কলেজের গন্ডী
পেরিয়ে ইউনিভার্সিটিতে প্রবেশ করেছি । আমি গ্রামের মেয়ে । কলেজের রেজাল্ট খুব ভাল
হয়েছিল । ইউনিভার্সিটিতে ভাল ভাবে চান্স পেয়ে গেলাম । বাড়ি থেকে বাবা দাদা কারোর
মত ছিল না । ওদের ইচ্ছে বিএ পাশ করেছে এবার মেয়ের বিয়ে দেওয়াই ভাল । কিন্তু বাদ
সাধলেন আমার মা । উনি পড়াশুনো খুব ভালবাসতেন । মায়ের ইচ্ছেতেই আমার ফিলসফিতে
অনার্স নিয়ে কলেজে পড়াশোনা । আর মায়ের ইচ্ছেতেই আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়বার সুযোগ
পেলাম । মা বলেছিলেন- আমি জোর করে তোমাকে ভর্তি করলাম আমার মুখ তুমি রেখো । মায়ের
কথাটা মনে গেঁথে গিয়েছিল ।
প্রথম বছর
একই ঘরে দুজন করে থাকা । আমার রুমমেট পেয়েছিলাম হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের একজনকে ।
নাম তার অরুণিমা । কিছুদিনের মধ্যে আমাদের বন্ধুত্ব হয়ে গেল প্রগাঢ় । ও ছিল
ডুয়ার্সের চাবাগানের মেয়ে । বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান । ওর মা বাবাও ভীষন ভাল
মানুষ । আমাকেও মেয়ের মতই ভালবাসতেন ।মেয়েকে দেখতে আসলে অনেক কিছু নিয়ে আসতেন ।
সঙ্গে আমার জন্যেও নিয়ে আসতেন নানা উপহার । মাঝে মাঝে দুএকদিনের ছুটিতে অরুণিমাকে
নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে আসতাম । আবার কখনো দুজনে ওদের বাড়িতেও ছুটি কাটিয়ে আসতাম ।
এভাবে ক্যান্টিনের আড্ডা ক্লাশ পড়াশোনা করে আনন্দেই কাটছিল দিনগুলো ।
দেখতে দেখতেই
চলে এল প্রথম বছরের ফাইনাল পরীক্ষা । আমরা যথারীতি পড়াশোনার মধ্যে বেশি জড়িয়ে
পড়লাম । হোস্টেলর একটা আনন্দ আছে সবাই মিলে পড়াশোনা করবার । আমরা সাধারনতঃ কাউকে
বুঝতে দিতাম না যে আমরা পড়াশোনা করি । সারাদিন দারুণ আড্ডা আর ক্লাশ নিয়ে মেতে
থাকতাম । পড়ার সময় হত রাত দশটার পর থেকে । আমরা প্রায় সারা রাতই পড়াশোনা করতাম ।
দেখতে দেখতে প্রথম বছরের ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেল । এবার বেশ কিছুদিনের জন্যে সবাই
চলে গেলাম যে যার বাড়িতে । স্বীকার করতে অসুবিধে নেই বাড়িতে মনই টিকতো না ।
হোস্টেলের কথা সব সময় মনে হত । কবে যে ইউনিভার্সিটি খুলবে এই আশায় দিন গুনতাম ।
অবশেষে
ইউনিভার্সিটি খুললো রেজাল্টও বের হল । ভাল রেজাল্ট হয়েছে ফার্স্টক্লাশ পেয়েছি ।
খুব আনন্দ হল । হোস্টেলে এসে দেখলাম যেহেতু আমাদের ফাইনাল ইয়ার তাই আমাদের জন্য
আলাদা ঘরের বন্দোবস্ত করা হয়েছে । আমি আর অরুণিমা পাশাশি দুটো সিঙ্গল রুম নিলাম ।
এটা নুতন বিল্ডিং । জানালা খুললে বরফে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা হাতছানি দিয়ে ডাকতো ।
ভোরবেলায় কাঞ্চনজঙ্ঘার কি যে অপূর্ব দৃশ্য লিখে বোঝানো যাবে না । আর রাতে দেখতাম
পাহাড়ে মিটিমিটি আলো জ্বলছে হয়তো তিনধরিয়া বা কার্শিয়াংয়ের । ভীষন ভালো লাগতো ।
প্রেমে পরে গিয়েছিলাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের । ক্লাশের পরে রুমে এসে আমি আর
অরুণিমা কিছু বানিয়ে খেতাম । বানাবার ব্যবস্থা ঘরেই ছিল । তারপর বাইরে হাঁটতে
যেতাম ।আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পারিপার্শ্বিক সৌন্দর্য্য ভীষন ভাল । মন ভালো হয়ে
যেত ঘুরে এসে । আস্তে আস্তে ফাইনাল ইয়ারের প্রথম সেমিস্টার সামনে এল । আমরা
যথারীতি পড়াশোনায় বেশি করে মনযোগ দেওয়া শুরু করলাম । রাত দুটো তিনটে অব্দি পড়াশোনা
করতাম দুজন দুজনের ঘরে । মাঝে একসাথে চায়ের রাউন্ডও হয়ে যেত । একদিন রাতে পড়তে
পড়তে আমার চোখে ঘুম এসে গিয়েছিল । হঠাৎ একটা বীভৎস চীৎকারে ঘুম ভেঙে গেল । আমি
বুঝতে পারছিলাম না যে কে এইভাবে চীৎকার করে উঠলো ! কারণ আমারও ঘুম চোখ । বার হয়ে
বুঝলাম অরুণিমার ঘর থেকে আওয়াজ আসছে । দৌড়ে ঢুকলাম । অরুণিমাকে দেখে আমি ভয় পেয়ে
গেলাম । কেমন উদভ্রান্ত চাহনি ওর । জানালার দিকে তাকিয়ে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলছে – কে কে ওখানে ! আমি জানালার সামনে এগিয়ে গেলাম । বন্ধ কাঁচের জানালা
কাউকে দেখতে পেলাম না । অরুণিমাকে ধাক্কা দিয়ে বলছি – কেউ
নেই তো ওখানে । কিন্তু বুঝতে পারছি ওর কানে আমার কোন কথাই পৌঁছুচ্ছে না । ও বিড়বিড়
করে বলেই চলেছে- কে কে …। বাধ্য হয়ে হোস্টেল সুপারকে
ডেকে আনলাম । আশেপাশের সব বোর্ডাররাই এসে পরেছে । সবাই বোঝাচ্ছে কিন্তূ ওর
উদভ্রান্ত চাহনির কোনও পরিবর্তন নেই । ভোর আলো ফুটে এসেছে । সুপার কুহুদি বললেন-
অ্যাম্বুলেন্সকে খবর দিচ্ছি ওকে নিয়ে মেডিক্যাল কলেজে দেখিয়ে নিয়ে এস । নিয়ে গেলাম
হসপিটালে । ডাক্তার ভর্তি করে নিলেন ।
পরদিন থেকে
আমাদের সেমিস্টার শুরু হয়ে গেল । মনটা ভীষন ভারাক্রান্ত । অরুণিমা হসপিটালে আর আমি
পরীক্ষা দিচ্ছি । হসপিটালে বেশ কিছুদিন রাখা হল । ওর মা বাবাও চলে এলেন ।
ডাক্তারের কথায় অরুণিমা কিছু দেখে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে । ওকে মেন্টাল
অ্যাসাইলামে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন । অবশ্য ওই ঘটনার পরদিন আমরা জানালার ওই
পাশে গিয়ে দেখেছিলাম দুটো পায়ের ছাপ । আমাদের ধারণা হয়তোবা কেউ অত রাতে ওর ঘরে আলো
জ্বলছে দেখে জানালা দিয়ে দেখতে গিয়েছিল । কাঁচের ওধারে দাড়ালে এই দিক থেকে অদ্ভুত
লাগে চেহারাটা । হয়তোবা অত রাতে ওই চেহারা দেখে অরুণিমা ভয় পেয়ে গিয়েছিল । অবশ্য
সবটাই রয়ে গেল রহস্য ।
আমি প্রায়ই
চলে যেতাম মেন্টাল হসপিটালে ওর সাথে দেখা করতে । কিন্তু ও আর আমাকে চিনতে পারতো না
। কাকু কাকীমাকে দেখলে ভীষন খারাপ লাগতো । ভগবানকে দোষারোপ দিতাম- কি হয়ে গেল ।
আমাদের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল । অরুণিমার আর পরীক্ষা দেওয়া হল না । শেষদিন
যখন ওর সাথে দেখা করতে গেলাম ওর ভাবলেশহীন দৃষ্টি কাউকে খুঁজেই চলেছে । আমি আর
চোখের জল রাখতে পারলাম না । প্রায় পালিয়েই চলে এলাম । কালের চক্রে বহুদিন কেটে
গিয়েছে । আমিও ফার্স্টক্লাশ নিয়ে পাশ করেছি এবং একটা কলেজে চাকরীও পেয়ে গেছি ।
কাকু কাকীমাকে খোঁজ করার চেষ্টা করেছিলাম অনেক । কিন্তু কাকু রিটায়ার করে কোথায়
চলে আছেন কেউ জানিনা । আর অরুণিমাকেও ওই হসপিটালে আর খুঁজে পাইনি ।
অরুণিমা
কোথায় তুই ? আর কি ফিরে আসবিনা ? আমার
স্মৃতির পাতায় তোর মুখ যে উজ্জ্বল । এখনও খুঁজে বেড়াই তোকে । ফিরে আয়... ফিরে আয় ।