আমাদের পাড়ার প্রকাণ্ড আমগাছটা বিরুদের । আদিগাছ । ওর জন্মের হদিস দিতে
পারে এ পাড়ায় সাধ্যি কার ? জন্ম থেকে আমরা কেবল স্বগর্বে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি ওকে
। ওটা কথা কয় জান ? মামুদপুর গ্রামের প্রতিটা ঘরে ঘরে সজল দৃষ্টি ওর । সকালের কাক
যখন ওর মগডালে বসে কা কা আওয়াজ করে বোধকরি সবাই শুনে সে ধ্বনি । সংসারের ছোট ছোট
ব্যাপার নিয়ে আহালু আর নঙ্ক যখন কলহ করে তখন সে চোখরাঙায় নিশ্চয় । রতনের ঘরে
জোড়াসন্তানের আগমনবার্তা শুনে সেও আহ্লাদী হয় । দখিনা বাতাসে পাতাগুলো দোল খায় তখন
।
বিরুদের
আমগাছটার পাশেই তাদের প্রকাণ্ড ফলের বাগান । তাতে মৌসুমি ফলের নৃত্য সমাহার ।
এগুলো ঘিরে কত স্মৃতি আমাদের । সময়গুলো ঝাপসা হয়ে যায় দিনে দিনে, মুছে যায়না নিজ
থেকে । গাঁয়ের ঘরে ঘরে সন্ধ্যায় বউয়েরা খড়ের গাদা পুড়িয়ে রাতের খাবার প্রস্তুত করে
। তাদের সৃষ্ট ধোঁয়াগুলো শূন্যে এসে সমবেত হলে ঘোমটবদ্ধ মেঘের রূপ নেয় । আমাদের
মুহূর্তগুলোও এখন তদ্রূপ ।
মামুদপুর
গ্রামে বিরুদের বাড়ী রায়ের বিল হতে উত্তরে । শুকনো মৌসুমে বিল পেরিয়ে আসতে সময়
লাগে বেশ । আষাঢ়ে বানের জলে যখন গ্রাম ভাসে বিলের ভাসা জল তখন আমগাছটার গোড়া ছোঁয়
। এ পাড়ার বাড়ীগুলোতে সাদাজল লুটোপুটি খায়, বিরুদের বাড়ীতে সে দৃশ্য গবেষণার
ব্যাপার । ওদের দহলিজটা বেশ উঁচু, ঘরগুলো আরও । মাঝিপাড়ার জেলেগুলো বন্যায় ঘাট হিসেবে
ব্যবহার করে আমগাছকে । ওর গোড়ায় কত কত নৌকা ভাসে তখন !
মাঝি বাড়ীতে
মানুষ মোটে দুজন । বয়স্ক হবিরন বিবি ভাল করে চোখে দেখেনা দিনে, রাতেতো নয়ই । বিরুর
বাপ গুনাই মাঝিকে আমরা চোখে দেখিনি কেউ । নাম শুনেছি কেবল । গুনাই মাঝি যখন পরবাসী
এ পাড়ায় হয়তো আমাদের আগমনী বার্তা বাজেনি তখনও । আমাদের আগমন গুনাই মাঝির উত্তরসূরি
হয়ে, এখনতো গাঁয়ে আমরাই বর্তমান ।
হবিরন বিবি
কিন্তু মানুষ ভাল । পাড়ায় আমরা কোনদিন কলহ করতে দেখিনি তাকে । যেচে কারো সাথে কথা
বলতেও যায়না সে । মরার আগে স্বামীর রেখে যাওয়া আবাদি জমিগুলো বর্গা দিয়ে সংসার চলে
তার । মৌসুমি ফল বিক্রির টাকাও যৎসামান্য নয় । ফলে বিরুদের অভাবের মুখোমুখি হতে
হয়না কখনই । বরং এ গাঁয়ে আর সবার থেকে দাপটে চলে তারা । ঘটা করে উৎসব পালন করে
বিভিন্ন । গুনাই মাঝির মৃত্যু দিবসে পাড়ায় ঘরে ঘরে ভোগ দেয় । হাভাতে ছেলেগুলোও
বছরে একদিন ভালমন্দে উদরপূর্তির লোভ করে দিনকে দিন ।
জানো,
এতকিছুর পরেও মনে কোথাও দুঃখ ছিল হবিরন বিবির । সংসারে একমাত্র ছেলে যে তার অন্য
দশটা ছেলেদের মত নয়, হয়তো এটা ভেবেই অশ্রু বিসর্জন দিত সে । যাহোক বিরু কিন্তু
জন্মেই এমন ছিলনা । গাঁয়ের মক্তবে ছোটবেলাই কায়দা পড়েছি আমরা । ওর বয়স যখন পাঁচ কি
ছয় তখন কি এক অসুখে পড়েছিল সে । তারপর সুস্থ হয়েছে সত্যি তবে কথা হারিয়েছে মুখে ।
মনের ভাব প্রকাশ করতে গেলে এখন কেবল অ্যাঁ অ্যাঁ শব্দ করে সে । মুখে লালা ঝরে
সারাদিন । বুদ্ধিটাও বোধয় আটকে আছে শৈশবেই । বয়সের ভারে কেবল দেহ বেড়েছে তার
বুদ্ধি বাড়েনি মোটেও ।
পাশের বাড়ীর
নজুখাঁর বউ হাঁসুলি বিকেলে পাড়া ঘোরার বাহানায় হবিরন বিবির সাথে খোশগল্পে মাতে । পানের
বাটাটা এগিয়ে দিলে মুখে পান চিবোয় সময় ধরে । তারপর বলে-
-একখান কতা
মুনে আহে, কমুনি চাচি ? হবিরন বলে-
-শরমাও যে,
কও হুনি ?
-বিরু ভাইনি
জন্ম পাগল ?
-অমুন কইরা
কও যে, পুলা মোর পাগলনি ? হুগনা বাতাস নাগচে মালুম অয় ।
পরক্ষণে কথা
বাড়ায়না হাঁসুলি । সেতো জানে এ পাড়ার সবাই যখন বিরুকে পাগল বলে সাব্যস্ত করে কেবল
হবিরন বিবি সত্যটা মানতে নারাজ । উত্তর পাড়ার নয়াব আলীর ষোল বছর বয়সী মাথা পাগল
ছেলেটা, কথা বলতে পারেনা সেও । নিজের খেয়াল রাখতেও অপারগ সে । অসচেতন হলে হয়তো
গোপন অঙ্গ প্রদর্শিত হয় জনসম্মুখে । কই, বিরুর মধ্যেতো এমন হাবভাব নেই । তাহলে
পাগল সে নয় নিশ্চয় । হবরন বিবি বিশ্বাস করে ভাল একদিন হবে ছেলে । কিন্তু কবে, কেবল
সে দিনটাই জানা নেই তার ।
রায়ের বিলের
তীরঘেঁষে যে কাঁচা সড়কটা বাজারমুখী ধাবমান তার কূলঘেঁষে আমাদের বাড়ীটা । প্রত্যহ
সওদা করে ফেরার পথে বিরুদের বাড়ীটা পাশ কাটিয়ে আসতে হয় আমাকে । সুযোগ পেলে সপ্তাহে
এক দুইবার যাওয়া হয় সেদিকে । হবিরন বিবি পুলকিত হয় তাতে । আমার আগ্রহ না জানি এতেই
। হবিরন বলে-
-বিন্দেনি,
দুস্তেরে দেকতে আইলি মুনে কয় ?
-হাঁচা, হগগল
ভালানি চাচি ?
-ভালা,
শিগগির যাসন্যা আইজ । খাসীর বেনুন রানছি বিরুর লগে দিমুনে ।
ইচ্ছে না
হলেও নিষেধ করা হয়না সহসা । সাহসেও কেমন ঘাটতি পড়ে যেন । মাঝে মাঝেই রাতের খাবার
খেয়ে আসতে হয় আমায় । মাঝি বাড়ী গেলে বিরুটা কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে । আচমকা
দৃষ্টি গেলে ভেতরে কোথাও ব্যথা হয় যেন ।
অগ্রহায়নের
গোড়া অথবা পৌষের শুরুতে বিয়ের ধূম পড়ে মামুদপুর । নতুন ফসলের আগমনে ঘরে ঘরে নবান্ন
উৎসব করে মেয়েরা । কামলাগোছের উড়নচণ্ডী ছেলেগুলো কাচাপয়সা উপার্জনের মুহে পড়লে ঘরে
নতুন বউ আনার পাঁয়তারা করে । বিরুর বয়সী গেঁয়ো ছেলেগুলো সংসারী হয় এক এক করে । বছর
ঘুরতেই কারো কারো ঘরে নবজাতকের কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায় । বিরুর ক্ষেত্রে সে দৃশ্য
কল্পনাতীত । ওরও বয়স হয়েছে বেশ । অন্তত যে বয়সে গাঁয়ের ছেলেরা সংসারমুখী হয় তার
চেয়ে বেশীই । কিন্তু মনে বিয়ের কোন গোপন মুহ নেই বিরুর । দুনিয়ার হদিস জানেনা যে,
অ্যাঁ অ্যাঁ করলে মুখে লালা ঝরে তাকে মেয়ে দিবে কে ? কিন্তু হবিরন বিবি সে সত্য
মানতে নারাজ । এ কুলে ছেলে তার একটাই । মরার পর এ সংসারে হাল ধরতেও মানুষ চাই তার
। বিরুর উপর ভরসা কই ? ইয়ার বন্ধুরা সংসারী হলে তাই ঘরে ছেলের বউ আনার পাঁয়তারা
করে হবিরন বিবি । গাঁয়ের বউয়েরা খোশগল্পের বাহানায় সমবেত হলে একদিন মনোবাসনা খুলে
বলে সে ।
-হুনছনি
বুজান, পুলার বউ দেহার খায়েশ অয় দিলে ।
এক দুই কথায়
বাঁধ সাধে কেউ কেউ । “ বউনি, পাগলারে মাইয়্যা দিব কেডা কওতো ?”
তখন প্রতীবাদ
করে হবিরন-“ মুখ সামাল দেও বুচির মা, পুলা কই পাগল না ।”
-হাঁচানি,
বিয়া কইরে ভাত দিব পুলা ?
-নিয্যস ।
হবিরনের কথা
মিথ্যে নয় । এ পাড়ায় মাঝি বাড়ীর প্রতিপত্তির কথা অজানা নয় কারও । সংসারে অভাবের
ছিটেফোঁটাও খোঁজে পাওয়া দায় । কামলাগোছের অভাবী মানুষগুলোর কাছে পেটের ক্ষুধায় শেষ
কথা । দিন শেষে উদরপূর্তি করতে পারলে আর কিছু চাইনা কেউ । কে জানে হয়তো এ মুহেই
কেউ কেউ কন্যা সম্প্রদান করতে পারে বিরুর হাতে । চেষ্টা করতে দোষ কি ?
বারুইল
গ্রামের ধলাই শেখ সম্পর্কে সৎ ভাই হবিরন বিবির । একই বাবার দ্বিতীয় ঘরের সন্তান সে
। ঘরে বউ ছাড়াও একটা মেয়ে আছে তার । নানকি । আহ ! কি ভাল দেখতে মেয়েটা । যেমন
স্বভাবে তেমন সৌন্দর্যে । বিরু যখন শৈশবে তখন ওকে ঘরের বউ করতে চেয়েছিল হবিরন বিবি
। এরপর কত বছর পার হয়েছে সাহস করে ভাইকে সত্যিটা বলতে পারেনি সে । ছেলে যে তার
অন্য দশটা ছেলের মত নয়, এটা ভেবেই মনকে সান্ত্বনা দিয়েছে সে । ধলাই শেখের আর্থিক
অবস্থা ভাল নয় এখন । কে জানে, বোনের প্রস্তাব হয়তো মেনে নিতেও পারে সে । অন্তত
একবার চেষ্টা করে দেখতে চায় হবিরন । বুড়ো কলিমুদ্দিন সম্পর্কে চাচাতো ভাই গুনাই
মাঝির । একদিন তাকে দিয়েই ভাইয়ের বাড়ী প্রস্তাব পাঠায় হবিরন বিবি । তারপর দিনভর আর
দেখা পাওয়া যায়না কলিমুদ্দির । সন্ধ্যায় ফিরে এসে জানায়-
-ভাই তোমার
রাজি নয়গো ভাবি, মনোবাঞ্ছা ছাড়ান দেও ।
তবুও আশাহত
হয়না হবিরন । মনে মনে ছেলের বউ খোঁজে বেড়ায় সে । পার্শ্ববর্তী কুলকান্দি গ্রামের
মতিঘটক বিয়ের কাজে পোক্ত লোক । এ পাড়ায় কতজনেরইতো বিয়ের পাত্রী জোগাড় করে দিয়েছে
সে । সে খবর কে না জানে । হবিরন বিবি খবর দিলে একদিন মাঝি বাড়ী দেখা যায় তাকে ।
হবিরন বলে-
-হগগল খবর
হুনছ মালুম অয় ঘটক ? মতি বলে-
-হ, ভরসা
কইরো ভাবী চাইলে বাঘের চোখ আইন্যা দিমু ।
-হাঁচানি ভাই
?
-নিয্যস,
মিছা কওনের মানুষনি মুই ?
মতিঘটক-
দেখতে পটকা মাছের মত মানুষটা, কনে দেখার ছলে মোটা টাকা হাতিয়ে নেয় হবিরন বিবির কাছ
থেকে । এক এক করে দিন যায় সহসা কনের সন্ধান মেলেনা কোথাও । একদিন আশাহত হয় হবিরনও
।
কদিন পরের
কথা । জিন্দারপুর গ্রামের মহেশ আলী, সংসারে অসচ্ছল গেরস্ত সে । ঘরে নিদারুণ অভাব ।
অভুক্ত স্ত্রী সন্তানদের অহর্নিশ আস্ফালন বিচলিত করে তাকে । বড় মেয়ে তিলক পনের
বছরে পা দিল এবার । এ বয়সী মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার প্রচলন গ্রামে । তিলকের বয়সী
মেয়েগুলোর বিয়ে হয়েছে কবেই । কারও কারও কূলে সন্তানও আছে এখন । তিলকের বিয়ে হয়নি
এখনও । বিয়ের বাজারে ওকে নিয়ে আগ্রহী হতেও দেখেনি কেউ । পাত্রপক্ষের অনীহার কারণ
হয়তো মহেশ আলীই । এজন্য গাঁয়ে কত কথাইতো শুনতে হয় তাকে । লোকে বলে-
-মাইয়্যা
নাউয়ের বশ করনি মহেশ, বিয়া দেওনা যে ?
লোকে নিন্দা
করলে মিথ্যা বলে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করে সে । সে বলে-
-দিমুগো মিয়া
ভাই, সরেস পুলা পাইন্যা যে ।
সরেস পাত্রের
কিন্তু সন্ধান করেনা মহেশ আলী । মেয়েকে কোন ভাবে পার করার চেষ্টা করে সে । সুযোগ
বুঝে মতিঘটক বিরুর বিয়ের প্রস্তাব দেয় তাকে । সে বলে-
-ভালা গেরছ
মিয়া ভাই মাইয়্যা দিবানি ? মহেশ বলে-
-কেডা কওতো ?
-মামুদপুর
গুনাই মাঝির পুলা বিরু ।
সংসারে এ
ধারুন দুঃসময়য়ে মতির কথা মনে ধরে মহেশ আলীর । এর কদিন পর ইয়ার বন্ধুদের সাথে
নিয়ে
মেয়ের বিয়ের পাত্র দেখতে যায় সে । কিন্তু ফিরে আসে আশাহত হয়েই । যদিও বিরুর কথা
আগেই বলেছিল ঘটক কিন্তু সে সমস্যা যে যৎসামান্য নয় এটা বুঝেই পিছাতে হয় তাকে । তবে
আশা ছাড়েনা মতিঘটক । মহেশ বলে-
-ইতা কেমুন
কও ভাই মাইয়ানি গাঙ্গে দিমু । মতি বলে-
-পুলার মাও
দুই বিঘা জমি দিব কয় দিলে বুঝ দেও ।
তখনও রাজী
হয়না মহেশ । তবে এর কদিন পরই হঠাৎ লোক মারফৎ খবর আসে বিরুর সাথে মেয়ের বিয়েতে রাজী
সে । তবে জমি আগেই নিঃশর্ত লিখে দিতে হবে তিলককে । হবিরন বিবি আপত্তি করেনা তাতে ।
এ সংসারে আল্লাহ অনেক দিছে তাদের । সেখানে দু’বিঘা সামান্যই । তাছাড়া বিয়ের পর
তিলকতো এখানেই থাকবে । যেখানে ছেলে পাগল তার সেখানে বউয়ের নামে সামান্য সম্পদ
থাকলে মন্দ কি ?
তিলকের কাছে
কিন্তু সত্য প্রকাশ হয়না কখনই । পাত্র কে, কি করে বিবাহ অবধি এগুলো অজানাই থেকে
যায় । জানতো, ওর মত মেয়েদের এসব জানার অধিকার থাকেনা । সংসারে পিতা বলে পরিচিত যে
মানুষটা তার ইচ্ছেই শেষ এখানে । তারপর বিয়ের দিনই হয়তো জীবনে বড় ধাক্কাটার
মুখোমুখি হয় তিলক । স্বামী নামক যে মানুষটার কাছে নিজের সর্বস্ব বিসর্জন দিতে
এসেছে সে, সে মানুষটা যে অন্য সবার মত নয় এটা ভেবেই অশ্রু বিসর্জন দেয় সে । তিলক
কিন্তু মেয়ে ভাল, দেখতেও বেশ । পরদিন বউ দেখে ধন্য ধন্য করে গাঁয়ের বউয়েরা ।
-হুনছনি বইচির
মা বিরুনি বিয়া করছে কাইল ।
-হাঁচানি, বউ
কেমুন কওতো ?
-চান্দের ঢং
সরেস কপাল পাগলার ।
তারপর এক এক
করে দিন যায় । দিনে দিনে হয়তো সংসারে বিতৃষ্ণা বাড়ে তিলকের । দেখতেতো সে মন্দ নয় ।
বিরুও হয়তো ভাগ্যের লিখন ওর । তাতে কি, পাগলের সাথে সংসার করা যায় কি ? ভালবাসা
প্রত্যাশী মেয়েটা রাতে স্বামীর জন্য উতলা হয় । অবুঝ বিরু ভ্রূক্ষেপ করেনা তাতে ।
হবিরন বিবি হয়তো বোঝতে পারে সবই । তথাপি তিলককে খুশী রাখার চেষ্টা করে সে । মহেশের
অসচ্ছল সংসারে আর্থিক সহায়তা দেয় দিনকে দিন । এতে সামান্য সচ্ছলতা আসে মহেশের ।
মন্দ কি ? বিরু পাগল বলেই হয়তো জন দশেক মানুষের উদরপূর্তি হয় এখানে ।
হাতে কাজ না
থাকলে তিলকের সাথে খোশগল্পে মাতে হবিরন । নানা সুখ দুঃখের গল্প করে দুজন । হবিরন
বলে-
-পুড়া কপালগো
বউ । আমি মরলে দেইখো বিরুরে ।
সহসা জবাব
দেয়না তিলক । এ সংসারে এসে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত ছাড়া বিশেষ কিছুই পায়নি সে । তবু
তাকে প্রবোধ দিতে হয় । নিজেকে প্রবোধ দেয় সে নানা কিছু ভেবেই ।
এরপর এক
জ্যৈষ্ঠের কথা । আম কাঁঠালের মৌসুমে জামাই দাওয়াত করে খাওয়ানোর রীতি আছে গ্রামে ।
জ্যৈষ্ঠের দাওয়াতে শ্বশুরবাড়ী যাওয়ার ফুরসৎ হয়না বিরুর । এ সবের গুরুত্ব জানা কথা
নয় ওর । অবশেষে তিলক একাই যায় । বাপের বাড়ী গেলে পাড়ার মেয়েরা জটলা করে ওকে ঘিরে ।
আচ্ছা,
মনাইয়ের কথা মনে আছে ? জিন্দারপুর গ্রামের হাছন আলীর ছেলে মনাই । সংসারে আপন বলে কেউ নেই তার । উদরপূর্তির তাড়নায় আগে
বারুইল বাজারে দুদু শেখের দোকানে পেট খোরাক মজুরী খটতো সে । কৈশোরে মনাইয়ের সাথে
মন দেওয়া নেওয়া করেছিল তিলক । সম্পর্ক ওদের বিবাহ পর্যন্ত গড়ায়নি । যেখানে নিজের
পেটের ভাত জোগানোর সামর্থ্য ছিলনা মনাইয়ের, সেখানে তিলকের ভরণপোষণ অসাধ্য ছিল তার
। মহেশ আলীও রাজী হয়নি মেয়ে দিতে । দুদু শেখের দোকানেই কাজ করে এখন মোটা টাকার
মালিক হয়েছে মনাই । বাড়ীতে ছনের দু’চালা ঘর তুলেছে নতুন । বাপের বাড়ী এলে একদিন
মনাইয়ের সাথে দেখা হয় তিলকের । তিলক বলে-
-ভালা আছ
মালুম অয় ? মনাই বলে-
-ভালা, আইছ
কবে ?
-কাইল ।
তারপর সময়
ধরে নানা কথা বলে দু’জন । মনাইয়ের বিয়ে হয়নি এখনও । ইয়ার বন্ধুদের নিয়ে কনে দেখছে
সে । তিলক রাজী থাকলে ওকেই ঘরে নিতে চায় সে । সেদিন রাতে হঠাৎ ভাবনায় পড়ে তিলক ।
বিরুকে মনে করে অশ্রু বিসর্জন দেয় সে । তারপর আচমকা সিদ্ধান্ত নেয় বিরুর সাথে সংসার
করবেনা সে । সত্য প্রকাশিত হলে হুঙ্কার করে মহেশ আলী । মরিয়ম বোঝানোর চেষ্টা করে
মেয়েকে ।
সেবার
মামুদপুর এসে আচমকা বদলে যায় তিলক । নানা ক্ষুদ্র ব্যাপার নিয়েও কলহ করে সে । ওকে
দেখে অবাক হয় হবিরন বিবিও । তবুও মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে নিজেকে মানানোর চেষ্টা করে সে
। বিরুতো কথা বলতে পারেনা । মনের কথা প্রকাশ করতে কেবল অ্যাঁ অ্যাঁ শব্দ করে সে ।
অবশেষে একদিন সত্য প্রকাশিত হয় হবিরনের কাছে । তিলক বলে-
-এ সংসার
করবার নয় । হামাক ক্ষেমা দেন ।
তিলকের
ইচ্ছায় অনীহা প্রকাশ করেনা হবিরন বিবি । সম্পর্ক ইচ্ছের বাইরে হয়না কখনই । জগত
সংসারে এসে অন্তত এ সত্যি জানা হয়েছে তার । বিরুতো পাগল, তিলক নয় । জিন্দারপুর খবর
গেলে মেয়েকে নিতে আসে মহেশ আলী । প্রস্থানে জমিটুকু ফেরত দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে
সে । হবিরন বলে-
-জমিনি,
কথাখান ছাড়ান দেন । জমিখান বউয়ের ।
তিলক ফিরে
গেলে সেদিন বিরুকে উঠানে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে দেখেছে সবাই । হবিরন বিবি সহসা
থামানোর চেষ্টা করেনি তাকে । দিনের শেষে রাতের অন্ধকার ঘনতর হয় । এক এক করে নীরবতা
নামে সর্বত্র । ঘুমে আচ্ছন্ন হলে মুখের লালায় বালিশ ভিজে বিরুর । অনাহুত ভবিষ্যৎ
ভেবে বিচলিত হয় হবিরন । বয়সের ভারে ন্যুব্জ মানুষটা যখন প্রস্থান করবে তখন ভবপারে
নিজের বলে কেউ থাকবেনা বিরুর । গোত্রের মানুষে ভরসা কি, হবিরন বিবি না থাকলে হয়তো
তার সবটুকুই কেড়ে নিবে সবাই । তখন বিরুর ঠায় হবে কোথায়, রাস্তায় ?
এর কদিন পরের
কথা । তখন মসজিদে ফজরের আযান হয়েছে কেবল । প্রকাণ্ড আমগাছটার মগডালে প্রত্যহ যে
কাকের আওয়াজ শুনা যায়, তার কণ্ঠ ধ্বনিত হয়নি তখনও । হবিরন বিবি বড় ঘরের দরজা খুলে
দেখে তিলক দাঁড়িয়ে । কি এক অদ্ভুত মুহে পড়ে আবার ফিরে এসেছে মেয়েটা ।
গাঁয়ে আমাদের
ভিটেটা অযত্নে পড়ে আছে আজও । দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়া থাকে সেখানে । বছর পাঁচেক
পর সেদিন গেছিলাম, আগাছা জন্মে পুরনো কবরগুলো নিশ্চিহ্ন প্রায় । আসার পথে দেখা হল
বিরুর সাথে । আমাকে দেখেই অ্যাঁ অ্যাঁ করে এগিয়ে এল সে । তারপর টেনে নিয়ে ভেতরে
বসাল যত্নে । ওর মুখে লালা ঝরেনা আর । কথাগুলোও স্পষ্ট হচ্ছে দিনকে দিন । ঘরে নতুন
মানুষ এসেছে । ওর বউ তিলক- কি এক অদ্ভুত মুহে পড়ে আজও এ অসম্পূর্ণ মানুষটির সাথে
সংসার করে চলেছে । সম্পর্কের ভাষা হয়না কখনই । ওর অদ্ভুত ক্ষমতা থাকে কেবল । বিরুও
হয়তো সম্পূর্ণ মানুষ হবে একদিন । কি কথা, কি বুদ্ধিতে । ওর পাশে তিলক আছে তো !