সেই বারান্দাটা দেখে মনে পড়ে গেলো । সেই যে বক্সার ফোর্টের ঝরোখা । অপূর্ব জালি কাজ পাথরের গায়ে । লতা পাতার সুক্ষ্ম ডিজাইন । ওমনিই যেন দেওয়ালের গায়ে
ঝুলে আছে । সাধারণ টুরিস্ট চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে চলে যায়। হয়তো ভাবে,এতে ঢোকবার রাস্তা কোন ভাবে ভেঙেচুরে
বন্ধ হয়ে গেছে, তাই দেখা যাচ্ছে না । আমি তলার ঘর গুলো দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছিলাম। এগুলো জেলখানার
ওপরতলার বড় বড়
ঘর । নীচে অজস্র গুমঘর,কয়েদখানা । তিনটে পরপর
ঘর পেরিয়ে একটা দেওয়ালের সামনে দাঁড়াতেই মনে পড়ে গেলো। দেওয়ালটা মনে হয় টানা, আসলে তা নয় । দুটো দেওয়াল যেখানে সমকোণ হয়ে মিশেছে সেখানে
ফাঁক আছে । সেই ফাঁকে সরু সিঁড়ি । গরম বিকেলে
ওই সিঁড়ি দিয়ে উঠে বারান্দায় দাঁড়ালে পুরো শহরটা দেখা যায় । ছায়ায় মিস্টি হাওয়া
আসে । কি ভাল লাগে-- মনে পড়ে গেলো ।
তুমি তাড়া দাও কত। ‘চল না ঘরে। কি দাঁড়িয়ে থাকো । সোনা, চলো না,চলো না’ । আমি কনুইয়ের গোঁত্তা মেরে বলি, ‘আরে দাঁড়ায়ো জি,এতো কি তাড়া ? কেবল আদর খাওয়ার ধান্দা, না? কি মিঠা হাওয়া । আ--হ-কি আরাম’ । তোমার
ঠোঁট ফোলে। গাল ফোলে। চোখ লাল হয়। চোখ ছলছল
দেখলে আমি নিচে ঘরের দিকে পালাই ঝুমঝুম করে। আহারে, বেচারাকে কষ্ট দিতে ভাল বাসি
না।একটু জ্বালাই।কিন্তু মন ভার হতে দেখলে আমার ও মন কেমন করে। হেসে ঘরের দিকে ছুট দিই দেওয়ালের পাশ দিয়ে একতলায় নেমে। পিছনে ছুঁড়ে দিয়ে যাই একরাশ কুলকুল হাসি। ‘পিয়ারে, দিল ভারি নহি করতে । মঁয় কোই
মিঠাই নহি হুঁ । ফুরিয়ে যাব না’। সব মনে পড়ে
গেলো। বারান্দার বাইরের দিকে পিঠ দিয়ে তুমি দাঁড়িয়েছ। পা দিয়ে
আমাকে আটকে রেখেছ সামনে।হাত দুটো আমার কোমরের নিচে বেড়,বারান্দার জাফরিতে ঢাকা আছে। বাইরে থেকে কেউ দেখলে তোমার
পিঠটাই দেখতে পাবে।বুঝতেই পারবেনা এতখানি গরম নিয়ে আমায় জড়িয়ে আছো। মনে পড়ে গেলো তোমার দ্রুত হওয়া নিঃশ্বাস । কানে শ্বাসের
আওয়াজ। ঠোঁটের ওপরে হাল্কা গোঁফের পাশে বিন্দু বিন্দু ঘামের রেখা।গলা দিয়ে গড়িয়ে
নামা ঘামের ফোঁটা বুকের মাঝ বরাবর । আর স্বচ্ছ হয়ে যাওয়া চোখের তারা । একটু একটু
করে গলে যাওয়া তুমি, কি সুন্দর ! চমকে চমকে
নেমে এলাম আজকের সময়ে ।
কোথায় আমি ?
এতো ভাঙাচোরা ফাঁকা হয়ে যাওয়া দুর্গ। এখানে
আমি তো রেশমি ঘাঘরার ওপর চোলি চাপিয়ে চুনরি উড়িয়ে আসিনি । পায়েল নেই পায়ে । স্নিকার্স পরে আছি । আর জিন্স । মাথায় টুপি । সঙ্গের দলবল অবাক হয়ে ডাকাডাকি করছে । ‘এই সোনিয়া, কোথায় উঠলি রে? ওখানে সাপখোপ থাকলে? সিঁড়ি ফিঁড়ি ভাঙা
কিনা দেখে আয়’ । নিচে নেমে এলাম।সবাই আশ্চর্য হয়ে
জিগেস করল, ‘আরে উঠলি কি করে? ওখানে রাস্তা
আছে যে ওই বারান্দাটাতে যাওয়ার তাই তো বোঝা যাচ্ছে না’! হুঁ হাঁ বলে কাটিয়ে বেরিয়ে এলাম ভিড়ের মধ্যে থেকে। এগিয়ে
গিয়ে দরবারের বড় মার্বেলের সিঁড়িতে বসলাম। কতদিনের পুরোনো হাওয়া এসে ফিসফিস করে বলতে থাকল," মনে আছে,সোনি? মনে আছে ? সেই যে----------"
বক্সা থেকে এলাহাবাদ চলে এসেছে কলেজি দলটা । বাস ভাড়া করা
হয়েছে বেনারস থেকে দিন কয়েক আগে । ইতিহাসের ছাত্র ছাত্রী এরা । কলকাতা থেকে এসেছে ।
গঙ্গার স্রোত ধরে এগিয়ে চলছে ট্যুর। বিভিন্ন দুর্গের ইতিহাসকে খুঁজে, ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা হচ্ছে । টিচার আর স্টুডেন্ট মিলে প্রায় তিরিশ জনের গ্রুপ । কলকাতা
থেকে দূরে বাবা মায়েদের ছাড়া এই প্রথম বেরোনো।খুব মজায় আছে সবাই। সোনিয়া দলের মধ্যে একটু কম কথা বলা, চুপচাপ মানুষ। বেশির ভাগ সময় জিন্স আর টি শার্ট পড়ে থাকে।
ছোট করে কাটা চুল।সাজগোজের ধার ধারে না খুব একটা।বন্ধুরা বলে ফোর্ট –পাগলা । দুর্গে
ঢোকার আগে থেকেই এত আল্লাদিত হয়, উৎসাহ দেখে প্রফেসাররা খুশি হয়ে
যান সেদিন বক্সা দুর্গের থেকে বেরিয়ে আসার পর থেকেই, আরো যেন চুপচাপ মেয়েটা।বন্ধুদের এটা ওটা কথায় ছোট ছোট উত্তর
আর হাল্কা হাসি
ভাসাচ্ছে । কিন্ত কোন কথোপকথনের ভিতরে ঢুকছে
না।কি যেন অন্যমনস্কতার কুয়াশায় আচ্ছন্ন। প্রয়াগ থেকে আবার বেনারসের দিকে যাচ্ছে বাস।বেনারস হিন্দু
য়ুনিভার্সিটির হষ্টেলে ডর্মিটারি বুক করা আছে । একটা দিন ওখানে থেকে, আবার আগ্রার দিকে রওনা । রাত নেমেছে । রাস্তায় ধাবার পাশে বাস দাঁড় করিয়েছেন
স্যাররা।রাতের খাওয়া দাওয়া সারা হবে।হাতে মুখে জল দিয়ে একটু ফ্রেস ও হয়ে নেবে ছেলে
মেয়েরা। সোনিয়া হাত ধুয়ে এসে একটা বেঞ্চির ধারে বসেছিল। মোবাইলটা
নাড়াচাড়া করতে করতে ভাবছিল বাড়িতে একটা ফোন করবে কিনা। মা বাবা শুয়ে পড়েছেন কি এত
ক্ষণে ? হঠাত সামনের বেঞ্চে চোখ পড়ল । একটি লোক খাচ্ছে বসে সেখানে । নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে গেল যেন।সোনি এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
পলকহীন । স্থির চোখ। তাকিয়ে রইল লোকটির কাঁচা পাকা দাড়িতে ঢাকা মুখের নিচের দিকে ।
পাকার ভাগই বেশি। হাল্কা হলদে ছাপ কিছু অংশে। গোঁফের রেখা মিলে মিশে গেছে দাড়ির সঙ্গে
। কিছু নেমে এসেছে ওপরের ঠোঁটে । সেই দিকে
তাকিয়েই তো মনে পড়ে গেলো ।
এমনি গোঁফের কিছু এলোমেলো চুল ওপরের পাতলা ঠোঁটে নেমে এলেই
আমার হাসি পেয়ে যায় । ইশ! কি বিচ্ছিরি রে বাবা । অস্বস্তি হয় না ? আমারই ত অস্বস্তি লাগে দেখে । তবে আগে দাড়িতে আরো রং ছিল বেশি।কমলা ঘেঁষা মেহেন্দি রং । চুলগুলো
লম্বা হয়ে প্রায় কাঁধের কাছে। নিচের দিকে চুলের ডগাগুলো কোঁকড়ানো । গোল হয়ে গুটিয়ে
থাকে । চোখে সূর্মা ছিল । গায়ে মলমলের পাতলা জামা।সাদা।কখনো হাল্কা
নীল।বুকের ওপর দিয়ে কোনাকুনি এনে পাশে রেশমের দড়ি দিয়ে বাঁধা । কোমরবন্ধ
ছিল।দরবারের পোষাকের মত জরি পাথর দেওয়া নয়।হাল্কা সুতির।ঢিলেঢালা । উঁচু পাঁচিলের পাশে দাঁড়িয়ে জিগেস করেছিল,
ঘর থেকে চলে গেলে যে?সবাই তো বসে
গান শুনছিল।
তো?
কাউকে তো বিরক্ত করিনি। খুব আস্তে আস্তে পিছন
দিয়ে বেরিয়ে এসেছি।
না,মানে,বেরিয়ে এলে কেনো?
তোমার কি ? তুমি কেন জিজ্ঞেস করতে এসেছ ?
আঃ,
বিরক্তির চাপা আওয়াজের সংগে ভুরু কোঁচকায়
লোকটি ।
সোজা প্রশ্নের সোজা উত্তর দিতে পারো না ?
না । পারি না । নীল রেশমের
ওড়নায় এবার ঢাকা পড়ে মাথা,মুখের এক পাশ ।
আর কিছু জিজ্ঞেস করার না থাকলে, আপনি আপনাদের গানের আসরের সুন্দরীদের কাছে ফিরে যেতে পারেন।
ভুরু কুঁচকে তাকিয়েই থাকে অন্য জন। যেন কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না । তারপর হঠাত কি মনে করে বলে, ‘সুন্দরী ? ওঃ,তা এ আসরে
সবারই তো চামড়ায় টান । খিটখিটে বুড়িদের সামিল’
এবার কুলকুল হাসি ফোয়ারার মত বেরিয়ে আসে বুকের মধ্যে থেকে।
চুনচুন আওয়াজ হয় সাচ্চা চাঁদির ঝিলিমিলি কাজ করা চুড়িতে। ঠোঁট কামড়ে হাসতে হাসতে ঝুঁকে পড়ে সোনি, ‘মিঁয়া সাব, ঠিক মত খিদমতগারি করে খুশি
রাখতে পারলে কোন মেয়েই খিটখিট করে না।এত বছরে এও যদি না শিখলে, তো শিখলে কি’ ? হাসির দমকে
লাল হয়ে যায় মুখ। সেই লালের আভা ছড়িয়ে পড়ে মিঁয়া
সাহেবের দাড়ির ওপরের ফাঁকা গালের চামড়ায়। ‘হুঁ, বদ বুদ্ধি বড় বেশি হয়েছে তোমার । তমিজ
বলে কোন জিনিস শিখে ছিলে কখনও’--- , মজার মুখভঙ্গীর সাথে ওড়না
সরে,
‘আজ্ঞে না,চুল তো আমার ও ওমনিই সাদা হল।
সে হতে এখন ও ঢের বাকি--- পাঁচিলের ওদিক থেকে দু তিনটি নারী কন্ঠের ডাক শোনা যায়,
আরে সোনিজি কা গইল বা...
চলে যাচ্ছি । তাড়াতাড়ি পা চালায় সোনি। দুপুরের গরমের ভাপ লেগে থাকে মেঝের
পাথরে সন্ধে বেলা অবধি। যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে আবার
নিঃশব্দে হাসে।
"কি হল?"
"ইশশ,দাড়ি না তো,যেন লোহার তার। হাতের এক টানে ডান
কাঁধ থেকে আঁচল সরে যায় । ধবধবে সাদা গায়ে লাল ছোপ ছোপ।
"দাড়ি কাটতে
পারো না মিঁয়া সাব? নয় তো সাঁওরিদের সংগে খাতিরদারি কর গিয়ে । তাদের চামড়ায় দাগ
ফুটে উঠবে না।
দৌড়ে চলে যাচ্ছিল লালচে পায়ের পাতা। গরম হাত ওড়নার এক
প্রান্ত ছুঁয়ে যায় । পিছনে ভারি হয়ে আসা গলা বলে -
তব তো নহী বোলা কি তকলীফ হুই। এবার নির্মল হাসি পিছনে ফেরে।
তকলীফ তব নহী হুয়া, ইয়ে বাদ মে
দিখাই দি। পাগল। ছোড়ো ভি,আমি খাবার সময় আসবো। ছম ছম পায়েল
ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে যায় অন্দরমহলের জাফরির দিকে।
----সেই ই তো। সেই
লোকটাই তো। বন্ধুরা পাশে চেয়ার টেনে কথা বলতে বলতে বসে।ধাবার টেবিলে
কনুই রেখে বসে থাকা সোনিয়াকে ধাক্কা মেরে বলে,
‘কি রে,আমরা টয়লেট ঘুরে এলাম, তুই হাঁ করে বসে কি ভাবছিস ? যা । বাস
বেশি ক্ষণ দাঁড়াবে না । টয়লেট সেরে, চটপট হাত মুখ ধুয়ে আয় । রুটি
তড়কা খেয়েই বেনারসের দিকে সোজা।
চমকে উঠে দাঁড়ায় সোনিয়া। ফিরে আসে নিজের মধ্যে। তারপর ব্যাকপ্যাকটা পিঠে নিয়ে ধাবার বাথরুমের দিকে যেতে
গিয়ে একবার ঘুরে তাকায় সামনের বেঞ্চটার দিকে। ফাঁকা। কেউ নেই। মাথার মধ্যেই শুধু ঝিলমিলি জাফরির ফাঁকে মশালের আলো, দরবারের ঝাড়ে হাজার মোমের গলে যাওয়া, সারেংগীতে মোচড় দেয়া ইমনের ঠুংরি,
- "কংকর মার জগায়ো রি, সাঁয়োরিয়া
ছোরা নে..." মনে মনে ভাবে,"
- আচ্ছা, সো দিস ইজ বিয়ার্ড বার্ন । সেদিন সবাই ইংলিশ নভেল পড়ে এত
মাথা ঘামাচ্ছিলাম ।
সোনিয়া গন্ধ পেলো। পুরোনো মাটিতে চাপা পড়ে থাকা জীবনের।
ভুলে ভুলে ফেলে আসা বাতি দানের,যার মধ্যে গন্ধ তেল ভরে ছিল রাতের
বিছানায় নেশা ধরানোর আশায়।কুলুঙ্গিতে পড়ে আছে। কাজল পড়ার রূপোর কাজ করা সূর্মা দান,মাটি চাপা পড়ে কালো ভুষূন্ডি।ওকে আজকের দিনের মানুষ চিনতে
পারবে না। এই বিজলি বাতির দিনে মশাল জ্বলা চোরা গলি দিয়ে ভালবাসার ঘরে পৌঁছাব কি
করে? বুক ভাংগা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জীন্স আর জামায় লেগে থাকা
খাবারের গুঁড়ো ঝেড়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়
মেয়েটা। বাস হর্ন দিচ্ছে। যেতে হবে।