রঘুনাথ গোলদার মারা
গেছে সেই কবে । কিন্তু এখনো নাকি তাকে দেখা যায় এলাকায় রাতের আলো-অন্ধকারে ।
চারদিক যখন জ্যোৎস্নার আলোয় ভেসে যাচ্ছে কিংবা অমাবস্যার গাঢ় অন্ধকার,তখন তাকে দেখা
যায় । কেমন পাশ কাটিয়ে কাটিয়ে নিজের অজানা গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছে । দেখে অনেকেই ভয়
পেয়েছে । কেউ-কেউ অসুখে পড়েছে । ওঝা ডাকতে হয়েছে । কিন্তু রঘুনাথের আসা-যাওয়া
চলছেই ।
বছর চারেক আগে রঘুনাথ
গলায় দড়ি দেয় রাধাপুরের মাঠের এককোণে এক আমগাছে । সে নাকি প্রেমে দাগা খেয়েছিল ।
অনেকেই আজ সে ব্যাপারটা ভুলতে বসেছে । শুধু মনে আছে ওর আত্মহত্যার কথা । সেদিন
রঘুর প্রতিবেশী রমেন ঘোষ বলছিল “রঘুর আত্মা এ এলাকা ছাড়তেই পারবে
না কোনোদিন । কারণ সে মেয়েটি এখন এখানেই আছে । বেশ সুখে ঘর করছে । শেষ ক্ষতি ওরই
করবে” ।
শিবানী । রমাকান্ত
দাসের মেয়ে । অনেকদিন ওর সাথে প্রেম ছিল রঘুর । মেয়েটাকেও বিশ্বাসও করেছিলো খুব ।
কিন্তু একই গ্রামের ছেলে বাসব চাকরী পেতেই শিবানীর বাবা ওর সাথেই বিয়ের ব্যবস্থা
করে । শিবানীও সেদিন কোন প্রতিবাদ করেনি । সেই কষ্টেই...
কয়েকদিন আগে প্রথম রাতে
রঘু নাকি চুপটি করে বসেছিল রমাকান্তর বাড়ির পিছনের জঙ্গলে । দেখেছে হারু । টর্চ
মারতেই সেই মুখ । তবে কেমন একটা যেন । আদল বোঝা যায় । কিন্তু তার অদ্ভুত রঙ ।
দেখেই হারু দ্দে-দৌড় । কদিন ধরে ও বিছানাত পড়েছে । ওঝায় কাজ হয়নি । রমেন ঘোষ
পরেরদিন সকালে সব শুনে বলে “রমাকান্তর মেয়ে এখন বাড়িতে আছে ।
সেই লোভে-লোভে এসেছে রঘু । দেখো না কি হয় । তবে রমাকান্ত ওসবে বিশ্বাস করে না ।
বলে “আমি কী করেছি যে রঘু আমাকে বিপদে ফেলবে” ? শুনে অনেকেই হাসে ।
কিন্তু কেউ চায়না কারোর কোন ক্ষতি হোক ।
কিন্তু তার পরেরদিনই
শিবানী ঘাট থেকে জল আনার পর কাঁপতে শুরু করলো । গায়ে প্রবল জ্বর এলো । চোখ-মুখ
উল্টে করুণ অবস্থা । সঙ্গে-সঙ্গে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল । সেখানেও ও ঠিক হল
না । হাসপাতালের কাছে যারা থাকে তাদের কেউ-কেউ বলল, “এখানেও এক ভূতের উপদ্রব । রাতেই বেশী দেখা যায় ।
অনেকেই দেখেছে । তাই এ জায়গা একেবারেই নিরাপদ নয় । জানলা দিয়ে রোগীর গায়ের দিকে
নাকি হাত বাড়িয়ে দেয়” । এসব কথা শুনে রমেন ঘোষ শোনালো, “ঘুরতে-ঘুরতে বুঝি রঘু
এখানেও চলে আসে । আর এখন তো শিবানী এখানে । হাসপাতাল বদল করাই বুঝি বুদ্ধির কাজ” ।
জেলা সদর হাসপাতালে
নিয়ে যাওয়া হল শিবানীকে । কিন্তু উন্নতি নেই কোন । একেবারে বিছানার সঙ্গে মিশে
গেছে । কোন ওষুধেই কাজ হচ্ছে না আর । রমেন ঘোষ পরিস্থিতি দেখে বলে উঠলো, “ভূতরা তো ভূতেরই বন্ধু
। রঘু মনে হয় এই হাসপাতালের চারদিকে যেসব ভূত ঘুরে বেড়ায়,তাদের ডাকেই
এসেছে । শিবানীর দিকে ওর বেশ কড়া নজর পড়েছে । কোলকাতায় গেলে বুঝি এমন আর হবে না ।
কোথায় নদীয়া আর কোথায় কোলকাতা” । ডাক্তারদের নির্দেশে
শিবানী এবার কোলকাতায় ।
কত সব বড় বড় ডাক্তার ।
কত আলোচনা । বৈঠকের পর বৈঠক । শিবানীর পরিবর্তন তেমন একটা দেখা যায় না । দিনে যদি
বা একটু সুস্থ মনে হয়,রাতে আবার আগের অবস্থা । ওর চিৎকারে পাশের বেডের রোগীরা পর্যন্ত
ব্যতিব্যস্ত । ডাক্তাররা হাল ছেড়ে দেয় একপ্রকার । জীবনও সব হাল ছেড়ে দিয়ে একদিন
মধ্যরাতে শিবানীকে তুলে দেয় মরণের হাতে । চরদিকে শোকের মধ্যে সেই রমেন ঘোষ উপস্থিত
। মুখ-ভার করে বলল অনেকের উদ্দেশ্যে, “রঘু খুব জেদি ছেলে ছিল
। পড়াশোনাটাও বেশ করেছিলো । চারদিকে যখন অনেকে টাকা দিয়ে চাকরী পাচ্ছিলো,ওই শুধু জেদ
ধরেছিল একটি পয়সা না দেওয়ার জন্য । সেই চাকরীও হল না । শিবানী গেলো অন্য ঘরে । রঘু
বহু দুঃখে শেষপর্যন্ত মরে ভূতই হয়ে গেলো । এত ব্যথা পেয়েছিলো ও যে নিজেকে কোলকাতার
মতো শহরেও ছড়িয়ে রেখেছিলো । এটাই ভবিতব্য ছিল । আর তাই হল” ।
পরের দিন থেকে এখন
পর্যন্ত টানা ছ'মাস রঘুকে আর রাধাপুর এলাকায় দেখা গেলো না । রমাকান্ত দাস লোক ঠিক
রেখেছিলো রঘুকে দেখার জন্য । কিন্তু তাকে কেউ খবর দিতে পারলো না রঘুর । রমেন ঘোষ
বলল, “আর দেখা যাবে না ওকে । শিবানীকে নিয়ে ও এখন প্রেতলোকে ঘর করছে” ।