গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৫

মৌ দাশগুপ্তা

ইন্দ্রিয়

চোখ
তের পর রাত চোখের পাতা এক করতে পারেনা সুমি।চোখ বুঁজলেই মেয়েটার নরপশুতে খোবলানো শরীর, ক্ষত বিক্ষত মুখ বুক, খোলা মৃতচোখে রাজ্যের বিভীষিকা আর আতংক। সুমির দম বন্ধ হয়ে আসে। রাগে ক্ষোভে অসহায়তায় গায়ে আগুন লাগিয়ে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যেতে ইচ্ছে করে ওর। পারে না সুমির বাপ আর ওদের আরো দু সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে। মনের আগুন তুষানল হয়ে দিনরাত জ্বলে আর জ্বালায়। কটা আর মদনা। নামদুটো ইষ্টদেবতার থেকেও বেশীবার করে মনে পড়ে। স্রেফ প্রমানের অভাবে ওরা আইনের কাছে ছাড়া পেয়ে গেছে কিন্তু মায়ের মনের আদালতে ওদের শাস্তি মৃত্যুদন্ড।
এরপর এভাবেই কেটে গেছে আরো অনেকগুলো দিন,মাসের পর মাস,ঘুরে গেছে চার চারটে বছর।কটা মদনার স্বভাব পাল্টায়নি মোটেও।বরঞ্চ অপরাধের মাত্রা তথাকথিত মামা দাদাদের ছত্রছায়ায় আরো বিকশিত হয়েছে,সূক্ষ্মতর হয়েছে। হয়ত সুমির বুকের তূষের আগুন স্তিমিত হয়েছে কিন্তু নেভেনি মোটেও। তাই খবরের কাগজে যেদিন কটা মদনা আর ওদের দুই সংগীকে পুলিশ এক নাবালিকাকে ধর্ষণ ও খুনের দায়ে গ্রেফতার করেছে খবরটা পড়েছে সেদিন থেকে সুমি আবার ন্যায়বিচারের আশায় বুক বেঁধেছে।এবার মেয়েটার লাশ বয়ে নিয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলা অব্ধি ঘটনার এক সাক্ষী আছে যে।
নিম্ন আদালতে যেদিন রায় ঘোষণা হল সেদিন অনেকদিন পরে টিভির স্ক্রিনে চোখ ছিল সুমির. টিভিতে সাংবাদিক সাক্ষ্য দেওয়া শপিংমলের নাইটগার্ড ছেলেটির বাইট নিচ্ছে। চারবছর পরেও যে মুখ চিনতে একটুও ভুল হয়নি সুমির... আকাশভাংগা ঘুম তাই সুমির চোখে।আজ স্বপ্নে মনি নেই, আজ স্বপ্নে সেই অল্পবয়সী ছেলেটার রক্তাক্তমুখ, সাইকেল এক্সিডেন্টে যার দুটো চোখ নষ্ট হয়ে গেছিল বলে মনির চোখদুটো বসানো হয়েছিল।

কানে শোনা
ঠাকুমা ঠিকই বলে..সোনুদের এখন সময়টাই খারাপ যাচ্ছে।প্রথমে হটাত করে দুদিনের জ্বরে দাদুমনি চোখ বুজলো.।সংসারের একমাত্র রোজগেরে কাকাইয়ের কাজটাও চলে গেল। বাড়ীর বড়দের হা হুতোশি শুনে সোনু টুনু ভাইবোনেরও মুখ শুকিয়ে আমসি।এর মধ্যে বিপদের ওপর বিপদ।ওদের বাড়ীর একতলাটা জুড়ে লাখোটিয়া ব্রাদার্সের জুয়েলারি শপ,কথা নেই বার্তা নেই সেখানে দোকানের শাটার ভেঙ্গে ডাকাতি।যা কিনা কস্মিনকালেও এপাড়ায় হয়নি। তাও শুধু ডাকাতি হলেও চলত , ডাকাতি করার সময় বাঁধা দেওয়ায় দোকানের রাতপ্রহরী সোনুটুনুদের পচাকাকূকেও খুন করে ফেলে রেখে গেছে।
পাড়া জুড়ে হৈচৈ,থানা পুলিশ ,টিভি খবরের কাগজের লোকজন,পাড়াপ্রতিবেশী,চেনাঅচেনা কত মুখ ! খেলা বন্ধ ..স্কুল বন্ধ..ঘরের বাইরে যাওয়া বন্ধ! হাওয়ায় শতেক গুজব হাজার রটনা।.যদিও সুরাহা কিছুই হলনা,তবে যতই পৌষের রাতের ঘটনা হোকনা কেন. ওপরের তলায় থেকেও নীচের তলায় এতবড় কর্মকান্ড বিন্দুমাত্র টের না পাওয়াটা কেউই বিশ্বাস করতে পারছিলনা। সন্দেহভাজনের তালিকায় থাকা পরিবারের ওপর দিয়ে তাই ঝড়ঝাপ্টাও কম গেলনা। শেষমেষ পুলিশও হাল ছেড়ে দিল। লাখোটিয়ারা সোনার দোকান তুলে নিয়ে গেল অন্যত্র।একতলায় ব্যাঙ্কলোন নিয়ে প্রেস খুলে বসল সোনুর কাকাই। খালি এই বছরখানেক সময়ের মধ্যেই কেমন যেন পাল্টে গেল সোনু টুনুর দুনিয়া। ওরা কিছু দেখেনি সেদিন, কিন্তু নিজেদের কানে শুনেছিল রাতে সদর দরজায় পরপর তিনটে টোকার আওয়াজ। ওদের ঘরের ঠিকপাশেই কাকাইয়ের ঘরের দরজা খোলার মৃদু ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ,সদর খোলার শব্দ, অনেক লোকের ফিসফিস কথা,.একটা মুখচাপা আর্তচিতকার থেকে কাকাইয়ের সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে ফিরে আসার শব্দ। কানে শোনা শব্দেরা পরের দিন গোটা কাহিনী মেলে ধরেছিল ওদের মনের সামনে, যাকে বলে কিনা কানে শোনা সত্যিকারের রহস্য কাহিনী!!

ঘ্রাণ
কদিন ধরেই শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা তুলসীর।.ক্লান্ত লাগছে খুব। পেটে একটা চাপ চাপ যন্ত্রণা। জোরে শ্বাস নিলেও খচখচ করে লাগছে। ডাক্তারের কাছে যেতেই হবে মনে হচ্ছে। এমনিতে তুলসী খুব স্বাস্থ্যসচেতন, শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে অসুখবিসুখও বিশেষ হয়না তাই ডাক্তার বদ্যির সাথে বিশেষ সদ্ভাবও নেই,কিন্তু এবার ব্যাপারটা অন্যরকম লাগছে।
বিশেষত এই গন্ধটা! কেমন ওষুধ ওষুধ, চামড়া পোড়া,মশাতাড়ানোর ধুপপোড়ার গন্ধ মিশানো আজব একটা গন্ধ। সারা ঘরে,সব খাবারে, এমনকি মনে হয় নিজের সারা ঘায়ে গন্ধটা ছেয়ে গেছে। নাকি ওর নাকেই গন্ধটা পাকাপাকি ভাবে বাসা বেঁধেছে? ঘরে অন্য কেউ কিন্তু গন্ধটা পায়না।ওর বর শিমুল, মেয়ে শিউলি, ছেলে মন্দার, কেউনা।উল্টে ওকেই খেপায় গন্ধবাতিক হয়েছে বলে।
পেটব্যাথাটা বাড়তে বাড়তে অসহণীয় হয়ে উঠতে ডাক্তারের কাছে গেল তুলসী। পারিবারিক ডাক্তার ভালো করে দেখে গম্ভীরমুখে মাথাটাথা নেড়ে একগাদা টেস্ট করতে দিলেন। তারমধ্যে একটা খট করে কিনে বাজলো..."বায়োপ্সি"'.,আড়চোখে নজরে পড়ল একনিমেষে শিমুলের মুখও শুকিয়ে আমসি।
দোতলায় বেডরুমে শুয়ে শিমুলের অপেক্ষায় তুলসী,আজ মেডিকেল টেস্টের রিপোর্ট আসবে।নীচে মৃদুশব্দে ইনোভাটা এসে দাঁড়ালো। ড্রয়িংরুমে টিভি চলছেনা। শিউলি দরজা খুলে দিল বোধহয়,সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে চেনা পায়ের আওয়াজ, ক্লান্ত অথচ সাবধানি। ঘুমের ভান করে ব্যাথা চাপতে চাপতে চোখ বোজে তুলসী। সারা ঘরে উড়ে বেরাচ্ছে সেই উগ্র গন্ধটা। গন্ধটাকে এখন ও চিনতে পেরেছে। ছোটবেলায় এই গন্ধটাই ও ওর অকালমৃতা মায়ের ঘরে ঢুকলেই পেত।মায়ের বিছানায়, পোশাকে,সারাগায়ে। ওর মা গলব্লাডার ক্যান্সারে মারা গেছেন সে ও তো প্রায় বছর চল্লিশেক হল।।

স্বাদ
শঙ্খলাগা গোধুলীর আলোয় মেয়েটিকে প্রথম চুমু খেয়েছিল ছেলেটি I ভারী মিষ্টি লেগেছিল সেদিন।তারপর চল্লিশ বছর ধরে ওদের বিবাহিত জীবনে অনেক টক, ঝাল,মিষ্টি,তিতো,পানসে স্বাদের সংমিশ্রণ ঘটেছে, তবু সেই চুমুর স্বাদটা আজো ভোলেনি ছেলেটা। আজ আবার সেই গোধুলীবেলা, শ্মশানঘাটে মেয়েটির হিমশীতল কপালে জীবনের শেষচুমুর ছোঁয়াটুকু রাখতে রাখতে ছেলেটা ভাবছিল আজ জিভে এত নোনতা স্বাদ আসছে কেন?


স্পর্শ
বিনীতা অন্ধ, তাই নিজের সৌন্দর্য্যটা ওর অজানা। বিনীতার বাবা সম্পন্ন মানুষ, ব্রেইল স্কুলে পড়াশুনো শিখেছে, ভালো গান গাইতে পাড়ে, রীতিমত ওস্তাদ রেখে তালিম নিয়ে গান শিখেছে বিনীতা। তাই অন্ধ হলেও স্তাবক কম ছিলনা বিনীতার। চোখ নেই বলে স্শর্শেন্দ্রিয় ওর বড় সজাগ। ওর শরীরের প্রতি অঙ্গে অনেক গোপন স্পর্শের ইতিহাস লেখা আছে একাকী থাকলে সেই স্পর্শ সুখ বা অ-সুখের স্মৃতিচারণ করেই দিন কাটায়।হাওয়ার স্পর্শ,ঘাসের স্পর্শ, মাটির স্পর্শ, বৃষ্টির স্পর্শ,আগুনের স্পর্শ,মানুষের স্পর্শ, দাম্পত্যের স্পর্শ,খালি সারাজীবন যে স্পর্শসুখের জন্য ওর অধীর অপেক্ষা,যাকে আশ্রয় করে ওর শরীরে আজ ভালোলাগার ইতিহাস রচিত হচ্ছে সেই সঙ্গীত লহরীর স্পর্শসুখ ও পায়না। সে এক অন্য ইতিহাস ।।