সমীরদার বিয়ে
পেন্টু আমার ছোটবেলার বন্ধু ।
আমি , পেন্টু ,খোকন তিনজনেই এক স্কুলে পড়তাম ।
সকালে স্কুল থেকে ফিরতে ফিরতে ১ টা বাজতো । স্নান সেরে খাওয়ার পর হোম ওয়ার্ক থাকলে
সেরে ফেলতাম । মা , সারা বাডির কাজ সেরে একটু
বিশ্রাম নিতেন দুপুরে । ঠিক সেই ফাঁকে আমি জাল আলমারিতে রাখা নারকেলের নাড়ু সব
ফাঁক করে দিতাম । মায়ের হাতের নারকেলের নাডুর স্বাদ এখন ভুলিনি। পেন্টুদের বাড়ী
আমাদের বাডীর উল্টো দিকে । ওদের বিশাল বাগান বাড়ী ছিল। বাগানে রকমারি তরি তরকারি , হাঁস , গরু , ছিল। একটা মস্ত পুকুর ছিল সেই
পুকুর পাড়ে আমরা গিয়ে গল্প করতাম। হাঁস গুলো দেখতে খুব ভালো লাগতো বিশেষ করে রাজ
হাঁস । আমাদের বাডীর কাছেই একটা খেলার মাঠ ছিল । আমরা সেখানে হয় ডাঙগুলি নয় চোর
পুলিশ খেলতাম ।
বিশ্বকর্মা পূজোর আগে আমাদের
ঘুডির সুতোর মাঞ্জা দেওয়ার রেওয়াজ থাকতো । তাই পেন্টুদের বডী থেকে য়ানতাম হামান
দিস্তা , ভাঙ্গা কাঁচ , হাঁসের ডিম । হামান দিস্তাতে
কাঁচ গুঁড় করে সেটা হাঁসের ডিম ফাটিয়ে সেই কুসুমের সঙ্গে মিশিয়ে একটা মন্ড তৈরি হত
। মাঠের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত সমস্ত
চৌহদ্দি
জুডে গাছের
গুঁড়িতে পাক খাইয়ে সুতো জড়ানো হত । এরপর মাঞ্জা দেওয়া হত হাতে সেই মন্ড
নিয়ে । সারা
দুপুর আমাদের চলতো এই কাজ । আর কিছু হাঁসের ডিম আস্ত সিদ্ধ করে খাওয়ার জন্য । তিনটে ইট আড়া আড়ি ভাবে রেখে
আরেকটা ইট রাখা হত যাতে উল্টো ইউ আকৃতি হয় । এরপর শুকনো বাঁশে
কাগজ দিয়ে আগুন ধরানো হত । ইটের উনুনে সিলভারের একটা বাটিতে চারটে , ছটা ডিম সিদ্ধ হত । ডিম সিদ্ধ
নুন লংকা দিয়ে খেয়ে লেগে পডতাম ঘুঁডির সুতোর মাঞ্জা দিতে । সেই আনন্দের দিন গুল
ভুলতে পারিনা
পেন্টুর জাঠতুতো
দাদা,
সমীরদা’ তখন সদ্য মার্চেন্ট অফিসে
চাকরিতে ঢুকেছেন । সমিরদাকে সকালে বাডীর ছাদে দেখা যেত কাগজ নিয়ে পডতে । আসলে কাগজ
পডা নয় মিনুদির সঙ্গে চোখে চোখ মিলিয়ে একটু ভাসা ভাসা প্রেম আরকি । মিনুদির বাডী
একটা বাডীর তফাতে তাই ওনাকেও সকালে হয় বই হাতে নয় কাপড় মেলতে দেখা যেত ।
আমাদের খেলার
মাঠের কাছেই একটা ইটখোলা ছিল। সেই ইটখোলাতে সমীরদা
রবিবার কিম্বা কোন ছুটির দিনে বিকেলে আসতেন । কেন আসতেন আমরা বুঝতাম না । হাতে
একটা সিগারেট , পরনে পায়জামা পাঞ্জাবী আর পায়ে স্লিপার ।
তখন সদ্য হাওয়াই স্লিপার উঠেছে । সমীরদা সামনের বাডীর ‘মিনুদির’ সঙ্গে যে চুপি চুপি প্রেম করতেন
তা আমরা বুঝতাম না তখন। মিনুদি আসতেন ইটখোলাতে সমিরদাকে দেখা করতে পরে জেনেছি ।
মিনুদি
খুব
সুন্দরী ছিলেন । যেমন রং সেইরকম মুখের গড়ন । টিয়া পাখির মতন টানা নাক আর টানা টানা
চোখ । সে , না দেখলে বোঝানো যায়না ।
প্রত্যেক দিন ভোর বেলায় মিনুদি তানপুরা নিয়ে রেওয়াজ
করতেন । পাড়ার ফাংশনে মিনুদির গান অবশ্যই থাকবে ।
সমিরদা নাটকেতে হিরোর রোল করতেন । অনেক ড্যান্স ড্রামা হত রবীন্দ্রনাথের ‘তাসের দেশ’
,’চিত্রাঙ্গদা’ ইত্যাদি । মিনুদি সব ড্যান্স
ড্রামা নিজে নির্দেশনা দিতেন । পাডার মেয়েদের দিয়েই সুন্দর ভাবে পরিবেশন করতেন ।
সত্যি দেখার মতন। নাটক মানেই সমীরদা । রাত জেগে রিহার্সাল দেওয়া, স্ক্রিপ্ট লেখা
সব সমীরদা । তাই বোধহয় সমীরদা মিনুদির মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। খুব
স্বাভাবিক ।
হঠাৎ পেন্টু বলল , সমিরদার বিয়ে । সমীরদার বাবা
জোর করে সমীরদার বিয়ে ঠিক করেছেন এক অল্প বয়সের মেট্রিক পাস মেয়ের সাথে । সমীরদা
কিন্তু ওনার মাকে মিনুদির কথা বলেছিলেন । জ্যাঠাইমা সব জানেন কিন্তু জেঠুর রাগের
কাছে কেউ তিষ্টতে পারে না। এই ছিল তখনকার কালের সমস্যা । সমীরদারা বারেন্দ্র
ব্রাহ্মণ ‘লাহিড়ী’ আর মিনুদিরা বদ্যি ‘সেনগুপ্ত’
!
অগত্যা সমীরদা বাডী ছাডা হলেন । অন্য জায়গায় বাসা ভাডা নিলেন। মিনুদিকে
আর রেওয়াজ
করতে শোনা গেলনা ।
দুটি
হৃদয়ের মিলন কি তাহলে অসম্ভব ! সেটাইতো প্রশ্ন !! কি হল তবে ?
এর মধ্যে জ্যাঠাইমার জন্ডিস হল।
সমীরদা মাতৃভক্ত ছেলে । মায়ের অসুখে কিছুতেই দূরে থাকতে পারলেন না । ফিরে এলেন
বাডীতে । জেঠু , ডাক্তার বদ্যি সব করলেন ।
অনেকদিন জ্যাঠাইমা ভুগলেন শয্যাশায়ী হয়ে। ক্রমে ছেলেকে-দিয়ে প্রতিজ্ঞা করালেন
মাথায় হাত রেখে সে যেন তার মা’কে ছেডে কোথাও না যায় । সমিরদা
ফ্যাসাদে পডলেন । ‘ফান্দে পডে বগা কান্দেরে’ এ কিছুটা
সেই রকম ই
অবস্থা । সমীরদা
ঠিক করেছিলেন মিনুদিকে বিয়ে করে আলাদা থাকবেন । ভগবান বাধ সাধলেন । জ্যাঠাইমা সমীরদা
কে বলেন বাবার পছন্দের মেয়ে কে বিয়ে করতে । সমীরদা গর রাজি । কিছুতেই রাজি করান
গেলনা । সরদার মা বিছানায় শয্যাশায়ী ছিলেন। আমরা জ্যাঠাইমাকে দেখতে যেতাম । আর
পেন্টু আসত না খেলতে । সামনে বিশ্বকর্মা পুজো । ওই দিন ঘুড়ি ওডাতেই হবে ।
জেঠু এরমধ্যে মেয়ের বাবাকে আশীর্বাদের
আয়োজন করার মনস্থ করেন । সমীরদার মা
অনেক অনুনয়
বিনয় করে ছেলেকে বোঝাতে চেষ্টা করেন । বাবা, কেন তুই বুঝছিস না”
সমীরদা,
“কিসের
সমাজ মা! ,আমি ওই সমাজ মানিনা যেখানে ভালোবাসার কোন দাম নেই ?”
মানি
না মানি না !!
হঠাৎ
ঘরে জেঠু ঢুকলেন । সব নিস্তব্ধ ।
জেঠিমার
চোখে জল । তিনি দোটানার মধ্যে পড়েন আর মানসিক অশান্তিতে কাটান ।
“তাহলে তোমার কি এটাই সিধান্ত খোকা”
, জেঠু
গম্ভীর ভাবে বলেন।
“হ্যাঁ বাবা । এটা আমার জীবনের
চরম সিদ্ধান্ত যা আমাকেই নিতে হবে । আমি চাইনা কোন মেয়ের জীবন নিয়ে ছেলে খেলা করতে
। আমি ওই অপরিপক্ব এক ম্যাট্রিক পাস মেয়েকে জীবন সঙ্গিনী করতে চাইনা। আমি আপনার
সঙ্গে এ বিষয় তর্ক করতেও চাইনা । আপনি আমায় বুঝতে চেষ্টা করুন” । সমীরদা গড় গড় করে ডায়লগ বলার
মতন বলে গেলেন।
খোকা
তুমি নাটক
করে নাটকের সংলাপ আমায় শোনাচ্ছ ! বাচালতার সীমা আছে । সীমা টপকাচ্ছ তুমি । নিজেকে
কি মনে কর তুমি ? ওই বদ্যি বাডীর মেয়ে তোমার মাথাটা খেয়েছে ।
ঠিক আছে তুমি জদি ওকেই বিয়ে করতে চাও তবে এ বাডীর দরজা তোমার জন্য চিরদিনের জন্য
বন্ধ ।
এ
কথা শুনে সমীরদা একদম বিচলিত হলেন না । পা বাড়ালেন দরজার দিকে ......।
জেঠিমা ফুঁপিয়ে কেঁদে
ওঠেন
...... খোকা যাসনি ! খোকা যাসনি !! তোদের
বাবা ছেলের
বচসাতে আমি যমের দ্বারে জেতে বসেছি । তুই আমার মরা মুখ দেখবি খোকা । আর
তোমাকেও
দোহাই তুমি কেন ছেলেটার মনের কথা বুঝে উঠতে পারছোনা? কি চাও তোমরা ?
জেঠু
চুপসে গেলেন এই কথায় । দাঁড়াও !! গর্জন করে ওঠেন !! খোকা দাঁড়াও !!!
সমীরদা
ধীর স্থির ভাবে দাঁড়ালেন দরজার কাছে ।
জেঠু
বলেন ,“ঠিক আছে তুমি ওদের বাডীতে খবর পাঠাও”
সমিরদা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন । সত্যি
বাবা ? ঢিপ করে প্রণাম করেন বাবা মাকে । আমি খবর
দিচ্ছি ।
বাডীতেই
বৈঠকখানায়
টেলিফোন ছিল । ফোনে খবর দেন মিনুদিকে ।
পরের
দিন মিনুদিদের বাডী থেকে মিনুদির মা বাবা আসেন সঙ্গে আংটি মিষ্টির বাক্স আর
জেঠিমার জন্য এক ঝুডী ফল , ডাব ইত্যাদি ।
জেঠিমা
এখন অনেকটা সুস্থ বলে মনে হচ্ছে । এতদিন পর মুখে হাঁসি দেখে সবাই আশ্বস্ত ।
আজ চাকর বাকর ,পাডা পোডশি , ছেলে ছোকরা সব্বাই খুশি । সকলেই
হার্দিক ভাবে এই যুগলকে বিবাহ বন্ধনে আবধ্য হতে দেখতে চান । আসলে জেঠু এ পাডার
একজন গণ্য মান্য ব্যাক্তি । তাই বিয়ের ভোজ খুব ভাল হবে । আমরা
সকলে বলি ,সমিরদা মিনুদির বিয়েতে কব্জি ডুবিয়ে খাবো ।
খুব ধুম ধাম করে বিয়ে হল । আমি নিত বর হয়ে
গেলাম সমিরদার সঙ্গে গাডীতে । দেখতে একটু লাল্টু ছিলাম তাই বোধহয় আমার ভাগ্যে নিত বর হওয়া জুটে গেল।