গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৩

আফরোজা অদিতি

সহসা সাহস

বেবুশ্যে মাগি
আমার সংসারে যেদিন ঢুকেছে সেদিনকাই সংসারটা উচ্ছন্নে গেছে
ঘরের ভেতর ছিল জবা শাশুড়ির শ্লেষ ভরা কথাগুলো গরম সীসার মতো কান দিয়ে ঢুকে মনের মধ্যে প্রবেশ করে কথাগুলো যে ওকেই লক্ষ্য করে ছোঁড়া হয়েছে বেশ বুঝতে পারে চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে জল
গালাগালি সবসময় চলতেই থাকে আজ একটু বেশি রহিম, ওর স্বামী মালয়েশিয়া যাবে এখন যাওয়ার খরচা জোগাড় করে দিতে হবে ওকে যেখান থেকে হোক, যে ভাবে হোক দিতে হবে ওকেই

ওদের পাঁচ বছরের সংসার বিয়ে করেছে নিজেরা পছন্দ করে বিয়ের আগে তিন বছরের প্রেম অনেক রঙিন স্বপ্ন ছিল রহিম বলেছে, একটা সাজানো- গোছানো ঘর থাকবে ঘরের সামনে বারান্দায় থাকবে নানা জাতের ফুলের টবি-বাগান ফুল ফুটবে গোলাপ, বেলী, হাসনাহেনা, মাধবী, গাঁদা, দুপুরচন্ডি, দোপাটি  সেই বাগানে থাকবে দুটো চেয়ার সন্ধ্যায় বসবে দুজনে চা খাবে গল্প করবে গুনগুন, গুঞ্জন শুধুই দুজন এখন কোন স্বপ্ন নেই, কাঁচের বাসনের মতো সে স্বপ্ন ভেঙে গেছে

সুখ নেই সংসারে, সুখ নেই মনে বদলে গেছে রহিম রহিমের এখন কথায় কথায় হাত মুখ দুই- চলে এক অন্য রহিম বিয়ের আগে যে মানুষকে চিনতো সে নয়, যেন অন্য এক মানুষ যেন এক খাদক মানুষ অথচ এই মানুষটার  জন্য বাবা, মায়ের অমতে নিজের লেখাপড়া, বাড়ি ঘর সব ছেড়েছে

বউমা, বউমা শুনে যাও
আজ শুক্রবার শশুর বাড়িতেশ্বশশুরের ডাকে মাথায় কাপড় দিয়ে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ায়
ডাকছিলেন বাবা ?
হ্যাঁ, টাকার ব্যবস' কি করলে ?
শ্বশুরের কথায় একটু চুপ করে থাকে তারপর আস্তে আস্তে বলে টাকার কী ব্যবস্থা করব এই তো সেদিন প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে লোন নিয়ে দিলাম,জমি কিনলেন এখন একবছর না গেলে তো লোনও পাওয়া যাবে না
লোন না পাও তোমার বাবার কাছ থেকে এনে দাও

জবার বাবা ব্যাংকের ক্যাশিয়ার বাড়িতে যে জমি আছে বেতন আর জমির আয় দিয়ে ভালোই চলে যায় সংসারে আরো দুই ভাইবোন আছে তারা লেখাপড়া করে চাইলে বাবা টাকা দিবে কিন' বাবার কাছ থেকে টাকা এনে শ্বশুরকে  দেওয়ার ইচ্ছা নেই জবার তা ছাড়া জবা শুনেছে ওকে না বলে ওর নাম করে রহিম জবার বাবার কাছ থেকে গত মাসে  বিশ হাজার টাকা এনেছে
শ্বশুরকে বলে জবা, বাবা টাকাটা আপনি কেন দিচ্ছেন না বিদেশ যাবে আপনার ছেলে, টাকা থাকবে আপনাদের, সেখানে আমার বাবা কেন টাকা দিবে বলেন তো !
জবার কথায় চিৎকার করে ওঠে জবার শ্বশুর কি যতো বড় মুখ নয় ততো বড় কথা ! ছলাকলা করে বিয়ে করছ আমার ছেলেকে এখন টাকার বেলায় যত ইকরি-বিকরি ওসব চলবে না টাকা দিলে বাড়িতে থাকবে না হলে চলে যাবে

জবাও কঠিন ভাবেই বলে, আমি কেন যাব বাবা বাড়ি আমার লোনের টাকায় কেনা সংসার চলে আমার টাকায় আপনিও তো চাকরি করেন না, আপনার ছেলেও নয় আপনার ছেলের মা- নয়, তাহলে !
ওমা ,মাগো কোথায় যাব গো
জবার শাশুড়ি ওখানেই ছিল বুক চাপড়িয়ে কান্না শুরু করে দিল সেদিকে তাকিয়ে ওখান থেকে চলে আছে জবা এসব লোক দেখানো কান্না ভালো লাগে না আর এসব কান্না নয় অভিনয় জানে এরপরে শাশুড়ির আরো নানা রকমের কথা শুরু হবে সে সব কথা শোনার ইচ্ছা হয় না জবার

তিন ভাইবোনের মধ্যে বড় জবা ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে কম্পিউটার কোর্স করে চাকরিতে ঢুকেছিল বিয়ের আগে থেকেই চাকরি করে জবা চাকরি করতে করতেই বিয়ে করেছে. এম. করেছে পি.এচ.ডি. করার ইচ্ছা ছিল কিন' রহিম পড়তে দেয়নি নতুন সংসার জবা কষ্ট পেলেও মেনে নিয়েছিল রহিম বি.. ফেল করেছিল আর পরীক্ষা দেয়নি জবা ভেবেছিল, ওর স্বামী যাতে কোন কমপ্লেক্সে না ভোগে কখনও যাতে রহিমের মনে না হয় ওর লেখা পড়া বেশি দেখে অবজ্ঞা করছে জবা জানা কথাও না জানার ভান করে চুপ থেকেছে যত কম কথা বলা যায় ততোই মঙ্গল এই কথা মেনে চলেছে সবসময় কিন' কী লাভ হয়েছে কোনই লাভ হয়নি

আজ শ্বশুরের কথায় ওর বুকের ভেতরটা শূন্য হয়ে যায় অসি' লাগে ওর এত চেষ্টা করেও সংসারটা মনে হয় ধরে রাখতে পারবে না ভেবে অস্বস্তি হচ্ছে ওর রহিম তিনদিন বাড়ি নেই কোথায় গেছে বলেও যায়নি শ্বশুর আর শাশুড়ি এখন চুপ করে আছে কিন' রহিম আসলে আর রক্ষা থাকবে না

রহিম আজ ওর কিনে রাখা বেতগুলোর ব্যবহার নিঃসন্দেহে করবেই সেই বিয়ের পর থেকেই এই রকম ব্যবহার করে আসছে বিয়ের পরে কয়দিন যে ভালো কেটেছে হাজার চেষ্টা করেও মনে করতে পারে না কোন ভালো স্মৃতি নেই মনে ওর খারাপ লাগলেও সব হাসি মুখে সহ্য করেছে শুধু মাত্র এই সংসারটা টিকিয়ে রাখার জন্য এই সংসারে মানিয়ে চলার চেষ্টা করেছে বিশ্বাস করে একটা সংসার ভেঙে দেওয়া যতোটা সহজ গড়া অতোটা সহজ নয়  কিন' আর কতোদিন এই বিশ্বাস বুকের ভেতর পুষে রাখতে পারবে জবা প্রায় পাঁচ বছর ধরে খারাপ ব্যবহার চলছে লাগাতার শুধু শ্বশুর শাশুড়ি হতো কথা ছিল না, স্বামীর ব্যবহারই কষ্ট দেয় বেশি

জবার কিছু ভালো লাগে না কাজ পড়ে আছে অনেক কিন' ভালো লাগছে না কাজ করতে কিন' কাজ করতেই হবে ঠিকা ঝি-এর আসার সময হয়ে এলো কাপড় ভিজিয়ে দিতে হবে আদা, রসুন বের করে দিতে পিঁয়াজ কাটাতে হবে উঠে দাঁড়ায় এমন সময় ময়নার মায়ের ডাক শোনে
ভাবী ভাবী বাইরে আসেন, দেইখা যান ভাইজান আইসে

জবা বের হয়ে আসে থমকে দাঁড়ায় রহিম এসেছে কিন' পেছনে লাল বেনারসি কে ? !
রহিম সোজা গিয়ে বাবার ঘরে পেছনে লাল বেনারসি জবাও পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় ওদিকে  দেখে রহিম আর লাল বেনারসি সালাম করে ওর শ্বশুর আর শাশুড়িকে
রহিম বলে, বাবা এর নাম নিম্মি তোমাদের নতুন বউ পরশু আমেরিকা যাবো আমরা দুজনেই সব ঠিক করে এসেছি
 সব ঠিক করে এসেছ মানে !
হ্যাঁ বাবা আমাদের দুজনের টিকিট দিয়েছে ওর বাবা ওখানে ওর বাবার ব্যবসা দেখবো
জবা চেয়ে দেখে ওর শ্বশুরের চোখে একটু জলের আভাস এদিকে শাশুড়ি ঘোমটা খুলে চিৎকার দেয় আরে এর যে এক চোখ কানা

তাতে কি হয়েছে মা এক চোখে তো দেখে তাছাড়া ওর বাবা আমাকে অনেক টাকা দিয়েছে যা দিয়ে আমরা দুজনে আমেরিকা অনেক আরামে থাকবো

আর আমরা ! শাশুড়ির বিস্মিত চিৎকার
তোমরা কী করবে তার আমরা কি জানি তোমাদের বলার দরকার তাই বলতে এসেছি না হলে তো আসতামই না

জবা ওখান থেকে চলে আসে কাজ করতে থাকে ওর কোন সাহস নেই সবকিছুতেই ওর পিছুটান সব তাতেই লোক ভয় সেই ছোট বেলায় ক্লাসের মেয়েরা ওকে উত্ত্যক্ত করতো কিছুই বলতে পারতো না ওর খাতা ছিঁড়ে দিতো, হোমওয়ার্কের খাতায় কালি ঢেলে দিতো টিচার ওকে শাস্তি দিতো কিন' কিছুই বলতে পারতো না মনে হতো টিচারকে বললে টিচার আরো বেশি শান্তি দিবে ছোট ভাইবোন ওর পছন্দের জিনিস নিয়ে নষ্ট করে ফেলতো কিছুই বলতে পারতো না মনে হতো ওরা ওরই নিজের ভাই বোন মা অযথা ওকে বকাবকি করতো মায়ের কথার জবাব দিতো না কখনও মনে হতো মা তো বকবেই মা তো ভালোর জন্যই বকে

ঠিকা ঝি, ময়নার মা, কাজ করতে করতে বকবক করে বলে, ভাবী আপনি চইলা যাইতে পারেন না এতো টাকা কামাই করেন, একলাই তো থাকতে পারেন আপনি একলা থাকলে তো আমাগো মতন মাইনষের বাড়ি খাইটা খাইতে হইবো না
তাই তো কথাটা মনে ধরে জবার কিন' আবার দোটানায় পড়ে বলে, লোকে কী বলবে !
লোকের খান না পরেন ময়নার মা বলে

এই পাঁচ বছর কার জন্য এই বাড়ি সাজিয়েছে, নিজের রক্ত পানি করা টাকাগুলো দিয়ে কোন আশায় এই সংসার গড়েছে একটু ভালো থাকার জন্যই তো চোখ দিয়ে জল গড়ায় ময়না মা ওকে বলে ভাবী আপনি চইলা যান এত্তো করলেন তারপরেও ভাইজান আবার বিয়া করলো

জবা নিজের ঘরে ঢোকে ওর বিছানায় বসে আছে নিম্মি পাশে দাঁড়িয়ে আছে শাশুড়ি জবার হঠাৎ রাগ হয়ে যায় শাশুড়িকে বলে ওকে আমার বিছানায় কেন বসিয়েছেন আপনি জানেন না খাট আমার টাকায় কেনা আপনার এতো বড় সাহস আমার কেনা খাটে এনে ওকে বসিয়েছেন

কে আম্মা ? নিম্মি প্রশ্ন করে
তোমার সতিন রহিমের বড় বউ  শাশুড়ির কথা শুনে লাফ দিয়ে ওঠে নিম্মি বলে, আপনার ছেলের আগের একটা বউ আছে
হ্যাঁ তাতে কি ?
 এবারে জবা বলে, শুধু বউ না চাকরি করা বউ রহিম কোন চাকরি করে না রহিমের বাবাও কোন চাকরি করেন না এই বউয়ের টাকায় সবাই বসে বসে খায় জবার কথায় নিম্মি নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে রহিম আলমারির ওপর থেকে বেত নামিয়ে জবাকে মারার জন্য হাত ওঠায় জবা রহিমের হাত থেকে বেত ছিনিয়ে নিয়ে রহিমকে মারার জন্য হাত তোলে তারপর কি ভেবে হাত থেকে বেত ফেলে দেয় কিছুক্ষণ পলকহীন রহিমের দিকে তাকিয়ে থাকে চোখে উপচে পড়ে ঘৃণা
এরপর আলমারি খুলে ব্যাগে কাপড় গুছিয়ে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে যায় জবা কোথায় যাবে জানে না পেছন থেকে শাশুড়ির ডাক শুনতে পায় বউ আমাদের ছেড়ে যেও না বউ মাফ কইরা দ্যাও রহিম তো চইলা যাবে আমাগো কে দেখবো যাইয়ো না মা

জবা কোন কথা কানে নেয় না বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে হাঁটতে থাকে সম্মুখে, পেছনে পড়ে থাকে পাঁচ বছরে কষ্টে মেশা সুখ-দুঃখের দিনগুলো