দেবপ্রিয় বৃদ্ধাশ্রম
ঢাকার বক্সি বাজারের বনেদে
পরিবারের মেয়ে সুহাসিনী। বাবা দিনেশ দাশগুপ্ত এক সময় স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম
সংগঠক ছিলেন। হাই স্কুলে পড়াকাল থেকেই সুহাসিনী বাবার আদর্শে নিবেদিত ছিলেন। ’৪৭
এর রায়টের সময় নোয়খালিতে দাঙ্গা থামাতে মহাত্মা গান্ধী তাঁর অনুসারীদের নিয়ে
নোয়াখালিতে আসেন। সুহাসিনী তখন তার মামাবাড়ি লক্ষ্মীপুরে, বয়স দশ এগার বছর হবে।
সুহাসিনীর মামাতো বোন বিনিতা তারই বয়সী। সুহাসিনীর মামা বিনোদ বিহারী হাই স্কুলের
শিক্ষক ও গান্ধীবাদী হওয়ায় দাঙ্গায় তাদের ক্ষতি না হলেও আশংকা কিন্তু ছিল। শেষদিকে
দাঙ্গা মারাত্মক রূপ ধারণ করলে বিনোদ বিহারী মেয়েদেরকে কলকাতার দক্ষিণেশ্বরের বড়
বোন বাড়িতে রেখে আসা কথা বিনিতার মাকে বলে আমার তো মনে হচ্ছে, মেয়েদের আর এখানে
রাখা ঠিক হবে না।
স্বামীর
কথায় বিনিতার মা এক মত হয়।
বিনোদ বিহারী সবার একটু সংগোপনে তার
দুই মেয়ে সুনীতা, বিনিতা এবং ভাগনী সুহাসিনীকে নিয়ে রাতের আঁধারে কলকাতার উদ্দেশ্য রওনা হন।
মহাত্মা
গান্ধীর শান্তি মিশন নোয়াখালির দাঙ্গা থামাকে সমর্থ হয়,তার আগেই যা হবার হয়ে যায়।
সুহাসিনীর বাবা দিনেশ দাশগুপ্তের আশা
ছিল বাংলাকে দ্বিখন্ডিত করা হবে না শেষ পর্যন্ত। কিন্তু সে গুড়ে বালি! বাংলা
দ্বিখন্ডিত হবার পর দুই বাংলার সংখ্যালঘু হিন্দু মুসলমানদের ভাগ্যে বিপর্যয় নেমে
আসে।
সুহাসিনীদের একাবর্তী পরিবার হঠাৎ
করেই একটা সুযোগ পেয়ে গেল। ঢাকার বক্সি বাজারের বাড়ি ও দোকানপাঠের সঙ্গে কলকাতার উপকন্ঠের
দমদমের সেলিম জোয়াদ্দারে বাড়ি ও দোকানপাঠেররসঙ্গে বিনিময় হয়ে যাওয়ায় পাকিস্তান ছেড়ে
যাওয়ার সুযোগ ঘটে সুহাসিনীদের। সুহাসিনীর বাবা কাকারা এতে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে।
সুহাসিনীর মামা বিনোদ বিহারী তার নিজের দুই মেয়ে ও ভাগনীকে রেখে এসেছিলেন তার বড়
বোনের বাড়িতে বেলঘড়িয়ায়।
বিনিময়
করে পাওয়া দমদমের নতুন বাড়িতে তাদের পরিবারবর্গ্ এসে উঠায় সুহাসিনীরা দাঙ্গার
আতঙ্কের হাত থেকে বাঁচে।
সুহাসিনীর মা বিনোদিনীর ইচ্ছে ছিল একমাত্র মেয়েকে ডাক্তার এবং একমাত্র
ছেলে সুশোভনকে ইঞ্জিনিয়ার বানোনোর। বাপ
কাকার মতো ঢাকার বক্সিবাজারে তেজারতি করানোর ইচ্ছে সুহাসিনীর মার কোন কালেই ছিল
না।
দমদমের বাড়িতে স্থিতু হবার পর
একদিন সুহাসিনীর মা মেয়েকে বললেন- মুইরাতো বাঙাল দ্যাশের বাঙাল, আর এহানকার লোকরা
তো ঘটি। আমাগেরে কথা শুনলি পারেই বুঝতি পারে আমরা বাঙাল। সদরে আবডালে কেউ কেউ
ঠাট্টা তামশাও করে।
মায়ের কথা শুনে সুহাসিনী মাকে বলে-
তাতে কী হইছে। বাঙালরা কী মানুষ না! দ্যাশ ভাগের পর বাঙাল হিন্দুরা তো দলে দলে
নিজের চোদ্দপুরুষের ভিটেমাটি ছ্যাড়ে শুন্য হাতে এদ্যাশে শরণার্থী ক্যাম্পে বাস
করতিছে।
সুহাসিনী ও তার একমাত্র ভাই সুশোভন
প্রথমে দমদমের বাড়ির কাছের প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হয়। একদিন সুহসিনীর মা তাকে
বলে- হুনতাছি তোগেরে স্কুলডা নাকি ভালই। তবে জানতি পারিছি, ঢাকা থিকে আসা অনেক
বাঙাল পোলাপানও নাকি তোগেরে স্কুলে পড়ে। আমি তোগেরে রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে দিতি
চাইছিলাম, কিন্তুক----
মায়ের
কথা থমিয়ে দিয়ে সুহাসিনী কয়- তুমি বাঙাল বাঙাল কও ক্যানে। আমরা ছিলাম ঢাকার
কুট্টি, তুমার বাপের বাড়ির লোকেরা তো নোয়াখালে।
-তাতে কী হইছে, তোর বাপ বাঙাল,
আমার বাপও বাঙাল। এ দ্যাশে যহন আইছি বাঙাল আর কয়দিন থাকবানে! তোরে ডাক্তার হতি
হবি, তুই তো শান্তিপুরের ভাষায় কথা বলতি পারিস্। তুই এহনও ক্যানে বাঙাল ভাষায় কথা
কইছিস। সুহাসিনী মায়ের কথা শুনে ভাবে,
মায়ের
কথা শুনে সুহসিনী মায়ের উপর উষ্মা প্রকাশ করে বলে- তুমিও তো বাঙাল ভাষায় কথা এহন
কও। শান্তিপুরের বাংলাটা কথা বলার অভ্যাস
কর তা হলি পারে।
মেয়ের কথা শুনে মা বলে – চেষ্টা তো
করতাছি। অজানতিই নোয়াখলির আর ঢাকালে টান আসে যায়। পাড়ার মাইয়াগের লগে বাঙাল ভাষায়
কথা কইতি মুই নজ্জায় মরি।
- তাতে লজ্জার কী আছে। তুমি তোমার
মাতৃভাষায় মন খুলে কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক। মায়ের মুখের ভাষা কত মিষ্টি!
সুহাসিনীর কথা শুনে ওর মা বলে- তুই
তো এহান কার কতা ভাল ভাবেই বলতি পারিস্, তাহলি বাঙাল ভাষায় কথা কস ক্যানে? – এখন
দেখলে তো আমি এখানকার ভাষায় কথা বলতে পারি সুন্দর ভাবে। কিন্তু তা কহন কব না , আমি
কাকের পাখনায় ময়ুর পুচ্ছ বেঁধে ময়ুর সাজতে চাই না। সত্যি সত্যি বলতে সুহাসিনীর
কথায় ঢাকালে ভাষার টান আছে।
সত্যি
সত্যি বলতে সুহাসিনীর কথায় ঢাকালে ভাষার টান আছে।
তারপর দিনের পর দিন গড়িয়ে যায়। প্রাইমারী
স্কুলের পাঠ শেষ করে মায়ের ইচ্ছে মতোই সুহাসিনী রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলের মেয়েদের
শিফটে ভর্তি হয় । সুহাসিনীর শিক্ষাদীক্ষা মোড় ঘুরিয়ে যায় রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুলের
পড়াকালে। সুহাসিনী ওখানকার পাঠ শেষ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা
ভাষাতত্ত্বে অর্নাস নিয়ে এম. এ.তে ফার্স্ট ক্লাস র্ফাস্ট হওয়ায় সুবাদে কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে রিডার পরে লেকচারার হন। লেকচারার হওয়ার পর সুহাসিনীর মা তার স্বামীতে
তাগাদা দেয় মেয়ের বিয়ের জন্য।
স্ত্রীর কথা শুনে সুহাসিনীর বাবা
বলেন- ছেলে কী আমি খুঁজছি না মেয়ের জন্যি। মা হিসেবে তোমার ও একটা দায়িত্ব আছে।
কেমন ছেলের ওর পছন্দ সেটা জানা দরকার। স্বামীর কথা শুনে সুহাসিনীর মা বলে- আমি তো
ওরে জিগাইছলাম। কিন্তু ও বলল- ডক্টরেট করে অধ্যাপক না হওয়ার আগে আমি বিয়ে করবো না।
- ও নাকি এখন আদিবাসী মেয়েদের
লেখাপড়া ও উন্নয়নের জন্যে কাজ করছে শুনলাম, ও নাকি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রফেসর
ড. দিবেন্দু পালের অধীনে আদিবাসীদের ভাষার উপর এম.ফিল করছে। এম.ফিল শেষ করার
ডক্টরেট করতে তো দু’এক বছর লেগে যাবে।
স্বামীর
কথা শুনে সুহাসিনী মা বলে – তাহলি পারে তো ভাবনার কতা।
সুহাসিনী আদিবাসীদের ভাষার উপর
ডক্টরেট করার পর একদিন ডক্টর সুহাসিনী দাশগুপ্ত হলেন, অধ্যাপক হওয়ার পথ খুলে গেল। এবার ডক্টর
সুহাসিনী বিয়েতে রাজি হলেন। সুহাসিনীর
বাবা দিনেশ দাশগুপ্ত সুহাসিনীর মাকে বললেন
– আমার মাকে তো যার তার হাতে তুলে দিতে পারি না।
স্বামীর কথা শুনে সুহাসিনীর মা
বললেন- আমি কই কী আমাগের দ্যাশের পোলা হলি তো ভাল হয়, তাই না গো, সুহার বাবা?
-কথাটা
ঠিক কইছে।
সুহাসিনীর
মা নোয়খালীর একটা ছেলে সন্ধান দেয়।
-আমার সই মীনাক্ষীর বড় পোলা
দেবজ্যোতি সঙ্গে বিয়ের কতা মনে মনে ভাবিচি, দেবজ্যোতিকে তুমি তো চিনতে না? ওর বাবা
দেবপ্রিয় বাবু এককালে আমাগেরে মাস্টার ছিলেন। আমাগেরে মতোই তারাও বিনিময় করে
বেলঘড়িয়াতে আসে।
বউয়ের কথা শুনে দিনেশবাবু তাকে
বলেন- তাদের ঠিকানা কি তুমি জান? ঠিকানা পেলে একটু চেষ্টা করে দেখতাম।
-সই
জানিনে তুমি ভাবতি পারলে ক্যামনে!
দিনেশবাবু মেয়ের বিয়ে জন্য ব্যস্ত
হয়ে পরেন। বেলঘড়িয়ার ঠিকানায় দেবপ্রিয়
বাবু পেতে দিনেশেবাবুর অসুবিধা হয় না। ডোরবেল বাজাতেই দরজা খুলে দেয় এক সুদর্শনা
মহিলা। দিনেশবাবু বুঝতে পারেন এ মীনাক্ষী না হয়ে যায় না। দিনেশবাবুকে নিজের পরিচয়
দিতে হয় না, মীনাক্ষী তাকে এক নজর দেখেই চিনে ফেলে। সে তার সই বিনোদিনীর বিয়েতে
উপস্থিত ছিল, তারপরও সইয়ের বর দিনেশকে দেখেছিল। যদিও ক্ষণিকের জন্য। মীনাক্ষী একটু
উচ্চকন্ঠে বলল- এদিকে এসো, গো কে এসেছে
দেখছে। সেদিনটি ছিল ছুটির। দিনেশবাবু ভাবল, আজ তো সাপ্তাহিক ছুটি সবারই তো বাড়িতে
থাকার কথা।
মীনাক্ষীর
স্বামী দেবপ্রিয়বাবু ভেতর থেকে বের হয়ে এসে বললেন- নমস্কার দাদা, কেমন আছেন?
মীনাক্ষী ভাবল, তবে কি তাদের মধ্যে
আগে থেকেই চেনা জানা আছে। মীনাক্ষী ইতস্তত করে কী যেন বলতে যাচ্ছিল। বউয়ের হাবভাব
দেখে তার স্বামী দেবপ্রিয় বাবু বললেন- তুমি অবাক হচ্ছো এটা ভেবে যে আমি তাকে
কীভাবে চিনি, তাই তো?
-হ্যাঁ,ঠিকইবলেছো । -
ঢাকার বক্সীবাজারের স্বদেশী আন্দোলনের
সংগঠক দিনেশ দাশগুপ্তকে কে না চেনে! ভেতর থেকে একটা সুদর্শন তরুণটি এলে
মীনাক্ষীদেবী দিনেশবাবুর সঙ্গে তরুণটির
পরিচয় করে দেবার জন্য বলল- এ আমাদের একমাত্র ছেলে দেবজ্যোতি, ও বর্তমানে
ম্যাল্টিন্যাশাল কোম্পানীর একক্সিউটিভ,কলকাতায়ই পোস্টটিং । দেবজ্যোতি হাতজোড় করে
দিনেশবাবুকে নমস্কার করল।
মীনাক্ষী
বলল- ঢাকা আর নোয়াখালির আমরা কত কাছাকাছি ছিলাম, অথচ এখন কাছে থেকেও কত দূরে, তাই
না? সেই থেকে আবার দু’পরিবারের মধ্যে পুরনো সম্পর্ক আবার গড়ে উঠল। মীনাক্ষী তার স্বামী দেবপ্রিয়বাবুকে বলল-
দেবজ্যোতির সঙ্গে সুহাসিনীর বিয়ে হলে কেমন হয়।
সুহাসিনী দেখতে শুনতে সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী ও বিদুষী। মীনাক্ষীর প্রস্তাবে
একবাক্যে সুহাসিনী বাবা মা রাজি হয়ে যায়। ঘটা করে সুহাসিনীর সঙ্গে দেবজ্যোতির বিয়ে
হওয়ায় উভয় পরিবারই বেজায় খুশি হল।
দুই
সুহাসিনী এখন স্বামী – সংসার ,
সন্তান আর শিক্ষকতা নিয়ে বড়ই ব্যস্ত।
বিয়ের দু’বছর পর সুহাসিনীর কোল আলো করে ছেলে জন্ম গ্রহণ করায় শ্বশুর শাশুড়ি
আনন্দিত। শিলাদিত্যের জন্মের এক বছর পর দেবজ্যোতি একটা প্রমোশন পেয়ে হেড অফিসে
বদলী হয়ে দিল্লিতে যাওয়ায় শ্বশুর শাশুড়ি’র জন্য সে সময় সুহাসিনীকে সংসারের
ঝুটঝামেলা পোহাতে হয় না।
দিনের
পর দিন গড়িয়ে যায়। বার্দ্ধক্যজনিত রোগ ভোগের কারণে এক বছরের ব্যবধানে শ্বশুর
শাশুড়ির মৃত্যুতে সুহাসিনী ভেঙে পড়ে। শ্বশুর শাশুড়ি মৃত্যু আগেই সুহাসিনীর বাবা মা
গত হওয়ায় সুহাসিনী যেন আরো নিরাশ্রয় হয়ে পড়ে।
তাদের একমাত্র শিলাদিত্যের পড়াশোনা
কথা ভেবে সুহাসিনী বড়ই চিন্তিত ছিলেন। সুহাসিনী ভাবে- শিলাদিত্যের ইন্টার পরীক্ষা
সামনে, দেবজ্যোতি দিল্লি না থেকে কলকাতায় থাকলে ছেলের পড়াশোনা ও সংসারের দেখভাল সে
করতে পারতো। এর কয়েকদিন পরে সুহাসিনী দেবজ্যোতির ফোন পেয়ে দেবজ্যোতির কোম্পানীর
হেড অফিস দিল্লি থেকে কলকাতায় আসায় খবর শুনে সুহাসিনী আশার আলো দেখতে পায়। দেবজ্যোতির
কোম্পানীর হেড অফিস দিল্লি থেকে কলকাতায় আসায় খবর শুনে সুহাসিনী আশার আলো দেখতে
পায়।
উনিশ’শ একাত্তরের মে মাস থেকে
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের পক্ষ থেকে ‘বাংলাদেশের শ্মরণার্থী সহায়ক
সমিতি’র বড় একটা দ্বায়িত্ব সুহাসিনীর উপর এসে পড়ায় তার কাজের পরিধি বেড়ে গেছে।
পূর্ব পকিস্তানের নিরস্ত মানুষের
উপর পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকচক্র পাকবাহিনী নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ ও লক্ষ
লক্ষ নারী, পুরুষ,শিশুকে বিতারণের ফলে তারা সীমান্ত অতিক্রম করে বিভিন্ন শরণার্থী
ক্যাম্পে বসবাস করছে, অনেকে আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতেও উঠেছে। সুহাসিনী ছোটভাই
সুশোভন ফোন করে জানিয়েছে, ঢাকার বক্সী বাজারের লক্ষ্মীপদ পোদ্দারের বউ, বেটারা
তাদের দমদমের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে।
সুহাসিনী ভাইয়ের কাছ থেকে খবর পেয়ে
দমদমের বাড়িতে যা দেখে ও শুনে এসেছে, তা বড়ই মর্মান্তিক। বক্সী বাজার প্রাইমারী
স্কুলে লক্ষ্মীপদ সুহাসিনীর সঙ্গে পড়ত, পাঁচ ক্লাস পর্যন্ত পড়ার পর পড়াশোনা ছেড়ে
বাপের মুদির দোকানে হাত লাগায়।
লক্ষ্মীপদ’র মায়ে সঙ্গে সুহাসিনীর বড়ই ভাব ছিল। ওর মাকে সে মাসিমা বলে ডাকতো।
বাপরে আমলে বিনিময় করে পাওয়া তাদের দমদমের বাড়িটি বেশই বড় ছিল। দক্ষিণ দিকের
বৈঠকখানাটা এতদিন পরিত্যাক্ত থাকলেও তা ঝাড়াপেছা করে লক্ষ্মীপদরা বাস করছিল দেখে
সুহাসিনীর বড়ই কষ্ট হল। তার মনে পড়ল , সে সময়ই ওরা ছিল তাদের এলাকার কোটিপতি।
সুহাসিনী প্রথম দেখাতেই লক্ষ্মীপদকে চিনিতে পেরে সে ঢাকালে ভাষায় তাকে বলল- লক্ষ্মীপদ
তুই মুইরে চিনোস্? এতদিন পরে সুহাসিনীকে চিনবার কথা নয় লক্ষ্মীপদ’র।
সে আমতা আমতা করলে সুহাসিনী বলে-
লক্ষ্মীপদ, মুই তোমাগেরে সুহা গো। সুহাসিনীর কথা শুনে লক্ষ্মীপদ কেঁদে ফেলে
বলে-তোরে তো কতদিন দেহিনে, আমি চিনবো ক্যামনে?
-তা
মুই’র মাসিমা খবর কী!
সুহাসিনীর কথার জবাব দিয়ে
লক্ষ্মীপদ হাউ হাউ করে কাঁদতে দেখে সুহাসিনী ভাবে, তবে কি মাসিমা মারা গেছেন।
এক সময় লক্ষ্মীপদ চোখ মুছে বলে-
মাকে রাস্তায় ফ্যালে রাখে আসতি হইছে। মার
তো হাঁটার তাগদ ছিল না, মোরা তারে ডুলিতে করে নিয়ে আসতিছিলাম , একটা বজরা নাওয়ে শ’খানেক মেয়ে পুরুষ আর বাচ্চা কাচ্চা এক
লগে পদ্মা পার ফরিদপুরের পারে আসলি পারে পাকমিলিটারিরা আমাগেরে দলের উপর গুলি
চালাতি শুরু করলি পারে আমরা দিশেহারা হয়ে যাই। মুই আর মুই’র ছোট ভাই রামপদ মাকে ডুলিতে
করে পাকা রাস্তা থিকে গ্রামের একটা ভাঙা দালানে উঠলে দু’দিক থেকে গোলাগুলি শুরু
হলে আমরা মাকে ডুলিতে মাকে রেখে পালিয়ে জীবন বাঁচাই। একটু এগিয়ে গেলে মুই’র দলের
দু’একজনকে দেখতি পাই। তারা বলে ওহানে মুক্তিবাহিনী পাক আর্মিকে আক্রমণ করিছে। মুই
ও রামপদ মারে আনবার জন্যি ওদিকি রওনা দিতি গেলি পারে সহলেই আমাগের সেদিকি যাতি দেয়
না।
লক্ষ্মীপদ এ পর্যন্ত বলার পর সে
হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে। রামপদ পাশ থেকে
বলে বুড়ো মাকে আমরা সেহানেই ফ্যালাইয়া
রাখে আসতি হইছি।
সুহাসিনী’র বয়সী একজন মহিলা এগিয়ে
এসে বলল- দিদিমণি, মা ছাড়া সহলেই এহানে আসে পড়িছি, আমাগের মার মতো বয়সী বুড়োবড়িকে
ভোলাডাঙার বর্ডারের গাছ তলে, খুপড়ির দাওয়ায় বসে বসে কাঁদতি দেখিছি।
মহিলাটির কথা শুনে বুঝতে পারে সে
অবশ্যই লক্ষ্মীপদ স্ত্রীই হবে। তাদের থাকা খাওয়ার ভাল ব্যবস্থার কথা তার ভাই
সুশোভন ও তার বউকে বলে সুহসিনী ওখান থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।
বাংলাদেশ শ্মরণার্থী আসা সংখ্যা
দ্রুত বেড়ে যাওয়ার খবর আকাশবাণীর রাতের খবর থেকে জেনে সুহাসিনী উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন।
তিনি ভাবেন, এ মুহূর্তে বাংলাদেশ থেকে বিতারিত ছিন্নমূল মানুষের পাশে দাঁড়ানো
একান্ত কর্তব্য। এখনই ‘বাংলাদেশের শ্মরণার্থী সহায়ক সমিতি’র কাছে নেমে পড়া উচিত।
রাতেই তিনি তাঁর স্বামীকে বললেন-দেবজ্যোতি, তোমার তো সপ্তাহে শনি, রবি দু’দিন ছুটি
আমরা গাড়ি জোগাড় না করতে পারা পর্যন্ত সপ্তাহে দু’দিন আমরা তোমার গাড়ি নিয়ে
শ্মরণার্থী ক্যাম্প গুলোতে যাব। দরকার হলে বর্ডারেও যেতে হবে। সুহাসিনীর কথা শুনে
দেবজ্যোতি বললেন- ঠিক আছে,আমিও দু’একদিন তোমাদের সঙ্গে যেতে পারি।
পরদিন ছিল শনিবার, দেবজ্যোতির গাড়ি
নিয়ে কলকাতার ধারে কাছের শ্মরনার্থী ক্যাম্পগুলোতে যে দৃশ্য তারা দেখল তা হৃদয়
বিদারক। শিশু ও বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। অনেক শিশু ও বৃদ্ধ – বৃদ্ধা
পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ক্যাম্পে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। সুহাসিনী তারপর থেকে একের
পর এক শ্মরণার্থী ক্যাম্প ও বর্ডার এলাকা ঘুরে উপলব্ধি করল বৃদ্ধ- বৃদ্ধারাই
সবচেয়ে কষ্টকর অবস্থার মধ্যে আছে, তার মধ্যে বৃদ্ধাদের অবস্থা বেশি শোচনীয়।
করিমপুর বর্ডারে শ্মরণার্থীদের শুকনো খাবার দিয়ে তারা কলকাতায় ফিরছিল। দেবজ্যোতি
নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করছিল।গাড়ি হাইওয়েতে পড়তেই দেবজ্যোতি গাড়ি ব্রেক করে বা’দিকের একটা
বাঁশের চাতালের কাছে থামল। সুহাসিনী জানালা দিয়ে মুখ বের করে দেখতে পেল দু’জন
বৃদ্ধা চাতালের উপর নি:সম্বল অবস্থায় বসে আছে। দেবজ্যোতিকে ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে
তাদের সঙ্গে কথা বলতে দেখে সুহাসিনীও গাড়ি থেকে সেখানে গেল। তারা জানতে পারল
বৃদ্ধা মহিলা দু’জন তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এখানে এসে পড়েছে, কোথায় যাবে
, কী করবে তা তারা বুঝতে পারছে না। তারা তাদেরকে গাড়িতে তুলে নিকটস্থ শ্মরণার্থী
ক্যাম্পে পৌঁছে দিয়ে কলকাতায় ফিরে এল।
তিন
তখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে ,
শ্মরণার্থীরা স্বাধীন দেশে ফিরে যাচ্ছে। দেবজ্যোতি ভাবে, শ্মরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে বসবাসকারী পরিবার থেকে
বিচ্ছিন্ন বৃদ্ধ-বৃদ্ধার এখন কোথায় যাবে!
দেবজ্যোতি সুহাসিনীকে বলে-শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে বসবাসকারী পরিবার থেকে
বিচ্ছিন্ন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের কথা কি তুমি ভেবেছো, তারা এখন কোথায় যাবে?
– বিষয়টা তো বড়ই ভাবনার কথা! আমরা
ঠিক করেছি কিছু বৃদ্ধকে রামকৃষ্ণ মিশনের বৃদ্ধ আশ্রমে দেব, কিছু বৃদ্ধাকে মাদার
তেরেসার বৃদ্ধাশ্রমে থাকার ব্যবস্থা করবো।
- সুহা, ভেবে দেখোতে আমার কথাটা ,
আমরা বেলঘড়িয়ার বাড়ি ছেড়ে বালিগঞ্জের নতুন বাড়িতে চলে আসার ওখানকার আমাদের অংশটা
তো তালা মারা অবস্থায় পড়ে আছে। ওখানে একটা বৃদ্ধাশ্রম করা যায় কিনা। আমরা তো একদিন
ওদের দেশেরই লোক ছিলাম। ওইসব নিরাশ্রয় বৃদ্ধ- বৃদ্ধাদের জন্য আমাদের কিছু করা উচিত
নয় কি? স্বামীর কথায় একবাক্যে সুহাসিনী রাজি হয়ে যায়। দেবজ্যোতি বৃদ্ধাশ্রমের নাম
সুহাসিনী বৃদ্ধাশ্রম করার প্রস্তার করলে সুহাসিনী প্রতিবাদ করে বলেন – না , না
আমার নামে কেন হবে ! বাড়ির মালিক আমার শ্বশুর ঠাকুর, তাই বৃদ্ধাশ্রমের নাম অবশ্যই
রাখতে হবে ‘ দেবপ্রিয় বৃদ্ধাশ্রম’।
‘ দেবপ্রিয় বৃদ্ধাশ্রম’ এর শুভ উদ্বোধন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বাংলাদেশের শ্মরণার্থী
সহায়ক সমিতি’ ইতিমধ্যেই বিভিন্ন শ্মরণার্থী ক্যাম্প থেকে প্রথম পর্যায়ে পরিবার
থেকে বিচ্ছিন্ন ১০ জন বৃদ্ধাকে ওখানে নিয়ে এসেছে। ফিতে কেটে দেবপ্রিয় বৃদ্ধাশ্রমের
শুভ উদ্ধোধন করলেন বরাহনগর রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজজী। মহারাজজী, দেবজ্যোতি, সুহাসিনী
ও ‘বাংলাদেশের শ্মরণার্থী সহায়ক সমিতি’
সম্পাদক বিনায়ক দাস তাদের বক্তব্যে ব্যক্ত করলেন যে তাদের অর্থিক সহায়তায় অল্প
দিনের মধ্যেই ‘ দেবপ্রিয় বৃদ্ধাশ্রম’ হবে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন বৃদ্ধাদের বেঁচে
থাকার একটা ঠিকানা। ‘ দেবপ্রিয় বৃদ্ধাশ্রম’ স্থাপন করে সবচেয়ে খুশি হল দেবজ্যোতি ও
সুহাসিনী।