গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৫

আবুরাশেদ পলাশ

কালবোধন

আমাদের পাড়ার প্রকাণ্ড আমগাছটা বিরুদের । আদিগাছ । ওর জন্মের হদিস দিতে পারে এ পাড়ায় সাধ্যি কার ? জন্ম থেকে আমরা কেবল স্বগর্বে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি ওকে । ওটা কথা কয় জান ? মামুদপুর গ্রামের প্রতিটা ঘরে ঘরে সজল দৃষ্টি ওর । সকালের কাক যখন ওর মগডালে বসে কা কা আওয়াজ করে বোধকরি সবাই শুনে সে ধ্বনি । সংসারের ছোট ছোট ব্যাপার নিয়ে আহালু আর নঙ্ক যখন কলহ করে তখন সে চোখরাঙায় নিশ্চয় । রতনের ঘরে জোড়াসন্তানের আগমনবার্তা শুনে সেও আহ্লাদী হয় । দখিনা বাতাসে পাতাগুলো দোল খায় তখন ।

বিরুদের আমগাছটার পাশেই তাদের প্রকাণ্ড ফলের বাগান । তাতে মৌসুমি ফলের নৃত্য সমাহার । এগুলো ঘিরে কত স্মৃতি আমাদের । সময়গুলো ঝাপসা হয়ে যায় দিনে দিনে, মুছে যায়না নিজ থেকে । গাঁয়ের ঘরে ঘরে সন্ধ্যায় বউয়েরা খড়ের গাদা পুড়িয়ে রাতের খাবার প্রস্তুত করে । তাদের সৃষ্ট ধোঁয়াগুলো শূন্যে এসে সমবেত হলে ঘোমটবদ্ধ মেঘের রূপ নেয় । আমাদের মুহূর্তগুলোও এখন তদ্রূপ । 
মামুদপুর গ্রামে বিরুদের বাড়ী রায়ের বিল হতে উত্তরে । শুকনো মৌসুমে বিল পেরিয়ে আসতে সময় লাগে বেশ । আষাঢ়ে বানের জলে যখন গ্রাম ভাসে বিলের ভাসা জল তখন আমগাছটার গোড়া ছোঁয় । এ পাড়ার বাড়ীগুলোতে সাদাজল লুটোপুটি খায়, বিরুদের বাড়ীতে সে দৃশ্য গবেষণার ব্যাপার । ওদের দহলিজটা বেশ উঁচু, ঘরগুলো আরও । মাঝিপাড়ার জেলেগুলো বন্যায় ঘাট হিসেবে ব্যবহার করে আমগাছকে । ওর গোড়ায় কত কত নৌকা ভাসে তখন !

মাঝি বাড়ীতে মানুষ মোটে দুজন । বয়স্ক হবিরন বিবি ভাল করে চোখে দেখেনা দিনে, রাতেতো নয়ই । বিরুর বাপ গুনাই মাঝিকে আমরা চোখে দেখিনি কেউ । নাম শুনেছি কেবল । গুনাই মাঝি যখন পরবাসী এ পাড়ায় হয়তো আমাদের আগমনী বার্তা বাজেনি তখনও । আমাদের আগমন গুনাই মাঝির উত্তরসূরি হয়ে, এখনতো গাঁয়ে আমরাই বর্তমান ।

হবিরন বিবি কিন্তু মানুষ ভাল । পাড়ায় আমরা কোনদিন কলহ করতে দেখিনি তাকে । যেচে কারো সাথে কথা বলতেও যায়না সে । মরার আগে স্বামীর রেখে যাওয়া আবাদি জমিগুলো বর্গা দিয়ে সংসার চলে তার । মৌসুমি ফল বিক্রির টাকাও যৎসামান্য নয় । ফলে বিরুদের অভাবের মুখোমুখি হতে হয়না কখনই । বরং এ গাঁয়ে আর সবার থেকে দাপটে চলে তারা । ঘটা করে উৎসব পালন করে বিভিন্ন । গুনাই মাঝির মৃত্যু দিবসে পাড়ায় ঘরে ঘরে ভোগ দেয় । হাভাতে ছেলেগুলোও বছরে একদিন ভালমন্দে উদরপূর্তির লোভ করে দিনকে দিন ।

জানো, এতকিছুর পরেও মনে কোথাও দুঃখ ছিল হবিরন বিবির । সংসারে একমাত্র ছেলে যে তার অন্য দশটা ছেলেদের মত নয়, হয়তো এটা ভেবেই অশ্রু বিসর্জন দিত সে । যাহোক বিরু কিন্তু জন্মেই এমন ছিলনা । গাঁয়ের মক্তবে ছোটবেলাই কায়দা পড়েছি আমরা । ওর বয়স যখন পাঁচ কি ছয় তখন কি এক অসুখে পড়েছিল সে । তারপর সুস্থ হয়েছে সত্যি তবে কথা হারিয়েছে মুখে । মনের ভাব প্রকাশ করতে গেলে এখন কেবল অ্যাঁ অ্যাঁ শব্দ করে সে । মুখে লালা ঝরে সারাদিন । বুদ্ধিটাও বোধয় আটকে আছে শৈশবেই । বয়সের ভারে কেবল দেহ বেড়েছে তার বুদ্ধি বাড়েনি মোটেও ।
পাশের বাড়ীর নজুখাঁর বউ হাঁসুলি বিকেলে পাড়া ঘোরার বাহানায় হবিরন বিবির সাথে খোশগল্পে মাতে । পানের বাটাটা এগিয়ে দিলে মুখে পান চিবোয় সময় ধরে । তারপর বলে-
-একখান কতা মুনে আহে, কমুনি চাচি ? হবিরন বলে-
-শরমাও যে, কও হুনি ?
-বিরু ভাইনি জন্ম পাগল ?
-অমুন কইরা কও যে, পুলা মোর পাগলনি ? হুগনা বাতাস নাগচে মালুম অয় ।
পরক্ষণে কথা বাড়ায়না হাঁসুলি । সেতো জানে এ পাড়ার সবাই যখন বিরুকে পাগল বলে সাব্যস্ত করে কেবল হবিরন বিবি সত্যটা মানতে নারাজ । উত্তর পাড়ার নয়াব আলীর ষোল বছর বয়সী মাথা পাগল ছেলেটা, কথা বলতে পারেনা সেও । নিজের খেয়াল রাখতেও অপারগ সে । অসচেতন হলে হয়তো গোপন অঙ্গ প্রদর্শিত হয় জনসম্মুখে । কই, বিরুর মধ্যেতো এমন হাবভাব নেই । তাহলে পাগল সে নয় নিশ্চয় । হবরন বিবি বিশ্বাস করে ভাল একদিন হবে ছেলে । কিন্তু কবে, কেবল সে দিনটাই জানা নেই তার ।
রায়ের বিলের তীরঘেঁষে যে কাঁচা সড়কটা বাজারমুখী ধাবমান তার কূলঘেঁষে আমাদের বাড়ীটা । প্রত্যহ সওদা করে ফেরার পথে বিরুদের বাড়ীটা পাশ কাটিয়ে আসতে হয় আমাকে । সুযোগ পেলে সপ্তাহে এক দুইবার যাওয়া হয় সেদিকে । হবিরন বিবি পুলকিত হয় তাতে । আমার আগ্রহ না জানি এতেই । হবিরন বলে-
-বিন্দেনি, দুস্তেরে দেকতে আইলি মুনে কয় ?
-হাঁচা, হগগল ভালানি চাচি ?
-ভালা, শিগগির যাসন্যা আইজ । খাসীর বেনুন রানছি বিরুর লগে দিমুনে ।
ইচ্ছে না হলেও নিষেধ করা হয়না সহসা । সাহসেও কেমন ঘাটতি পড়ে যেন । মাঝে মাঝেই রাতের খাবার খেয়ে আসতে হয় আমায় । মাঝি বাড়ী গেলে বিরুটা কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে । আচমকা দৃষ্টি গেলে ভেতরে কোথাও ব্যথা হয় যেন ।

অগ্রহায়নের গোড়া অথবা পৌষের শুরুতে বিয়ের ধূম পড়ে মামুদপুর । নতুন ফসলের আগমনে ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসব করে মেয়েরা । কামলাগোছের উড়নচণ্ডী ছেলেগুলো কাচাপয়সা উপার্জনের মুহে পড়লে ঘরে নতুন বউ আনার পাঁয়তারা করে । বিরুর বয়সী গেঁয়ো ছেলেগুলো সংসারী হয় এক এক করে । বছর ঘুরতেই কারো কারো ঘরে নবজাতকের কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায় । বিরুর ক্ষেত্রে সে দৃশ্য কল্পনাতীত । ওরও বয়স হয়েছে বেশ । অন্তত যে বয়সে গাঁয়ের ছেলেরা সংসারমুখী হয় তার চেয়ে বেশীই । কিন্তু মনে বিয়ের কোন গোপন মুহ নেই বিরুর । দুনিয়ার হদিস জানেনা যে, অ্যাঁ অ্যাঁ করলে মুখে লালা ঝরে তাকে মেয়ে দিবে কে ? কিন্তু হবিরন বিবি সে সত্য মানতে নারাজ । এ কুলে ছেলে তার একটাই । মরার পর এ সংসারে হাল ধরতেও মানুষ চাই তার । বিরুর উপর ভরসা কই ? ইয়ার বন্ধুরা সংসারী হলে তাই ঘরে ছেলের বউ আনার পাঁয়তারা করে হবিরন বিবি । গাঁয়ের বউয়েরা খোশগল্পের বাহানায় সমবেত হলে একদিন মনোবাসনা খুলে বলে সে ।
-হুনছনি বুজান, পুলার বউ দেহার খায়েশ অয় দিলে ।
এক দুই কথায় বাঁধ সাধে কেউ কেউ । “ বউনি, পাগলারে মাইয়্যা দিব কেডা কওতো ?”
তখন প্রতীবাদ করে হবিরন-“ মুখ সামাল দেও বুচির মা, পুলা কই পাগল না ।”
-হাঁচানি, বিয়া কইরে ভাত দিব পুলা ?
-নিয্যস ।
হবিরনের কথা মিথ্যে নয় । এ পাড়ায় মাঝি বাড়ীর প্রতিপত্তির কথা অজানা নয় কারও । সংসারে অভাবের ছিটেফোঁটাও খোঁজে পাওয়া দায় । কামলাগোছের অভাবী মানুষগুলোর কাছে পেটের ক্ষুধায় শেষ কথা । দিন শেষে উদরপূর্তি করতে পারলে আর কিছু চাইনা কেউ । কে জানে হয়তো এ মুহেই কেউ কেউ কন্যা সম্প্রদান করতে পারে বিরুর হাতে । চেষ্টা করতে দোষ কি ?

বারুইল গ্রামের ধলাই শেখ সম্পর্কে সৎ ভাই হবিরন বিবির । একই বাবার দ্বিতীয় ঘরের সন্তান সে । ঘরে বউ ছাড়াও একটা মেয়ে আছে তার । নানকি । আহ ! কি ভাল দেখতে মেয়েটা । যেমন স্বভাবে তেমন সৌন্দর্যে । বিরু যখন শৈশবে তখন ওকে ঘরের বউ করতে চেয়েছিল হবিরন বিবি । এরপর কত বছর পার হয়েছে সাহস করে ভাইকে সত্যিটা বলতে পারেনি সে । ছেলে যে তার অন্য দশটা ছেলের মত নয়, এটা ভেবেই মনকে সান্ত্বনা দিয়েছে সে । ধলাই শেখের আর্থিক অবস্থা ভাল নয় এখন । কে জানে, বোনের প্রস্তাব হয়তো মেনে নিতেও পারে সে । অন্তত একবার চেষ্টা করে দেখতে চায় হবিরন । বুড়ো কলিমুদ্দিন সম্পর্কে চাচাতো ভাই গুনাই মাঝির । একদিন তাকে দিয়েই ভাইয়ের বাড়ী প্রস্তাব পাঠায় হবিরন বিবি । তারপর দিনভর আর দেখা পাওয়া যায়না কলিমুদ্দির । সন্ধ্যায় ফিরে এসে জানায়-
-ভাই তোমার রাজি নয়গো ভাবি, মনোবাঞ্ছা ছাড়ান দেও ।
তবুও আশাহত হয়না হবিরন । মনে মনে ছেলের বউ খোঁজে বেড়ায় সে । পার্শ্ববর্তী কুলকান্দি গ্রামের মতিঘটক বিয়ের কাজে পোক্ত লোক । এ পাড়ায় কতজনেরইতো বিয়ের পাত্রী জোগাড় করে দিয়েছে সে । সে খবর কে না জানে । হবিরন বিবি খবর দিলে একদিন মাঝি বাড়ী দেখা যায় তাকে । হবিরন বলে-
-হগগল খবর হুনছ মালুম অয় ঘটক ? মতি বলে-
-হ, ভরসা কইরো ভাবী চাইলে বাঘের চোখ আইন্যা দিমু ।
-হাঁচানি ভাই ?
-নিয্যস, মিছা কওনের মানুষনি মুই ?
মতিঘটক- দেখতে পটকা মাছের মত মানুষটা, কনে দেখার ছলে মোটা টাকা হাতিয়ে নেয় হবিরন বিবির কাছ থেকে । এক এক করে দিন যায় সহসা কনের সন্ধান মেলেনা কোথাও । একদিন আশাহত হয় হবিরনও ।

কদিন পরের কথা । জিন্দারপুর গ্রামের মহেশ আলী, সংসারে অসচ্ছল গেরস্ত সে । ঘরে নিদারুণ অভাব । অভুক্ত স্ত্রী সন্তানদের অহর্নিশ আস্ফালন বিচলিত করে তাকে । বড় মেয়ে তিলক পনের বছরে পা দিল এবার । এ বয়সী মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার প্রচলন গ্রামে । তিলকের বয়সী মেয়েগুলোর বিয়ে হয়েছে কবেই । কারও কারও কূলে সন্তানও আছে এখন । তিলকের বিয়ে হয়নি এখনও । বিয়ের বাজারে ওকে নিয়ে আগ্রহী হতেও দেখেনি কেউ । পাত্রপক্ষের অনীহার কারণ হয়তো মহেশ আলীই । এজন্য গাঁয়ে কত কথাইতো শুনতে হয় তাকে । লোকে বলে-
-মাইয়্যা নাউয়ের বশ করনি মহেশ, বিয়া দেওনা যে ?
লোকে নিন্দা করলে মিথ্যা বলে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করে সে । সে বলে-
-দিমুগো মিয়া ভাই, সরেস পুলা পাইন্যা যে ।
সরেস পাত্রের কিন্তু সন্ধান করেনা মহেশ আলী । মেয়েকে কোন ভাবে পার করার চেষ্টা করে সে । সুযোগ বুঝে মতিঘটক বিরুর বিয়ের প্রস্তাব দেয় তাকে । সে বলে-
-ভালা গেরছ মিয়া ভাই মাইয়্যা দিবানি ? মহেশ বলে-
-কেডা কওতো ?
-মামুদপুর গুনাই মাঝির পুলা বিরু ।
সংসারে এ ধারুন দুঃসময়য়ে মতির কথা মনে ধরে মহেশ আলীর । এর কদিন পর ইয়ার বন্ধুদের সাথে 
নিয়ে মেয়ের বিয়ের পাত্র দেখতে যায় সে । কিন্তু ফিরে আসে আশাহত হয়েই । যদিও বিরুর কথা আগেই বলেছিল ঘটক কিন্তু সে সমস্যা যে যৎসামান্য নয় এটা বুঝেই পিছাতে হয় তাকে । তবে আশা ছাড়েনা মতিঘটক । মহেশ বলে-
-ইতা কেমুন কও ভাই মাইয়ানি গাঙ্গে দিমু । মতি বলে-
-পুলার মাও দুই বিঘা জমি দিব কয় দিলে বুঝ দেও ।

তখনও রাজী হয়না মহেশ । তবে এর কদিন পরই হঠাৎ লোক মারফৎ খবর আসে বিরুর সাথে মেয়ের বিয়েতে রাজী সে । তবে জমি আগেই নিঃশর্ত লিখে দিতে হবে তিলককে । হবিরন বিবি আপত্তি করেনা তাতে । এ সংসারে আল্লাহ অনেক দিছে তাদের । সেখানে দু’বিঘা সামান্যই । তাছাড়া বিয়ের পর তিলকতো এখানেই থাকবে । যেখানে ছেলে পাগল তার সেখানে বউয়ের নামে সামান্য সম্পদ থাকলে মন্দ কি ?
তিলকের কাছে কিন্তু সত্য প্রকাশ হয়না কখনই । পাত্র কে, কি করে বিবাহ অবধি এগুলো অজানাই থেকে যায় । জানতো, ওর মত মেয়েদের এসব জানার অধিকার থাকেনা । সংসারে পিতা বলে পরিচিত যে মানুষটা তার ইচ্ছেই শেষ এখানে । তারপর বিয়ের দিনই হয়তো জীবনে বড় ধাক্কাটার মুখোমুখি হয় তিলক । স্বামী নামক যে মানুষটার কাছে নিজের সর্বস্ব বিসর্জন দিতে এসেছে সে, সে মানুষটা যে অন্য সবার মত নয় এটা ভেবেই অশ্রু বিসর্জন দেয় সে । তিলক কিন্তু মেয়ে ভাল, দেখতেও বেশ । পরদিন বউ দেখে ধন্য ধন্য করে গাঁয়ের বউয়েরা ।
-হুনছনি বইচির মা বিরুনি বিয়া করছে কাইল ।
-হাঁচানি, বউ কেমুন কওতো ?
-চান্দের ঢং সরেস কপাল পাগলার ।

তারপর এক এক করে দিন যায় । দিনে দিনে হয়তো সংসারে বিতৃষ্ণা বাড়ে তিলকের । দেখতেতো সে মন্দ নয় । বিরুও হয়তো ভাগ্যের লিখন ওর । তাতে কি, পাগলের সাথে সংসার করা যায় কি ? ভালবাসা প্রত্যাশী মেয়েটা রাতে স্বামীর জন্য উতলা হয় । অবুঝ বিরু ভ্রূক্ষেপ করেনা তাতে । হবিরন বিবি হয়তো বোঝতে পারে সবই । তথাপি তিলককে খুশী রাখার চেষ্টা করে সে । মহেশের অসচ্ছল সংসারে আর্থিক সহায়তা দেয় দিনকে দিন । এতে সামান্য সচ্ছলতা আসে মহেশের । মন্দ কি ? বিরু পাগল বলেই হয়তো জন দশেক মানুষের উদরপূর্তি হয় এখানে ।
হাতে কাজ না থাকলে তিলকের সাথে খোশগল্পে মাতে হবিরন । নানা সুখ দুঃখের গল্প করে দুজন । হবিরন বলে-
-পুড়া কপালগো বউ । আমি মরলে দেইখো বিরুরে ।
সহসা জবাব দেয়না তিলক । এ সংসারে এসে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত ছাড়া বিশেষ কিছুই পায়নি সে । তবু তাকে প্রবোধ দিতে হয় । নিজেকে প্রবোধ দেয় সে নানা কিছু ভেবেই ।
এরপর এক জ্যৈষ্ঠের কথা । আম কাঁঠালের মৌসুমে জামাই দাওয়াত করে খাওয়ানোর রীতি আছে গ্রামে । জ্যৈষ্ঠের দাওয়াতে শ্বশুরবাড়ী যাওয়ার ফুরসৎ হয়না বিরুর । এ সবের গুরুত্ব জানা কথা নয় ওর । অবশেষে তিলক একাই যায় । বাপের বাড়ী গেলে পাড়ার মেয়েরা জটলা করে ওকে ঘিরে ।

আচ্ছা, মনাইয়ের কথা মনে আছে ? জিন্দারপুর গ্রামের হাছন আলীর ছেলে মনাই । সংসারে আপন  বলে কেউ নেই তার । উদরপূর্তির তাড়নায় আগে বারুইল বাজারে দুদু শেখের দোকানে পেট খোরাক মজুরী খটতো সে । কৈশোরে মনাইয়ের সাথে মন দেওয়া নেওয়া করেছিল তিলক । সম্পর্ক ওদের বিবাহ পর্যন্ত গড়ায়নি । যেখানে নিজের পেটের ভাত জোগানোর সামর্থ্য ছিলনা মনাইয়ের, সেখানে তিলকের ভরণপোষণ অসাধ্য ছিল তার । মহেশ আলীও রাজী হয়নি মেয়ে দিতে । দুদু শেখের দোকানেই কাজ করে এখন মোটা টাকার মালিক হয়েছে মনাই । বাড়ীতে ছনের দু’চালা ঘর তুলেছে নতুন । বাপের বাড়ী এলে একদিন মনাইয়ের সাথে দেখা হয় তিলকের । তিলক বলে-
-ভালা আছ মালুম অয় ? মনাই বলে-
-ভালা, আইছ কবে ?
-কাইল ।

তারপর সময় ধরে নানা কথা বলে দু’জন । মনাইয়ের বিয়ে হয়নি এখনও । ইয়ার বন্ধুদের নিয়ে কনে দেখছে সে । তিলক রাজী থাকলে ওকেই ঘরে নিতে চায় সে । সেদিন রাতে হঠাৎ ভাবনায় পড়ে তিলক । বিরুকে মনে করে অশ্রু বিসর্জন দেয় সে । তারপর আচমকা সিদ্ধান্ত নেয় বিরুর সাথে সংসার করবেনা সে । সত্য প্রকাশিত হলে হুঙ্কার করে মহেশ আলী । মরিয়ম বোঝানোর চেষ্টা করে মেয়েকে ।
সেবার মামুদপুর এসে আচমকা বদলে যায় তিলক । নানা ক্ষুদ্র ব্যাপার নিয়েও কলহ করে সে । ওকে দেখে অবাক হয় হবিরন বিবিও । তবুও মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে নিজেকে মানানোর চেষ্টা করে সে । বিরুতো কথা বলতে পারেনা । মনের কথা প্রকাশ করতে কেবল অ্যাঁ অ্যাঁ শব্দ করে সে । অবশেষে একদিন সত্য প্রকাশিত হয় হবিরনের কাছে । তিলক বলে-
-এ সংসার করবার নয় । হামাক ক্ষেমা দেন ।
তিলকের ইচ্ছায় অনীহা প্রকাশ করেনা হবিরন বিবি । সম্পর্ক ইচ্ছের বাইরে হয়না কখনই । জগত সংসারে এসে অন্তত এ সত্যি জানা হয়েছে তার । বিরুতো পাগল, তিলক নয় । জিন্দারপুর খবর গেলে মেয়েকে নিতে আসে মহেশ আলী । প্রস্থানে জমিটুকু ফেরত দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে সে । হবিরন বলে-
-জমিনি, কথাখান ছাড়ান দেন । জমিখান বউয়ের ।

তিলক ফিরে গেলে সেদিন বিরুকে উঠানে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে দেখেছে সবাই । হবিরন বিবি সহসা থামানোর চেষ্টা করেনি তাকে । দিনের শেষে রাতের অন্ধকার ঘনতর হয় । এক এক করে নীরবতা নামে সর্বত্র । ঘুমে আচ্ছন্ন হলে মুখের লালায় বালিশ ভিজে বিরুর । অনাহুত ভবিষ্যৎ ভেবে বিচলিত হয় হবিরন । বয়সের ভারে ন্যুব্জ মানুষটা যখন প্রস্থান করবে তখন ভবপারে নিজের বলে কেউ থাকবেনা বিরুর । গোত্রের মানুষে ভরসা কি, হবিরন বিবি না থাকলে হয়তো তার সবটুকুই কেড়ে নিবে সবাই । তখন বিরুর ঠায় হবে কোথায়, রাস্তায় ?
এর কদিন পরের কথা । তখন মসজিদে ফজরের আযান হয়েছে কেবল । প্রকাণ্ড আমগাছটার মগডালে প্রত্যহ যে কাকের আওয়াজ শুনা যায়, তার কণ্ঠ ধ্বনিত হয়নি তখনও । হবিরন বিবি বড় ঘরের দরজা খুলে দেখে তিলক দাঁড়িয়ে । কি এক অদ্ভুত মুহে পড়ে আবার ফিরে এসেছে মেয়েটা ।
গাঁয়ে আমাদের ভিটেটা অযত্নে পড়ে আছে আজও । দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়া থাকে সেখানে । বছর পাঁচেক পর সেদিন গেছিলাম, আগাছা জন্মে পুরনো কবরগুলো নিশ্চিহ্ন প্রায় । আসার পথে দেখা হল বিরুর সাথে । আমাকে দেখেই অ্যাঁ অ্যাঁ করে এগিয়ে এল সে । তারপর টেনে নিয়ে ভেতরে বসাল যত্নে । ওর মুখে লালা ঝরেনা আর । কথাগুলোও স্পষ্ট হচ্ছে দিনকে দিন । ঘরে নতুন মানুষ এসেছে । ওর বউ তিলক- কি এক অদ্ভুত মুহে পড়ে আজও এ অসম্পূর্ণ মানুষটির সাথে সংসার করে চলেছে । সম্পর্কের ভাষা হয়না কখনই । ওর অদ্ভুত ক্ষমতা থাকে কেবল । বিরুও হয়তো সম্পূর্ণ মানুষ হবে একদিন । কি কথা, কি বুদ্ধিতে । ওর পাশে তিলক আছে তো !