শিলচর শহরের মায়া ত্যাগ করে দিল্লীতে চাকরির
সন্ধানে এসে কয়েক মাস বন্ধুর ওখানে থাকার পর কাল আমি নতুন বাসায় চলে এলাম। বাসা মানে
একটা রুম আর একটা কিচেন , বাথরুম। ছোট্ট একটা বসার ঘর শেয়ার করা যাবে মালিকের সাথে। অর্থাৎ কেউ আসলে
মালিকের বসার রুমে বসানো যাবে। সোফা টেবিল ইত্যাদি আছে সেখানে।সামান্য একটা চাকরি পেয়েছি
মাত্র, এর বেশী বেতনের তুলনায় বিলাসিতা।
বাসার মালিক এক বৃদ্ধা মহিলা। প্রথম যেদিন উনার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম,
জিগ্যেস করেছিলাম, আপনার সাথে আর কে কে থাকে?
উনার মাথা ভর্তি সাদা চুল । লাঠি নিয়ে হাটতে হয়। দেয়ালে টাঙ্গানো এক শিখ গুরুর
ফটো দেখিয়ে বললেন, এই তো গুরুজী আছেন আমার সাথে!
পরে কথাবার্তায় জানলাম উনার দুই ছেলের ছোটছেলে থাকে বাড়ীর তিনতলায়। বড়ছেলের
ছিল দোতলা। সে সেটা অন্যের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। সবাই তাঁকে ডাকে বিজী। পাঞ্জাবী
ভাষায় বৃদ্ধা দাদীমা স্থানীয় মহিলাদের বিজী বলে ডাকা হয়।
বিজীর জন্য খারাপ লাগছিল। তিন তলায় ছেলে ,ছেলের বৌ, নাতি পুতি। অথচ একতলায় উনাকে একা থাকতে হচ্ছে। খাওয়া দাওয়ার জন্য কাজের মহিলার
উপর নির্ভরশীল। আর আয় বলতে আমাকে দেওয়া ঘরভাড়া ও প্রয়াত স্বামীর পেনশনের টাকা।
আজকে বিজী খুব খুশী ছিলেন। উনার মেয়ে এসেছিল ওর ছেলে মেয়েকে নিয়ে। বিজী আমার
সাথে অনেক গল্প করলেন। বললেন, বড় নাতনীকে তিনশ আর ছোট নাতনীকে
দুইশ টাকা দিলাম।
মানুষ যে কিসে আনন্দ পায় কে জানে। নাতি নাতনীকে
দিতে গিয়ে পাচশ টাকা শেষ । অথচ এই বিজীকেই আমি দেখেছি সবজীওয়ালার সাথে টমেটোর দাম নিয়ে দর কষাকষি করতে। আর দুই টাকা কেজিতে বেশী চাওয়াতে তিনি শেষ পর্যন্ত টমেটো
কেনেননি।
বিজী বললেন, মানুষ ভালবাসার কাঙ্গাল।
আমি বললাম, আপনার মেয়েকে খাইয়ে দিয়েছেন তো?
বিজীর মুখ একটু নিষ্প্রভ হয়ে গেল। বললেন, মেয়েই নিজের হাতে কিছু রান্না
করেছে। অবশ্য কুনালের মা এসেছিল নীচে।
কুনাল বিজীর ছোট ছেলের দিকে নাতি।যারা তিনতলায়
থাকে।ঘরভাড়ার কথা ফাইনাল করার সময় ওর কাছেও ইন্টারভিউ দিতে হয়েছিল। সেদিন আমার উপস্থিতিতেই
কুনাল ও বিজী ওদের নিজস্ব কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলছিল। কুনাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। ওর
একটা উক্তি এখনো মনে আছে, মে কিসিকা টেনশন নেহী লেতা।
বিজীর সাথে বেশ কিছুক্ষন গল্প করা হল। তিনি আমাকে উনার মেয়ের আনা কিছু মিষ্টী
দিলেন।
বিজী আমাকে জানালেন, আমি আসার আগে আমার রুমটা একটা
মেয়েকে ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মেয়েটী ওর বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে আসতো প্রায়ই এবং ছেলেটীও
প্রায়ই অনেক রাত পর্যন্ত থাকত। তাই ওকে বিদায় করে দিয়েছেন।
আমি হেসে বিজীকে বললাম, আপনি টেনশন ফ্রী থাকুন বিজী।কোনো
গার্লফ্রেন্ড আমি রুমে নিয়ে আসব না।
বিজী আরও বললেন , তার আগে যে ছেলেটী ছিল সে খুব ভাল ছেলে
ছিল। রোজ ওফিস থেকে এসে দেখা করত। এখন সে মিডিল ইস্ট চলে গেছে। সেখান থেকেও মাঝে মধ্যে
ফোন করে।
নিজেকেই প্রশ্ন করলাম, আমি কি এতটা ভাল হতে পারব?মালিক ভাড়াটে সম্পর্ক কোনো আত্নীয়তা নয়, তবু ভালবাসা
কোনো আত্নীয়তা থেকে কম নয়।
বিজী একটু থেমে আমাকে বললেন, তুমিও আমার সাথে এসে কথা
বার্তা বলবে। বিজী তো সারাদিন ঘরে একলা থাকে,তাই না?
শেষের কথাগুলো যখন বললেন , বিজীকে মনে হল মানসিক ভাবে
দুর্বল একজন মানুষ এবং তিনি কাতরভাবে একটি জিনিষ চাইছেন আমার কাছে। উনার ছেলেদের কথা
ভাবছিলাম।
এটা কি খুব কষ্টের কাজ যে নিজের মা’র সাথে এসে কিছুক্ষন কথা বলবে,
ওর খোজখবর নেবে?
নিজের রূমে আসার পর বেশ টায়ার্ড লাগছিল। অফিসে সারাদিন কাজের লোড থাকে।ওফিস
থেকে আসতে সময় রাতের খাবারটা হোটেল থেকে কিনে নিয়ে এসেছি।
কিন্তু এটা কি জীবন? মা বাবা, ভাই-বোন, আত্নীয়-স্বজন-বন্ধুবান্ধব
থেকে দূরে জীবনটা যেন মেশিন যার কাজ মাসে মাসে বেতন উৎপাদন? চাকরি
জীবনে ঢুকার পর বুঝতে পারছি সত্যিকার অর্থে বন্ধু পাওয়া খুব দুস্কর।
রাতের
খাবারটা তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে পাশের পার্কে হেটে হেটে চলে যাই ।ফিরতে সময় বিয়ারের একটা
ক্যান আর দু প্যাকেট চিপ্স নিয়ে আসলাম। বিয়ার জিনিস্টার স্বাদ তেতো,কিন্তু খেলে এক ধরনের চিল ভাব
আসে। বাড়িতে যে পরিবেশে বড় হয়েছি তাতে বিয়ার বা মদ গেলা প্রায় পাপ জাতীয় কাজ।কিন্তু
এখানে যখন দেখি মেয়েরাও এসব জিনিসে অভ্যস্ত তখন বিশ্বাসে ধাক্কা লাগে।
বিয়ারটা শেষ করে বাড়ীতে ফোন করলাম। বাবা ফোন ধরলেন।
-আমি তুহিন বলতেছি।কি করতেছ?
-আর কি? সকালের
পেপারটাই আবার ভাল করে পড়তেছি।
-রাত্রের খাওয়া দাওয়া করে নিয়েছ?
-না,না।মাত্র
সাড়ে আটটা বাজে। তুই খাওয়া দাওয়া ঠিকমত করিস।শরীরই আসল।
-ওষুধ খাচ্ছ তো ঠিকমত?
- ওষূধ খাই। তোর নতুন বাসায় কোনো
অসুবিধা নাই তো?
-না,তেমন
কোন অসুবিধা নাই।
-পূজার সময় আসবি তো বাসায়?
-আসার তো ইচ্ছা আছে।দেখি।মাকে একটু
দেও ফোনটা।
-তোর মা তো ঘুমাচ্ছেন।খাওয়ার সময় উঠবেন।কয়েক দিন ধরে বলছেন শরীর খুব দুর্বল
লাগছে।
-ও।আচ্ছা, থাক তাহলে।
ফোনে কথাবার্তা শেষ হওয়ার পর বুঝতে পারি , অনেকগুলো কথাই রুটিন জিগ্যাসা
হয়ে যাচ্ছে।কিন্তু রাত সাড়ে আটটার সময় মা ঘুমাচ্ছেন? মা’র সংসারের কর্মব্যস্ত রুপটাই আমার কাছে ভাসে বেশী। ছোটভাই এখন ইউনিভার্সিটি
হোস্টেলে থাকে বলে বাড়ীতে সত্যি লোক কম।মনের ইচ্ছা আরো গাঢ় হয়।দূর্গাপূজার সময় আমাকে
বাড়ীতে যেতেই হবে। অফিসের কাজের চাপ এই কয়দিনেই আমার প্রানশক্তি চুষতে শুরু করেছে।বাবা,মা,ছোটভাই আর আমি, সুন্দর একটি
পরিবারের ঘনিষ্ট বন্ধন আবার দেখতে পাব।
এভাবে
একটা একটা করে দিন যায়। অফিসের পর রুমে এসে মুড ভাল থাকলে বিজীর রুমে এসে বসি। তিনি
এই বয়স্ক শরীর নিয়েও আমাকে আপ্যায়নের চেষ্টা করেন বলে আমি তার কথাগুলো শোনার চেষ্টা
করি।প্রসংগগুলো এরকম-
কাজের বাই বেতন বাড়ানোর কথা বলেছে।
পেনশনের টাকা তুলতে গিয়ে রাস্তায় ক্লান্ত হয়ে
মাথা ঘুরছিল। একজন দেখে চিনতে পেরে গাড়ীতে করে বাসায় এনে দিয়ে গেছে।
বড়ছেলে এসে একবার দেখে গেছে।
বড়ছেলের ছোটমেয়ের বয়ফ্রেন্ড কে,সেটা পরিচয় করিয়ে দিয়েছে ছোটছেলের
বউ।
একেক দিন একেক গল্প।আমিও অফিসের কিছু গল্প বিজীকে বলি।এর মধ্যে কিছু
ঝামেলার গল্পও থাকে।ঝামেলার গল্পগুলোতে বিজী আমার পক্ষ অবলম্বন করে আমাকে বিভিন্ন
বুদ্ধি বলে দেন।
তবে বিজীর ওখানে বেশিদিন থাকা হল না।
দিল্লীতে ধীরে ধীরে পরিচয়ের ব্যাপ্তি বাড়ছিল।অফিসের কাছাকাছি একটা জায়গায় ফ্ল্যাট
ভাড়া করে কয়েকজন চাকরিজীবী ব্যাচেলার একসাথে থাকে।সবাই উত্তরপূর্বাঞ্চলের বাঙ্গালী।
ভাড়া কম লাগবে আর অফিস থেকে দূরত্বও কিছুটা কম হবে , তাই সেখানেই চলে এলাম।
জীবন
চলতে থাকে এভাবেই ।সামান্য একটা সেলসের চাকরিতে টার্গেট পুরা করার জন্য বসের দুঃশাসন
আর অনেক আপসকে সঙ্গী করে। অবশেষে পূজা ঘনিয়ে এলে অফিসে ছুটির প্রসংগ তুলি। কমপক্ষে
ছয় সাতদিন ছুটী দরকার। কিন্তু দিল্লীতে শরৎকাল কিছু আছে বলে জানি না, শুধু দশেরার বন্ধ হয় এক দিনের
জন্য। দিল্লী থেকে আসামের এক প্রান্তিক শহর শিলচর , ট্রেনে করে
আসতেই লেগে যাবে তিনদিন। হয়ত সময় বাচাঁতে গুয়াহাটী পর্যন্ত ফ্লাইটে আসা যেতে
পারে।
ওফিসের
বস এক কথায় ছুটি নাকচ করে দিল।ওর ভাষ্যমতে দশ দিনের ছুটী চাওয়াটাই নাকি পাগলামোর শামিল।অফিসের
সিলিংটাই আজ আমার সীমিত জীবনের আকাশ।দুর্গাপূজায় দেশের বাড়ীতে যাওয়া , মা’র কাছে
যেতে চাওয়া আজ পাগলামোর শামিল?
দিল্লীতে আমি নতুন। চাকরিতে সেটল হতে হবে, কিছুটা অভিজ্ঞতা হয়ে গেলে আরো
ভাল বেতনের চাকরির জন্য এপ্লাই করতে হবে । আমার চিন্তাগুলো প্রতিদিন এসবকে কেন্দ্র
করে আবর্তিত হচ্ছে ।অন্তত বৎসরে একবার বাড়িতে যাব সেই আশা মনের মধ্যে পোষন করতাম।সেটাও
হল না।
দেরী না করেই বাসায় ফোন করি প্রতীক্ষার প্রহর
গুনা থেকে মুক্তি দিতে-পূজার সময় আসা সম্ভব হবে না। এখানে ছুটি পাওয়া যায়নি।
অপর প্রান্তে
দীর্ঘশ্বাস। আমার ইচ্ছে অনিচ্ছেগুলো যখন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে কর্মজীবনের অদৃশ্য সুতায়,তাদের কথাগুলো অবুঝ আবদার বলে
মনে হয়।পরিবার থেকে দূরে থাকার বেদনা লুকিয়ে রেখে ইন্টারনেটে খোজ করি দিল্লীতে
কোথায় কোথায় পূজা হয়।
স্মৃতির টর্চের আলো ধীরে ধীরে কম হতে থাকে। পুরানো
দিনের মুখগুলো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে ।মা আর বিজীর মুখ ও তাদের কথা একাকার হয়ে যায়।