গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ৯ মার্চ, ২০১৬

নীহার চক্রবর্তী / দুটি গল্প

অমল-আলো

         একটা দোকান থেকে অমলকে ঘনঘন লক্ষ্য করছিলো ওর সাবেক বাড়িওয়ালা সন্তোষ পাল । মুখে তার মিষ্টি-মিষ্টি হাসি । দেখে বেশ মজা পাচ্ছিলো অমল । ভাবতে থাকলো,এই মানুষটার জন্য কয়েকমাস আগে হঠাৎ করে বাড়ি ছাড়তে হয়েছিলো । একেবারে হাড়-বজ্জাত । কী হল আবার ? নতুন ভাড়াটে বুঝি হাওয়া ? তাই আমাকেই...
         একথা ভাবতে ভাবতে অমল গেলো সন্তোষ পালের কাছে । স্মিত হেসে তাকে জিজ্ঞেস করলো কেমনআছেন,দাদা ?হঠাৎ তার মুখ শুকিয়ে এলো । তারপর একটু চুপ থেকে বলল আর ভালো । ছেলেটার কোম্পানির চাকরীটা গেছে । বাড়িতেই বসে আছে । বৌমা ছেলের নামে কেস ঠুকেছে । আপনার বৌদিও খুব অসুস্থ । তার কথা শুনে অমল মনে মনে হাসতে লাগলো । ওর মনে হল,হাতী এবার খাদে পড়েছে । তবে সন্তোষ পালের স্ত্রীকে ওর পছন্দই হয়েছিলো । একজন অভদ্রর সঙ্গে তার দিন কাটাতে হয় তাকে । একথা ভেবে অমল খুব কষ্ট পেতো আগে । আজো ওর সে কথাই মনে হল । তাই অমল জানতে চাইলো তার অসুস্থতার কারণ ।
         চমকে উঠলো অমল যখন সন্তোষ পাল বলল,ওর জরায়ুতে টিউমার হয়েছে ধরা পড়েছে । ডাক্তারবাবুরা ভয় পাচ্ছে খুব । জানি না কি আছে কপালে । শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অমল । কি উত্তর দেবে বুঝে উঠতে পারলো না। শুধু তাকে সান্ত্বনা দিলো । বলল,ভয় নেই । সব ঠিক হয়ে যাবে । আজকাল এসব কোন ব্যাপারই না । এরপর অমলের মনে হল,নতুন ভাড়াটে সম্পর্কে কিছু জানতে চাওয়া যাক । ওকে কিছু বলতে হল না । সন্তোষ পাল নিজেই খুব দুঃখের সঙ্গে থাকলো,সংসারের হাল খুব খারাপ এখন । আপনি চলে আসার পর যে ভাড়াটে এলো,সেও দুমাস পরে চলে গেলো । এখন সেই একে-ওকে কান ভাঙচি দিচ্ছে । কী যে অবস্থা আমার !
         সন্তোষ পালের কথা শুনে অমলের আনন্দ পাওয়ার কথা ছিল । কিন্তু শুনে খুব কষ্ট পেলো ও । ওর মন থেকে সন্তোষ পাল হারিয়ে গেলো । মন থেকে সব বিদ্বেষ চলে গেলো নিমেষে । ওর চোখের সামনে ফুটে উঠলো একটা দুঃস্থ পরিবারের করুণ ছবি । তাই অমল তার কাঁধে হাত রেখে বলে উঠলো এক-মুখ হেসে,''ভাবছেন কেন ? আমি তো আপনার ভায়ের মতো । আবার আমি আসছি আপনার বাড়িতে । আর এ হপ্তাতেই । আপনি বাড়ি ফিরে ঘরগুলো একটু ঠিকঠাক করুন অমলের কথা শুনে মুহূর্তে সন্তোষ পালের চোখ জলে ভরে এলো । অমলকে বুকে জড়িয়ে ধরে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলতে থাকলো,আমাকে ক্ষমা কর,ভাই । আমার কিছু ভুলছিল তখন । মানুষ চিনতে ভুল করেছিলাম । আর অমন ভুল হবে না । আমি আজই সব ব্যবস্থা করছি
        বাড়ি ফিরে অমল ওর স্ত্রী আলোকে সব খুলে বলল একে-একে । শুরুতে ওর রাগ হয়েছিলো খুব । পরে সন্তোষ পালের স্ত্রীর কথা শুনে কেঁদে বুক ভাসাল ও । ওদের আর্থিক অবস্থার কথাও ওর মনে হল খুব । তাই সব জানার পর আলো বলল,''তবে তাই হোক । মানুষের এত বড় বিপদে আমাদের দাঁড়ানোই উচিৎআমাদের একমাত্র ছেলেটার কথা ভেবে । তৈরি হই তবে আজ থেকেই ?তখন দুজনের মুখে যে তৃপ্তির অমল আলোকময় হাসি দেখা গেলো,তা নিশ্চয় অন্তরীক্ষে বসে ঈশ্বরও প্রত্যক্ষ করে একটিবারের জন্য মানব-সৃষ্টির কথা ভেবে ধন্য হলেন ।



স্বপ্ন সুদিন

         পাত্র দেখতে এলেও পাত্রীর বাবার সাহসে কুলায় না বলতে,''ছেলে আমাদের পছন্দ ।'' একথা ভেবে হেসে মরত অনিন্দিতা । বান্ধবীদের মাঝেমাঝেই বলতো কথাটা । বান্ধবীরা ওকে খুব বোকা ভেবেছিলো । তাই হেসে উঠে বলত ওকে,''তুই না একটা কি । কি বলিস না যা-তা । বাবা বলতে যাবে কেন ? মেয়ে তো তার" । তবু অনিন্দিতা নিজের কথায় স্থির ছিল এক-মুখ হাসি নিয়ে । এর কিছুদিনের পরের ঘটনা--
         অনিন্দিতাকে এক পাত্র দেখতে এলো । আগেই অনিন্দিতা ওর বাবাকে বলে দিয়েছিলো, ''পাত্র পছন্দ তুমিই আগে বলবে" । বাবা শুনে হেসে মরে । মা রাগ করে খুব । বলে,''এ বুঝি বলা যায় ? ওরাই তো দেখতে আসবে তোকে" । বাবা শেষে একমাত্র আদুরে মেয়ের কথাতেই সম্মত হলেন । হেসে-হেসে বললেন, "দেখাই যাক না একবার" । কিন্তু অনিন্দিতার মা প্রমাদ গুণতে শুরু করলেন ।
        পাত্র-পক্ষ হাসি-হাসি মুখে বসেছিল খাটের ওপরে বেশ ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে । হঠাৎ অনিন্দিতার বাবা এক-মুখ হেসে বলে উঠলেন,''আপনাদের ছেলে আমাদের খুব পছন্দ । তারপর" অমন কথা শুনে অনিন্দিতার মা আঁতকে ওঠেন । রাগে-দুঃখে পাশের ঘরে চলে যান । তার কিছু পরে অনিন্দিতা এলো পাত্র-পক্ষের সামনে । খুব সামান্য সাজ । যেন একটু পরেই কলেজে যাবে । পাত্রর বাবা-মা আর দিদি তন্নতন্ন করে অনিন্দিতাকে দেখতে থাকলো । সুদর্শন পাত্র একটু পেছনে বসে হাসি-হাসি মুখ করে অনিন্দিতাকে খুব লক্ষ্য করছিলো । কিছু প্রশ্নের পর উত্তর দেওয়ার পর অনিন্দিতা স্মিত হাসি দেখিয়ে অন্য ঘরে চলে গেলো ।
         তারপর মুখ-মিষ্টি । এরপর অনিন্দিতার বাবা অনিন্দিতা সম্পর্কে পাত্রর বাবার কাছে কিছু জানতে চাইলেন । কিন্তু পাত্রর বাবা খুব আমতা আমতা করতে থাকলেন । পাত্রর মা আর দিদিও মুখে কুলুপ এঁটেছে । আর পাত্র তো লজ্জায় ল্যাজে-গোবরে । তবু অনিন্দিতার বাবা আগ্রহের সঙ্গে পাত্রর বাবার কাছে জানতে চাইলেন কিছু । শেষে তিনি যা বললেন, তাতে যেন বিয়ের আগাম সুর বেজেই উঠলো অনিন্দিতার বাড়ির উঠোন-জুড়ে ।
         পাত্রর বাবা খুব তৃপ্তির হাসি মুখে নিয়ে বললেন, "ছেলে তো আপনারাই পছন্দ করেছেন আগে,তাই আপনারাই বলুন কবে কি করছেন ।‘’ একথা শুনে অনিন্দিতার বাবা হা-হা করে হেসে উঠে পাত্রর বাবাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন,’’কী যে বলেন, বেয়াই । মেয়ে তো আমাদের । কিছু বলবেন না" ?
‘’বেয়াই ? কবে থেকে" ?--অবাক-বিস্ময়ে বলে ওঠেন পাত্রর বাবা । সঙ্গে-সঙ্গে জবাব দেয় অনিন্দিতার বাবা, "দেখছেন না আপনার ছেলেকে কীভাবে চোখ মেলে চারদিক চেয়ে-চেয়ে দেখছে ? আর মুখের হাসিটা দেখুন একবার । এরপরও আপনাকে বেয়ান না বলা কি ঠিক হবে" সাথে-সাথে পাত্র শুনে খুব লজ্জা পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো । তার পেছনে চলল অনিন্দিতার ভাই তুতান । ও বুঝি ভেবেছে,জামাইবাবুর হিসি পেয়ে গেছে খুব । বাথরুমটা দেখিয়ে দেওয়া দরকার ।
বিয়ের পরে অনিন্দিতা ব্যাপারটা জানিয়েছিল ওর বান্ধবীদের । বান্ধবীরা শুনে অবাক হলেও পরে বলল,’’এটা একটা আপসেট । ঘটে গেছে আর কি । সবাই কি তুই আর তোর বাবার মতো ?’’ তাদের কথা শুনে অনিন্দিতা হতাশ । মুখ-কালো করে অস্ফুট গলায় বলে,’’হলে কিন্তু বেশ হত । তাই না ?’’ বান্ধবীদের এর উত্তর আর জানা ছিল না বোধহয় । তাই সেখানেই থেমে গেলো তারা ।