গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৫

মুস্তাইন সুজাত

পোষা ময়নাটা মুখ ফিরিয়ে নেয়, অভিমানে নাকি ঘৃণায়


আজ কিচ্ছুভাল লাগছেনা অনন্তের । এমনকি পড়াশুনা করতেও ইচ্ছে করছে না । মনটা তার ভীষণ খারাপ ।আর হবেই না বা কেন? সেই সাত সকালে মার ডাকে ঘুম ভাঙে,তারপর চোখ কচলাতে কচলাতে বাজারে যাও ।ঘরে যে এক চিমটি চিনি নেই, সে কথাটা গতদিন বললেই পারতো? মা এমনই। সময়ে কোন কিছুরই খেয়াল থাকে না ।তার উপর সারারাত ঘুমায়নি সে ।কম্পিউটারে গেইমস খেলেছে । মাসখানেক ধরে এক বদঅভ্যাস হয়েছে । রাত জেগে গেইমস খেলা । অবশ্য রাত জাগতে বেশ লাগে ইদানিং । সবাই ঘুমিয়ে পড়লে নিস্তব্দ চারদিক, শুধু রাস্তার কুকুরগুলো ডেকে উঠে হঠাৎ হঠাৎ আর এলাকার বয়স্ক পাহারাদারফজরালি দাদুরমৃদু হাঁকডাক । তাছাড়া রাত না জেগে কোন উপায় আছে? ঘুম নামক বস্তুটি যে তার ধারে কাছেই ঘেঁষতে চায় না আজকাল। তাও ভোর রাতের দিকেঘুম একটু ছোঁয়া দেয় কিন্তু মার ডাকে প্রায়ই উঠে যেতে হয় । এই যেমন আজকেও !
সদ্য কৈশোরে পা দেয়া এক টগবগেদুরন্ত বালক অনন্ত চৌধুরী । ক্লাস টেন এর ছাত্র । বাবা নাদের চৌধুরীএকজন উচ্চ পদস্ত সরকারী কর্মকর্তা । মা-বাবা আর বছর পাঁচেকের বোন তন্বী, এই চারে মিলে তাদের ছোট্ট পরিবার । তন্বীটা খুব মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে, কেবল সারাক্ষণ কথা বলে । তন্বী যখন কথা বলে তখন মুখে যেন খই ফুটে । বাবা এ বছরই স্কুলে ভর্তি করে দিতে চেয়েছিলেন, তন্বীও এক পায়েখাড়া স্কুলে যাবার জন্য ! কিন্তু মার ইচ্ছা এবছর নয়, আগামী বছর । তাছাড়া ওরতো এখনো স্কুলে যাবার বয়সই হয়নি!গুটিগুটি পায়ে বাড়িময় ঘুরাফেরা করার বয়স ।এটা ওটা ভেঙে সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখার বয়স !
বাড়ি বলতে সামনে বিশাল উঠোন, বিরাট বিরাটপুকুর, অনেক অনেক গাছপালার ছড়াছড়ি কিংবা ফসলের খেত চারপাশে এমনটা নয়, তিন তলা বিল্ডিঙেরনিচ তলায় চার কামরার একটা ফ্ল্যাট ।তবে ফ্ল্যাটটা বেশ বড় । মার পছন্দ ছিল দোতলাটা কিন্তু বাবা আর অনন্ত নিচ তলায় ফ্ল্যাটই নেবে । বাবার মুখে ফেলে আসা গ্রামের বাড়ির কথা শুনতে শুনতে অনন্ত এ বাড়িকেই নিয়ে যায় কল্পনায়, সাজায় নিজের মত করে । বাবা অবশ্য বারান্দা আর ছাদে নানান রকম ফুল ফলের গাছ লাগিয়েছেন । মাঝে মাঝে এতে গ্রাম্য একটা শোভা পাওয়া যায় । বিশেষ করে শীতের সকালে শিশিরের দানাগুলো যখন সবুজ কচি পাতাদের উপর জমে থাকে আর সূর্যের মায়াবী আলো পড়ে চিক চিক করে তখন । তাছাড়া প্রতিদিন সকালে কাকেদের কর্কশ ডাক, দু’একটা চড়ুই-শালিকের পাখা ঝাপটানো কাঁচের জানালায়, মন্দ লাগে না ।
বাড়িতে অনন্তইতন্বীর একমাত্র খেলার সাথী । তার যত সুখদুঃখ সব অনন্তের কানে ঢালে । মা কখন বকেছে, কেন বকেছে, কেন মেরেছে সব কিছু অনন্তকে বলা চাই । বোনের দুঃখে সেও সমান দুঃখী হয় । অবসরে সে তন্বীকে নিয়েই মজে থাকে ।বোনের দুঃখের কথা শুনতে শুনতে মার উপর মাঝে মাঝে রাগ হয়, অভিমান হয় । মাকে অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করে । রাগ চলে গেলে নিজের মনে ভাবে, ধুর !মাকে কিছু বলা যায় নাকি ? স্কুলের টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে অনন্ত বোনের জন্য লজেন্স, চিপস নিয়ে আসে । অনন্ত যতক্ষণ স্কুলে থাকে তন্বী থাকে উদাস,জানালা দিয়ে কিছুক্ষণ পরপর তাকায় পথের দিকে । দাদাভাই কখন আসে এই তারচিন্তা ।ও হ্যাঁ, তন্বী অবশ্য অনন্তকে দাদাভাই বলে ডাকে ।
মার ডাকে ঘুম থেকে উঠে বাজারে যায় অনন্ত । বাজার থেকে এসে মুখ-হাত ধুয়ে পড়তে বসেছে। কিন্তু পড়ায় মন বসাতে পারছে না ঠিকমত । কেন জানি মনটা উসখুস করছে । মাওদিকে সকাল থেকে নাস্তা তৈরিতে ব্যস্ত । বাবার অফিস, তার মর্নিং স্কুল । কিছুক্ষণের মাঝেই বাবা বেরিয়ে যাবেন । তারপর অনন্ত যাবে স্কুলে । বাবা বেড়িয়ে যেতেই মা তাড়া লাগাবে অনন্তকে । স্কুলের পোশাক পড়ে নাস্তা খাওয়া ঝটপট । কাঁধে বইয়ের ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলের পথে । আর তন্বী মায়ের আচল ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে যতক্ষণ না দাদাভাই অদৃশ্য হয়। এটা প্রতিদিনকার চিত্র ।
বেশ কিছুদিন হল অনন্ত আর স্কুল ভ্যানে যাচ্ছে না । ছোটদের মত ভ্যান গাড়িতে গাদাগাদি করে যেতে তার ভালো লাগে নাএকদম । সে এখন বেশ বড় হয়েছে । সে একা একা স্কুলে যেতে পারে । পাবলিক বাসে ঠেলাঠেলি করে উঠতে পারে । বন্ধুদেরসাথে গল্প করতে করতে যেতে পারে ।
বিকেল হতেই তন্বী ঘড়ির দিকে তাকায়,বারবার । সে এখন কাঁটা-ঘড়ি দেখে সময় বলে দিতে পারে । দাদাভাই-ই তাকে শিখিয়েছে । অবশ্য বড়দের মত একবার দেখেই চট করে বলে দিতে পারে না । অনেকটা সময় নিয়ে আঙ্গুলে গুনে গুনেবের করতে হয় সময় । তারপর বলতে হয় । তন্বী দেখলো ঘড়িতে এখন প্রায় চারটা তিরিশ বাজে । প্রতিদিন এই সময়েইদাদাভাই আসে স্কুল থেকে । জানালা দিয়ে সে বার বার বাইরে তাকাচ্ছে ।একটু পরপর বারান্দার গ্রিল ধরে উঁকি দিয়ে দেখছে দাদাভাই আসছে কিনা। নাহ, এখনো তো ফিরছে না। মাকে জিজ্ঞেস করল বার কয়েক। মা যেন কোন পাত্তাই দিচ্ছে না তার কথায়! মা ঘরে কি কাজে যে এত ব্যস্ত থাকে, তন্বী কিছুতেই বুঝে না ।
দাদাভাই ফিরলে এটা বলবেই আজ। আরও বলবে মাকে যেন আচ্ছা করে বকে দেয় । মন গম্ভীর তার । এছাড়া আর কি ই বা করার আছে তার ?একেতো বাইরে একা একা যাওয়া বারন, তার উপর কোন কাজও নেই । মাঝে মাঝে তন্বী টেলিভিশন দেখে কিন্তু একা একা দেখতে আর কতক্ষণ ভালোলাগে ? দাদাভাই থাকলে টেলিভিশন দেখতে অনেক মজা । যে জিনিসটা সে বুঝতে পারে না, দাদাভাই সেটা বুঝিয়ে দেয় । তখন তন্বী বুঝে যায় খুব সহজে ।
তন্বীর দাদাভাই যে ময়না পাখিটা পোষে,বারান্দায় দোলানোবাঁশের খাঁচায় ওটা । অনেকক্ষণথেকেই ডানা ঝাপটাচ্ছে। মা খাবার দিয়ে গেছেসেই সকালে, এখনো পড়ে আছে অর্ধেক । তন্বীর যখন খুব মন খারাপ হয়, খাঁচাটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় । ময়নাটাতন্বীকে দেখে; তন্বীওময়নাটাকে । একজন আরেকজনকে এমন ভাবে দেখে যেন দুজনের বন্দিত্বে দুজন বেশ মজা পায় । ময়নাটা খাঁচায় বন্দী আর তন্বী পুরু বাড়িতে বন্দী !
অন্যদিন তাকে দেখে ময়নাযেমনটা শান্ত হয়ে যায় আজ ঠিক তার উল্টো । ডানা ঝাপটানো আরও বেড়ে যায় । খাঁচার এপাশ ওপাশ করতে করতে মিহিসুরে চিঁচিঁশব্দে চেঁচাতে থাকে । ময়নাটা এখনো কথা বলা শিখেনি । ওটা কি যে বলতে চায় তন্বী বুঝতে পারে না । দাদাভাই থাকলে অবশ্য এমন সময় খাঁচা খুলে ময়নাটাকে বাইরে ছেড়ে দেয় । দাদাভাই যখন হাতে নেয় ময়নাটাকে, তখন ঠোঁট দিয়ে মাঝে মাঝে দাদাভাইয়ের আঙ্গুল চেপে ধরে, কামড় বসাতে চায় । তন্বী তখন কি যে ভয় পায় ! দাদাভাই ভয় পায় না । এই পাখিটাকে দূর থেকে দেখতেই তার ভালোলাগে । দাদাভাই পাশে থাকলে অবশ্য অন্য কথা ! আজ তন্বী আস্তে করে সরে আসে খাঁচার কাছ থেকে ।
সন্ধ্যা হতে দেরি নেই খুব একটা । চারদিকের প্রকৃতি কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে আসছে । রোদেরা কেমন যেন হালকা হতে হতে মিলিয়ে যায় আকাশেআর পুব দিকে ফ্যাকাশে চাঁদটা অনেকটা উপরে উঠে আসে দক্ষিণে হেলে । ময়নাটার ডানা ঝাপটানো এখন আর বুঝা যাচ্ছে না, হয়তো ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে ।মা এখন রান্না ঘরে ।
সময় কাটে একটু একটু করে আর মায়ের উদ্বিগ্নতা বাড়ে এর সাথে সমানে । অনন্ত তো এখনো বাসায় ফিরেনি । বাবাও অফিসে । মা ফোনে বাবার সাথে কথা বলে। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় স্বজনদের বাসায় খবর নেয়। কোথাও যায়নি অনন্ত । তাহলে গেলো কোথায় ছেলেটা ? এমন তো কখনো হয়নি ? অনন্ত তো মাকে না বলে কোথাও যাবার ছেলে নয়, তাহলে ?
আঁধারআজ হুট করেই যেন গ্রাস করছে পৃথিবীকে । এই আঁধারের সাথে তাল রেখে যেন দেশের সার্বিক অবস্থা এগিয়ে যাচ্ছে এক মহাসঙ্কটের গহীনে । রাষ্ট্রীয় উন্মত্ততা, ক্ষমতার নগ্ন অভিলিপ্সা ছড়ানো চারদিকে । দুর্বিষহ যন্ত্রনাকাতর ধ্বংসাত্মক পরিণতির মুখে দাঁড়িয়ে সাধারণের জীবন-প্রান ওষ্ঠাগত । মানবতা যেন ঝরছে রক্তপুঁজ হয়ে রাষ্ট্রের গা থেকে । সার্বিক মূল্যবোধ পচনের তীব্র গন্ধ নাকে লাগে মিডিয়ার কল্যানে । কি প্রিন্ট জগত, কি ভার্চুয়াল জগত সবখানে একই অবস্থার সাতকাহন । নিজেদের অহমিকা আর লাম্পট্যের দর কষাকষি যেন চলছে সজ্ঞানে । টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলখুললেই কেবল ক্লেদাক্ত রাজনৈতিকবিষ্ঠার ছুড়াছুড়ি ।
পথে পথে হত্যাযজ্ঞ আর একাত্তরের প্রেতাত্মাদের প্রকাশ্যউল্লম্ফন ।নববধুর শঙ্কা, হায় বুঝি দিনান্তে স্বামী ফিরলো না ঘরে । মায়ের শঙ্কা, এই বুঝি সন্তানের স্কুল বাসে আগুনশিখারা নৃত্য করে উঠলো । বাবার চিন্তা, রাতে বাসায় ফিরতে পারবো তো ! শংকা-চিন্তা-হাহাকার আর দুঃস্বপ্নের ঘোরে কাটছে মানুষের দিনরাত । এবেলার চিন্তা ওবেলা বেঁচে থাকবো তো !ঠিক তেমনি একটা ক্রম চলমান অতিবাহিত সময়ে, সন্ধ্যার প্রাক্কালে অনন্তের মায়ের মনে দেখা দেয় নানান আতঙ্ক । উদ্বিগ্ন মা শংকিত হয়ে উঠে ছেলে যে এখনো ফেরেনি ঘরে । বাবার চাহনিতে উৎকণ্ঠা, কণ্ঠে ভীতি জড়ানো কম্পন ।
অনন্তের মামা কাকারা সবাই ড্রয়িং রোমে জড়ো হয়েছে। রাস্তায় যাত্রী বোঝাই বাসে আগুনের তাণ্ডবতা দেখাচ্ছে টেলিভিশনের পর্দায় একটু পরপর । পুড়ে যাওয়া মানুষদের চিৎকারে নিরাকার খোদার আসনও টলে উঠে বুঝি, শুধু টলে না অমানুষদের মন । দমে না পশুদের হিংস্রতা । এই বুঝি অনন্তের পুড়া মুখ দেখালো, এই বুঝি অনন্তের ঝলসানো শরীরটা ভেসে উঠলো পর্দায়, এমনই একটা ঘোর লাগা শঙ্কা মায়ের মনে ।
যারা অনন্তকে খুঁজতে বেরিয়েছে তারা এখনো ফিরেনি । বিমর্ষ বাবা আর মায়ের চোখে পুত্র শোকের পানি । আর তন্বী, সেতো অনেকটা পাথরের মত নিশ্চুপ । এমনই এক শোকাবহ গম্ভীর পরিবেশে টেবিলের উপর রাখা সেল ফোনটা বেজে উঠে হঠাৎ । ওপাশে অনন্তের চাচাতো ভাইয়ের গলায় বিষাদের খাদ ।
“কাক্কু, একটুতাড়াতাড়িচলেএসো ঢাকা মেডিকেলে । কাউকে কিচ্ছু বলার দরকার নেই এখন ।”
“কোনসিরিয়াসকিছুবাবা, আমাকেখুলেবল ?”
“নাকাক্কু, তেমন চিন্তার কিছু না ।”কেমনযেনকাঁপনধরাকণ্ঠ।
“তবে...।”
“তবেকি? থামলি কেন ? বল, বল বাবা আমাকে ?”
“আজকেরযেবাসটাপুড়েছেওটায়...”
কথা আর এগোয় না । দু’পাশে যেন নামে হিম নীরবতা । ওপাশে ফুফিয়ে ফুফিয়ে কান্নার শব্দ আর এপাশে ? নিশ্চুপবাবা । তিনিভেঙ্গে পড়েননা । তার এখন অনেক কাজ, সবাইকে সামলাতে হবে ।হাসপাতাল যেতে হবে । ছেলের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে ।
তন্বীমাকে আর জ্বালাতনকরেনা । দাদাভাইয়ের কথাওজিজ্ঞেস করে না একদম । জানে সে কথায় মার চোখ ভিজে উঠে, আঁচলে মুখ লুকান । আর বাবার ছলছল চোখে নামেনীরব ধারায়অশ্রুরা ।
আর পোষা ময়নাটা ? সেও মুখ ফিরিয়ে নেয়, অভিমানে নাকি ঘৃণায়!