বৃন্দা গত দুবছর যাবৎ ফেসবুকে আছে । তিন হাজারের ওপর
বন্ধু; সাথে আড়াইশোর মত ফলোয়ার । প্রতিদিন না হলেও সপ্তাহে
অন্তত তিন-চারবার সে অনলাইন হয়, কবিতা
ঠবিতা লেখে;
প্রশংসা পায় ইত্যাদি । বৃন্দার বাড়ি ভবানীপুর; কোলকাতা । বাড়িতে বাবা আছে, মা
আছে, এক আইবুড়ি দিদি আর ঠাম্মা । সেদিক থেকে দেখতে গেলে
দুইজন বুড়ি আছে ওর বাড়িতে ।
বৃন্দা প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙার পরপরই বেশ কৌতুহলী হয়ে
ওঠে ওর ফেসবুক নোটিফিকেশন নিয়ে । দাঁত মাজতে মাজতে ভাবতে থাকে কে তার কোন কবিতায়
কি কমেণ্ট করতে পারে, কতগুলো লাইক পড়তে পারে, কে তার কবিতা শেয়ার করতে পারে এসব নিয়ে । তা এতকিছু
ভাবতে ভাবতে মাঝে মাঝেই তার ম্যাক্সির গলায় টুথপেস্ট পড়ে যায় । ব্রাশটাকে মুখের
বাঁদিকে গুঁজে সে কলের দিকে চোখ ফেরায় । থেমে থেমে জল পড়ে ।
বৃন্দাদের একটা ছোটো মুদি দোকান আছে, ওর বাবা বিশ্বেশ্বর নাথই সেই দোকানে বসেন, তবে দুপুরে খাবার খেতে যখন বাড়িমুখো হন , নীতা, বৃন্দার
দিদি তখন দোকান চালান । এই দোকান, মহামায়া
ভ্যারাইটিজকে নিয়েও কোনসময় বৃন্দা একটা কবিতা লিখেছিল, সেখানে বলেছিল ও জীবনটাও তো ব্যবসা, অভিজ্ঞতার । অবশ্য ফেসবুকো কবিমহলের ধারণা , দোকানে খুব একটা বিক্রিবাট্টা নেই বলেই সে এসব লিখেছে ।
বৃন্দার বন্ধু বলতে দুজন, এক আমি আরেকজন অর্পিতা । তবে ইদানিং শুনেছি অর্পিতা চাকরি পেয়ে
যাওয়ার পর নাকি বৃন্দা খুব একটা যোগাযোগ রাখেনি । আর বৃন্দা চাকরী পায়নি বলেই
অর্পিতা এখনও খোঁজ নেয়, পাড়া পড়শির মত । তাই
বন্ধুত্বও রয়ে গেছে । আর আমি বৃন্দাকে চিনি ঐ লেখালেখির সূত্র ধরেই । ফেসবুকেই
আলাপ । ওর প্রথম কবিতা ‘পূনর্মিলন’ পড়েই খুব ভালো লেগেছিল । কমেন্ট করেছিলাম, ‘বাহ বেশ সাবলীল হাত তোমার কবি । আরও কবিতা পড়ার
অপেক্ষায় রইলাম ।‘ এরপর প্রায় প্রতিদিনই
ইনবক্সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমাদের কথা হত । কবিতাবিষয়ক, রাজনীতিবিষয়ক, এছাড়া
কনটেম্পোরারি যত রকমের টপিক আছে, সেসব
নিয়ে । আর সেসব আলাপচারিতার ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝেই ঢুকে পড়ত ওদের পারিবারিক নানান
সমস্যা, অর্থনৈতিক অবস্থা
আরও কত কি ! এভাবেই হয়ত বন্ধুত্বের
বেটনটা এক হাত থেকে আরেক হাতে চলে আসে । এভাবেই হয়ত কবিত্ব ফুড়ুৎ করে উড়ে গিয়ে
বন্ধুতা মিশে যায় দুজনের মনে ।
এই কথাগুলো যেমন আমি ভাবি, বৃন্দাও ভাবে নাকি থেমে থেমে । তারপর ধীরে ধীরে মুক্ত
হতে চায় কবিতায় । আর শেষমেষ কবিতাগুলো চলে যায় ওর ফেসবুক ওয়ালে, একশো তেত্রিশ লাইক পড়ে, ঊনচল্লিশখানা কমেণ্ট । বৃন্দা আপ্লুত হয় । ওকে আমি একদিন বলেছিলাম, তোর কি মনে হয় তোর বাংলা সাহিত্যকে দেওয়ার মত নতুন কিছু
আছে ? প্রশ্নটা শুনে ও তিনটি স্মাইলি সাইন দিয়ে আমাকেই আমার
প্রশ্নটা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে । বলে ‘তোর
কি মনে হয় ?
আমার কি কিছু দে’বার আছে ?’ আমি ‘এইচ এম এম’ (হুম)
লিখে পাঠাই । আসলে আমি ওর মধ্যে কিছু পেয়েছি বলেই সেদিন ঐটুকু লেখার পরও থেমে থাকি
নি । ওকে ডিরেক্ট ফোন করে বলি, ‘জানিস
তো গোটা পৃথিবীটাই হল কবিতা দিয়ে মোড়া, কিন্তু
গোটা কবিতাটা ফেসবুকে মোড়া না । তুই তো তোর লেখাগুলো বিভিন্ন লিটিল ম্যাগে পাঠাতে
পারিস, তারপর কিছুটা
পরিচিতি পাবার পর দেশ কৃত্তিবাস তো আছেই । তুই একটা কাজ কর । আচ্ছা ছাড় তোর কিছু
করতে হবে না,
সামনে তোর জন্মদিন আছে , আমি তোকে একটা বই গিফট করবো । সাহিত্যের ইয়ার বুক নাম ।
ওখানে
তুই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার ঠিকানা, তাঁদের সম্পাদকের নাম, ফোন নাম্বার সব পাবি । তুই চাইলে আগে ওদের সাথে কথাও বলতে পারিস, তারপর না হয় লেখা পাঠাবি ।‘ এটা শোনার পর ও বলল , ‘না না গিফট লাগবে না; আমি নিজেই কিনে নেব, তুই
শুধু আমাকে একটু হেল্প করিস যে কোথায় কোথায় আগে পাঠাবো, মানে বেটার হবে তুই যদি তাদের ঠিকানা আমাকে এখনই দিয়ে দিস, টেক্সট করে । আসলে মাসের শেষ তো টাকা পয়সা খুব একটা নেই
রে হাতে ।‘
‘আরে বলছি তো আমি গিফট করবো
। দাঁড়া কালই তোকে একটা কুরিয়ার করে দিচ্ছি, তোর
বাড়ির ঠিকানাটা বল ।‘ ‘নারে গিফট ফিফট করতে হবে না । ঋন রাখা উচিত না’ ‘আমার সাথে তোর লেনদেনের সম্পর্ক?’ ‘উফফ ! আচ্ছা বাবা, দিস ।
তবে আমি খুব এক্সাইটেড রে । তাই পারলে আজই একটা নাম্বার দে না, কথা বলে দেখতাম ।‘ ‘আজই ? আচ্ছা দাঁড়া , একটু
সময় লাগবে,
কোথায় যে রেখেছি বইটা, একটু খুঁজ... ‘ ‘আরে
হ্যাঁ রে ঠিক আছে, কোনো তাড়া নেই বস ।‘ আমিও এক কান হেসে বিকেলের মধ্যে মেসেজ করে দেবো জানিয়ে
তখনকার মত ফোনটা রেখে দি । কিন্তু
বিকেলের জন্য ওয়েট করতে হয়নি, আমি
সেদিন মাত্র দুমিনিট খোঁজাখুজির পরই ওটা পেয়ে যাই । ওকে আর ফোন করিনি, তবে দুটো ফোন নাম্বার আর সেই পত্রিকাদুটোর ঠিকানা
টেক্সট করে দেই । তার মধ্যে একটার নাম কবিতাসঙ্গ, আরেকটা লাল নক্ষত্র ।
ও মেসেজটা পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে আমায় কল করে বসে । ‘এই হুম এদের নাম শুনেছি । তবে খুব একটা নাম করা না, বল ?’ ‘ওই আর
কি ।‘ আমি বলি । ‘ঠিক
আছে, তালে এদের মধ্যে আগে কোনটাকে ফোন করা যায় বলত ?’ ‘তোর যা ইচ্ছে ।‘ একটা
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি । ‘আমার তো লাল নক্ষত্র নামটা
পছন্দ ।‘ বেশ উৎফুল্লতার সঙ্গে বৃন্দা জানায় । ‘তালে তাই কর ।‘ ‘এই
তোর কি কিছু হয়েছে ?’ ‘না তো’ ‘তালে এভাবে কথা বলছিস যে?’ ‘কিভাবে ?’ ‘ছাড়
বাদ দে । ঠিকাছে আমি লাল নক্ষত্রে ফোন করে তোকে জানাচ্ছি, পরে ।‘ আমি ‘ওকে’ বলে
ফোন রেখে দি । সেদিন রাতে আমি জানতে পারি
লাল নক্ষত্রের সম্পাদক মুকুলবাবু নাকি ওকে দেখা করতে বলেছেন লিটিল ম্যাগাজিন মেলায়, সামনের মাসে । ও আমাকে মেসেজ করে ‘ভাই যাবি আমার সাথে পিএলজেড?’ আমি ‘চেষ্টা
করবো’ লিখে দি। । ডিসেম্বর-১, ২০১৩, সময়
সন্ধ্যে ৭টা স্থান-বৃন্দার বাড়ির বসার
ঘর ।
এই ঘরে বসেই বৃন্দা মুকুলবাবুকে
দ্বিতীয়বার ফোন করে । আসলে এই ঘর থেকে বৃন্দাদের
টিভির ঘর অনেকটা দূরে । সেখানে সিরিয়াল চলে, ডালমুঠ
খাওয়া হয় । কবিতার খোঁজ কেউ রাখেনা সেখানে । বৃন্দা ফোন করে । ওপাশে বাজতে থাকে কলার টোন- হাউ মেনি
রোডস মাস্ট এ ম্যান ওয়াক ডাউন, বিফোর
ইউ কল হিম অ্যা ম্যান... খানিক্ষণ
এ ভাবে বাজার পর মুকুলবাবু ফোন তোলেন এবং এক নিমেষেই চিনে যান বৃন্দাকে । উনি বলেন, ‘হ্যাঁ মা, আমার
মনে আছে । তুমি কাল তোমার কিছু কবিতা নিয়ে এসো বারোটার দিকে । এখানে আমাদের স্টল
আছে । তুমি মোটামুটি কলেজ স্কোয়ারের গেটের সামনে এলেই আমাকে একটা কল করো, ক্যামন ?’ বৃন্দা
খুশী হয়ে যায় । তারপর মুকুলবাবুর ফোন রেখেই সোজা আমাকে ফোন করে জানায় কোন টাইমে
কোথায় আমাকে আসতে হবে । আমি রাজি হয়ে যাই ।
ডিসেম্বর, ২, ২০১৩, স্থান- কলেজ স্কোয়ার, কোলকাতা সময়- বেলা বারোটা বৃন্দা মুকুলবাবুর কথা মত কলেজ স্কোয়ারের গেটের কাছে
এসেই ফোন করে । মুকুলবাবু আসেপাশেই ছিলেন । উনি বৃন্দার সাথে দেখা করেই ওকে নিয়ে
যায় ওদের স্টলে । সেখানে বসে অনেক্ষণ বৃন্দার কবিতা পড়েন । বাহবা দেন এবং বৃন্দার
মধ্যে নাকি এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের সন্ধান পান । অনেক উঠতি লেখক কবিদের সাথে পরিচয়
করিয়ে দেন,
বৃন্দার কবিতা ওনার এতটাই ভালো
লেগে যায় যে ওই স্টলগুলোর সামনের দিকে এক কোণে, যেখানে
ছোট্ট একটা মুক্তমঞ্চ করে কবিরা বিভিন্ন কবিতাপাঠ করছিলো, সেখানে উঠে মুকুলবাবু বৃন্দার নামও ঘোষণা করেন মাইকে ।
এবং ওকেও একটি কবিতা পাঠ করতে আমন্ত্রণ জানান । বৃন্দা, এমন
অপ্রত্যাশিত আমন্ত্রণে, পুরো লাজে রাঙা হয়ে, আর কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে যখন মুক্তমঞ্চে উঠে মাইকের সামনে
আমার পরিচিত ‘পূনর্মিলন’ কবিতাটি
পাঠরতা, তখন আমি কলেজ
স্কোয়ারের ঠিক গেটটার সামনে । বৃন্দা তখন বেশ নিমগ্ন ওর কবিতায় । ও ভেতরে ভেতরে
বেশ খুশীই হচ্ছিলো এটা দেখে যে ওর সামনে অজস্র লাল-নীল চেয়ারে বসে থাকা বিশিষ্ট
কবি-লেখক-সম্পাদকেরা খুব মনোযোগ দিয়েই ওর কবিতা শুনছেন । আমিও অনেকটা অবাক হলাম, ওই ভাবে যে কখনও ওকে কবিতা পাঠ করতে দেখিনি, তাও আবার কোন কবিতা? যার
হাত ধরে আমার ওর সাথে আলাপন । অথচ পরক্ষণেই অনেক অনেক বেশী অবাক ও কিছুটা বিচলিত হয়ে গেলাম একটা দৃশ্য দেখে । দেখি মুক্তমঞ্চের
নীচে
বসে থাকা কবিদের সংখ্যা হাজারে
হাজারে শুধু বেড়েই চলেছে । পৃথিবীর এক প্রান্ত ফুঁড়ে অপর প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে
লক্ষ লক্ষ কবি-সাহিত্যিক-পাঠক-পাঠিকা । তারা ঠিক যেন সরীসৃপের মত এক এক করে বেয়ে বেয়ে মুক্তমঞ্চের ওপরে
উঠে
বৃন্দার আঙুলে দাঁত বসাচ্ছে ।
আমিও কেন জানো আর লোভ
সামলাতে পারছি না ।