কুকুর বেড়াল
দুচোখে দেখতে পারেন না সত্যবতী। ঠাকুমার আপত্তিতেই অর্ক কুকুর পুষতে পারছে না।
সত্যবতীর সাফ কথা, যদি বাড়িতে কোনদিন কুকুর ঢোকে তবে সেই মুহূর্তেই তিনি যেদিকে
দুচোখ যায় চলে যাবেন। সত্যবতীর কথার ওপরে এ বাড়িতে কারো কথা চলে না। বয়েস সত্তর
ছুঁইছুঁই। কিন্তু কে বলবে। চুলে সামান্য পাক ধরানো ছাড়া বয়েস তার শরীরে বিশেষ কোন
ছাপ ফেলতে পারেনি।
সত্যবতী রোজ
সকালে হাঁটতে বেরিয়ে পড়েন। এই হাউজিংটা বেশ নিরিবিলি। হাঁটার মত প্রচুর জায়গাও
আছে। আশেপাশের ফ্ল্যাটগুলো থেকে অনেকেই সকালবেলাতে হাটতে আসেন। তাঁদের সঙ্গে
দেখাসাক্ষাৎ, নানা সুখদুঃখের গল্প হয়। একটু এগোলেই বড় একটা ঝিল। সেখানে অনেক সাপলা
শালুক ফুটে থাকে, মাছ ঘাই মারে। খুব শান্ত স্নিগ্ধ চারপাশ। পরিষ্কার বাতাস। বুক
ভরে নিঃশ্বাস নিতে খুব ভালো লাগে।
অর্করও খুব
ভোরবেলাতেই ঘুম ভাঙ্গে। ঝিলের পাশের মাঠে সকাল বেলাতে আধঘণ্টার একটা ফুটবল
প্র্যাকটিস হয়। আরও অনেকে থাকে। কোন কোন দিন ঠাকুমার সঙ্গ ধরে অর্ক। তা ধরুক, তাতে
আপত্তি নেই। কিন্তু যত বিপদ তা ঐ কুকুর প্রেমের জন্যই। যত রাজ্যের কুকুরগুলো সব
অর্কর ভীষণ ন্যাওটা। রাস্তায় বেরোলেই ছুটে ছুটে আসবে। লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে গায়ে উঠতে
চাইবে। অর্কও সেরকম। পারলে পরেই মুখে মুখ লাগিয়ে ঘেয়ো কুকুরগুলোকে আদর করবে।
সত্যবতী দারুণ
অস্বস্তিতে পড়ে যান। হাতে একটা লাঠি অবশ্য তার সঙ্গী থাকে। না হাঁটতে কোন অসুবিধে নেই
তাঁর। কিন্তু লাঠি থাকলে দু’টো কাজ হয়। এক, কুকুর ঠেকানো । দুই, লাঠির বাঁকা অংশটা
দিয়ে রাস্তার বেওয়ারিশ গাছগুলো টেনে ধরে তার থেকে ফুল পাড়া। অর্ককে একটু তফাতে
চলতে হয়। কুকুরগুলোকে খাওয়াবে বলে পকেটে কিছু বিস্কুট নিয়ে বেরোয় সে। সব কটা
রাস্তার কুকুরের নাম সে জানে। অন্তত গোটা দশেক তো হবেই।
কিন্তু
ঠাকুমা কাছে থাকলে কুকুর ছোঁয়া বারণ। কোন ভাবে যদি কুকুর ছুঁয়ে ফেলে তবে স্নান না
করা পর্যন্ত সে ঠাকুমাকে আর ছুঁতে পারবে না।
লালি নামের
কুকুরটার বাচ্চা হয়েছে। দুটো বাচ্চা। দেখলেই বোঝা যায় লালির বাচ্চা। ঠিক লালির মতই
খয়েরি সাদা রঙ। একটা বাড়ি উঠছে ঝিলের ধারেই। তার নিচে শেডের তলায় বস্তার ওপরে বড়
হচ্ছে লালির সন্তানেরা। সবে চোখ ফুটছে। সকালবেলাতেই বাচ্চাগুলোর ঘুম ভেঙ্গে যায়।
অর্ক যখন ওদের কাছে আসে তখন দেখে দুটো বাচ্চাই চোখ বুজে একমনে মায়ের দুধ খেয়ে
চলেছে। লালি অর্ককে দেখে বাচ্চাগুলোকে ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত কুঁই কুঁই আওয়াজ
করে। অর্ক বিস্কুট খাওয়ায়, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। লালি শান্ত হয়ে যায়। আবার
গিয়ে বসে বাচ্চাদের কাছে।
সত্যবতী দূর
থেকে এসব কাণ্ডকারখানা দেখেন। কিন্তু অর্ক কাছে গেলেই খুব গম্ভীর হয়ে যান। কুকুর
নিয়ে কোন আলোচনাই করতে চান না।
এভাবেই বেশ
কাটলো কয়েকটা দিন।
কিন্তু সেদিন
ঝিলের ধারের সেই বহুতলের সামনে একটা জটলা। কি যেন একটা ঘটনা ঘটেছে! কাছে যেতেই, যে
বন্ধুগুলোর সঙ্গে সে ফুটবল খেলে তারা অর্ককে ছেকে ধরল। অর্কর কুকুর প্রীতির কথা তো
সবারই জানা। তারাই বিবরণ দিলো। খুব ভোরে বালির লরিটা ব্যাক করতে গিয়ে এসে পড়েছিল
লালির আশ্রয়স্থল সেই বস্তাটার ওপরে। বাচ্চা দুটোর একটা মুখে করে সরিয়ে দিয়ে
কোনরকমে বাঁচাতে পেরেছে লালি । কিন্তু তাকে আর তার অন্য বাচ্চাকে শেষ করে দিয়েছে
ঘাতক লরিটা।
কোথা থেকে
একটা ঠেলা গাড়ি যোগাড় হয়েছে। কিছুটা দূরে রেল লাইন। তার পাশে বিল আছে। সেই বিলের
পাশেই মাটি খুঁড়ে সবাই কুকুর বিড়ালের অন্তিম সৎকার করে।
অন্য
বাচ্চাটার কিন্তু কোন হেলদোল নেই। দিব্যি টালুমালু হাঁটছে। এত লোকজন একসঙ্গে দেখে
তার খুব আনন্দ। সবার কাছে ছুটে ছুটে যাচ্ছে। কিন্তু মাঝে মাঝে একটু অন্যমনস্ক হয়ে
যাচ্ছে। কুঁই কুঁই করে যেন কেঁদে নিচ্ছে খানিকটা। তারপর আবার হাঁটছে।
অর্কর চোখ
ফেটে জল এলো। ঠেলার মধ্যে বস্তা ঢাকা লালি আর মৃত বাচ্চার দেহ। লালির চোখ দুটো
খোলা। দাঁতের ফাঁক দিয়ে জিভটা যেন বেরিয়ে এসেছে শেষ জলতেষ্টায়।
বহুতলের
পাহারাদার ছেলেটা ঠেলা গাড়িটা নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সেই বিলের দিকে। ভিড়টাও
কমে গেলো। জীবিত বাচ্চাটা ঠেলার পেছন পেছন কিছুটা এগিয়ে গেলো। তারপর আবার ফিরে এলো
বস্তাটা যেখানে পাতা থাকত সেই আস্তানায়।
অর্ক কান্না
চেপে বিস্কুট বের করল পকেট থেকে। একটু একটু ভেঙ্গে বাচ্চাটার সামনে রাখল। বাচ্চাটা
শুঁকল, চাটল - কিন্তু খেলো না। অর্কর মুখের দিকে তাকিয়ে
আবার লেজ নাড়তে শুরু করল।
কখন যে
সত্যবতী অর্কর কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন- সে টেরও পায়নি। ঢোঁক গিলে সে বলেই ফেলল,
‘আ----- আমি
এটাকে পুষব।’
সত্যবতী
বললেন,
‘চেন দিয়ে
বেঁধে রাখতে হবে’।
অর্ক বলল,
‘রাখব।’
‘শ্যাম্পু
দিয়ে স্নান করাতে হবে।’
‘করাব’।
‘পটি করলে
পরিষ্কার করতে হবে’।
‘করব।’
‘ডগ ক্লিনিকে
নিয়মিত নিয়ে যেতে হবে’।
‘নিয়ে যাব।’
সত্যবতী কথা
না বাড়িয়ে বাড়ি ফিরে চললেন। মনটা বড় খারাপ লাগছে।
অর্ক
বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে লাফাতে লাফাতে ছুটল। তার মন খারাপের কালো মেঘটা এতক্ষণে কেটে
গেছে।