গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৫

ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

অচেনা

বিকেলে স্কুল থেকে ফেরার পথে বাস থেকে নামতে গিয়ে পায়ের ব্যথাটা টের পেল সুমনা। কাঁধে একটা বড় ব্যাগ ছিল, খাতাপত্রে ভর্তি হয়ে আছে। এছাড়াও শাল, হাতব্যাগ। সব নিয়ে কোনরকমে বাস থেকে নেমে এল সে। কিন্তু নামার পর আর যেন দাঁড়াতে পারছে না সুমনা। ফাঁকা জায়গা, এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিছু দেখতে পেল না। শুধু দু-একটা চায়ের দোকান, আর অল্প একটু দূরে একটা ধাবা। সুমনা জানে, এখানে আর কোন দোকান নেই, যা আছে, কলোনীর  ভিতরে। ধাবাটাও খুব ভালো কিছু নয়, এসব জায়গায়  যেমন হয়...পথ চলতি যেমন হয় আর কি! ভাল হওয়ার  কথাও নয়। কলোনীর বাইরে এই সব দোকানে ভদ্রঘরের বউ-মেয়েরা কেউ একটা আসে না।  কলোনীর লেবার জাতীয় লোকেরা আর ছেলে-ছোকরারাই আসে কখনো-সখনো। বাস এসে  দাঁড়ায় কলোনীর  মুখের কাছে, রাস্তা পেরিয়ে ওপারে গিয়ে কলোনীর গেট। সেদিকেই এগিয়ে যাবার চেষ্টা করল, পারল না। তীব্র যন্ত্রণা, পা  ভারী হয়ে আসছে। আজ হাতের কাছে মুঠো ফোনও নেই, সকালের তাড়াহুড়োতে বাড়িতেই ফেলে এসেছে। তাছাড়া থাকলেও মা কিছু করতে পারতেন না। বাবা এখন অফিসে, মায়ের পক্ষে একা একা এখানে এসে সুমনা কে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কোনরকমে এক পা এগোতে গিয়ে বুঝতে পারল এখন সে দাঁড়াতেই পারবে না। কিছু  একটা ধরার আশায় মরিয়া হয়ে একটু এগিয়ে একটা বাইকের হাতল ধরার চেষ্টা করল। লাল-কালো রঙের একটা বাইক কেউ দাঁড় করিয়ে রেখেছে দোকান আর ধাবার মাঝখানে। কিন্তু বাইকে হাত রাখতে না রাখতেই তার উপরেই হুমড়ি খেয়ে পড়ল সে, সব কিছু আবছা হয়ে আসছে...আর কিছু জানে না।

--শুনছেন...শুনুন, এই যে শুনছেন! আমি বাইকটা নেব...শুনছেন...’, একটি বছর পঁচিশ/ছাব্বিশের ছেলে ডাকছিল সুমনাকে। সুমনা তখনও বাইকের উপরে পড়ে আছে। হালকা কথা-বার্তা কানে আসছিল, কিন্তু সে উঠতে পারছে না। অসহ্য যন্ত্রণায় চোখমুখ ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছে। ততক্ষণে দু/চার জন পথ চলতি মানুষের ভীড় জমেছে। ধাবার মালিক পবনও এসে হাজির। সকলের সামনে ছেলেটিই সুমনাকে ধরে নাড়া দিল। পবনের হাতে জলের জগ, ছেলেটি সেটি হাতে নিয়ে দু একবার জলের ছিটে দিল পাশ থেকে। আবার দু-এক বার দিতে মেয়েটি ঘুরে দাঁড়িয়ে সামনে দেখার চেষ্টা করল। চোখ মেলতেই পবনকে দেখল। ততক্ষণে সে বাইকটা ধরে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে, কিন্তু কাঁপছে, পারছে না। মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল পবন---
---হায় রাম, ইয়ে তো মাষ্টার দিদিমণি আছে, ই কলোনী মে থাকে, হামি জানি উয়াকে...
ছেলেটি একটু ইতস্ততঃ করে বলল সুমনাকে---আমি বাইকটা এবার নেব যে...আপনি...
একবার সামনে পবনের দিকে, আর একবার ছেলেটির দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বলে উঠল সুমনা---আমি ঠিক  দাঁড়াতে পারছি না...
ভয় পেল ছেলেটি। সে সুমনাকে চেনে না। কলোনীর ঠিক কোথায়  থাকে, তাও জানে না। কাছাকাছি হলে নাহয় পৌঁছে দিতে পারত, কিন্তু... একবার হাতঘড়িতে সময় দেখল ছেলেটি। আর মিনিট পনেরো সে অপেক্ষা করতে পারবে, তারপর তাকে যেতেই হবে, কোন উপায় নেই। সুমনার দিকে তাকিয়ে বলল-- আপনি কোথায় থাকেন? কাছাকাছি কোথাও হলে আমি নাহয় আপনাকে কিছুটা  এগিয়ে দিতে পারি...। 
ম্লান হাসি হেসে বললে সুমনা---উঠতে পারব কি! বুঝতে পারছি না।
ততক্ষণে পবন তার ধাবা থেকে দু/একজন কর্মীকে ডেকে নিয়েছে। সুমনাকে বলল--হামি আপনাকে পাকড়াবো দিদিমণি, আপনি হামাকে ধরে থাকেন, ঠিক হ্যায়? সকলে মিলে ধরাধরি করে তাকে কোনরকমে বাইকের উপরে বসালো । ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল---ই খুব নজদীক আছে দাদা, লিয়ে যান, বেশিদুর নাই আছে। হাঁ, দিদিমণি, ঠিক সে পাকড়াবেন, পারবেন তো?
নিজের উপরে খুব ভরসা করতে পারছে না সুমনা। ছেলেটির দিকে একবার তাকাল। ছেলেটি বাইকে চড়তে চড়তে বলল---আপনি আমাকে ধরুন, নইলে পড়ে গেলে বুঝব কি করে? আপনার ভয় নেই, আমি খুব আস্তে চালাব... বাইকে স্টার্ট দিল সে।

 (২)
মাস তিনেক পরে এক বিকেলে যথারীতি স্কুল থেকে কলোনীর গেটে নামার সময় চোখ পড়ল লাল-কালো রঙের একটা বাইক। সেই বাইকটা না! চমকে উঠল সুমনা। হে ভগবান, সেই যেন হয়! সেদিনের পর থেকে কত খুঁজেছে সুমনা সেই ছেলেটিকে। সেদিন যন্ত্রনায় কাতর ছিল, ছেলেটিও কোনরকমে সামনের ঘরে পৌঁছে দিয়ে চলে গিয়েছিল। তাঁর নাম-ধাম, ফোন নম্বর কিছুই জানা হয়নি। তারপর থেকে কত খুঁজেছে সুমনা। কিছুই  করতে পারেনি। নিজেও প্রায় সপ্তাহ দুয়েক ঘরবন্দী ছিল। না, ভেঙ্গে-টেঙ্গে যায়নি কোথাও, কিন্তু ডাক্তার, ওষুধ, ফিজিওথেরাপি, মায়ের রাগ, বাবার বকুনি সব মিলিয়ে একেবারে জেরবার। সেদিন বাস থেকে নামতে গিয়ে সাময়িক ভাবে পায়ের পেশিতে টান ধরেছিল তীব্রভাবে। হয়ত বাস থেকে নামতে গিয়ে হয়েছিল, কিংবা অনেকক্ষণ বাসে একটানা বসে থাকার পর দাঁড়াতে গিয়ে...ঠিক কিভাবে হয়েছিল সুমনা জানে না। কিন্তু সেই ব্যথা  এতটাই তীব্র ছিল, যে সেদিন প্রায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল সুমনা। ওই ছেলেটী না থাকলে কি করে যে সেদিন বাড়ি পৌঁছত...! সত্যি, রাস্তাঘাটে এমন কিছু মানুষ আজও আছেন  বলেই ভরসা। বাইকটার দিকে এগিয়ে গেল সুমনা। একটু অপেক্ষা করে যাবে সে, যদি ছেলেটি হয়! মুখ নিচু করে কিছু ভাবতে যাচ্ছিল সুমনা, আওয়াজ শুনল---আপনি?...আপনিই  সেদিন...আপনাকেই তো  একদিন পৌঁছে দিয়ে এসেছিলাম, তাই না?
মৃদু হাসি হাসল সুমনা। --সত্যি, আপনি না থাকলে কি যে হত সেদিন। অথচ দেখুন,  আপনার কোন খবরই নিতে পারিনি, এক কাপ চা খাওয়ানোও হয়নি। ভাবলে এত খারাপ লাগে...!
--আরে, না না, সে পবন দারা ঠিক  কিছু একটা ব্যবস্থা করে বাড়ি পৌঁছে দিতেন। উনি তো চেনেন আপনাকে... হেসে বলল ছেলেটি।
এখানে কোথায়...জিজ্ঞেস করল সুমনা।
--এই তো, কলোনী থেকেই ফিরছি... উত্তর দিল ছেলেটি। কলোনীতে থাকে... কিন্তু দেখেছে বলে মনে করতে পারল না সুমনা। তারাও প্রায় সাত বছর হল এখানে এসেছে, কোনদিন দেখেছে বলে মনে হয় না। জিজ্ঞেস না করে পারল না সুমনা... আপনি কলোনীতে থাকেন?
--আমি নতুন এসেছি, আপনাদের কলোনীতে নতুন যে ব্যাঙ্কটা হয়েছে, সেখানে এসেছি বদলি হয়ে, রামগড় থেকে।
ওহ্‌...--এবার বুঝল সুমনা। --একদিন আসুন বাড়িতে, আপনার তো চেনা হয়ে গেছে, মা-বাবাও বলছিলেন আপনার সেদিনের কথা...
--না না, কি এমন...যাব একদিন--বাইকে ওঠার চেষ্টা করল ছেলেটি। না উঠে এগিয়ে এল ---আপনি কি এখন ওখানেই যাবেন? মানে, স্কুল থকেই ফিরছেন তো! কি ভাবে যান, খানিকটা তো মনে হয় হাঁটতে হয়...
--যাবার সময় বাবা স্কুটারে নামিয়ে দেন, ফেরার সময় সারাদিনের পর এটুকু হাঁটতে ভালই লাগে। আমি যেতে পারব, আর কোন অসুবিধে নেই। আপনি আসুন... একটু যেন লজ্জ্বা পেয়ে বলল সুমনা।
আচ্ছা বেশ। গেলাম তাহলে... বাইকে স্টার্ট দিল ছেলেটি।

(৩)
পরের দিন রবিবার। গতকাল স্কুল থেকে ফেরার পর বাবা-মাকে বলা হয়নি সেই ছেলেটির কথা। সকালে উঠেই মনে হল এখন  চায়ের টেবিলেই বলবে। নিখিলেশ সুমনার দিকে একবার ইঙ্গিত করেই  খেতে শুরু করে দিয়েছেন। সুমনা অপেক্ষা করছে মায়ের জন্য। মা এলে একসঙ্গে শুরু করবে। খাবার টেবিলটা রবিবারের দু/তিনটে খবরের কাগজ, দুটো পত্রিকা, চা-জলখাবারের প্লেট, কাপ-চামচে বোঝাই হয়ে আছে। মিনতি নিজের চায়ের কাপ রাখার জন্য একপাশে একটা কাগজ সরিয়ে রেখে বসলেন। চায়ের কাপ মুখে দিয়েই আবার নামালেন।  আজকে  বেশ কিছু কেনা-কাটার দরকার, আগে সেগুলো বলে নিতে চান, নইলে কে, কখন, কোথায় বেরিয়ে যাবে, হয়ে উঠবে না। সেসব ফিরিস্তি শেষ হলে সুমনা জিজ্ঞেস করল নিখিলেশকে...বাবা, তোমার কিছু?
নিখিলেশ কাগজে মুখ ঢেকে রয়েছেন। হাতের ইশারায় জানিয়ে দিলেন---না।
একথা-সেকথায় একরকম ভুলেই গেল সুমনা মা-বাবাকে সেই ছেলেটির কথা বলতে। আজ তার অনেক কাজ। জামা-কাপড় ধোয়া, ইস্ত্রি করা, আবার সাতদিনের সব ব্যবস্থা করে রাখা। কাজের মাসির কাছে চুলে তেল দিতে হবে। নিজেকেও আজ একটু ঘষা-মাজা  করতে হবে--একবার ঝুমুরের বাড়ি যেতে হবে, খবর নিতে। কালকে দেখা হয়েছিল শীলা কাকিমার সঙ্গে একেবারে বাড়ির মুখেই। ঝুমুর তার এখানকার একমাত্র বন্ধু,গলাব্যথা আর জ্বর নিয়ে বিছানায়, কাকিমা হাসপাতাল থকে ওষুধ নিয়ে ফিরছিলেন। উঠে পড়ল সুমনা। আজ আর তার সময় নেই, বহুত কাজ ।

বিকেলে বাজার সেরে মায়ের সঙ্গে জিনিসপত্র নামিয়েই চলে গিয়েছিল ঝুমুরের বাড়ি। সেখান থেকে ফিরতে একটু সন্ধ্যেই হয়ে গেল।  বাড়িতে পা রেখে দেখল বসার ঘরে বাবার বেশ কয়েকজন বন্ধুবান্ধব রয়েছেন, উমেশ কাকার উত্তেজিত কথাবার্তা কানে আসছিল। সুমনা বুঝল কিছু একটা আজ হয়েছে কলোনীতে। নইলে এতজন এখানে আসতেন না। মাঝে মাঝে অবশ্য দল বেঁধে যে আসেন না, তা নয়। কিন্তু সে বিশেষ কোন দিনে, সাধারণ ভাবে নয়। সুমনা সে ঘরে না গিয়ে সোজা মায়ের কাছে। মায়ের দিকে ভুরু কুঁচকে চাইতেই মিনতি বলে উঠলেন...কি জানি, আমি কি সব জানি!
--যা জান, তাই বল না... বলে উঠল সুমনা... কি হয়েছে, মা!
--কে বাপু একটা নতুন ছেলে এসেছে রাঁচী না রামগড় থেকে, এখানে ব্যাঙ্কে, সে বেশ কিছু টাকা চুরির দায়ে ধরা পড়েছে। ওর আগের অফিস থেকেও নাকি খবর পাঠিয়েছে, সেখানেও একই ঘটনা...আমি অত কিছু জানি না।  তোর বাবার সঙ্গে উমেশদারা কথা বলছিলেন, চা দিতে গিয়ে খানিক শুনলাম। কি সব ছেলে বাবা... ভয়ে-ভয়ে কিছুটা  বিরক্তিতে বলে উঠলেন মিনতি।
ধ্বক্‌ করে উঠল সুমনার বুক। সেই ছেলেটা নয় তো! সেও যেন এমনি কিছু একটা বলেছিল। রাঁচী না রামগড় থেকে বদলি হয়ে এখানে এসেছে। কিন্তু তাই বলে চুরি! ছেলেটির চেহারা, কথাবার্তা, ভদ্র ব্যবহার, পরোপকার...এগুলোর সঙ্গে কোথাও মিল খুঁজে পাচ্ছিল না। চুরি করলে কেউ নিজের সত্যি কথা বলে? সে যে রামগড় থেকে এখানে বদলি হয়ে এসেছে, বলেছে তো, কোথাও কি ভুল হচ্ছে...!
--তুমি ঠিক জান, মা?
--আমি কি ওখানে চাকরি করি নাকি? উমেশ দারা বলাবলি করছিলেন, বিরক্ত হচ্ছিলেন...তাই শুনলাম। ছেলেটিকে দেখে নাকি বোঝাই যায়নি...’  
--ভুলও তো হতে পারে...মা!
--না, তাহলে ওর আগের অফিসও একই কথা বলে খবর করবে কেন? মিনতি হয়ত আরো কিছু বলছিলেন। সুমনা নিজের ঘরে চলে এল। খারাপ লাগছিল তার, খুব খারাপ লাগছিল। কেমন যেন একটা কষ্টের মতো কিছু গলায় আটকে গেছে...কই, একবারও তো ছেলেটিকে দেখে কিছু মনে হয়নি। কি মমতার সঙ্গে সে সেদিন বাড়িতে এনে দিয়ে গেছে। ভাল না হলে কেউ দেয়? এত ভদ্র ব্যবহার...মনে মনে ছেলেটির হয়ে যুক্তি সাজাচ্ছিল সুমনা। কালকেও কি সুন্দর ব্যবহার করেছে ছেলেটি। এগুলো কি তবে মুখোশ? যদি, কালকেই এই ঘটনা হয়ে থাকে, তারপরেও কি করে ছেলেটি অমন স্থির ছিল? মানতে পারছিল না সুমনা। মানুষকে চিনতে এত ভুল করল সে, নাকি  চেনা সত্যিই যায় না!
কি করে এমন হয়, কেন হয়! ভাবতে পারছিল না সুমনা। তাঁর সরলতা, বিশ্বাস, ছেলেটির প্রতি মুগ্ধতায় কোথাও আঘাত লাগছিল। নিজের ঘরের জানালা দিয়ে দুরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে রইল সে। একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা যেন কুরে কুরে খাচ্ছিল সুমনাকে.....