আকাশবাবু ছেলেবেলা থেকেই একটা
সুন্দর বাড়ীর স্বপ্ন দেখতেন। খড়ের ছাওনি দেওয়া জরাজীর্ণ বাড়ীটা দেখতেন আর ভাবতেন
এই বাড়ীটাকে একদিন পাকা বাড়ীতে রুপান্তরিত করবেন। মনের মত সাজাবেন। তাই সরকারী
চাকুরী পেতে না পেতেই অফিস থেকে লোন নিয়ে বাড়ী শুরু করলেন।
প্রতিটি
ইঁটের সঙ্গে মাখিয়ে দিলেন পরম মমতা
। ঘামে চুবিয়ে দিলেন স্বপ্ন,রক্ত
দিয়ে রঙীন করে তুললেন ভেজা স্বপ্ন ।
একদিন তিন কামরার ছোট্ট পাকাবাড়ীটার স্বপ্ন বাস্তবে রুপান্তরিত হল। গৃহপ্রবেশের
দিন সেকি আনন্দ। আকাশবাবু আর তাঁর স্ত্রী স্বপ্না ও তাঁদের একমাত্র সন্তান
হিমাদ্রীকে নিয়ে গৃহপ্রবেশ করলেন। তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো দিন,মাস,বছর।
হিমাদ্রী ও ভাস্বতী । কয়েক মাসের
প্রেম ভালবাসা পেরিয়ে পরিণয়। বাড়ীতে হিমাদ্রীর পেনশন ভোগী বাবা ও বুড়ী মা । দুজনেই
প্রায়শ বার্ধক্য জনিত অসুখে ভোগেন। হিমাদ্রী একটা বেসরকারি অফিসে কাজ করে। মাইনে মোটামুটি।
বাবার পেনশন আর মাইনের টাকায় চলে যায় স্বচ্ছন্দে ।
এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক। বছর খানেক
ঘুরতেই ছোটখাটো অশান্তি । ভাস্বতী অবস্থাপন্ন বাড়ীর মেয়ে। অনভ্যস্ত ভাস্বতী
সাংসারিক কাজকর্ম শেখার বা করার আগ্রহ দেখায়নি। বুড়ী শ্বাশুড়ীকে সে কাজের মেয়ে
হিসেবেই দেখে। তাছাড়া শ্বশুর আকাশ বাবু অসুস্থ শরীর নিয়ে কাজের লোকের মত বাজার হাট
অন্যান্য ফাইফরমাশ
খাটেন। কোন অনুযোগ করতে দেখা যায়নি তাঁকে ।
কিন্তু যেদিন ভাস্বতী তিনকামরার বাড়ী
ছেড়ে আউটহাউসে থাকতে বলল সেদিন আকাশবাবুর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। তিনি ভাবতেও পারেননি
যে নিজের ঘাম রক্ত, ও লোনের বিনিময়ে যে বাড়ি তৈরি করেছেন সেখান
ছেড়ে আউটহাউসে কাজের লোকের মত থাকতে হবে। তবু তিনি মেনে নিলেন অশান্তির ভয়ে।
অব্যক্ত যন্ত্রনায় কেঁপে উঠল
বাড়ীটা । হিমাদ্রীর শত অনুরোধেও ফিরতে পারেননি তাঁর স্মৃতিবিজড়িত শোয়ার রুমে। কারনটা
বুঝতে পারেনি হিমাদ্রী। দিনের বারো ঘন্টায় বাড়ীতে নিঃশব্দে কি ঘটছে কিছুই বুঝতে
পারেনি। কেননা মা বা বাবার কাছ থেকে কোন অভিযোগই পায়নি।
একসময় আকাশবাবু সন্ধ্যেবেলায় পাশের
পদ্মঝিলে বসে ডিঙিচাঁদের জলছবি
দেখতেন। আর ভাবতেন এই ডিঙিচাঁদ একদিন পুর্ণতা পাবে। পূর্ণিমার আলোয় ভরে উঠবে 'পূর্ণিমা ভিলা'। এখন আর পদ্ম ঝিলে পদ্ম ফোটে না। ঝিলের জলে প্রতিবিম্বিত হয়না ডিঙি
চাঁদ বা পূর্ণরাকা। পদ্মঝিল ঢেকে গেছে কচুরীপানায়।
পরের বছর পরপর মৃত্যু হল পূর্ণিমা
ও আকাশবাবুর। শান্তি পেল ভাস্বতী।
শ্বশুরের জমানো টাকায় ফ্রিজ টিভি ওয়াশিং মেশিন, হুন্ডাই গাড়ী বাহারি ফার্নিচার ইত্যকার জিনিষে ভরিয়ে ফেলল বাড়ী।পুরোনো
স্মৃতি মুছে দিয়ে বাড়ীটা সাজালো নুতন সাজে।
হঠাৎ একদিন হিমাদ্রীর কোম্পানিতে
তালা ঝুললো। আকাশ ভেঙে পড়লো হিমাদ্রীর মাথায়। বেকার হিমাদ্রী বাড়িতে মনমরা হয়ে বসে
থাকত। বাড়ীর রাঁধুনি,কাজের মাসী,বাগানের মালীকে ছাড়িয়ে দিতে বাধ্য
হলো ।
দিন গেল,মাস গেল বছর
গেল। সঞ্চিত অর্থও একদিন শেষ হয়ে এলো। কথায় বলে বসে খেলে নদীর বালিও একদিন শেষ হয়।
একরাশ দীনতা গ্রাস করল হিমাদ্রী ও ভাস্বতীকে। বাড়ির সবকিছু বিক্রি করেও সামাল
দেওয়া গেলনা। অগত্যা বাড়ীটা বিক্রি করতে হলো ।
হাত বদল হতেই পূর্ণিমার আলোয়
"পূর্ণিমা ভিলা" খিল খিল করে হেসে উঠল।