ইন্ডিয়া
১৯৭১ এ রোশনারাদিরা ইন্ডিয়া
ছেড়ে বাংলাদেশ চলে গেল। যাবার সময় যখন জাহানারা মানে ছুটকি আমায় জড়িয়ে ধরে অঝোরে
কাঁদছে তখন ওদের বাড়ির উল্টোদিকে সবজি দোকানের মালিক জিয়ারাম চাচা ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল...কি ব্যাপার, এত কান্না কিসের? রোশনারাদি উত্তর দিল...আমরা
যে ইন্ডিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছি চাচা...। সেই প্রথম যেন ভাল করে
জানলাম এটা ইন্ডিয়া। তার আগে এভাবে কেউ বলেনি। এখন অনেকদিন হয়ে গেছে। তখন আমরা কিছুটা ছোট। ছোট মানে তখনও পেনি ফ্রক পরি। দাদাদের
ঘাড়ে চাপি, ঘুমোবার সময় ওদের গায়ে
ঠ্যাং তুলে দিয়ে ঘুমোই। তখন চাঁদ, ফুল এসব দেখে মনখারাপ করা
শুরু হয়নি। তখনও দুষ্টুমি করলে মা বিরক্ত হয়ে বলেন না...কি হচ্ছে! পা নামিয়ে ঠিক
হয়ে বসো।
রোশনারাদির বোন জাহানারা
যার ডাক নাম ছিল ছুটকি, সে আর আমি ছিলাম একেবারে
হরিহর আত্মা। রোশনারাদির ডাক নাম ছিল টুশকি। আয়ুব কাকা, মানে ওদের বাবা আমায় ডাকতেন রুনকি বলে। মানে কিছু নেই,
নামের
সঙ্গে নাম মিলিয়ে রাখা, এই আর কি! ছুটকির মা’কে আমরা বলতাম গোলাপ-কাকি।
ওনার নাম ছিল আনোয়ারা চৌধুরী মিতা। প্রথমে ভেবেছিলাম, ওটা বুঝি ওদের পদবী। যেমন আমাদের ছিল বসুচৌধুরী। কিন্তু রোশনারা, জাহানারা এরা তো মিতা লেখে না! একদিন ছুটকিকে জিজ্ঞেস করলাম ওদের পদবীর কথা। তখন দুজনেই
দুবাড়ির মাঝখানের ফটকের উপরে বসে কাঁচা পেয়ারা চিবুচ্ছি। ছুটকি একবার পেয়ারায় কামড় দিয়ে তার রসটাকে শুষে নিয়ে
ছিবড়েটা ফেলে দিয়ে বললে----তুই বুঝবি না, ওটা আমাদের নাম। বুঝব
না মানে? আমার কি বুদ্ধি কম নাকি!
তাহলে হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষায় ওর
থেকে তেষট্টি নম্বর বেশি পেলাম কি করে? সেকথা বলতেই ছুটকি
বলল---দুটো এক হল? মুখে পেয়ারা ,তাই তখনকার মত ব্যাপারটা মুলতুবি রইল। পরের দিন ইস্কুলে
টিফিন-টাইমে এক্কা-দোক্কা খেলার সময় ছুটকির কিছুতেই দুটো পা একঘরে পড়ছে না দেখে
একটা পায়ে আমার পা লেগে যেতেই ওর দুটো পা একঘরে পড়ে গেল, ছুটকি আউট হল। আমার দিকে ফিরে বলল---এটা কি হল? আমি বললাম--তুই বুঝবি না। বললে---আমায় পা লাগিয়ে আউট
করলি কেন? আমি বললাম---লেগে গেল, দুটো এক হল...?
গোলাপ কাকির নামটা নাকি ওর
ঠাকুমা মানে দাদি দিয়েছিলেন। গোলাপের মত সুন্দরী বৌ, তাই নাম গোলাপ। তা গোলাপ
কাকি সুন্দরী ছিলেন বটে! আয়ুব-কাকার সঙ্গে কোথাও বেরোলে কালো বোরখার ভিতর দিয়ে
ধবধবে হাত দুটো যখন বেরিয়ে থাকত, মনে হোত যেন গোলাপী রঙ করা। ছোটবেলা থেকেই দু-বাড়ির খুব ভাব ছিল। অনেকদিন এমন হয়েছে, আমি রাতের খাওয়া ওবাড়িতে খেয়ে ছুটকি আর কাকির কাছেই ঘুমি
য়েছি।
একেবারে সকালে স্নান-খাওয়া সেরে এবাড়িতে বই-খাতা নিয়ে একসঙ্গে ইসকুল গেছি। কতদিন
বাবা আর আয়ুব-কাকা বিকেলের জলখাবার একবাড়িতে বসে খেয়েছেন। ওদের ঈদের সময় মা আর
কাকি মিলে ফিরনি তৈরী করেছে। আমাদের পুজোর সময় কাকিও এসে মায়ের সঙ্গে মিষ্টি তৈরী
করেছে। রোশনারাদি আমাদের বাড়ি সারাদিন যাওয়া-আসা করলেও কোনদিন রাতে থাকেনি। দাদা
তাই বলত ---তোর খুব গুমোর, দেখিস, যখন বিয়ে হবে, আমরা তোর পিঁড়ি ধরব না...’ দাদা জানত না, রোশনারাদি দের বিয়েতে পিঁড়ি
ধরা হয় না। বাংলাদেশ যাবার সময় রোশনারাদির
ইস্কুলের পড়া শেষ হয়েছে। শুনলাম, ওখানে গিয়ে কলেজের পড়া
করবে। দাদা একদিন বলল---টুশকি, তুই কলেজের পড়াটা এখানেই
করে গেলে ভাল করতিস। তুই থেকে যা, একেবারে ওখানে গিয়ে চাকরি
করবি...! রোশনারাদি সেদিনও
বলল---এখানকার পড়ায় যদি চাকরি না হয়! তখনো ইন্ডিয়া বলেনি। ইন্ডিয়া
শুনলাম একেবারে যাবার দিন জিয়ারাম চাচাকে যখন বলল। বাড়ির সামনে সবাই জড়ো হয়েছে। জিনিসপত্র গাড়িতে তোলা হয়ে গেছে। এবার
বিদায় নেবার পালা। আয়ুব কাকা বাবাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন। আমরাও প্রনাম
করলাম কাকা-কাকিকে। তারপরই ছুটকির কি কান্না! মাঝে মাঝে সেকথা মনে হলে এখনো কাঁধের
কাছটা ভিজে ভিজে লাগে। দাদা একটু হেসে রোশনারাদিকে
বললে---টুশকি, তোর বিয়েতে নেমতন্ন করিস, গিয়ে কোমর বাঁধব...’
।
রোশনারাদিও ম্লান হেসে
বলল---ইন্ডিয়া থেকে যদি যেতে বা দেয়...!
আবার
সেই ইন্ডিয়া...! কিন্তু যেতে দেবে না মানে ? ওরা তো আমাদের বাড়ির লোক , ওদের কাছে যাবো না তো কাদের কাছে যাবো? গোলাপ কাকি সেই যে মায়ের হাত ধরেছেন, এখনো আঁকড়ে আছেন। মুখ দেখা যাচ্ছে না,কিন্তু হাতের চাপ বাড়ছে। দাদি সেই যে গাড়িতে গিয়ে উঠেছেন, একবারের জন্যও মুখ দেখাননি। শুধু রোশনারাদির মুখ একটু
উজ্বল লাগছে। সে কি কলেজে পড়ার জন্য নাকি ইন্ডিয়া ছেড়ে যাবার জন্য সেটা বুঝিনি।
তাহলে এত বছর রইল কি করে? তখন তো ইন্ডিয়া ছিল না? যাবার সময় একে একে সকলে গাড়িতে ঊঠলেন। আমরাও আরো গাড়ির
কাছে চলে এলাম। ঘিরে দাঁড়ালাম গাড়ির
চারিদিক। যতটা কাছে কাছে থাকা যায়! বাবা আয়ুব কাকাকে বললেন---যখনই এখানে আসবেন
তখনই...’ আর বলা হল না। চশমা খুলে
বাবা একবার গাড়ির ভিতরে দাদির হাতটা ছুঁয়ে বললেন...আচ্ছা আম্মা...’ তখনও বাকিটা বলা হলনা। দাদি রোগা হাত দিয়ে বাবার একটা
হাত ধরে কাঁপা গলায় বলে ঊঠলেন......ও বাপন (দাদি বাবাকে বাপধন বলে ডাকতেন, কখনও বা বাপন), খুকনায় (খোকন, আয়ুব কাকার দাদা) আমাকে বাংলাদেশ নিয়ে যায়...কিসের জন্য
বাপ? জন্ম-কম্ম সবই তো এইখানে...এতদিন
পর এইটা ইন্ডিয়া হল, আর ওইটা হল আমার দেশ
বাংলাদেশ...! কিন্তু চোখের পানিগুলান যে এইখান হতে নিয়া গেলাম রে বাপন...’ ভেঙ্গে পড়লেন কান্নায়। গাড়ী চলে গেল ।
না, রোশনারাদিরা আর কোনদিন আসেনি। হয়তো ইন্ডিয়া থেকে চলে
গিয়ে ভালই আছে। যাবার দিন ছুটকি আমায় একটা ড্রইং খাতা দিয়েছিল, তাতে দুটো বাচ্চা মেয়ের ছবি আঁকা---আমি আর ছুটকি। সেটা আমার ঘরে আছে,
যদি
কোনদিন ছুটকি আসে...!