গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ২৪ মার্চ, ২০১৬

তাপসকিরণ রায়

আছি, নেই


এমনটা নাকি হতে পারে। খুব অসুস্থ, মৃত্যু শয্যার লোকটা অনেক সময় দেখতে পায় যমদূত তাকে নিতে এসেছে। এর সত্যি মিথ্যার প্রমাণ দেওয়া যাবে না। 
জন্মজন্মান্তরের কথা শুনেছি। কিন্তু তার প্রমাণ কি পেয়েছি ? তবু ভাবতে হয়, মনে আস্থা রাখতে হয়। অনেক মুনি-ঋষিদের কথায় উঠে আসে এই জন্ম-জন্মান্তরবাদ। মাঝে মাঝে ভাবতে ইচ্ছে হয় অনেক কিছু। দেহ নয় , আত্মা নাকি অমর. আচ্ছা তা না হয় মেনে নিলাম, কিন্তু আমার আজের অস্তিত্ব সত্তাকে জন্মান্তর কি এমনি ভাবে ধরে রাখতে পারে ? নাকি কোন সমষ্টি আত্মার মাঝে সে মিলিয়ে যায় ? আমরা চাই, না হয় এ জন্মের কথা ভুলে যাবো, কিন্তু আমার এই খণ্ড-একক অস্তিত্বই যেন থেকে যায় আমার পরজন্মে। তা না হলে মৃত্যুতেই যদি সমস্ত নিজত্বের ইতি ঘটে যায় তবে কতটা বিমর্ষ, আস্থাহীন হয়ে যাব আমরা!
এ প্রসঙ্গে আমার রাজস্থানের এক বন্ধুর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। তার নিজের জীবনের ঘটনার কথা তিনি গল্পচ্ছলে বলে ছিলেন। প্রমাণ না থাকলেও বন্ধুর কথা আমরা বিশ্বাস না করে পারি না। এবার সেই বন্ধুর গল্পটাই আপনাদের শোনাই--
আমি প্রায় দু মাস ধরে রোগ শয্যায় পড়ে ছিলাম। ডাক্তার আসল রোগ ধরতে না পেরে নানান রোগের ওষুধ দিয়ে যাওয়ার ফলে আমি সুস্থ হবার বদলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। একদিন হঠাৎই আমার বুকের ধড়ফড়ানি শুরু হয়ে গেল। আমার হার্ট যেন বারবার লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছিল ! প্রচণ্ড বুকের ব্যথায় আমি বারংবার চীৎকার দিয়ে উঠছিলাম। এক সময় আমার মনে হল আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলছি। চোখে অন্ধকার নেমে আসছিল। চোখের সামনে কিছু হলুদ ফুলকি ফুলকি নজরে আসছিল। ব্যাস, আর কিছু আমার মনে নেই।
তারপর এক সময় আমি যেন জেগে উঠছিলাম। ঘরের লোকদের চীৎকার-চেঁচামেচি শুনতে পারছিলাম। বাবার ক্ষীণ গলা আমার কানে ভেসে এলো, ডাক্তারের নাম্বার লাগলো না--কোন ড্রাইভার এত রাতে...
মা আমার গায়ে হাত রেখে চীৎকার করে উঠলেন, ওগো আমার ছেলে মরে যায়নি তো ? স্ত্রীর কান্না কানে এলো। আমার ছেলে মেয়েরা বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়ে ছিল। আমি অনুভব করতে পারছিলাম, বিবশ একটা অনুভব আমায় জড়িয়ে ধরে ছিল। হঠাৎ আমি দেখতে পেলাম আমার অস্তিত্ব আমার দেহ থেকে আলাদা একটা ছায়ায় পরিণত হয়ে গেছে। আর এ কি ! আমি আমার মধ্যে থেকে উঠে বসেছি ! 
--হ্যাঁ, সাব, বোলিয়ে, ড্রাইভার দরজার সামনে এসে বলে উঠেছিল। 
বাব দেখলেন, ড্রাইভার হবে, কালো চাদর জড়িয়ে এসেছে। 
--হসপিটাল জানা হায়, তুরন্ত চলো--বাবা বলে উঠলেন।
আমি আর এক আমিকে দেখতে পাচ্ছিলাম ! ড্রাইভার, বাবা, মা, এমন কি মনে হল আমিও নিজের দেহটা তুলে ধরে গাড়িতে  উঠিয়ে দিতে সাহায্য করলাম। 
মেডিকেল ভেন তীব্র গতিতে মেট্রো হসপিটালের দিকে ছুটে চলছিল। আর আশ্চর্য হয়ে আমি দেখি, গাড়ীর স্টিয়ারিংয়ে আমি নিজে বসে আছি!
বাবা মুহ্যমান বসে আছেন আমায় ধরে। স্ত্রী আমার মাথার কাছে। আমার মা ঘরে থেকে গেছেন হবে তাঁর নাতি নাতনীকে পাহারা দিতে। 
তীব্র গতির মধ্যে আমি ব্রেক কষলাম। ক্যাঁচ করে একটা আওয়াজ হল। হসপিটালের মেইন গেটে পৌঁছে গেছি, গাড়ির ঝাঁকুনিতে আমি যেন আমার অন্য সত্তাকে আবার হারিয়ে ফেললাম। খুব হালকা অনুভবে বুঝতে পারছিলাম যে আমার দেহ হসপিটালের স্টাফরা স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাচ্ছে। 
এদিকে বাবা এসে অনেক খুঁজেও মেডিকেল ভেনের ড্রাইভারকে খুঁজে পেলেন না। 
পরদিন দিব্বি আমি চোখ মেলে তাকালাম। আমার সামনে আমার বাবা, মা, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, সবাই তখন দাঁড়িয়ে। 
সে দিনের ঘটনার ব্যাপারে অনেক ভেবেও কোন কুল-কিনারা করতে পারিনি, আমি যদি নাই মরে থাকি তবে কি আমার সেদিনের সেই বিচিত্র অনুভূতিগুলি শুধু অনুভূতি মাত্র ছিল ?