গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ৯ মার্চ, ২০১৬

ঝর্না চট্টোপাধ্যায়

অনাথ


আমাদের ভাইবোনেদের তিনজনেরই নজর ছিল মায়ের ওই ভাঙ্গা বাক্সটার দিকে। সেই কোন ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি, মা তার যাবতীয় সব কিছু রাখে ওই বাক্সটায়। কিন্তু জিজ্ঞেস কর, অমনি ভুরু কুঁচকে বলে উঠবেআমার জিনিস আমি  বুঝব, তোদের এত মাথা ব্যথা কিসের?’

দাদা যেদিন বাড়ির বাইরে চলে গেল, মা সারারাত ঘুমোতে পারেনি। অনেক কষ্টে মা আমাদের মানুষ করেছে। বছরের পর বছর একই জামা পরেছি, তবু স্কুলে গেছি। মা চাইত না তার ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া না শিখে ঘরে বসে থাকুক, কিংবা পরের বাড়িতে কাজ করুক। মা কাজ করেছে, রান্নার কাজ। বিকেলের দিকেও এক বাড়িতে যেত, সেলাই করতে। সেখানে নানারকম সেলাই-ফোঁড়াই হত, মাও একটু হাত লাগিয়ে আসত। তাতে টাকা খুব বেশী না পেলেও পুরনো জামা, শাড়ি এগুলো পেত যা দিয়ে আমাদের জামাকাপড়ের প্রয়োজন কিছুটা মিটে যেত। আমার আর মায়ের অসুবিধে ছিল না, মুশকিল হত দাদা আর ছোড়দা কে নিয়ে। দাদা বড় বলে নাকি মায়ের প্রথম সন্তান হওয়ার সুবাদে একটু মা-ন্যাওটা ছিল, বায়নাও ছিল। আমি আর ছোড়দা অনেক সময় অবাক হয়ে যেতাম দাদার বায়না দেখে, রাগ হত, খারাপও লাগত। দাদা কি জানে না, মা কি করে সংসার চালায়? কিন্তু দাদার সব সময় এটা চাই, ওটা দাও।খুব রাগ হত।
      দাদা চলে যাবার পর একদিন দুপুরে আমি তখন ঘুমিয়ে। ছোড়দা পাড়ার ক্লাবের ছেলেদের অনেক ধরে- য়ে একটা কাজ যোগাড় করেছে। সামান্য কাজ, টাকাও কম,  তবু তো কাজ! দাদা নেই, মায়েরও শরীর ভাঙ্গছে, কাজ না করলে চলবে কেন? ছোড়দা বাড়ি থেকে বেরোত ঠিক বিকেলের খানিক আগে, ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে যেত। দাদা ছিল না, ছোড়দাও বাইরে, মা সেলাইয়ের কাজটা ছেড়ে দিল। আমি তখন বড় হয়ে উঠছি। বাড়িতে কেউ না থাকলে চলে, আমায় কে দেখবে?
সেদিন ছোড়দা চলে যাবার পর ঘুমোতে ঘুমোতেই আমি চোখ মেলেছি। হয়ত আমার ঘুম ভেঙ্গে গেছে, নয়ত ঘুমের মধ্যেই পাশ ফিরেছি। দেখি, মা সেই ভাঙ্গা বাক্সটার থেকে একরাশ কিসব বের করেছে। অবাক হয়ে চোখের পাতা আর ফেলতে পারছি না। কিন্তু মা জানতে পারলে তো এখুনি সব বন্ধ করে দেবে, তাই ঘুমের ভান করে পড়ে আছি। দেখছি, রংচটা মলিন হয়ে যাওয়া রঙ্গিন ছোট ছোট জামা, দুটো ছোট স্টীলের বালা, একটা তোবড়ানো বাটি, খুব ছোট্ট একটা ঝিনুক এমনি আরও কত কিসব মা বার করছে, নেড়ে চেড়ে দেখছে আর ঝর ঝর করে চোখের জল পড়ছে। আমি আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করলামমা, ওগুলো কার, দাদার? 
সেদিন যে মায়ের কি হয়েছিল, জানি না। মা যেন কেমন বোবার মত আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর মাথা নেড়ে বললনা।
--তবে,কার মা, হাবলুর?’ছোড়দাকে আমি কখনও কখনও নাম ধরে ডাকি। মা মাথা নেড়ে বললনাতারপর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
                এখন অনেক রাত,আমি স্তব্ধ হয়ে বসে আছি ঘুমন্ত মায়ের দিকে তাকিয়ে। মা ককিয়ে ককিয়ে কাঁদছিল, কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ছে। মাকে এখন মা বলে ভাবতে আমার খারাপ লাগছিল। দাদা কি জেনেছিল, দাদা, আমরা মায়ের কেউ নয়? মা আমাদের হাসপাতাল থেকে এনেছিল। আমরা তবে কোথা থেকে এলাম, মা কি আমাদের চুরি করে এনেছিল? ছিঃ, মা কি চোর? মা কেন এমন করেছিল? তবে কি দাদার মত আমাদেরও চলে যেতে হবে একদিন?
আমি আর ভাবতে পারছিলাম না। যেমনই হোক,তবু তো আমাদের মা,আমাদের এত কষ্ট করে মানুষ করেছে! এক বুক রাগ-দুঃখ-অভিমান বুকে নিয়ে মাকেই  জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইলাম। শুধু একটা কথা  কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না,আমরা যেখান থেকেই আসি, মা আমাদের যেভাবেই নিয়ে আসুক, মা থাকলে একজন বাবা তো থাকবে! কিন্তু সে কই,তাকে কোনদিন দেখিনি কেন?