গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৫

অসিত বরণ চট্টোপাধ্যায়

বৈতরণী

প্রতিমা বাউরি। শহরের বাউরি পাড়ায় জন্ম। জন্মেছিল একঢাল রুপ নিয়ে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ  হলেও প্রতিমার মত গড়নের কারণে বাড়ির সবাই নাম রেখেছিল প্রতিমা।
বাবা রিক্সা টানে গোটা দিন, মা ঠিকে ঝি এর কাজ করে পাড়ার এবাড়ী ওবাড়ী। 
বাড়ীর বড় ছেলে বিকলাঙ্গ। পা চালাতে পারেনা। মাথায় বাবরি চুল, গায়ের রং টকটকে ফর্সা। কথায় জড়তা, ঠিকভাবে কথা বলতে পারেনা।
 
এহেন পরিবারের দিন গুজরাণ হয় দুজনের রোজগারে ঠিকই। কিন্তু সন্ধ্যে গড়িয়ে যেতেই শুরু হয় অশান্তি। ভাটি থেকে আকন্ঠ দিশি মদ খেয়ে এসে নীলকন্ঠ বাউরি অত্যাচার শুরু করে স্ত্রী পারু বাউরির উপর। প্রতিদিনের ইস্যু একটাই। বড় ছেলে গনা নাকি তার ছেলেই নয়।
ক্যাবলা বিকলাঙ্গ গনু কিছুতেই বুঝতে পারে না কেন বাবা মাকে প্রতিদিন চ্যালাকাঠ দিয়ে মারে, গালিগালাজ করে। ফ্যালফ্যাল করে তাকায় শুধু আর শোনে
--- হারামজাদি মাগী কার না কার ছেল্যাকে হামার বলে চালাছিস। উটা হামার ছেল্যা হতেই পারে নাই।
--- হেই মা মনসার দিব্যি খাঁয়ে বলছি উটা হামদের দুজনারই ছেল্যা বঠে।
--- তুই বললেই হামাকে মান্যে লিতে হবেক? হামাকে বকা পাঁয়েছিস?
--- তুই যে ঠাকুরের পা ছুঁয়ে কিরা খাত্যে বলবি সেই ঠাকুরের কিরা খাঁয়ে বলব ঐ রগলা ছেল্যাটো তরেই বঠে। তামা তুলসী নিয়ে বলব ভালা।
--- বারভাতারী তুই হামকে শিখাছিস উ ছেল্যাটো
  হামার বঠে, ত হামরা দুজনেই কালো কুধরা আর ছেল্যাটা গোরা ফচ্চ্য হল্য কেনে বল হামাকে।
এ ঝগড়ার শেষ নেই। প্রতিদিন রুটিন মাফিক চলতে থাকে এ ঝগড়া। কিছুক্ষন পরে না খেয়েই শুয়ে পড়ে নীলু। সেই সঙ্গে পারু।
এভাবেই চলছিল নীলু পারুর সংসার। অতিক্রান্ত হয়ে গেল পনের বছর। গনুর বয়স যখন ষোল তখন মেয়ে প্রতিমার বয়স বারো। বাসি খাবার খেয়ে একদিন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হল গনু।
পারু রিক্স করে সদর হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তিও করল,কিন্তু শেষরক্ষা হল না। গনু মরে গিয়ে যাবতীয় বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে দিয়ে অচিনপুরের পথিক হয়ে চলে গেল।
হঠাৎ গনুর মৃত্যুসংবাদে হতচকিত হয়ে পড়ল নীলু। না চাইতেও তার চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। ভাবলো যাকে নিয়ে এত বিতর্ক, ঝগড়া, নিত্য ঝামেলা সেই যখন চলে গেল তখন আর পারুর সঙ্গে ঝগড়া কেন। নীলু ভালো মানুষ হতে চেষ্টা করল। মদের নেশা কমিয়ে সংসারে মন দিল। পারু প্রায় নির্বাক। পারু নীলুর আচরণ দেখে ভাবতে শুরু করল যে মানুষটা হয়ত বদলে গেল।
প্রতিমা পাড়ার প্রাইমারী স্কুলের পড়া শেষ করে লাগোয়া পাড়ার গিরিশ বিদ্যাপীঠে পঞ্চম শ্রেনীতে ভর্তি হয়েছিল নিজের চেষ্টায়। ছাত্রী হিসেবে খুব একটা খারাপ ছিল না।। সপ্তম শ্রেনীতে উঠতেই বাবা নীলুর হঠাৎ মাথা চাগাড় দিয়ে উঠল মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। লেখাপড়া শিখলে নাকি বিয়ে হয়না। তাই পারুকে একদিন বলেই ফেলল
--- পারী পতিমার বিহাটা হামি ঠিক করিন ফেল্যেছি।
--- এখনই বিহা দিঁয়ে কি করবি? উ পড়ছে ত পঢ়ুক ন ভালা। পঢ়াশুনা করল্যে হামার মতন পাঁচদুয়ারে বাসন মাজতে,কাপড় কাচতে হবেক নাই।
--- না গ একটা ভাল ছেল্যা পাঁয়েছি। হামার বন্ধু বীরবল, উয়ার বেহাই বেটা শঙ্কর সিমিট কারখানায় কাম করে। মাস পুহাল্যে চারশ টাকা বেতন।
 
--- ত মদ তদ খায় নকি?
--- তা দেখ বাবু বেটা ছা একটু মদ গাঁজা খাত্যেই পারে। তবে সুনিনছি রোজেই নাই খায়। একদিন মদভাটিতে দেখিনছি। পোক্তা ছা।তবে বয়েসটায় টুয়েক ফারাক হত্যে পারে। ঐ দুকুড়ির মতন বয়েস হবেক।
--- বেজাঁয় ফারাক হবেক যে। এককুড়ি পাঁচ বছরের ফারাকটা কমেই হল্য? উ ভালা পঢ়ছে পঢ়ুক। পরে ভাবা যাবেক।
--- এমন ছা নাই পাওয়া যাবেক পারী। তাহল্যে শেষে ঐ রিক্সাওয়ালা মাতাল জুটবেক। বুঝিন ভাবিন দেখ।
---না না বিটিটা হামার পঢ়াশুনায় ভাল। উয়াকে দে ন পঢ়তে। হামদের জাত্যে মাধ্যমিক পাশ করল্যেই নকি চাকরী পায় শুনিনছি।
---রাখ তোর মাধ্যমিক। কত হাতি গেল তল মশা বলে কত জল। মেয়্যাছেল্যার আরো পঢ়াশুনা। হামি শঙ্করার সঙ্গেই বিহা দিব।
পারীর অনুরোধ ধোপে টিকল না। মাঘমাসের প্রথম লগ্নেই প্রতিমা আর শঙ্করের বিয়ে সুসম্পন্ন হলো। মদ আর ভেড়ার মাংস পেটপুরে খেলো বরযাত্রীরা। পনের বছরের কিশোরী কিছু বোঝার আগেই শ্বশুর বাড়ীতে পা রাখলো। ওখানে গিয়ে বুঝতে পারলো তার বাবা শঙ্করের কাছ থেকে বেশ কিছু টাকা ধার করেছিল। তার বদলে মেয়েকে দিয়ে ধার শোধ করেছে। সোজা অর্থে প্রতিমা বিক্রি হয়ে গেছে।
বিয়ের মাস কয়েক পরেই নীলকন্ঠ অতিরিক্ত নীল পান করে পৃথিবী থেকে বিদায় নিল। মা পারু হারিয়ে গেল জনারণ্যে।
শঙ্কর বোঙাবাড়ীর সিমেন্ট কারখানায় কাজ করত বটে,কিন্তু সন্ধ্যে বেলায় ফিরত আকন্ঠ মদ খেয়ে, বাড়ীতে এসেই গাঁজায় টান মারতো। সংসারে কোন মন ছিল না। এমনকি প্রতিমার সংগেও খুব একটা কথা বলত না। তবু প্রতিমা বছর দুই শ্বশুরের ভিটে ছাড়েনি। ভেবেছিল এদের মানসিকতার পরিবর্তন হবে। শ্বাশুড়ী গঞ্জনা দেবে না, শ্বশুর একদিন অন্তঃত স্নেহের চোখে দেখবে। কিন্তু না। তার সে স্বপ্ন বিধাতা সফল করেননি। এই দু বছরে তার বয়স অনেক বেড়ে গেল। আর নয়। একদিন ভোররাতে প্রতিমা শ্বশুরবাড়ি ছাড়লো।
অনেক ভাবনা চিন্তা করে অনেকটা পথ হেঁটে এসে আশ্রয় নিল শহরের সেচ দপ্তরে। তিনটে দপ্তর ঘুরে জনে জনে আর্তি জানালো একটা কাজের জন্য। অবশেষে নির্বাহী বাস্তুকার মিঃ স্থানপতি বললেন
--- রান্নার কাজ জানো?
--- হ্যাঁ স্যার। ঝাড়ু দেওয়া বাসনমাজা সব কাজই জানি।
--- ঠিক আছে রেষ্টশেডে যারাঁ আসবেন তাঁদের রান্না করতে হবে। পারবে? মাস্টাররোলে একশ কুড়ি টাকা পাবে মাসের শেষে।
--- পারবো স্যার। ঠিক আছে ।
--- আজ থেকেই লেগে পড়। আর শুনো, এই যে বিনোদকে দেখছো, ও যেভাবে বলবে সেভাবে কাজ করবে আর ভালভাবে সাবধানে থাকবে।
বুড়ো বিনোদ মাহাত যে কিনা রেষ্টশেডের কেয়ারটেকার, কন্যাস্নেহে ওকে নিয়ে গিয়ে সব বুঝিয়ে দিল। সেখানে তখন একটা রুমে সুজন নস্কর ছিলেন। সহকারী বাস্তুকার। মাস দুয়েক আগেই নুতন জয়েন করেছেন। সরকারী  কোয়ার্টার পাননি তাই রেষ্টশেডেই থাকেন। তুখোড় ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন ইতিমধ্যে। আপাতত এই নস্কর সাহেবের জন্য রান্নাটা করতে হবে। বিনোদ সব বুঝিয়ে দিল প্রতিমাকে। তার থাকার জন্য খালাসী শেডের দরজা খুলে দিল। বলল,
--- দেখ মা,সব কিছু বুঝিয়ে দিলাম। তোর তো কেউ নেই। আমি পাশের কোয়ার্টারে থাকছি। সাবধানে থাকিস। ভালভাবে থাকিস। কোন অসুবিধা হলে আমায় বলিস।
প্রতিমা ঘাঢ় নেড়ে সম্মতি জানালো। টুক করে বিনোদকে একটা প্রনাম করলো প্রতিমা। শুরু হলো নুতন অধ্যায়।
বেশ কয়েকমাস কেটে গেল। নস্কর সাহেব প্রতিমার রুচিবোধ দেখে একদিন প্রশ্ন করলেন,
--- প্রতিমা তোমার বাড়িতে কে কে আছেন? মনে হচ্ছে তুমি পড়াশুনা জানো। প্রতিদিন দেখি তুমি খবরের কাগজ পড়।
পাশ থেকে বিনোদ বলে উঠলো,
---ঠিক ধরেছেন স্যার। ও সাত ক্লাস পর্যন্ত পড়েছে। আর রান্নাবান্না ঘর গোছান দেখে তো বুঝতেই পারছেন স্যার ও খুব ভাল মেয়ে"। ওর ভাগ্যটাই শুধু খারাপ।
--- কেন কেন?
 
--- ওর ভাই মারা গেল, বাবা ওর বিয়ে দিলো এক বুড়োর সঙ্গে, বাবা মারা গেল কিছুদিন পরে, তারপরেই মা নিখোঁজ হলো। এদিকে শ্বাশুড়ীর গঞ্জনা,শ্বশুরের অত্যাচার, স্বামীর নির্লিপ্ততা। বাধ্য হয়ে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বাঁচলো।
অবাক হলেন নস্কর সাহেব। এই বয়সে ওই মেয়ে এত শক্তি পেল কোত্থেকে!  তারপরই জিজ্ঞেস করলেন,
--- তুমি কি ফিরে পড়াশুনা করতে চাও?
প্রতিমা মাথানেড়ে সম্মতিসুচক উত্তর দিল।
পরদিনই খোঁজ নিলেন কোন স্কুল থেকে প্রাইভেটে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া যাবে। ডি আই অফিসে গিয়ে সমস্ত কিছু খবরাখবর নিয়ে যা কিছু ফরম্যালেটিজ সব করলেন। বইপত্তরও কিনে আনলেন।
সে কি আনন্দ প্রতিমার। বইয়ের গন্ধ শুঁকতে শুরু করলো। নস্কর সাহেব হেসে উঠলেন। বললেন,
--- গন্ধ শুঁকছো কেন?
--- সরস্বতীর গায়ের গন্ধ আমার বড় ভাল লাগে স্যার।
নস্কর সাহেব এই উচ্ছলতা দেখে আবারও হাসলেন। বললেন,
--- খুব পড়তে হবে কিন্তু।
প্রতিমা ঘাড় নাড়লো। দ্বিগুন উৎসাহে শুরু করলো জীবনের দ্বিতীয় ইনিংস।
নস্কর সাহেব প্রতিমাকে পড়াতে শুরু করলেন। অফিস ছুটির পর পড়ানো শুরু হতো রাত্রি আটটা পর্যন্ত। কিছুদিনের মধ্যে ছাত্রী শিক্ষকের সম্পর্ক পালটে গিয়ে প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্কে রুপান্তরিত হলো। অফিস চত্তরে কানাঘুষো শুরু হলো। নস্কর সাহেব কোন পাত্তা না দিয়ে লক্ষে অবিচল থাকলেন। মাধ্যমিক পরীক্ষাও একদিন শেষ হলো, রেজাল্ট বেরুলো। বেশ ভালভাবেই প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ  হলো প্রতিমা। তার কিছুদিন পরই  অবিশ্বাস্য ভাবেই সুজন নস্কর কোর্ট ম্যারেজ করলেন প্রতিমাকে। অফিস চত্তরের গুঞ্জন থেমে গেলো আচমকা। বরং পার্টি খেয়ে সুজন বাবুকে তাঁর সাহসী সিদ্ধান্তকে অফিসের সবাই বাহবা দিলেন।
প্রতিমা নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করলো। সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না এই অবিশ্বাস্য পরিস্থিতি। নস্কর সাহেব অতঃপর স্ত্রীকে নিয়ে উঠলেন তাঁর সরকারী কোয়ার্টারে। প্রতিমা যে কোনদিন ইঞ্জিনিয়ারের গৃহিণী হবে স্বপ্নেও ভাবেনি। প্রতি মুহূর্তে চিন্তা কুরে কুরে খাচ্ছিল ঘটনা সত্য নাকি স্বপ্ন। এ সত্য ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে না তো?
প্রকৃতির নিয়মে প্রতিমা একদিন গর্ভবতী হল।
নমাস অতিক্রান্ত হতেই বর্ষার এক রাতে প্রতিমা অসহ্য প্রসববেদনায় কাতর হয়ে পড়ল। প্রতিমা নস্কর সাহেবকে জানালো বেবী নড়াচড়া করছে না। হাসপাতালে যাওয়া দরকার।
জীপগাড়ীর ড্রাইভারেরা যে যার বাড়ী চলে গেছে। হেঁপো রোগী বিনোদ শয্যাশায়ী। অগত্যা নিজেই রাঁচিরোড মোড়ে গিয়ে এক রিক্সো নিয়ে এলেন। রিক্সাওলার সাহায্য নিয়ে ধরাধরি করে রিক্সায় চড়িয়ে সোজা সদর হাসপাতালের ইমার্জেন্সীতে। ডাক্তার দেখে বললেন সিরিয়াস কন্ডিশন। এক্ষুনি অপারেশন করতে হবে। ভর্তি হলো প্রতিমা। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় রোগীকে নিয়ে যাওয়া হল অপারেশন থিয়েটারে।
অপারেশন থিয়েটার সংলগ্ন করিডরে অনন্ত প্রতীক্ষায় সুজন নস্কর। প্রায় দেড় ঘন্টা পর থিয়েটার থেকে বেরুলেন ডাঃ সেন, বললেন
--- সরি মিঃ নস্কর। কাউকেই বাঁচানো গেল না। অপারেট করে দেখা গেল স্টিল বেবি, যা কিনা চব্বিশ ঘন্টা আগেই মারা গেছে। অতিরিক্ত টেনশনের কারণে মিসেস নস্করের হার্ট ফেলিওর হয়েছে। গড ব্লেস ইউ।
এই প্রথমবার ভেঙে পড়লেন নস্কর সাহেব। রাত প্রায় দেড়টা। কি করবেন এখন। বাইরে বেরিয়ে এলেন। হাসপাতাল মোড়ে একটাই রিক্সা।পেছনে লাল কালি দিয়ে লেখা "বৈতরণী"। কাছে গিয়ে রিক্সাওলার সাথে কথা বললেন। রিক্সাওয়ালা অভয় দিয়ে বলল,
--- কিচ্ছু ভাববেন না স্যার। আমি সব কিছু সমাধা করে দেব। কিন্তু কাঠের দাম বাদ দিয়ে আমাকে একশ টাকা দিতে হবে।
 
--- ঠিক আছে। তাই দেবো। তাহলে চল ডেডবডি নিয়ে আসি।
হাসপাতালের ফরম্যালেটিজ মেনে ডেডবডি নিয়ে রিক্সা চলল বরাকর রোড ধরে বোঙাবাড়ি শ্মশান। মাঝেমাঝেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি। বৈতরণী রিক্সায় সদ্য প্রসূতির লাশ,আর একটা সদ্যজাত শিশুর মৃতদেহের পুঁটুলি। পাটনি ওরফে রিক্সাচালক বিশ্বশ্বর বাউরী। পেছনে হেঁটে চলেছেন হতভাগ্য সুজন নস্কর। রাত আঁধার। নিশাচর পাখীর ডানা ঝাপটানির শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।
শ্মশান কালীমন্দিরের পাশের শেডে শবদেহ দুটো রেখে বিশ্বেশ্বর কাঠ আনতে গেলো পাশের গোদামে। কাঠ এনে রিক্সার পেট থেকে কোদাল বার করল। নদীর বালিচরে বেশ কিছুটা গর্ত খুঁড়ে কাপড় জড়িয়ে শিশুটিকে শুইয়ে দিল পরম মমতায়। তারপর বালি আর মাটিতে ঢেকে দিল। ঘন অন্ধকারে বিষ্ণুপুরী টিমটিমে লন্ঠনের আলোয় মুখটা দেখে চমকে উঠেছিলেন সুজন নস্কর।
দুফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ল নিজের অজান্তেই। এক্কেবারে প্রতিমার মুখের আদল। হঠাৎ দমকা হাওয়ায় নিবে গেল বিষ্ণুপুরী লন্ঠন। ঘুরঘুট্টি  অন্ধকার। কেঁপে উঠলেন সুজন বাবু। 
---এবার উপায়?
রিক্সাওয়ালা বলল,
--- মন্দির চাতালে এক জন শুয়ে থাকে,ওর কাছে ম্যাচিস থাকে বাবু, আমি দেখছি।
বলেই ওকে উঠিয়ে আনলো। খোঁচা খোঁচা কাঁচা পাকা দাড়ি, ময়লা ছেঁড়া গেঞ্জি শতছিন্ন ধুতি। নোঙরা কাপড় থেকে বেরিয়ে আসছে শ্মশানের কটূ গন্ধ। কেমন যেন পাগলাটে। লোকটা বলে উঠল,
--- কার কপাল ভাঙলো খুড়া? শালা রাইতে ছাড়া কেউ মরত্যে চাইছে নাই নকি ব! মুঁহে আগুন দিয়ার ছালিয়াটা আসিনছে ন নাই? যদি না আসে ত তাও খেতি নাই হামি মুখে আগুনটা দিঁয়ে দিব। গাঁজার দামটা লাগবেক।
--- ঠিক আছে। মাচিসটা বাহির কর। পলাশ কাঠিতে মারকিন বাঁধ্যে কেরাসিনে ভিজাঁয় রাখিনছি, ঐ বাবুটা মুখে আগুন দিবেক। জ্বাল, জ্বাল বাপ। চাঁড় কর। কাজটা সমাধা হোক, গাঁজার দাম দিয়া করাব।
নস্কর সাহেব মুখাগ্নির জন্য তৈরী। ফস করে ম্যাচিস জ্বালালো লোকটা। কেরোসিন ভেজানো মারকিনে আগুন ধরতেই আলোতে স্পষ্ট দেখা গেল প্রতিমার মুখ শেষবারের মত। হঠাৎ পাগলাটে লোকটার গগনবিদারী চিৎকারে শ্মশানের নিস্তব্ধতা খানখান করে উঠলো।
--- প---তি---মা। পতিমা তুই? শেষ পর্যন্ত তুই মর‍্যে গেলি? হেই দেখ হামি তর সোয়ামি শঙ্কর বাউরী।
বলেই কাঁদতে কাঁদতে বুক চাপড়াতে লাগলো।
--- ই হামার কি হল্য গ_____
সুজন বাবু ভয়ে মুখাগ্নির পলাশকাঠি ফেলে দিয়ে আস্তে আস্তে পিছোতে শুরু করলেন। অন্ধকার আর বাধা হয়ে উঠেনি_____
বৃষ্টি ঝরতে শুরু করলো আবারো মুষলধারায়।