বিহান রাগে গজ গজ করতে করতে
স্কুল থেকে ফিরছিল । মাথাটা এখনও টনটন করছে । পরীক্ষা ছিল । অনেকেই লেখা শেষ করতে
পারে নি । অনেকেই বেরিয়ে নিজেদের মধ্যে এটা ওটা নিয়ে বলা কওয়া করছিল । বিহান ওসবের ধার ধারে না তাই
আগেভাগে চলে এসেছে ।
দু বার মাথায় হাত বুলিয়ে নিল ।
তাই বলে পরীক্ষার দিন মারবে ?বেত পায় নি তাই হাতের আঙ্গুল
বাঁকিয়ে টাঁও টাঁও মারল মনোজবাবু । আরে বাবা , অঙ্ক ভুল হয়েছে নম্বর কেটে নে । তা না কেন ভুল করলি ? যদিও প্রথমবার ভুল হয়ে গেছে রি-ভাইজ করে
নে তা না করে কেন সময়ের আগে জমা দিলি ? বলেও মার বলে মার । মাথাটা টন টন করছে ?
মা বাবা এমন কি দাদাও কোনদিন এ
রকম মারে নি । বিহান ছোট বলে কত আদর পেয়েছে । মনোজবাবুকে প্রায়ই দেখেছে বিহানের
পেছনে লেগেই থাকে অঙ্কটা ঠিক করে করার পরেই বলবে –এখানে কাটলি কেন ? সাত নয়ে তেষট্টি লিখতে এখানটা এত
হিজিবিজি কেন ? দেখছিস এ পৃষ্ঠায় হবে না তাও এখানে করলি ?আবার এখানে এতটা পৃষ্ঠা ছেড়ে
দিলি সস্তার খাতা পেয়েছিস ?
–এই সব কত
কি বলে ? পাশে পকাই মিণ্টা সূচী এরা অঙ্ক পারেই না, কাটাকুটি করে নিয়ে গেলেও ধীর শান্ত । বলবে – যা ভাগ , আবার কর । নিজেও বোর্ডে করতে
করতে লিখবে আর মুছবে । কিন্তু বিহানের বেলায় ওসব চলবে না ঠিক লিখতেই হবে । রাগ হয়
না ?
বাড়ি ফিরে মাকে সে কথা বলতেই মা
হেসে লুটোপুটি । একবার মুখে চুক চুক শব্দ করে মাথায় হাত দিয়ে – এখানটায় মেরেছে বুঝি? বলেই কি সব বলছিল বিহানের মাথায় ঢোকে নি । সংসারের সাত পাঁচ কাজে লেগে পড়ল গুরুত্ব
দিল না ।
দাদাকে তো বলাই যাবে না । বললেই
বলবে – তুই ভুল করলি কেন ? এই সাত আর পাঁচ এর মাঝে সময় ঢুকে কাজ বাড়ায় না কমায় এটুকু জানিস না ? বলেই পিঠে থাপা দেওয়ার নাম করে মারবে ? যেন নিজে কোন ভুলই করে না ? মা অবশ্য হাসতে হাসতে চলে যায় । যেন দাদার ভালোবাসা বিহানের উপর উথলে পড়ছে ।
সবাই জানে এখন স্কুলে মারা চলবেই না । তাও
মনোজবাবু মারল কেউ প্রতিবাদ করছে না । শুনে সবাইয়ের কেমন খুশি খুশি ভাব । রাস্তার
গজ গজ রাগ মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল । বাবা একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বোঝাল । সঠিক তো করতেই হবে ।
তাছাড়া পরীক্ষার মত জায়গায় অত অন্যমনস্ক হলে চলে । আরো ভালোর শেষ নেই । বলে অনেক আদর করল কিন্তু মারের কথা তুললই না ।
ধুর , খালি সব ঠিক কর ঠিক কর । একটু ভুল হলেই বলবে কি পড়াশুনা ছেড়ে দিলি নাকি ? খালি খেলা আর খেলা ? গবেট হবি ? গাধা হবি ? মাঠের ঘাস কাটবি ?
ফলে স্কুলে একটা ভয় নিয়ে বিহানের
কাটে । ওরে বাপরে ঠিক বলতেই হবে করতেই হবে । আবৃত্তি করতে উঠে ঠিক বলতেই হবে ।
স্টেজে উঠে ভয়ে হাত পা কাঁপে । একটু বলার পরেই ভরসা পায় । তারপর হাততালি কুড়িয়ে
তবে ভয় কাটে । ক্লাসে ইতিহাস বাংলা ঠিক বোঝাতেই হবে না হলে আবার স্যার বলে না বসে – কবে বড় হবি ? সাধারণ ব্যাপারটা বলতে ঢোঁক
গিলছিস ? কাছে এসে বড় চোখ করবে ? অন্যরা হাসবে ? ভাল বন্ধু মিকি পরে প্যাঁক দেবে
সেই ভয় নিয়ে বিহান বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে আপ্রাণ চেষ্টায় ঠিক বলতেই থাকে ।
এই বিহান যখন অনেকটা সাঁতরে মাঝ
পুকুরে চলে যায় , গাছের মগডালে উঠে আম পাড়ে , টিউশন পড়ে একা আঁধার পথে বাড়ি ফেরে , বক্সীদের উঁচু পাঁচিল সহজেই টপকায় , বন্ধুদের সঙ্গে মিলেমিশে খেলতে খেলতে মারামারি করেও আনন্দে থাকে তখন পাড়া
প্রতিবেশীর সঙ্গে বাড়ির সবাই প্রায়ই বলবে – এইটুকু ছেলে দশ পেরোল না আর কি সাহস ? তোর ভয় করে না ?
বিহান মুচকি মুচকি হাসে । আর ভয়
উপভোগ করে । এই ভয় নিয়ে রেজাল্টের দিন স্কুলের সমস্ত স্যারেদের পাশে উঠতে হয়েছিল ।
স্যারেরা কে কি বলেছিল একটুও কানে ঢোকে নি । তবে পিঠ চাপড়ে দিয়েছিল মনোজবাবু ।
অঙ্কে ১০০ ।
সেই ভয় বিহানকে আরো অনেক অনেক
বেশি ভয় জয় করার রাস্তা করে দিয়েছে । এবং বিহান সফলও হয়েছে ।