গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৫

দেবাশিস কোনার / লোপামুদ্রা মুখার্জী

লম্বকর্ণ

         বেদনা প্রকাশের কোন ভাষা জানা ছিল না সুতনুর । খুব সহজেই সে মানুষকে বিশ্বাস করে ফেলে । এই কারনে সে জীবনে কম অপমানিত হয় নি । তবু সে কখনও মানুষকে বিশ্বাস না করে পারে নি । সুতনুর জীবনে প্রথম আঘাতটা এসেছিল একজনের কাছ থেকে । ওর নাম অভি । অভির বাবা মারা যাওয়ার পর বেচারা অসহায় হয়ে পরেছিল । হাতে কোন কাজ ছিল না । বাড়িতে মা অসুস্থ । ভাইটা তখনও লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত । হটাত একটা ম্যানি মার্কেট কোম্পানিতে যোগ দিয়েছিল অভি । একে বেকারত্বের চরম জ্বালা - যন্ত্রণা আবার তার ওপর সংসারে অভাব অনটন ।অভি তাই ওদের ফাঁদে পা দেয় ।
        
         সুতনুকে এসে তার সমস্যার কথা অকপটে বলে । অভি তার বন্ধু । তার ওপর অভাবের জ্বালায় জ্বলছে , তাই দাদা অতনুকে ধরে ওকে একটা কেশ করিয়ে দেয় । দিলি তো দিলি বেশ করলি । সেই কোম্পানি এখন লাটে উঠে গেছে ।কিন্তু অভি আরও যেটা করল , সেটা হল তাকেও ওই পাঁকে নামাল । এখন সেই সব টাকা জলে ।
     
         মাঝে মাঝেই কাস্টমারদের জঘন্য অপমানে সুতনুর বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই শেষ হয়ে যায় । মনে হয় আর বেঁচে থাকার কোন অধিকারই তার নেই । আত্মহত্যাই তার শেষ অস্ত্র । অভি এখন ক্যুরিয়ার সার্ভিসে কাজ করছে । তাকেই বা কি বলবে সুতনু ?
      
         এইরকম সময়ে হানাই ভাই এল তার জীবনে । শুধু একটা প্লান ! একটা প্লান যে তাকে এমন বদলে দিতে পারে তা ভাবতেই পারে নি সুতনু । অথচ এই হানাইকে সে কখনও , তার কাছের বন্ধু বলে স্বীকারই করেনি সে । আগে থেকেই নেট মার্কেটিঙের
অভিজ্ঞতা ছিল তার । সেই সুযোগ কাজে এল । যারা তার মাধ্যমে আগের কোম্পানিতে টাকা রেখেছিল তাদের কাছে শুধু এক বছরের সময় চেয়ে নিল সুতনু ।
     
         তারপর সবটাই ইতিহাস । আজ হানাই তার বস । তার জীবনে আশার আলো ফুটিয়েছিল যে বন্ধু । একই পাড়ায় থাকার সুবাদে হানাই জানত সুতনুর বিপদের কথা । হানাই 'ফর ইউ' তে জয়েন করে বসেছিল বহুদিন । এক সন্ধ্যায় চায়ের দোকানে সুতনুকে দেখে সে প্লানটা বলল । শুনে সুতনু অবাক । এত ভাল একটা প্লান । যেখানে কলার ধরে কেউ বলবে না টাকা ফেরত দেবার কথা । আধুনিক প্রযুক্তি । সরকারকে ট্যাক্স দিয়ে স্বচ্ছ পথে উপার্জনের এত ভাল পথ আর কি হতে পারে ?
          সুতনু এখন বিপদসীমার বাইরে ।


লোপামুদ্রা মুখার্জী

রংনাম্বার

একলা দুপুর। মধুছন্দা সবে স্কুল থেকে এসে ছোট্ট প্রেসার কুকারে খিচুরি চাপিয়ে দিয়ে স্নান করে খাটে এসে বসেছে। তাঁকে একটা মোটোরোলার সেট দিয়েছে সন্দীপ, তাঁর হবু বর। সেখানথেকে রোজ সে ভুলভাল দশটা নাম্বারে ডায়াল করে বিভিন্ন অজানা লোকের কন্ঠস্বর শোনে।পরে সে ওই নাম্বারগুলো থেকে ফোন এলে ডিলিট করে দেয়। এটা একটা মজা তাঁর নিঃসঙ্গ সময় কাটানোর। আজও একটা রং নাম্বারে ফোন করল। ওপার থেকে এক পুরুষকণ্ঠ। -হ্যালো.. মধুছন্দা মুচকি হেসে বলল, দুর বাবা হ্যালো আবার কে?বলতে পারেন না হ্যালো ম্যাম ওপাশ থেকে পুরুষালী গলা বলল, বলুন ম্যাম! মধুছন্দা আরেকটু মজা করে বলল, অত রেগে কেন? বলুন না ম্যাআ্যম পুরুষকন্ঠ একটু হেসে, বলুন ম্যাম। মধুছন্দা চুপ। পুরুষকন্ঠ, হ্যালো..হ্যালো..হ্যালো মধুছন্দা এবার বলল, আচ্ছা আমি পরেই হেলা হেলি না হয় করি, আগে খেয়ে নি। পুরুষটি বলল, আচ্ছা খেয়ে নিন, পরে কথা হবে। তারপর মধুছন্দা তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে আবার খাটে এসে বসল। কেন জানিনা এই ফোনটা তাঁকে আবার মনের তারে টান দেয়। মনে মনে ভাবে আজো যদি ওপার থেকে ফোন আসে! তখন সন্ধ্যে ৭.৩০ ওপার থেকে ফোন এলো। -ম্যাডাম কেমন আছেন? মধুছন্দার সাদা উত্তর, ভালো -কতটা ভালো? -বেশ ভালো। -নাম কি, কোথায় থাকা হয়? মধুছন্দা অদ্ভুত মন্ত্রমুগ্ধের মত সবই বলে দিল। - আপনি?’ সে বলল আসানসোল। কাজ করে টেলিফোন এক্সচেঞ্জে। নাম পার্থ। -রাত্রে কি করেন আপনি, ফোন করতে পারি? -হ্যাঁ, করবেন।
প্রথমদিন থেকে তাঁরা বাসর জাগতে শুরু করল। বিভিন্ন কথা। মধুছন্দার রেজিস্ট্রী হয়ে গেছে। বিয়ে হবে ডিসেম্বরে। সে একলা থাকে। একটা স্কুলে কাজ করে। তার টেলিফোনেই মজা। তবু কেন যে তোমার ফোনে বারবার সাড়া দিই, কে জানে। কীসের টানে? তোমার গলায় কি যাদু আছে কী জানি। -এই শোন, কোনদিন আমরা একসাথে দেখা করবো না। এই ফোনালি বন্ধু আছি ঠিক আছি। এর থেকে বেশি কিছু নয় কিন্তু। রাতের পর রাত কেটে যায়। ফোনের পর ফোন আসে।বার্তা নিকট থেকে নিকটে আসে।সব বাঁধন ছিঁড়ে একদিন পার্থ তার সাথে দেখা করতে চাইল।বর্ধমানের কদমতলায়। মধুছন্দা এখানেও কেন জানি রাজি হয়ে গেল।
ওরা কদমতলা থেকে এক মন্দির চত্বরে এসে বসল। পার্থ মধুছন্দার হাতে হাত দিয়ে বলল, মধু আমি তোমাকে প্রথম দেখেই পাগল হয়ে গেছি। আমি চাই তোমাকে নিয়ে হারাতে, অনেক দূরে সুদূরে। মধুছন্দা করুণ দৃষ্টিতে বলল, আমি হারাতে পারিনা। উড়তেও পারি না। আমার রেজিস্ট্রী হয়ে গেছে। আমি একজনের ভাবী স্ত্রী। তোমাকে ফোনে বলেছিলাম তবু তুমি দেখা করলে একটা রংনাম্বার, রং রুটে। দুজনকেই একে অপরকে ভুলতে হবে। সেদিন এক পশলা বৃষ্টি হয়েছিল তবে আরো বেশি পড়ল দুজনের মধ্যে। মধুছন্দার চোখ ঝাপসা, পার্থেরও হয়ত। পার্থ মধুছন্দার হাত ধরে কিছুক্ষণ বসল। একে অপরের দিকে তাকাতে পারল না। পার্থ বলল ভারী গলায়, তোমার সাথে দেখা হল কেন তাহলে। কিসের জন্য রংনাম্বার। কি পেলাম। আলতো করে হাতের উপর একটা চুম্বন দিয়ে পার্থ আর দাঁড়াল না। মধুছন্দা দেখল তাঁর ঝাপসা দৃষ্টিতে পার্থ জলছবি হয়ে গেল। রেললাইন পেরিয়ে প্লাটফর্ম ধরে হারিয়ে গেল রংনাম্বারের মতো মধুছন্দার কাছে। আর কোন ফোন আসেনি অনেকদিন। অনেকক্ষণ মোটোরোলার দিকে তাকিয়ে থাকত শুধু একটা ফোন আসুক, শুধু গলাটা শুনে রেখে দেবো। তবু এলো না সেই রংনাম্বার।