বাবুরা, খেলা দেখাবার আগে আমার দুটো অনুরোধ আছে। প্রথম,আমাকে সিকির কম পয়সা দেবেন না। না থাকলে দেবার প্রয়োজন নেই । আর দ্বিতীয়,খেলা শেষ হবার আগে, কেউ চলে যাবেন না। তাহলে আমার ভাই মরে যাবে।
সত্তর দশকের প্রথম ভাগে,সেই
আমার প্রথম বিষ্ময় বালক দেখার সুযোগ হয়। সত্যি কথা বলতে কী,
পঁয়ত্রিশ বছরের মধ্যে আমার আর কোন ছেলেকে বিষ্ময়কর বলে মনে হয়
নি। আশায় আশায় থাকি, কবে আবার দ্বিতীয় কাউকে দেখবো,
যাকে বিষ্ময়কর বলে মনে হ’তে
পারে।
গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে আরও অনেকের মতো টাইপ-শর্টহ্যান্ড
শিখি, কাগজ দেখে চাকরির দরখাস্ত করি, আর ঘরের খেয়ে বনের
মোষ তাড়াই। একদিন সাইকেল নিয়ে বাস রাস্তার ওপর একটা দোকান থেকে সিগারেট কিনে,
চারিদিক ভাল করে লক্ষ্য করে সবে ধরিয়েছি,
একটু দুরে একটা জটলার মাঝ থেকে ডুগডুগ ডুগডুগ করে একটা আওয়াজ
শুনে কাছে গিয়ে দেখলাম, বছর বার-তের
বয়সের একটা ছেলে ম্যাজিক দেখাচ্ছে। সঙ্গে একটা ছয়-সাত
বছরের বাচ্চা ছেলে। তার কথায় জানলাম যে, সে তার ভাই।
ছেলেটা তার অনুরোধ শেষ করে, খেলা
দেখাতে শুরু করলো। জানিনা এটাই তার প্রথম খেলা কী না। একটা নাইলন জালে তার ভাইকে ভাল
করে জড়িয়ে, একটা বস্তার মধ্যে ঢুকিয়ে,
বস্তার মুখটা আলতো করে বেঁধে দিল। এবার একটা ছুরি বস্তার মধ্যে
বেশ জোরে ঢুকিয়ে দিয়ে, সে বস্তার মুখের ভিতর থেকে,
তার হাতটা বার করে আনলো। হাতে একটা মাংসের টুকরো। জিনিসটা মাংসের
দোকানে যে হার্ট জাতীয় অংশটা ঝোলে, বোধহয় তাই। তবে
সেটা হয়তো আজ-কালের মধ্যে সংগ্রহ করা হয়নি। মাংসের টুকরোটা হাতে নিয়ে সে জানালো,
সেটা তার ভাই এর শরীরে ছুরি বসিয়ে কেটে বার করে আনা হয়েছে,
আবার জুড়ে দেওয়া হবে। সে আবার অনুরোধ করলো,
কেউ যেন চলে না যায়। তাহলে তার ভাই মারা যেতে পারে।
জায়গা ছেড়ে কাউকে চলে যেতে দেখলাম না। যেটা দেখলাম,
সেটাই আমাকে প্রথম অবাক করলো। অনেকে থুথু ফেলছে,
কেউ কেউ আবার বমিও করলো। সিকি, আধুলি
প্রচুর পড়লো। পাঁচ টাকা, এমন কী দশ টাকার নোটও কিছু পড়লো।
সেই সময় সিকিরও যথেষ্ট মূল্য ছিল। পাঁচ, দশ টাকা দেবার
কথা ভাবাই যেত না।
কিছুক্ষণ পরে মাংসের টুকরোটা বস্তার মুখ খুলে ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে,
বস্তা থেকে ভাইকে বার করে আনলো। আশ্চর্যের ব্যাপার যেটা ছিল,
সেটা হ’ল ভাই কিন্তু নাইলন জালের মধ্যে নেই।
কয়েকজন দর্শক উৎসাহ দেবার জন্য হাততালি দিল।
ছেলেটা আরও দু’একটা ছোটখাটো
খেলা দেখিয়ে, আবার সিকির কম মূল্যের পয়সা না দেওয়া ও জায়গা
ছেড়ে না যাওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে, তার নতুন খেলা
শুরু করলো।
একটা চাদর পেতে ভাইকে শুইয়ে দেওয়া হ’ল।
বাস-রাস্তার এই জায়গাটা একটা বাঁকের মুখে বলে, জায়গাটা
অনেকটা চওড়া। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, তার পাশ দিয়ে
বাস, লরি, মোটর
গাড়ি যাতায়াত করছে। ছেলেটা কিন্তু খেলা দেখিয়ে যাচ্ছে। এবার ভাই এর শরীরের ওপর একটা
চাদর চাপা দিয়ে দেওয়া হ’ল। এরপর হঠাৎ সে সেই ছুরিটা বাচ্চাটার
গলার কাছে, চাদরের তলা দিয়ে সজোরে ঢুকিয়ে দিয়ে, অন্য হাতে
এক টানে চাদরটা, শরীরের ওপর থেকে সরিয়ে নিল। আমরা সবাই দেখলাম ছুরিটা বাচ্চাটার গলার
একদিক দিয়ে ঢুকে, অন্য দিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে। এবার
সে ছুরির হাতলটা এক হাতে ধরে, অন্য হাতে বাচ্চাটার পা দু’টো
ধরে, বাচ্চাটাকে তার মাথার ওপর তুলে ধরলো।
এই দৃশ্য দেখার পর আরও অনেকে বসে পড়লো। অনেকে বমি করতে শুরু
করলো। শুরু হ’ল নতূন করে পয়সা ও নোটবৃষ্টি।
পৃথিবীর অন্যতম সেরা শল্য চিকিৎসকও এভাবে কারো গলায় ছুরি মারলে,
তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। হয়তো গলার এক দিক দিয়ে দক্ষ হাতে ছুরি
ঢুকিয়ে, অন্য দিক দিয়ে বার করলেও রক্তক্ষয় ছাড়া আর কোন
ক্ষতি নাও হতে পারে, তবে তার জন্য অবশ্যই একটা প্রস্তুতির
প্রয়োজন। রাস্তার ওপর একটা নোংরা ছুরি চাদরের তলা দিয়ে আন্দাজে কারো গলায় ঢুকিয়ে,
সেটা সম্ভব নয়।
কিন্তু একহাতে ছুরির হাতল, অন্যহাতে
পা দু’টো ধরে বাচ্চাটাকে ওপরে তুললো কী ভাবে?
তাহলে তো মাধ্যাকর্ষণ মিথ্যে। নিশ্চয় ছুরিটা গলার নীচ দিয়ে,
অর্থাৎ পিছন দিয়ে রাস্তার ওপর রাখা হয়েছিল। অর্থাৎ ওপরে তোলার
সময় বাচ্চাটার মাথা ছুরির ওপরে রাখা হয়েছিল, এবং
তাই বাচ্চাটাকে ওভাবে ওপরে তোলা সম্ভব হয়েছে। তাহলে ছুরির ফলার অগ্রভাগ বাচ্চাটার গলা
দিয়ে রাস্তা থেকে দু’তিন ইঞ্চি উঁচুতে ওভাবে বার করা হয়েছে
কী ভাবে? ভাল করে দেখার জন্য ছেলেটার কাছাকাছি এগিয়ে গেলাম।
কিন্তু ততক্ষণে বাচ্চাটাকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে, আবার
চাদর চাপা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরপর একে একে রক্তমাখা ছুরি টেনে বার করা,
চাদর সরানো এবং বাচ্চাটার উঠে দাঁড়ানোর পর্ব শেষ হ’ল।
শুরু হ’ল নতুন করে থুথু ফেলা,
বমি করা, আর পয়সা ছোঁড়ার পর্ব।
আমি ভিড় থেকে বেরিয়ে, বাড়ি
ফিরবো বলে একটু এগিয়ে এসে সাইকেলে উঠবার আগে, মনে
হ’ল শরীরের ভিতর কী রকম একটা অস্বস্তি হচ্ছে। সাইকেলে
উঠে কিছুটা চালিয়ে গিয়ে বুঝলাম, আমার পক্ষে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফেরা
অসম্ভব। জায়গাটা থেকে আমার বাড়ি, হেঁটে সাত-আট
মিনিটের পথ। সাইকেল থেকে নেমে, হেঁটে বাড়ি ফিরবার চেষ্টা করলাম।
সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। খুব ধীর গতিতে হেঁটে, অনেক
সময় নিয়ে, অতি কষ্টে বাড়ি ফিরে এলাম। সাইকেলটা দোতলায় তুলতে
পারলাম না। একতলার দেওয়ালে হেলান দিয়ে সাইকেল রেখে, সিঁড়ি
ভেঙ্গে দোতলায় উঠে শুয়ে পড়লাম। আমাকে দেখে বাড়ির সকলে বুঝতে পেরেছে,
আমি অসুস্থ। কী কষ্ট হচ্ছে, কখন
হ’ল ইত্যাদি প্রশ্নবাণে,
আমি আরও অসুস্থ হয়ে পড়লাম। চোখে মুখে জল দিয়ে,
পাখার বাতাস করে, আমাকে সুস্থ করার
চেষ্টা চললো। যাহোক্, বেশ কিছুক্ষণ পরে আস্তে আস্তে আমি
সুস্থ হ’তে শুরু করলাম।
আমার ছোট ভাই আমার থেকে পাঁচ বছরের ছোট। সে তখন বাড়ি ছিল না।
ফিরে এসে সব শুনে সে আমার কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করলো। তাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম। আমি
নিজে বরাবর একটু বাস্তববাদী। সবকিছু যুক্তি দিয়ে বিচার করার চেষ্টা করি। আমার ভাই আমার
প্রতি একটা বিশ্বাস, একটা আস্থা রাখে। আমার যুক্তিবাদী
চিন্তাধারাকে সে সম্মান করে। তাই সব শুনে, সে
শুধু বললো—“ তোর মতো যুক্তিবাদীর এই দশা হ’ল”?
আমি বললাম, “এই ছেলেটার খেলা দেখেই যে আমার শরীর
খারাপ হয়েছে, তার কী মানে আছে”? যদিও
অত লোকের শরীর খারাপ হওয়া দেখে, আমার নিজেরও তাই মনে হচ্ছে।
ঘটনাটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো, বা
উচিৎ ছিল, কিন্তু বাস্তবে তা হ’ল
না। মাসখানেক পরে আমি একদিন বড় রাস্তায় দোকানে এসেছি। বাসস্ট্যান্ডে বাসগুলো যেখানে
দাঁড়ায়, সেখানে একটা বড় গাছকে ঘিরে একটা গোল বেদী আছে।
সেই বাঁধানো জায়গায় দেখি গৌতম শুয়ে আছে, আর আমার ভাই তার
চোখে মুখে জল দিচ্ছে ও একটা হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করছে। গৌতম আমার ভাই এর বন্ধু। খুব
রসিক ছেলে। লেখাপড়ায় খুব ভাল। স্বাস্থ্যও চমৎকার।
এগিয়ে গিয়ে ভাইকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম,
গৌতম হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তার, আমাদের
বাড়ি যাবার ক্ষমতা পর্যন্ত নেই। অথচ এখান থেকে আমাদের বাড়ি পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথ। একটু
অপেক্ষা করে, একটা রিক্সা ডেকে গৌতমকে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসা
হ’ল। ও এসে চুপ করে শুয়ে থাকলো এবং কিছুক্ষণ পরে
ঘুমিয়ে পড়লো।
এতক্ষণে ভাই এর সাথে কথা বলার সুযোগ পেলাম। ও শুধু বললো
“রাঙাদা, গৌতম সেই ম্যাজিশিয়ান ছেলেটার ছুরি
মেরে ভাইকে শুন্যে তোলার খেলাটা দেখে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ঐ বেদীর ওপর অনেকক্ষণ শুয়ে
ছিল। তুই না আসলে বিপদে পড়তাম”।
ওর কথা শুনে চমকে উঠলাম। আবার সেই বাচ্চা ম্যাজিশিয়ান?
ওর মধ্যে কী এমন ক্ষমতা আছে, যে
দলে দলে লোক, তার খেলা দেখে অসুস্থ হয়ে পড়ছে?
বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন অনেককে
বাচ্চাটার কথা বলতে, সকলেই একটা কথা বলেছে—
“হিপনোটাইজ করে”। কিন্তু হিপনোটাইজ
করলে যা দেখাবে তাই হয়তো দেখবে, অসুস্থ হবে কেন?
তাছাড়া ভারত শ্রেষ্ঠ ম্যাজিশিয়ানের লেখায় পড়েছিলাম—
সকল মানুষকে একসাথে হিপনোটাইজ করা যায় না। যে কোন জায়গায় ইচ্ছে
করলেই হিপনোটাইজ করা সম্ভব নয়। আসলে দর্শকরা, কী
করে হচ্ছে বুঝতে না পারলেই মনে করে, তাদের হিপনোটাইজ করা হয়েছিল।
এটা হয়তো ঠিক, কিন্তু এই বাচ্চাটার
ক্ষমতাটা তাহলে কী? কিসের জোরে সে খোলা রাস্তায় একসাথে
এত লোককে বোকা বানাচ্ছে? শুধু বোকাই বানাচ্ছে না,সেই
সঙ্গে অসুস্থ করে ছাড়ছে ?
মাস দু’তিন পরের কথা,আমি
দোতলায় বসে টাইপ করছি। বড় রাস্তার পাশে, ঐ বাড়িটার দোতলায়
টাইপ-শর্টহ্যান্ড শিখতে আসি। রাস্তার অপর পার থেকে
ডুগডুগির আওয়াজ শুনে বারান্দায় এসে দেখি, রাস্তার অপরপারে,
ছোট একটা খোলা মাঠের মতো জায়গায়,সেই
ছেলেটা ম্যাজিক দেখাচ্ছে। ঠিক করলাম আজ খুব কাছ থেকে কড়া নজরে তার খেলা দেখতে হবে।
দেখতে হবে কী ভাবে বাচ্চাটাকে শুন্যে তোলে। কেনই বা সকলে বমি করে,অসুস্থ
হয়।
সঙ্গে সঙ্গে নীচে নেমে জায়গাটায় গিয়ে ছেলেটার একবারে পাশে গিয়ে
দাঁড়ালাম। আবার সেই ছুরি মেরে হার্ট বার করা, আবার
সেই ছোটখাটো কয়েকটা খেলা। চারপাশে অনেক দর্শক। বেশ ভিড় জমেছে। এবার সেই ছুরি মেরে বাচ্চাটাকে
শুন্যে তোলার খেলা, আমিও তৈরি। বাচ্চাটা খেলাটা দেখাতে
শুরু করার ঠিক আগে, অনেক দর্শক একসাথে ঐ খেলাটা দেখাতে
বারণ করলো। ছেলেটা তবু একবার দেখাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু অত লোকের তীব্র আপত্তিতে
তার আর খেলা দেখানো হ’ল না।
তাকে আর কোনদিন দেখিনি। তার সেই গোপন ক্ষমতা আজও আমার অজানাই
থেকে গেল। আজও কোন বাচ্চা, ম্যাজিক দেখালে দাঁড়িয়ে পড়ি। কিন্তু
সেই বিষ্ময়কর বালক আর দেখলাম কই?