এক বিকেলে মা বাপির কাছে
আমাদের রেখে বেড়াতে বেরুবে। খুব সেজেছে।
অপর্ণা সেন অপর্ণা সেন স্টাইলে। বাপির সাথে আমরাও বলে উঠি,আহা ছবি- ছবি।
আয়নার ভেতরে মা চোখ গরম করে তাকায়। বইয়ের আড়াল থেকে বাপি বলে উঠে সেধে সেধে কষ্ট কুড়াতে যাচ্ছ ত।
পাত্তাই পায় না বাপি। যেন চেনে না এমন ভাব দেখিয়ে ব্যাগ দুলিয়ে
বেরিয়ে যায় মা। সুযোগ পেয়েই আমরা পেড়ে ফেলি বাপিকে। গল্প বল। এ্কটু একটু না।
পুরো গল্প। ও আচ্ছা - গেল দিন কোন গল্পটা
যেন বলেছিলাম ? বলতে গিয়েই বিচ্ছু
বাচ্চাদের মত থেমে যাই। এহ, জানারেল নলেজের টেস্ট নিচ্ছে। হবে না। চলবে না।
নতুন গল্প চাই । বাপি বিশ্ব সাহিত্যের লাইব্রেরী থেকে নতুন কোন গল্প শুরু করে। ঝড়ের
মত ঘরে ঢুকে মা। ব্যাগটা ফেলে দিয়েই বাপির দিকে তাকিয়ে বলে, কেন এলে ও দেশ ছেড়ে?
মার চোখে টলমলে জল।
পাপড়ির ঝাঁপটায় গড়িয়ে পড়বে এক্ষুনি। আয়নার ভেতর
ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাচ্ছে মা। নুয়ে যাচ্ছে মাথা পিঠ। কোন এক অচেনা অজানা শহরের
গঙ্গানদী আয়নার ভেতর দিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে আমার মাকে। আমরা ছুটে আসি। মুখে চোখে
কপালে অজস্র আদরের চুমুতে ভরিয়ে দিয়ে না জানা, না রাখা না পারা প্রতিজ্ঞায় বলে উঠি
, দেখো একদিন তোমাকে ঠিক নিয়ে যাব সেই নদীর ধারে যেখানে নৈবদ্যের ফুল ভেসে যায়
স্রোতে, তুমি পা ডুবিয়ে বসে থেকো । দেখো একদিন তোমাকে সেই ঘর খুঁজে দেব যার
বারান্দায় তুমি সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালাতে যার সাথে তার কপালে সিঁদুর । দেখো সাদা
পতাকা উড়িয়ে আর পালাতে হবে না তোমাকে তোমার প্রিয় ঘর, নদী, শহর বন্ধুদের ছেড়ে ।
আবার ফিরিয়ে দেবো তোমার শহর তোমাকেই ---
সাতচল্লিশের দেশভাগ মা
বাপিকে করেছিল অপূর্ণ মানুষ । অমিল সংস্কৃতিতে টক্কর খেতে খেতে ওরা কোনদিন স্বভূমি
খুঁজে পায়নি। কেবল ভেসে গেছে নৈবদ্যের ফুলের মত।
মাঝে মাঝে দেওয়াল ঘেঁষে রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে থাকত মা। তার চিকন নরম দীর্ঘ
শরীরে লতানো বেলির বিভঙ্গ । হাট্টাগোট্টা আমি খেলা ছেড়ে প্রশ্ন করতাম, মাগো তুমি
কি নিজেকে শুকিয়ে নিচ্ছ ভেজা কাপড়ের মত ? মায়ের চোখে অনির্দেশ্য শূন্য দৃষ্টি ।
নিস্তব্ধ ঠোঁট জুড়ে শুয়ে থাকত মরা এক নদী। যেন কোনদিন বাণ ডাকেনি সে ঠোঁটে । অজস্র
বৃষ্টির মত যেন কখনো ঝরে পড়েনি গভীর গহন চুমু। কোন গান! কথকতার ফুলঝুরি।
কাকে দেখো তুমি ? এই ত
আমি ! অপরিচয়ের ছায়া তবু ভাঙ্গে না। আমার মা
মাঝে মাঝেই বাঁধা পড়ে যেত কোন এক লাল বাড়ির উঠোনে । অজগরের মত চলা ধীরছন্দের ট্রামে, ভিক্টোরিয়া, বইপাড়া, নাটক
আর ইশকুল পালিয়ে সিনেমার হলে। কোন কোন দিন বাপি উদাস হলে আমার সব আনন্দ নিভে যেত। স্বাধীন
বাংলার স্বাধীন আমাকে ওরা চিনতে পারত না কিছুতেই। আমি অভিমানের হাজার হাজার নৌকা ভাসিয়ে দিতাম প্রৌঢ় পিতামাতার দিকে, না
দেশের মানুষরা তোমরা পচা!
উত্তরাধিকারের খাতা খুলে
দেখি আমার জন্যে না দেশটি রেখে গেছে ওরা। । কনিষ্ঠকে কি দিই গো মামণি! এই নাও
স্মৃতিগন্ধ রক্তমাখা পাঁজরের হাড়, বেদনানীল হৃদয়, আজন্মের অশ্রুজবা ঘেরা আমাদের এই
না দেশটি তুমিই রাখো মেয়ে।
আমার সবুজ পাসপোর্টে
স্থায়ীত্বের অমনিবাস। তবু জলধোয়া মাটিহীন শিকড়ের মত বেরিয়ে পড়ে কষ্টের যন্ত্রণারা!
সাকিন না দেশ। কে আমি ?