গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ২৪ মার্চ, ২০১৬

দময়ন্তী দাশগুপ্ত

ঈশ্বরের সঙ্গে দেখা

পথেঘাটে মাঝে মধ্যেই ঈশ্বরের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়ে থাকে। এই সেদিনও হয়েছিল - কলকাতা শহরে যে বেশে তাকে পাওয়া সবচেয়ে দূর্লভ,অর্থাৎ কিনা ট্যাক্সিচালক। অশোক সেন-এর স্মরণসভা থেকে ফিরে দশদ্রোণে মা-কে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ফিরছিলাম। রাত দশটা বেজে গেছে। ওই রাস্তায় অত রাতে বাস বন্ধ হয়ে যায়। অন্য কেউ হলে থেকেই যেত হয়ত। কিন্তু যতক্ষণ আমার পদযূগল আছে ততক্ষণ আমি ও নিয়ে বিশেষ চিন্তা করি না। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে অটো বা রিক্সা কিচ্ছু না পেয়ে হাঁটা দিলাম। একটা স্টপেজ মতো হেঁটেও ফেললাম। এর আগে আমাকে স্টপেজে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এক স্কুটারচালক হাসি হাসি মুখে এগিয়ে এসে বলেছিলেন,‘এখন তো বাস পাবেন না’। মনে হল, ভদ্রলোকের হয়তো মনে হয়েছিল আমাকে কিছুটা এগিয়ে দেওয়ার কথা,কিন্তু মুখ ফুটে ঠিক বলতে পারলেন না। যাইহোক,হঠাৎ একটা হলুদ ট্যাক্সি থামল ঘ্যাঁচ করে – ‘যাবেন নাকি?’ দেড়শো টাকা চাইল। আমার মনঃপুত হল না। আরে বাবা,ভি আই পি কী নিদেন পক্ষে চিনার পার্ক পৌঁছাতে পারলেও কিছু না কিছু পেয়েই যাব। বলি,নাহ্‌,যাব না। আবার হাঁটা দিই। এবারে একটা সাদা গাড়ি এসে দাঁড়াল,সেটা ট্যাক্সি বা এমনি গাড়ি ঠিক বলতে পারব না। একশো টাকা চাইতে উঠে বসলাম। জয়া সিনেমার-র কাছে নামিয়ে দিয়ে গেল। বাড়ি ফিরে বললাম, দেখলে তো কেমন চলে এলাম,মিছিমিছিই চিন্তা করছিলে। মনে মনে ভাবি,রাখে কেষ্ট, হাঁটে কে?
অনেকদিন আগে,কালান্তরে চাকরি করার সময় একদিন পার্কসার্কাস থেকে এক ভদ্রলোক আমাকে অমনিই পৌঁছে দিয়েছিলেন। আমি অন্যান্য রানিং গাড়ি যেগুলো যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়,তেমন ভেবে হাত দেখিয়েছিলাম। সেই ভদ্রলোকও গাড়ি থামিয়ে কেবলমাত্র আমাকে তুলে নিয়েই আবার রওনা দিলেন। অর্ধেক রাস্তা উনি গাড়ি চালাতে চালাতে মোবাইলে কথা বলে গেলেন আর আমি পিছনে বসে আক্রমণ করলে জলের বোতল না ছাতা কোনটা আত্মরক্ষার জন্য বেটার হবে ভেবে গেলাম। আর বাকি অর্ধেক রাস্তা আমার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন দূরবস্থা নিয়ে গম্ভীর আলোচনা করে গেলেন। ভদ্রলোক প্রবাসী বাঙালি,কয়েকদিনের জন্য এসেছেন। নামার সময় ভাড়া দিতে গেলে বললেন,কী মুশকিল,আমি তো এপথেই যাচ্ছিলাম,আপনার জন্য আমার তো বাড়তি কোনো তেল পোড়েনি। অকাট্য যুক্তি। আমিও আর কথা বাড়াই নি।
কিছু কিছু অভিজ্ঞতা,কিছু কিছু মানুষের কথা ফিরে ফিরে আসে মনে। ঈশ্বরের দেখা পাওয়া, তাও গাড়ি সমেত,কলকাতা শহরে,সে কি সোজা কথা?

‘তাই হেরি তায় যেথায় সেথায় তাকাই আমি...’।