গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ২৪ মার্চ, ২০১৬

নীহার চক্রবর্তী

পিপাসা 

রঘুনাথ গোলদার মারা গেছে সেই কবে । কিন্তু এখনো নাকি তাকে দেখা যায় এলাকায় রাতের আলো-অন্ধকারে । চারদিক যখন জ্যোৎস্নার আলোয় ভেসে যাচ্ছে কিংবা অমাবস্যার গাঢ় অন্ধকার,তখন তাকে দেখা যায় । কেমন পাশ কাটিয়ে কাটিয়ে নিজের অজানা গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছে । দেখে অনেকেই ভয় পেয়েছে । কেউ-কেউ অসুখে পড়েছে । ওঝা ডাকতে হয়েছে । কিন্তু রঘুনাথের আসা-যাওয়া চলছেই ।
বছর চারেক আগে রঘুনাথ গলায় দড়ি দেয় রাধাপুরের মাঠের এককোণে এক আমগাছে । সে নাকি প্রেমে দাগা খেয়েছিল । অনেকেই আজ সে ব্যাপারটা ভুলতে বসেছে । শুধু মনে আছে ওর আত্মহত্যার কথা । সেদিন রঘুর প্রতিবেশী রমেন ঘোষ বলছিল রঘুর আত্মা এ এলাকা ছাড়তেই পারবে না কোনোদিন । কারণ সে মেয়েটি এখন এখানেই আছে । বেশ সুখে ঘর করছে । শেষ ক্ষতি ওরই করবে
শিবানী । রমাকান্ত দাসের মেয়ে । অনেকদিন ওর সাথে প্রেম ছিল রঘুর । মেয়েটাকেও বিশ্বাসও করেছিলো খুব । কিন্তু একই গ্রামের ছেলে বাসব চাকরী পেতেই শিবানীর বাবা ওর সাথেই বিয়ের ব্যবস্থা করে । শিবানীও সেদিন কোন প্রতিবাদ করেনি । সেই কষ্টেই...
কয়েকদিন আগে প্রথম রাতে রঘু নাকি চুপটি করে বসেছিল রমাকান্তর বাড়ির পিছনের জঙ্গলে । দেখেছে হারু । টর্চ মারতেই সেই মুখ । তবে কেমন একটা যেন । আদল বোঝা যায় । কিন্তু তার অদ্ভুত রঙ । দেখেই হারু দ্দে-দৌড় । কদিন ধরে ও বিছানাত পড়েছে । ওঝায় কাজ হয়নি । রমেন ঘোষ পরেরদিন সকালে সব শুনে বলে রমাকান্তর মেয়ে এখন বাড়িতে আছে । সেই লোভে-লোভে এসেছে রঘু । দেখো না কি হয় । তবে রমাকান্ত ওসবে বিশ্বাস করে না । বলে আমি কী করেছি যে রঘু আমাকে বিপদে ফেলবে ? শুনে অনেকেই হাসে । কিন্তু কেউ চায়না কারোর কোন ক্ষতি হোক ।
কিন্তু তার পরেরদিনই শিবানী ঘাট থেকে জল আনার পর কাঁপতে শুরু করলো । গায়ে প্রবল জ্বর এলো । চোখ-মুখ উল্টে করুণ অবস্থা । সঙ্গে-সঙ্গে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল । সেখানেও ও ঠিক হল না । হাসপাতালের কাছে যারা থাকে তাদের কেউ-কেউ বলল,এখানেও এক ভূতের উপদ্রব । রাতেই বেশী দেখা যায় । অনেকেই দেখেছে । তাই এ জায়গা একেবারেই নিরাপদ নয় । জানলা দিয়ে রোগীর গায়ের দিকে নাকি হাত বাড়িয়ে দেয় এসব কথা শুনে রমেন ঘোষ শোনালো,ঘুরতে-ঘুরতে বুঝি রঘু এখানেও চলে আসে । আর এখন তো শিবানী এখানে । হাসপাতাল বদল করাই বুঝি বুদ্ধির কাজ
জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল শিবানীকে । কিন্তু উন্নতি নেই কোন । একেবারে বিছানার সঙ্গে মিশে গেছে । কোন ওষুধেই কাজ হচ্ছে না আর । রমেন ঘোষ পরিস্থিতি দেখে বলে উঠলো,ভূতরা তো ভূতেরই বন্ধু । রঘু মনে হয় এই হাসপাতালের চারদিকে যেসব ভূত ঘুরে বেড়ায়,তাদের ডাকেই এসেছে । শিবানীর দিকে ওর বেশ কড়া নজর পড়েছে । কোলকাতায় গেলে বুঝি এমন আর হবে না । কোথায় নদীয়া আর কোথায় কোলকাতা ডাক্তারদের নির্দেশে শিবানী এবার কোলকাতায় ।
কত সব বড় বড় ডাক্তার । কত আলোচনা । বৈঠকের পর বৈঠক । শিবানীর পরিবর্তন তেমন একটা দেখা যায় না । দিনে যদি বা একটু সুস্থ মনে হয়,রাতে আবার আগের অবস্থা । ওর চিৎকারে পাশের বেডের রোগীরা পর্যন্ত ব্যতিব্যস্ত । ডাক্তাররা হাল ছেড়ে দেয় একপ্রকার । জীবনও সব হাল ছেড়ে দিয়ে একদিন মধ্যরাতে শিবানীকে তুলে দেয় মরণের হাতে । চরদিকে শোকের মধ্যে সেই রমেন ঘোষ উপস্থিত । মুখ-ভার করে বলল অনেকের উদ্দেশ্যে,রঘু খুব জেদি ছেলে ছিল । পড়াশোনাটাও বেশ করেছিলো । চারদিকে যখন অনেকে টাকা দিয়ে চাকরী পাচ্ছিলো,ওই শুধু জেদ ধরেছিল একটি পয়সা না দেওয়ার জন্য । সেই চাকরীও হল না । শিবানী গেলো অন্য ঘরে । রঘু বহু দুঃখে শেষপর্যন্ত মরে ভূতই হয়ে গেলো । এত ব্যথা পেয়েছিলো ও যে নিজেকে কোলকাতার মতো শহরেও ছড়িয়ে রেখেছিলো । এটাই ভবিতব্য ছিল । আর তাই হল
পরের দিন থেকে এখন পর্যন্ত টানা ছ'মাস রঘুকে আর রাধাপুর এলাকায় দেখা গেলো না । রমাকান্ত দাস লোক ঠিক রেখেছিলো রঘুকে দেখার জন্য । কিন্তু তাকে কেউ খবর দিতে পারলো না রঘুর । রমেন ঘোষ বলল,আর দেখা যাবে না ওকে । শিবানীকে নিয়ে ও এখন প্রেতলোকে ঘর করছে