গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ২৪ মার্চ, ২০১৬

সুবীর কুমার রায়

কৌশানির এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা

প্রায় চার দশক আগে হঠাৎ নৈনীতাল, আলমোড়া, রাণীক্ষেত, কৌশানি, ইত্যাদি জায়গা ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ এসে গেল। সত্যি কথা বলতে কী, সেটাই আমার প্রথম একা একা দুরপাল্লার ভ্রমণ শুধু নয়, সেটা আমার প্রথম হিমালয় দর্শন, ও তার প্রেমে পড়া। টেলিফোন ভবনের এক পরিচিত ভদ্রলোকের সুপারিশে পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফ রিক্রিয়েশন্ ক্লাবের সাথে ঐ সব জায়গা ঘুরতে যাওয়া। আমরা দলে মোট তেত্রিশজন ছিলাম, যদিও সঙ্গীদের একজনও আমার পূর্বপরিচিত নয়। অন্যান্য জায়গা ঘুরে কৌশানিতে এসে এক বিচিত্র ঘটনার সাক্ষী হওয়ার সুযোগ হয়েছিল, যা আজও মাঝে মাঝে স্মৃতিপটে উদয় হয়।
আমাদের দলে একজন ভদ্রলোক ছিলেন, তাঁর নাম ব্রজেশ্বর মুখার্জী। ট্রেন ছাড়ার পর থেকেই লক্ষ্য করলাম, তিনি সবার অতি প্রিয়পাত্র। ছোটখাটো ম্যাজিক দেখাতে পারেন, এবং তাই হয়তো ম্যজিক দেখাবার কিছু উপকরণও তিনি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। হলদোয়ানি থেকে আমরা একটা স্টেটবাস রিজার্ভ করেছিলাম। কৌশানি যাবার পথে অল্প সময়ের জন্য বাস দাঁড় করিয়ে, কয়েকজন ব্যক্তিগত প্রয়োজনে রাস্তায় নেমেছিলেন।   তাঁদের কাজ শেষ হবার আগেই, হয়তো বা শুরু হবার আগেই, আমাদের বাস ঘন ঘন হর্ণ বাজিয়ে, ছেড়ে  দিল। কোনমতে ছুটে এসে চলন্ত বাসে লাফিয়ে উঠে তাঁরা যখন উত্তেজিত হয়ে ড্রাইভারের পূর্বপুরুষদের  উদ্দেশ্যে চোখা চোখা শব্দবাণ প্রয়োগ করতে উদ্যত হ’লেন, ঠিক তখনই ড্রাইভার তাঁদের বাসের পিছন দিকে দেখতে বললো। পিছনে তাকিয়ে একটা বড় বাস ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়লো না। জানা গেল কৌশানির গান্ধী আশ্রমে আগে এলে আগে পরিষেবা নীতিতে ঘরের বুকিং দেওয়া হয়। পিছনের বাসটা আমাদের আগে সেখানে হাজির হলে, আমাদের এত লোকের থাকার জায়গা পেতে অসুবিধা হতে পারে। ব্যস, যাঁরা কিছুক্ষণ আগে ড্রাইভারের পূর্বপুরষদের উদ্দেশ্যে গালমন্দ করতে যাচ্ছিলেন, তাঁরাই এবার ড্রাইভারের উত্তরপুরুষ, এমন কী সম্ভাব্য উত্তরপুরুষদের উদ্দেশ্যেও শুভেচ্ছা ও আশীর্বাদ উজাড় করে দিতে কার্পণ্য করলেন না।
যাহোক, শেষপর্যন্ত আমরা পিছনের বাসের লোকজনের ঠিক আগে ঢোকার সুবাদে, আগে থাকার জায়গা   পেলাম। তাঁদেরও ছড়িয়ে ছিটিয়ে ব্যবস্থা হয়ে গেল। যদিও এখানে থাকা-খাওয়ার জন্য কোন চার্জ লাগেনা উল্লেখ করা আছে, তবু আমাদের কাছ থেকে মাথাপিছু দশ টাকা করে দাবি করা হ’ল। কৌশানি আমি পরেও গেছি, এখনকার মতো তখন কিন্তু এত হোটেল বা থাকার ব্যবস্থা ছিল না। থাকার জায়গার বেশ অভাব ছিল বলা-ই বোধহয় ঠিক হবে। দশ টাকার মূল্য সেই সময় খুব একটা কম ছিল না। যদিও দশ টাকায় একজনের প্রতিদিন থাকা খাওয়ার খরচ হয়তো কমই, তবু ফলাও করে কোন চার্জ লাগেনা বলে টাকা দাবি করাটা কিরকম হাস্যকর বলে মনে হ’ল। আশ্রমে পর্যটকের সংখ্যা অনেক হওয়ায়, রাতে আমরা আশ্রমের প্রধান, বা মহারাজের অনুমতি নিয়ে সকলকে রাতের খাবার পরিবেশন করলাম। আমাদের দলপতির ব্যবস্থাপনায় আমাদের রাতে শোয়ার ব্যবস্থাও মন্দ হ’ল না। আমাদের দলের তেত্রিশ জনের মধ্যে অনেক মহিলা ছিলেন, যাঁদের অনেকেরই অবসর নেওয়ার সময় প্রায় হয়ে এসেছে। এছাড়া, বেশ কিছু বয়স্ক ভদ্রলোকও ছিলেন। দলে আমরা সাতজন তেইশ-চব্বিশ বছরের যুবক ছিলাম। আমার সাথে কারো পূর্বপরিচয় না থাকলেও, তারা একই জায়গায় কর্মরত হওয়ার সুবাদে সবাই সবার বন্ধু। আমাদের দলপতি, অর্থাৎ গ্রুপ সেক্রেটারি আমাদের ‘সেভেন স্টার’ আক্ষা দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর ঐ ছয়জন সহকর্মীকে ভালোই চিনতেন, আর তাই আমার ওপর তাদের সামলে রাখার ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন।

পরদিন আশ্রমের একজন আমাদের বললেন, “আপনারা টেগোরের দেশ থেকে এসেছেন শুনে, মহারাজ আজ সন্ধ্যায় টেগোরের গান, কবিতা ইত্যাদি নিয়ে আপনাদের একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে অনুরোধ করেছেন”। প্রসঙ্গক্রমে তিনি আমাদের অনুষ্ঠান শেষে মহারাজকে চার্জের ব্যাপারটা একটু বিবেচনা করার অনুরোধ করতেও পরামর্শ দিলেন।
সন্ধ্যার পর নির্দিষ্ট বড় হলঘরটায় আমরা সবাই হাজির হলাম। অনেকেই জমায়েত হয়েছেন, বিদেশী বেশ কিছু নরনারীও হাজির হয়েছেন দেখলাম। আশ্রমের কিছু কর্মচারী ও সন্ন্যাসীসুলভ ব্যক্তিত্বদের আসন গ্রহণ করতেও দেখলাম। আর দেখলাম, তাঁদের পাশে বসে একজন বিদেশীনিকে ফুলের মালা গাঁথতে।
আমাদের মধ্যে অনেকেই চলনসই রবীন্দ্র সংগীত বা রবীন্দ্র কবিতা জানেন। প্রবীর মুখার্জী নামে একজন, ও   তাঁর স্ত্রী, উভয়েই খুব ভালো গান করেন বলে শুনলাম। যাহোক, এই প্রবীর মুখার্জী প্রথমে গান শুরু করলেন। “এসো আমার ঘরে। বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছ অন্তরে।।” গানটা শেষ করা মাত্র ঐ বিদেশীনি মালা গাঁথা ছেড়ে হঠাৎ টানা টানা বাংলায় প্রশ্ন করে বসলেন, এশো এশো আমার ঘরে এশো আমার ঘরে, টু হুম? প্রবীর মুখার্জী একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে উত্তর দিলেন, টু গড্। যাঁরা গান জানেন, বা একা গাইতে সক্ষম, তাঁরা একাই গাইলেন। সমবেত কন্ঠেও বেশ কিছু গান গাওয়া, ও কবিতা আবৃত্তিও হচ্ছিল। শীতের রাতে, নির্জন পাহাড়ের কোলে, বাঙালি, অবাঙালি, বিদেশী, সকলেই অনুষ্ঠানটি বেশ উপভোগও করছিলেন। এই পরিবেশে স্বাভাবিক ভাবেই ব্রজেশ্বর মুখার্জীর মনে ম্যাজিক দেখাবার ইচ্ছা জাগবে, এতে আর আশ্চর্য হবার কী আছে? এই ক’দিনে তাঁর বেশ কিছু ম্যাজিক দেখা হয়ে গেছে। এটাও জানা হয়ে গেছে, যে তিনি একজন ভারত বিখ্যাত ম্যাজিশিয়ানের দলের সাথে যুক্ত, এবং ম্যাজিকের বেশ কিছু উপকরণ তিনি সঙ্গে করে নিয়েও এসেছেন। কিন্তু রবীন্দ্র সংগীত বা রবীন্দ্র কবিতার সাথে ম্যাজিকের কোন সম্পর্ক না থাকায়, মহারাজের কাছে অনুমতি চাওয়া হ’ল। মহারাজ তাঁকে আধঘন্টা মতো সময় ম্যাজিক দেখাবার অনুমতি দিলেন।
ব্রজেশ্বর মুখার্জী খুব খুশি হয়ে ঘর থেকে ম্যাজিকের সরঞ্জাম নিয়ে আসলেন। উপস্থিত সমস্ত দর্শকও খুশি। কিছু পরেই তিনি ম্যাজিক দেখাতে শুরু করলেন। প্রায় প্রতিটা ম্যাজিকেই তিনি দর্শকদের মধ্যে থেকে কাউকে না কাউকে, তাঁকে সাহায্য করবার জন্য ডেকে নিচ্ছেন, কিন্তু কোনবারই আমাদের দলের কাউকে কিন্তু ডাকছেন না। আশ্রমের কেউ, বা আমাদের দেশের বা বিদেশী কোন পর্যটককে তাঁর কাছে ডেকে নিচ্ছেন। পর পর বেশ কিছু খেলা দেখাবার পর, তিনি একটা দড়ি কাটার খেলা দেখাবার সময়, এই প্রথম হঠাৎ আমাকে ডেকে বসলেন। আমি তাঁর কাছে যেতে, তিনি একটা দড়িতে গিঁট দিয়ে, আমার হাতে একটা কাঁচি দিয়ে, দড়িটা কেটে ফেলতে বললেন। আমার মনে হ’ল দড়িটা বোধহয় কাটা উচিৎ হবে না, এবং সেইজন্যই তিনি এই খেলাটায় বাইরের কাউকে না ডেকে, নিজের দলের থেকে আমাকে ডেকে নিয়েছেন। আমি খুব নীচু গলায় সত্যিই দড়িটা কাটবো কী না জিজ্ঞাসা করায়, তিনিও খুব আস্তে শুধু বললেন, “হ্যাঁ কাটো”। আমি দড়িটা তাঁর কথামতো কেটে দিলাম, ও এতক্ষণে বুঝতে পারলাম যে তিনি আকন্ঠ পান করে আছেন।
এবার আবার একটা নতুন খেলার শুরু। এবার আবার আশ্রমের একজন মালি জাতীয় কর্মীকে ডেকে, একটা  ছোট রঙচঙে লাঠি দেখিয়ে, সবাইকে শুনিয়ে বললেন যে এটা তাঁর যাদুদণ্ড, এটার সাহায্যে তিনি যা খুশি তাই করতে পারেন। এবার হঠাৎই তিনি ঐ যাদুদণ্ডের সাহায্যে কর্মীটির গাল, মাথা, কোট, ইত্যাদি থেকে কয়েন বার করে বললেন, আমার যখনই পয়সার দরকার হয়, আমি আমার এই যাদুদণ্ড দিয়ে তৈরি করে নিই। আশ্রমের সবাইকে দেখেই মনে হচ্ছিল, ম্যাজিক জিনিসটার সাথে তারা পূর্বপরিচিত নয়। ব্রজেশ্বর মুখার্জীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আশ্রমের কর্মীটি হঠাৎ বলে বসলো, “বাবু এ যাদুদণ্ড মুঝে দে দিজিয়ে”। ওর কথায় অনেকে হেসে উঠলেও, আশ্রমের কেউ কেউ গম্ভীর হয়ে গেলেন।  
বেশ চলছিল, হঠাৎ ব্রজেশ্বর মুখার্জী কোথা থেকে একটা লিকলিকে সাপ বার করে বসলেন। সাপটা রবার বা ঐ জাতীয় কিছুর তৈরি হলেও এত সুন্দর ফিনিশিং যে, যে কেউ এটাকে জীবন্ত সাপ বলে ভুল করতেই পারে। শুধু তাই নয়, ব্রজেশ্বর মুখার্জী মাঝে মাঝে কিছু একটা করছেন, যার ফলে সাপটা কিলবিল করে তাঁর হাত থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছে, এবং তখন তার কাটা জিভটাও জীবন্ত সাপের মতই বাইরে  বেরিয়ে আসছে। মুহুর্তের মধ্যে আশ্রমের সবাই ভয়ে দাঁড়িয়ে পড়লে, ব্রজেশ্বর মুখার্জী অশান্ত পরিবেশ মেরামত  করতে বলে উঠলেন, “ঠিক আছে আমি সাপটাকে বাইরে ছেড়ে দিয়ে আসছি”। তিনি দ্রুত হলঘরের বাইরে গিয়ে একটু পরে ফিরে আসলেও, ফল কিছু হল না। ততক্ষণে হলঘর প্রায় ফাঁকা। আশ্রমের মহারাজ, ও দু’-একজন ছাড়া সবাই প্রায় হল ছেড়ে চলে গেছেন। আমরা ছাড়া দর্শকদের প্রায় সবাই এরপর আর অনুষ্ঠান চলার সম্ভাবনা নেই বুঝতে পেরে হয় বেরিয়ে গেছেন, নাহয় চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছেন।
ব্রজেশ্বর মুখার্জী পরিবেশটা শান্ত করার জন্য তবু আবার বললেন যে তিনি সাপটাকে বাইরের জঙ্গলে ছেড়ে দিয়েছেন। উত্তরে আশ্রমের একজন কর্তা শুধু “কাজটা আপনি ভালো করেন নি। এখানে কোন সাপের উপদ্রব নেই, কাজেই এখানে সাপটাকে আপনি না ছাড়লেই ভালো করতেন।” বলে, ব্রজেশ্বর মুখার্জীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আমরা কিছুক্ষণ বোকার মতো দাঁড়িয়ে থেকে নিজেদের ঘরে ফিরে আসলাম। আজ রাতে কিন্তু আমাদের খাবার পরিবেশন করতে দেওয়া হ’ল না। তাঁরা সরাসরি আপত্তি না করলেও, “প্রয়োজন নেই, আমাদের তো লোক আছেই, তারাই পরিবেশন করে দেবে” ইত্যাদি বলে এড়িয়ে গেলেন। ভয় করছিল সেই কর্মচারীটা আবার যাদু দণ্ডের লোভে রাতে না ঘরে আসে।
পরদিন আমরা চলে আসার সময় কিন্তু আশ্রমের প্রায় সবাই, এমনকী স্বয়ং মহারাজ আমাদের বাস পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। থাকা খাওয়া বাবদ চার্জ কিছু কমিয়ে দেওয়া বা আবার আসার অনুরোধ করা হলেও, পরিস্থিতিটা কিন্তু কিছুতেই আর মেরামত করা সম্ভব হ’ল না। আমরা ফিরে আসলাম।