গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৫

সুবীর কুমার রায়

যেখানে আঁটের ভয়

বৃদ্ধটি হাত জোড় করে ডুকরে কেঁদে উঠে বললোবাবু আমার জোয়ান ছেলেটা মরে গেছে, তার কাজে টাকার প্রয়োজন। টাকাটা আমায় তুলতে দিন। আমি আপনার ঋণের টাকা ঠিক শোধ করে দেব।  
মেদিনীপুর জেলার একটা গন্ডগ্রামে অবস্থিত, একটা সরকারী ব্যাঙ্কের শাখায়, আমি তখন রুরাল ডেভেলপমেন্ট্ অফিসার হিসাবে কর্মরত। এ অঞ্চলের আর প্রায় সকলের মতো, এ লোকটাও তার ঋণের টাকা পরিশোধ করে না। আজ সে তার সেভিংস্ একাউন্ট থেকে সামান্য জমানো টাকা তুলতে আসলে, আমি তাকে ভয় দেখাবার জন্য, টাকা তুলতে দেব না বলায়, তার মুখ চোখের অবস্থা করুণ হয়ে যায়, এবং কান্নায় ভেঙ্গে পরে আমায় কথাগুলো বলে।
জোয়ান ছেলে মারা গেল কী ভাবে?
বাবু, তারে আঁটে নিয়ে গেছে। বৃদ্ধটি হাতজোড় করে কপালে ঠেকালো। আমার উদ্দেশ্যে না আঁটের উদ্দেশ্যে, বুঝলাম না।
তাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম— “ঘটনাটা ঘটলো কী ভাবে”?
বাবু, দুদিন আগে সন্ধ্যাবেলা আমার বড়ছেলে, তার ছোট ভাই এর সাথে হ্যারিকেন নিয়ে পাশের পুকুর ঘাটে গিয়েছিল। সেখান থেকেই তারে আঁটে নিয়ে গেছে। ছোটছেলের চিৎকারে আমরা গিয়ে দেখি, সব শেষ।
ছোটছেলের বয়স কত?
তা দশ-বার হবে বোধহয়, ওর মা বলতে পারবে।
পুলিশে খবর দিয়েছিলে?
কী যে বলেন বাবু, পুলিশ কী করবে?
ডাক্তার ডেকেছিলে?
এ গাঁয়ে ডাক্তার কোথায়? নন্দ হোমপ্যাথকে ডেকে ছিলাম। সে সাঁঝের বেলা ভয়ে সেদিক মাড়ায় নি।
পঞ্চায়েত এ খবর দাও নি? মেম্বারকে জানিয়েছিলে?
পঞ্চায়েতের মেম্বার দুলালের ভাইরে আর বছর আঁটে নিলে। তারে বলতে সে বললে, আমি আর কী করবো, পুজো দাও।
ছেলের দেহ কী হ?
কী হবে? আর পাঁচজন মরলে যা হয়, মাঠের শ্মশানে পুড়ায়ে ফেললাম।
এই এলাকায় এসে প্রথম আঁটের কথা শুনি। আঁট এখানকার ব্রহ্মদৈত্য গোছের কিছু একটা হবে। প্রায় সকলের মনেই একটা ভয় মিশ্রিত শ্রদ্ধা আঁটের প্রতি আছে। আঁট নিয়ে অনেক গল্প, যদিও এরা বলে ঘটনা, শোনা হয়ে গেছে। ফলে আঁট সম্বন্ধে একটা কৌতুহল আমার মনে জেগে ছিল। শেষে বৃদ্ধটিকে টাকা তুলতে দেওয়ায়, সে নমস্কার করে, টাকা নিয়ে চলে গেল।
আমি আঁট নিয়ে আরও খোঁজ খবর নিতে শুরু করলাম। অনেক নতুন নতুন তথ্যও পেলাম। আঁট হিন্দু হয়, মুসলমানও হয়, তবে অন্য কোন ধর্মের আঁট, এ অঞ্চলের মানুষ দেখে নি। হয় কী না জানেও না। আঁট শুধু মাত্র পুরুষই হয়। মেয়ে আঁট বা আঁটী (?) হয় না। ফলে এদের বংশ বৃদ্ধি না হওয়ায়, আঁট সম্প্রদায় যাতে লুপ্ত না হয়ে যায়, সেই জন্য এরা পুরুষ মানুষ মেরে আঁটের সংখ্যা বৃদ্ধি করে।
এর কিছুদিন পরেই অফিসের হেড ক্যাশিয়ার রাধেশ্যামবাবু, চিৎকার করে একজন লোককে খুব ধমক দিয়ে বলছে— “বেঞ্চি থেকে নেমে দাঁড়াও, ওর ওপর উঠেছ কেন? নেমে দাঁড়াও
তার চিৎকারে লোকটার দিকে চোখ গেল। আমি যে জায়গাটায় বসে আছি, সেখান থেকে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি, লোকটা মাটিতেই দাঁড়িয়ে আছে। অসম্ভব রকমের লম্বা, চোখ দুটো যেন গর্তের মধ্যে থেকে ঠিকরে বেড়িয়ে আসতে চাইছে, গায়ের রঙ কুচকুচে কালো। কাউন্টারের অপর প্রান্ত থেকে রাধেশ্যামবাবু, লোকটার মাথা থেকে বুকের কিছুটা নীচ পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে। ফলে আর পাঁচজন কাষ্টোমারের থেকে অত উচ্চতায় লোকটার মাথা দেখে, তার ধারণা হয়েছে যে লোকটা বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
আমরা সকলে হাসাহাসি করায়, লোকটা কেমন ঘাবড়ে গিয়ে চলে গেল। রাধেশ্যামবাবুও তার বোকামির জন্য লজ্জা পেয়ে গেল। পঞ্চায়েতের একজন মেম্বার আমার কাছে কাজে এসেছিল। সে-ই আমাকে গোপন খবরটা দিল— “ফিলটারবাবু, ওকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করবেন না, ও কিন্তু আঁট। ওর এই ব্র্যাঞ্চে লোন আছে
এই প্রথম আমার আঁট দর্শন। লোকটা মুসলমান। লোন নিয়ে আঁট হয়েছে, না আঁট হয়ে লোন নিয়েছে, জানা গেল না। শুধু ফিল্ড্ অফিসার বা এই অঞ্চলের ফিলটারবাবু হিসাবে বুঝলাম, এর লোন আদায় হবার নয়।
এ অঞ্চলে একজন ফর্সা, বেশ লম্বা লোককে প্রায়ই রাস্তায় দেখি। যথেষ্ট বয়স হয়েছে। সবাই দেখি তাঁকে হাত তুলে নমস্কার করে। একদিন শুনলাম এই ভদ্রলোক এই এলাকার একমাত্র জীবিত মানুষ, যিনি আঁটের হাত থেকে বেঁচে ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছেন। হয়তো আঁটের কবল থেকে বেঁচে ফিরে আসা একমাত্র জীবিত মানুষ হিসাবে তাঁর নমস্কার প্রাপ্য, কিন্তু আমার আঁট সম্বন্ধে কৌতুহল, ভদ্রলোক আরও বাড়িয়ে দিলেন।
এইভাবে বেশ দিন কাটছিল, হঠাৎ আমাদের অফিস প্রায় আধ কিলোমিটার দুরে একটা নতুন তৈরী বেশ বড়, সুন্দর বাড়িতে স্থানান্তরিত হল। বাড়িটার ঠিক পাশে একটা বড় বট গাছ এবং কতগুলো চালতা গাছ ছিল। গোটা অঞ্চলে বিদ্যুৎ ও টেলিফোনের ব্যবস্থা এখনও হয় নি। আগের বাড়িতে প্রাগৈতিহাসিক যুগের রাজা-বাদশাদের মতো পঙ্খাপুলারের ব্যবস্থা ছিল। দুটো ছেলে পালা করে মাদুরের বড় বড় পাখা, দড়ি ধরে টানতো। নতুন বাড়িতে পাশের বটগাছের নীচে, শেড্ করে জেনারেটার বসানো হল। আমাদের কষ্ট কিছুটা কমলো। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই সেটা বিকল হল। সারানোর কয়েক দিনের মধ্যেই আবার খারাপ হল। সন্ধ্যার সময় জায়গাটায় আলোর ব্যবস্থা করার জন্য, বটগাছ থেকে তার ঝুলিয়ে একটা বাল্ব জ্বালানো হত।
কয়েক দিনের মধ্যে জেনারেটারের মালিক আমাদের জানালো, সে আর জেনারেটার ভাড়া দেবে না। অথচ এ অঞ্চলে অন্য কোথাও তার জেনারেটার ভাড়া দেবার কোন সুযোগ নেই। বনু নামে একটা জোয়ান ছেলে ঐ জেনারেটারটা চালাতো। সে আগের বাড়িতে মাদুরের পাখাও টানতো। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন তার মালিক জেনারেটার ভাড়া দিতে চাইছে না। ভেবেছিলাম সুযোগ বুঝে ভাড়া বাড়ানোর কথা বলবে।
টাকা কী কম দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করছে?
না স্যার।
তবে কেন চালাতে চাইছে না?
অন্য অসুবিধা আছে স্যার।
কী অসুবিধা খুলে বল, না বললে বুঝবো কী ভাবে?
দেখছেন না বারবার জেনারেটার খারাপ হচ্ছে?
দেখছি তো। ওটাকে ভালভাবে মেরামত করার ব্যবস্থা কর।
আমাদের মেশিন ভালই আছে স্যার, অন্য কারণে বারবার খারাপ হচ্ছে।
কী কারণে ?
স্যার, আপনারা অন্য জেনরেটারের ব্যবস্থা করুন। ওরা চাইছে না আমরা জেনারেটার চালাই।
কারা চাইছে না?
স্যার, এখানে আঁট আছে। তারা অসন্তুষ্ট হচ্ছে। শব্দ বা আলো ওরা পছন্দ করে না।
মরেছে, মাদুরের পাখা খুলে ফেলা হয়েছে। তাছাড়া সে গুলোর যা হাল হয়েছিল, নতুন করে লাগানো যাবে বলেও তো মনে হয় না। কোথায় খুলে রাখা হয়েছে, তাও তো জানি না। এ তো ঢাকও গেল, ঢুলিও গেল অবস্থা। শেষে অনেক বোঝাবার পর, সে চালাতে রাজী হল বটে, তবে সন্ধ্যের পর চালাতে পারবে না, পরিস্কার জানিয়ে দিল।
ঠিক আছে তাই হবে।
এরপর থেকে কোন কারণে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ থাকলে, নিজেরাই জেনারেটার চালাতে শুরু করলাম।
দিন কয়েক পরেই বনু জানালো, মালিক বলেছে দুপুরের দিকটা মেশিনটা কিছুক্ষণ চালানো যাবে না।
কেন? দুপুরে আবার কী অসুবিধা?
ঐ সময়ে সব শুনশান্ হয়ে যায়। মেশিনের আওয়াজে আঁটেদের অসুবিধা হয়।
এ তো মহা আপদ। তোমার মালিক কী আঁট, না আঁটরা তোমার মালিকের বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় স্বজন, যে সে এত খবর পায়?
অত বুঝি না। আমার জানানোর কথা জানিয়ে দিলাম, এবার আপনারা যা ভাল বোঝেন করুন।
পাড়ার অনেকেই এই জেনারেটার চালানো নিয়ে আপত্তি তুললো। এতে তাদের ও আমাদের কত ক্ষতি হতে পারে, তাও জানালো। তবে এর পরেও জোড়াতালি দিয়ে কোন মতে জেনারেটার চালানো চললো, তবে বনু দুপুরের দিকে বা সন্ধ্যার সময় জেনারেটারের শেডে না থেকে, ব্র্যাঞ্চের ভিতর বেঞ্চে বসে থাকতো।
এর মধ্যে অতসীদি দুদিন অফিসে আসলো না। অতসী মন্ডল আমাদের অফিসে, সাব স্টাফের কাজ করে। ওর স্বামী এই ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার ছিলেন। ভদ্রলোক সম্ভবত ব্লাড ক্যানসারে মারা যাবার পর, অতসীদি চাকরী পায়।
কী ব্যাপার, দুদিন অফিস কামাই করলেন কেন?
আর বলবেন না। আপনাকে বললে তো বিশ্বাস করবেন না। আমাদের পাশের বাড়ির একটা বাচ্ছা ছেলেকে আঁটে ধরে খড়ের চালে গিঁথে রেখেছিল। শরীরের অর্ধেক খড়ের চাল ফুঁড়ে বাইরে, অর্ধেক ছাদ থেকে ঘরে ঝুলছে। শেষে অনেক চেষ্টা, অনেক পুজো, অনেক সাধ্যসাধনার পর, তাকে মুক্ত করা হয়েছে।
কী জন্য ছাদে উঠেছিলো? ঘুড়ি ধরতে বোধহয়?
আরে না না। সন্ধ্যের পর বাচ্ছাটার চোখ মুখ লাল হয়ে, কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। তারপর সে কী রকম অস্থির হয়ে যায়। শেষে তার শরীরে কী রকম একটা শক্তি জন্মায়। এক লাফে খড়ের ছাদ ভেদ করে, ঐ রকম ভাবে আটকে যায়।
আপনি বাচ্ছাটাকে মেঝে থেকে লাফিয়ে ছাদ ভেদ করে যেতে দেখলেন?
আমি দেখবো কী ভাবে? আমি কী তখন ঐ ঘরে ছিলাম?
তবে কে কে দেখেছে?
তা জানিনা বাপু, তবে অনেকেই বলছে ঐ ভাবে ছাদে আটকে গেছে।
বাচ্ছাটার পা দুটোতো ঘরের ভিতর ঝুলছিল। পা দুটো টেনে তাকে নামিয়ে, ডাক্তার ডাকলে তো পারতেন।
আপনার কোন ধারণা নেই বলে, এ কথা বলছেন। আঁটে ধরলে তাকে টেনে নামানো, বা ঠেলে সরানো সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব।  
এতো দেখছি আঁটে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা।
আশেপাশের কাষ্টোমাররা সুযোগ পেয়ে আঁট সম্বন্ধে তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার কথা বলতে শুরু করলো। এদের কাছ থেকেই আঁটের মানুষ ধরার একটা নতুন কায়দার কথা জানতে পারলাম। সাধারনত সন্ধ্যের পর যখন অন্ধকার নেমে আসে, তখন আঁটরা তাদের পছন্দ মতো কোন একজন নিরীহ লোককে কায়দা করে পুকুর পাড়ে, বা কোন জলা জমির কাছে নিয়ে গিয়ে, তাকে তাদের সমাজের সদস্য হতে আহ্বান জানায়। কোন মানুষই এই প্রস্তাবে রাজী হয় না। কেউ হয়তো করুণ সুরে মিনতি করে বললো তাকে ছেড়ে দিতে, কারণ তারা খুব গরীব এবং সে নিজে সংসারে একমাত্র উপায় করে। বাড়িতে অনেক লোক তার সামান্য আয়ের ওপর বেঁচে আছে। আঁট সঙ্গে সঙ্গে লোকটার হাতে একটা টর্চ লাইট দিয়ে বললো, সামনের গাছটার নীচে একবার আলো ফেলেই নিভিয়ে দিতে। আঁট হঠাৎ টর্চ কোথায় পেল, এরাই বা এত খবর কোথা থেকে পেল জানতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু এদের কাছে এসব প্রশ্নের কোন মূল্য নেই। যাহোক্, বাধ্য হয়ে লোকটা গাছতলায় আলো ফেললো এবং সঙ্গে সঙ্গে টর্চ নিভে গেল। ঐ স্বল্প সময়ে লোকটা দেখতে পেল গাছ তলায় অনেক, অনেক টাকা রাখা আছে। তখন লোকটাকে আঁটরা নির্দেশ দিল টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে, এবং আগামী কাল সন্ধ্যাবেলা ঠিক একই জায়গায় ফিরে আসতে। লোকটার পক্ষে এ নির্দেশ অমান্য করার সাহস বা উপায় থাকে না। পরদিন তাকে ঐ জায়গায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।   
সব শুনে অতসীদিকে জিজ্ঞাসা করলাম— “তা হঠাৎ আপনাদের আঁট মহারাজ এই বাচ্ছাটাকে না মেরে, জিওল মাছের মতো জিইয়েই বা রাখলো কেন? বাচ্ছাটাকে তারা ছাদ ভেদ করে নিয়ে যেতেই বা পারলো না কেন? আঁটেদের বোধহয় বাচ্ছাটাকে পছন্দ হয় নি”?
আপনি কোনদিন ওদের হাতে পড়লে অবিশ্বাস করা ছুটে যাবে। আপনি শহরের লোক, গ্রামের কতটুকু খবর রাখেন? যাহোক্, আজ কিন্তু সকাল সকাল বাড়ি চলে যাব। আজও অফিসে আসার ইচ্ছে ছিল না, খুব বেশী ছুটি নেই বলে, বাধ্য হয়ে আসতে হয়েছে।  
কেন আজ আবার কী?
আজ পাড়ায় ভিডিও শো আছে।
ভিডিও শো এর জন্য তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হবে? কোথায় হবে?
ঐ ছেলেটার বাড়ির পাশে, একটা মাঠে।
কেন? হঠাৎ ভিডিও শো কেন?
আঁটকে খুশী করার জন্য। পুরহিত মশাই বলেছেন।
কোন ছবি দেখানো হবে, বাংলা না হিন্দী? কার পছন্দ মতো ছবি দেখানো হবে, পাড়ার লোকের, পুরহিতের, না স্বয়ং আঁটের পছন্দ মতো?
অত শত জানিনা। আপনার মতো অবিশ্বাসী লোকের সাথে কথা বলা মানে সময় নষ্ট করা।
বিকেল হতেই অতসীদি চলে গেল। তাড়াতাড়ি যাওয়ার কারণ আঁটের ভয় না ভিডিও শো, সেই জানে।
সন্ধ্যের পর আমি আর প্রসুনবাবু অফিস বন্ধ করে বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। আমরা পাঁচজন একই শাখার কর্মী, একটা দোতলা বাড়ির এক তলায় মেস্ করে থাকি। প্রসুনবাবু আমাদের অফিসের ম্যানেজার। অফিস থেকে বাড়ির দুরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার পথ। আমরা দুজনে প্রায় রোজই এক সাথে হেঁটে বাড়ি ফিরি। একতলায় একটা ঘরে আমি একা থাকি। প্রসুনবাবু অন্য একটা ঘরে আর একজনের সাথে থাকেন। তৃতীয় ঘরটায় আরও দুজন স্টাফ্ থাকে। অসম্ভব গরম পড়ায়, প্রসুনবাবু দোতলার গ্রীল দিয়ে ঘেরা বারান্দায় একটা বড় চৌকিতে রাতে একা শুতে যায়। আমি সাধারণত রাতে ছাদে শুই। নিজের ঘরে অনেক রাত পর্যন্ত হ্যারিকেনের আলোয় বই পড়ে ছাদে চলে যাই। কখনও কখনও নিজের ঘরে বা প্রসুনবাবুর পাশেও শুয়ে পড়ি।
বাড়ি ফিরে প্রসুনবাবু হঠাৎ বললো, “আজ রাতে আপনি দোতলায় আমার পাশে শোবেন তো”?
কেন আঁটের ভয় পাচ্ছেন নাকি? চারিদিক তো গ্রীল দিয়ে ঘেরা, ভয়টা কিসের?
না না, প্রচন্ড গরম পড়েছে বলে বলছি। ওপরটা বেশ ঠান্ডা।
আমি তো রোজই ছাদে শুতে যাই। গরম লাগলে নাহয় ছাদেই চলে যাব।
কী দরকার? ছাদে হিম পড়ে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। দোতলায় বারান্দায় শুয়ে পড়বেন, চৌকিটাতো বেশ বড়। চারিদিক গ্রীল দিয়ে ঘেরা। বেশ ঠান্ডা, আরামে ঘুমবেন।
আজ হঠাৎ জলা বা পুকুর ছাড়া ঘরেও আঁট আসে, আর খড়ের ছাদ ভেদ করে বাচ্ছাটাকে নিয়ে যাবার কথা শুনে, ভয় পেয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। আমি আপনাকে কথা দিতে পারি, যে আঁট গ্রীল দিয়ে ভিতরে ঢুকলেও, আপনাকে কিছুতেই গ্রীলের ভিতর দিয়ে বাইরে নিয়ে যেতে পারবে না।
বাজে কথা রাখুন। প্লীজ আজকে দোতলায় শুতে চলুন না।
ঠিক আছে রাতে দেখা যাবে।
প্রসুনবাবু রোজই সবার আগে খুব তাড়তাড়ি দোতলার চৌকিতে শুতে চলে যায়। আমরা বলতাম পাছে অন্য কেউ শুয়ে পরে, তাই আগেভাগে গিয়ে জায়গাটার দখল নেয়। অন্য কেউ তার পাশে শোয়, এটা তার খুব একটা পছন্দ হত না।
রাত দশটা নাগাদ প্রসুনবাবু আমার ঘরে এসে জানালো যে সে দোতলায় যাচ্ছে, আমি যেন বেশী রাত না করে, দোতলায় তার পাশে শুতে চলে যাই।
দেখা যাবে।
দেখা যাবে কেন? এ ঘরে কষ্ট করে গরমের মধ্যে শোবার দরকারটা কী?
তাহলে ছাদে চলে যাব। আচ্ছা দেখবো কী করা যায়।
দেখবো না। ছাদে শুলে ঠান্ডা লাগার ভয় আছে। কী দরকার ছাদে শোবার? আমি একটা এক্সট্রা বালিশ নিয়ে যাচ্ছি।
আচ্ছা যাব।
বেশী রাত করবেন না। গুড নাইট।
ঠিক আছে। গুড নাইট।
ও চলে যেতে আমি বই এ মনোনিবেশ করলাম। অনেক রাতে ঘূম আসায়, আমি নিজের ঘরেই আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। ওপরে যাবার কথা মনেও ছিল না।
গভীর রাতে হঠাৎ প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। ধরমর করে উঠে বসে হালকা আলোয় ঘুমচোখে দেখি, বিছানার কাছে কে একজন দাঁড়িয়ে আছে। ভাল করে দেখে বুঝলাম আঁট নয়, প্রসুনবাবু।
আপনি তো আচ্ছা ছোটলোক মশাই, দোতলায় যাবেন বলে গেলেন না।
আপনি কী এতক্ষণ জেগে ছিলেন?
না, হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখি আপনি পাশে নেই, তাই নীচে নেমে এলাম।
এত রাতে আর ওপরে গিয়ে নতুন করে আবার ঘুমের সাধনা করতে ভাল লাগছে না।
তাহলে আমিই না হয় এখানে শুয়ে পড়ি।
শুধু শুধু আপনি ভয় পাচ্ছেন। আঁট যদি আসেই, তাহলে আমি কী তাকে আটকাতে পারবো? তাছাড়া আমাদের মধ্যে আপনাকেই যে আঁটের পছন্দ হবে, তারই বা গ্যারান্টি কোথায়? কাল থেকে বরং ঐ ভদ্রলোক, যিনি আঁটের হাত থেকে ফিরে এসেছেন, তাঁকে পাশে নিয়ে শোবেন।
থামুন মশাই, এত রাতে আর আপনার লেকচার ভাল লাগছে না। আপনি ওপরে যাবেন না তো?
নাঃ, এত রাতে আর ভাল লাগছে না।
তবে আমি এখানেই একটু জায়গা ম্যানেজ করে নি।
বাধ্য হয়ে ছোট একটা চৌকিতে, গরমের মধ্যে, ঘেমো গায়ে দুজনে পাশাপাশি, ঠেসাঠেসি করে শুয়ে পড়লাম।
এরপর থেকে কোনদিন প্রসুনবাবুকে একা দোতলায় শুতে যেতে দেখি নি।