গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ৯ মার্চ, ২০১৬

তাপসকিরণ রায়

খালিস্থান


আনন্দ বাবুর সাময়িক ভাবে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে যায়। আজ কমাস ধরে এমনটাই হচ্ছে। মানুষের মনের  সৃষ্টিই এমনি। মনেরও সীমা থাকে, সুখ দুঃখের ভার বহনের, তারপর আসে শূন্যস্থান। সে শূন্যস্থান হল বিশ্রামের স্থান। যেমন ব্যথা ধরে রাখার মাঝেও মনের সীমানা বাঁধা আছে। সে সীমানার বাইরে গেলেই মানুষ জ্ঞান হারায়। এ সব ভগবানের দেন। আসলে সৃষ্টির সমস্ত কিছুই তো ডায়নামিক, স্বয়ংক্রিয়। মানুষ কিন্তু তার এক বিন্দু আবিষ্কার করেই মুগ্ধ হয়ে থাকে!
হঠাৎই সবকিছু মনে পড়ে যায় অনন্ত বাবুর। তাঁর পরিবার ছিল, একটা ছেলে, একটা মেয়ে, স্ত্রী। এই তো সেদিনের কথা। রাত তখন গভীর--সবাই ঘুমচ্ছিল। কেবল ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছিল আর তার ঠিক পাশের সিটে বসে অনন্ত বাবু ঝিমচ্ছিলেন। তিনি জানতেন ড্রাইভারের পাশে বসে ঝিমানো বা ঘুমানো ঠিক না। কিন্তু পারছিলেন না তিনি, বারবার ঘুমে ঢুলে পড়ছিলেন। ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, ঠিক আছে সে,  স্বাভাবিক। তবে সন্ধ্যের পর থেকেই টের পাচ্ছিলেন, সামান্য ভোঁটকা গন্ধ, তত উগ্র না হলেও বোঝা যায় সামান্য পান করেছে ড্রাইভার। ওটা ওদের স্বভাব--কথায় আছে, স্বভাব যায় না মলে ! বরং এ স্বভাবের ব্যতিক্রম হলেই ওরা বিগড়ে যায়। 
তারপরই ঘটনাটা ঘটল, হঠাৎ বিকট আওয়াজ হল, গাড়ী খুব স্পীডের মাথায় ফুল ব্রেক কষলে যেমনটা হয় ! কেঁ কেঁ চ, কোঁচ চ চ চ চ...এরপর পতনের ঘূর্ণি দোলা খেয়ে ধপাস আওয়াজ, ব ব, ভ ভ ভস, ঠাস ভস বিভিন্ন শব্দ করে থেমে গেল। আসলে গাড়ীটা উল্টে গিয়ে একেবারে ব্রিজের ধার ভেঙে নীচে নদীর চড়ে গিয়ে পড়ল । তা হাত পঞ্চাশ ওপর থেকে নীচে পড়েছে গাড়ী । একদিকে গাড়ির কান ফাটা শব্দ, তার মাঝে ছেলে মেয়ে স্ত্রীর আর্ত চীৎকার, গোঁঙানি। সে ছিল ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা !
অনন্ত বাবু সব শব্দ, চীৎকার, পতন, তারপর মাথায় তীব্র ব্যথা অনুভবের পর জ্ঞান হারিয়ে ছিলেন। তাঁর জ্ঞান ফিরল বেলা বারটার পর। ফেলফেল করে চারিদিকে তাকিয়ে অবশেষে ডাক্তার, নার্স দেখে বুঝতে পেরে ছিলেন যে তিনি হাসপাতালে আছেন। সামান্য পরেই তিনি ভাঙা গলায় কেঁদে উঠলেন, আমার স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে...? 
সবাই চুপ করে ছিল। সবার মুখ চোখ মলিন, নিচের দিকে ঝুঁকে আছে। 
অনন্ত বাবু মাথায় চোট পেয়ে ছিলেন। মাস খানেক হাসপাতালে থেকে ছুটি পেয়ে ঘরে ফিরে ছিলেন। ডাক্তারের কথা মত তিনি তখন সম্পূর্ণ সুস্থ। 
আজ ক’মাস হল ঘরে ফিরেছেন অনন্ত বাবু।  কাজ কর্মের অবসরে এ কথা তাঁর মনে পড়ে যে ছেলে, মেয়ে, বউ কেউ তাঁর বেঁচে নেই। এখন তিনি শুধু একা ! মনের  ক্ষতবিক্ষত  ভাবনাগুলি অনেক দূর এগিয়ে চলে। তার মধ্যেই হঠাৎ তাঁর কানে তীব্র একটা শব্দ এসে পৌঁছয়। সেই শব্দ--কারের ব্রেক মারার, মরণ চীৎকারের, সমস্ত কিছু গুলিয়ে যাবার ধ্বংসোদ্গার যেন ! তারপর স্তব্ধতা। সবকিছু স্তব্ধ। অনন্ত বাবু স্মৃতি শক্তি হারালেন। সুখ দুঃখের এক স্পর্ধার সীমানা পেরিয়ে অনন্ত বাবু এখন খালিস্থানে পড়ে আছেন। বর্তমানটুকুই এখন তাঁর স্মৃতির সীমানা।