গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৬

উত্তম বিশ্বাস

একটি বাউরা পাতিহাঁসের গল্প
                                                 


ভিজে-গমের বাটি হাতে নিয়ে বিষ্টুদের পুকুরপাড়ে চৈ চৈ করে অনেক্ষণ তোয়াজ করার পর একেবারে ধৈর্য হারিয়ে ঝপ-করে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল খেপি ! কিন্তু না , আজও সে আজরাইলকে বাগে আনতে পারল না । ক্ষেপি ডুবদেয় তো আজরাইল ভাসে , আর আজরাইল ডুব দিলে ক্ষেপি একেবারে জল ছিটিয়ে কাদা ঘুলিয়ে ছাড়ে !
একটি মাদী পাতিহাঁস । ক্ষেপির চোখে বড্ড বেয়াড়া হতচ্ছাড়ি তার আজরাইল । একঝাক হাঁসের মধ্যে ও একেবারে খাপছাড়া পরভুলানি ভিটেজ্বালানি অলক্ষ্মী ! ক্ষেপির ডিম বেঁচেই সংসার । সন্ধ্যা হলেই সে হাসগুলোর গলা খপ করে ধরে আর বাঁ হাতের চারটে আঙুল গুজেদেয় হাঁসগুলোর তলপেটে ____ ঠিক গুহ্যদ্বারের কাছে । আঙুলের আন্দাজে টিপে টিপে গুনে নেয় কাল সকালে সে ক’ডজন ডিম পাবে । কিন্তু নাহ ! প্রতিদিন ক্ষেপির হিসাবে গোলমাল হয়ে যাচ্ছে ! রোজ সন্ধ্যাবেলা সে দ্যাখে আজরাইলের তলপেটে আস্ত নোড়ার মতো একটা হেঈয়া ডিম ; কিন্তু সকাল দশটা বাজলেও দেখা যায় পরম মমতায় সেটি পেটে করে কাঠের বাক্সে বসে ঘাড়মাথা ফুলিয়ে একেবারে গোখরোর মতো ফুঁসছে ! ক্ষেপি রোজ ওদের তলপেট টিপে টিপে বাক্সে তোলে আবার সকাল হলে টিপে টিপেই ছাড়ে । আজরাইলকে ধরতে গেলেই ছোবল খেতে হয় ; তবু রেহাই নেই __ জালের মুখবান্ধা ঝুড়িতে ওকে তোলা চায়-ই চাই ! ক্ষেপির মুঠো বড় শক্ত মুঠো !

দু-পাচদিন ওকে ঝুড়িচাপা দিয়ে রেখে দেখেছে । ভোঁতা আঙুল দিয়ে গুগলি গাদিয়ে গাদিয়ে খাইয়ে দেখেছে ; তাতেও তার ডিম দেবার কোনো লক্ষণ দেখা যায়না । কিন্তু যদি না একবার ছাড়া পেয়েছে , অমনি উড়ে গিয়ে বিষ্টুদের পুকুরের জলে পুটকরে ডিমটি ছেড়ে দেবে ! বিষ্টুর মা খয়েরি , সে একেবারে মুখে মটরভাজা নিয়ে বসে থাকে ! তার ইন্তাজারি থেকে ডিমটা উদ্ধার করতে হলে ক্ষেপির আরও একটা পুকুর কাতিয়ে দিয়ে তবেই রেহাই পেতে হবে ;  বুড়ির এমন দাপট !

পরের পুকুর বলে কথা ! ক্ষেপি অন্তরে অন্তরে চিড়ের-ধানের মতো সেদ্ধ হয় , তবু মুখে হাসিটুকু বজায় রাখে । কেননা পাড়ায় ওরমতো এতো পঙ্গপাল হাঁসপাখি আর কারও নেই । দুপুরে ডিম ব্যবসায়ী শেফালি এসে বসে ক্ষেপির দাওয়ায় । আঁচলভরে  ডিম বাইরে আনে ক্ষেপি , তবু যেন তার মন ভার ! মুখ ব্যাজার দেখে শেফালি বুঝতে পারে ক্ষেপির আফসোসের কথা । শেফালি পরামর্শ দেয়___’’ শুধুশুধু গুগলি খাওয়ালি ডিম পাকে নাকো ! তুমি ধানকুড়োর পাশাপাশি  চালগম এগুলোও খাইয়ে দেখতে পার দিদি । এতে ডিম রাতারাতি পুরুষ্টু হয় ।“ শেফালি সারা গ্রাম ঘুরে ঘুরে ডিম সংগ্রহ করে আর যেখানে যেমন দরকার উপদেশ দেয় । শেফালির কথাশুনে ক্ষেপির কান্না পায় খুব ! রেশনের সমস্ত চালগম ভুষি সবই আজরাইলের জন্যে বরাদ্দ ! তাতেও যদি ওর সুমতি হয় ! ঘরের খেয়ে পরের পুকুর ভর্তি করে আসছে আদাড়ে হাঁসটি রোজ ! শেফালি মেয়েলি কৌতুহলে ফিসফিস করে জানতে চায়___” দলে মদ্দাটদ্দা আছে তো , ঝাঁপে ? “
__” কি বলো দি ! আমি ওই শেখপাড়ারথে চারজুড়া জাদরেল মদ্দা কিনে এনে ওদের দলে ছেড়ে দে রেকেচি । ওর ঝুটির পাখনা আর এট্টাও আচে দ্যাকচো না ? তাতেও যদি ও গুটি জব্দ হয় ! মরণের মত্তি মরবে সেই বিষ্টুদের কোর গত্তোয় ! খাওয়াব আমি আর ব্যাটা উটবে গিয়ে পরের খানায় !” শেফালি পান খাওয়া ঠোঁট ফুলিয়ে চিন্তার বহর আরো একটু রাঙানোর চেষ্টা করে । কিন্তু ক্ষেপির হিসাব একেবারে চুলচেরা । সে এর একটা বিহিত করেই ছাড়বে । তা-নাহলি সে হরিশমোড়লের মেয়েই না ! ঝাঁঝের সঙ্গে পয়সার পুঁটলিটা আঁচলে বেঁধে পিঠের ওপর চেলে দিয়ে বলে___” আজ উঠুক ঢেমনি পুকুর থে , পোদটিপে যদি দেখি ডিম নেই ; ওর আছড়ে নাড়ি বের করে নেব ! ওর পেট চটকাব ! চটকাব ! চটকাব ! “

শেফালি একেবারে শুকনো শিরিসফলের মত হেসে গড়িয়ে পড়ল__” তুই তো দেখছি মুরুখখু মুন্ত্রীদের মতো কতা বলচিস ! কিছু কিছু পাবলিক আছে বুঝলি , পেটে ওদের একবস্তা গম গাদিয়ে গলায় পাড়া দিবি ; দেখবি দুদিক থেকে আটার লেচি বেরোচ্চে কিন্তু আসল মতলবটা কিছুতেই বের করতে পারবিনে ! তোর আজরাইলও হচ্ছে ওদেরি একজন ! “

হঠাত ওদের কথা থামিয়ে দিয়ে ধা করে ছুটে আসে বিষ্টুর মা ! মারমুখো হয়ে একঝাঁক হাঁস খেদিয়ে দিয়ে গেল ক্ষেপির উঠোনে ! ক্ষেপি এক গামলা ভিজে গম এনে ডাক দিল__” আয় ! আয় ! চৈ চৈ চৈ________!”
কিন্তু গোল বাঁধল এইখানে ; ঝাঁকের সবাইকে ঠুকিয়ে কামড়ে তাড়িয়ে পুরো গামলার দখল নিল সেই বাউরা আজরাইল ! দেখে ক্ষেপির মাথায় রক্ত চড়ে গেল । পাশেই পড়ে থাকা একটা আধভিজে চলাকাঠ উঠিয়ে এক্কেবারে আজরাইলের মাথায় সজোরে_________! আজরাইল দুএকবার ডানা ঝাপটাবার চেষ্টা করল , পায়ের নখ দিয়ে উঠোনের ভিজেমাটিতে কয়েকবার আঁচড় কাটল ; তারপর ঠোঁটের কোনা বেয়ে কয়েকফোঁটা রক্ত মিশে গেল ভিজে গমের বাটিতে !

শেফালির ব্যবসায়ী চোখ । সে দেখতে পেল আজরাইলের তলপেটের নিচ থেকে বাটনাবাটা নোড়ার মতো দারুণ সাইজের একটা রক্তমাখা ডিম ক্ষেপির ঢাল উঠোন বেয়ে খয়েরিদের পুকুরের দিকেই এগিয়ে চলেছে !