল। দু বছরের মধ্যে যে বউ
শ্বশুর সোয়ামী সব খেয়েছে সে তো ছেলেকেও খাবে! শোকে দুঃখেময়না পাগল হয়ে গেছিল। কোলের
খোকাটাকে একটু দেখবে বলে সারাদিন এ দোরে ও দোরেলোকের বাড়ির দেওয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে
কাঁদত।এরই মধ্যে বর্ষা এল ঝেঁপে। শেষরাতে জাল গুটিয়ে বাড়ি ফেরার সময় লখাইদের বাড়ির
নিয়মমাফিক কান্না শুনতে শুনতেই কথাগুলো পরিষ্কার হল... সাপে কেটেছে... মনসার ঝি
ডাইনি বউটাশেষ অবধিকোল থেকে নিল আমার নাতিটাকে বলে চিৎকার করে কাঁদছে লখাইয়ের
মা... দৌড়েছিল সবাই... বুড়ি নাতিকে পাশে নিয়েই ঘুমোয়। মাঝরাতে নাতির কান্নায় উঠে
নাকি দেখেলিকলিকে সবজে লাউডগাটা খোকার পা বেয়ে নেমে যাচ্ছে আর ময়না দরজায় দাঁড়িয়ে
দেখতে দেখতে খিলখিল করে হাসছে... শিউরে উঠেছিল সরল ।সোয়ামী আর ছেলে হারানোর
জ্বালায় বুড়ি ময়নাকে বাঁচতে দেবে না আর... এ সময় সবাই বাড়ির চারপাশে কার্বলিক
অ্যাসিড ছড়িয়ে রাখে। সাপের সাথে বাস করা তো নতুন না। এ বাড়িতে কোন পুরুষ নেই।
এসবগুছিয়ে করার লোক কই আর! সরল নিজেকেই দুষছিল । লখাই নেই,
এখন ওরও তো এসব খেয়াল রাখা উচিত।লখাইয়ের মায়ের ইনিয়ে বিনিয়ে
কান্নার মাঝে ময়নাকে কিন্তু কেউ কোথাও খুঁজে পায় নি সে রাতে।
নাতিটা
কিন্তু মরে নি। সাপে কাটেই নি বোধহয়। অথচ নাতি মরল নাতি মরল বলে কাঁদতে
কাঁদতেইলখাইয়ের মা ময়নার ঘর থেকে জিনিসগুলো ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলবাইরে।পরের
দিন ঘরে ফিরে চতুর্দিকে ওর জিনিস ছড়ানোদেখেও রা কাড়েনি ময়না।ঘরেও তোলেনি
কিছু।শাশুড়ি বুড়ি ওকে দেখেই লাঠি হাতে তেড়ে এসেছিল। পায়ে পায়ে পিছোতে পিছোতে বাড়ির
বেড়া পার হয়ে গেল শেষে। বিকেলের দিকে ছিপ টেনে ফেরার সময় সরল দেখেছিলনদীর ঢালের
গায়ে ভাঙা দেউলের পাশের তস্যভাঙ্গা ঘরটার গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছেময়না।সাধারণত
গাঁয়ের মেয়ে বউরা ওখানে চাতালে বসে দুটো গল্প সল্প করে,
নদীতে নেয়ে উঠে কাপড় চোপড় বদলায়।আর কোথাও ঠাঁইনা পেয়ে ঐ পোড়ো ঘরেই
আশ্রয় নিয়েছিল মেয়েটা।এদিকে লখাইয়ের মায়েরগল্পটামুখে মুখে খুবছড়াল। কেউ বলে বুড়ি
নাকি উঠে দেখেছে বড় বড় দাঁত বেরিয়ে এসেছে ময়নার। ছেলের পা ধরে টান দিচ্ছিল।সেই
টানেই খোকাটা কেঁদেওঠে । নইলে তখনি দাঁত বসিয়ে রক্ত চুষত। কেউবলে রাতে বুড়ি
ঘুমোলেই ময়না নাকি পাড়া বেড়াতেবেরোয়। কারুর ঘরের দরজা খোলা আছে কিনা দেখে...
পাড়ার
বউ ঝিরাও ধীরে ধীরেঐ ঘাট এড়িয়ে চলতে শুরু করল। সরল কখনও কখনও ঘাটে গিয়ে দেখেছে ময়না
নদীরে পারে জল কাদার মধ্যে চুপ করে বসে দূরে কোথায় তাকিয়ে থাকে। মা বাপ মরেছে
সরলের সেই কোন ছোটবেলায়। নিজেরও বে থা নিয়ে মাথা ঘামাতে ইচ্ছে করে না। শুধু এই
মেয়েটাকে দেখেই বুকের ভেতরে যেন মায়া চুঁইয়ে নামে।প্রায় দিনই খানিকটা খাবার কাগজে
মুড়ে ওর ভাঙা দরজার কাছে রেখে আসে সরল।
মাঝে
দুদিন গঞ্জে থাকতে হল। মহাজনের আড়ত থেকে টাকা তুলে চিংড়ির মীন কিনে বিকেলের দিকে
গাঁয়েফিরে দেখে সালিশি সভা চলছে। বর্ষার মধ্যেঘরে ঘরে জ্বর জ্বারি পেটের ব্যামো
ভেদবমি লেগেই থাকে। কিন্তু এবছর এসবেরকারন নাকি ময়না। অবাক হয়ে শুনছিল সরল ময়না
নিজের ছেলেটাকে খেতে না পেরে এখন গ্রামের ছেলেপুলের দিকে হাত বাড়িয়েছে। এমনকি কদিন
আগে বিভু ঘোষের নতুন বিয়োনো ছাগীটাও মরেছে ওরই নজরে। বিভুর ছেলে নাকি দেখেছে
ছাগীটা উঠোনে পড়ে যখন ছটফট করছেতখন ওদের বেড়ার ধারে ময়না একদৃষ্টিতে ওদিকেই তাকিয়ে
দাঁড়িয়ে ছিল । এই ডাইনিকে আর গাঁয়ে থাকতে দেওয়া যায় না... বলছিল অনেকেই।
অসহ্য
লাগছিল সরলের। কিন্তু সালিশি সভায় বিরোধিতা মানে নিজেকে দাগিয়ে দেওয়া। সরে এসেছিল
তখন। ঘন্টাখানেক পর হইহই শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে বুঝেছিল বিধান দেওয়া সারা হয়েছে।
ময়নাকে খুঁচিয়ে মারার উল্লাস স্পষ্ট হয়ে উঠছিল দলটার মধ্যে। চট করে ভেবে নিয়েছিল
সরল। পুলিশ থানা বারো ক্রোশ দূরে। তাছাড়া তাদের খবর দিতে পারলেও আসত কিনা সন্দেহ।
দড়ি থেকে গামছাটা টেনে তাতে তেল ঢেলে আগুনটা ধরিয়ে ছুঁড়ে দিয়েছিল মোড়লের খামারে...
খুব
সরু আলোর রেখা চুঁইয়ে আসছে দরজার ফুটো দিয়ে। পিছনে পায়ের আওয়াজে চমকে লাফিয়ে ঘুরে
দাঁড়ায় সরল। কোমরের হেঁসোটা হাতে উঠে আসে। নাহ,
পিছনে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে বলাই
"যাও কেনে,ঘরে আছে মা আমার... তবে কিছুই খাওয়াতে পারি নাই। দেখ তুমি যদি
পার"
পায়েপায়ে
এগোয় সরল। জানলার পাশে তক্তাপোষের ধারে চুপ করে দাঁড়িয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে আছে
ময়না। গোটা চুলে জট, হাতে
পায়ে এত শ্যাওলা যেন পাকা বোয়ালের শরীর। চকিতে ভেসে আসে ক'বছর আগের দেখা চিকন শ্যামলা ঘোমটা টানা নাকের নথ সামলাতে গিয়ে
হেঁচে কেশে একসা সেই ছোট্ট বউটি।
কাঁধে হাত দিতেই
চমকে পাশ ফেরে আর এই প্রথমবার দুচোখ ভেঙ্গে জল উপচে আসে মেয়েটার । শক্তপোক্ত
সরলকেদুহাতেআঁকড়ে ধরেময়না ডুকরে ওঠে 'খোকা কই! খোকানাই!!'
বাইরে বলাই
ঠাকুরের গুণগুণ সুর ভাসে
মানুষ জীবন দুই
মুঠো ছাই
কোথায় রাখি কোথায়
সাজাই
যে জন আছে হৃদ
মাঝারে
পেয়েও তারে চক্ষে
হারাই .....
নিঃশ্বাস ফেলা
দূরত্বে থেমে থাকা জল থইথই দুচোখের ভাষা পড়তে পড়তে দুটো কড়া পড়া হাত ময়নাকে বুকেটেনে
নেয় । আর না, এই সাঙ্ঘাতিক ডাইনিটাকে নিজের
বুকে আগলে রাখার সুযোগ আর হারাতে চায়না সরল।