গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৩

তাপসকিরণ রায়

ইজ্জত

---আমারে তোর ভাল্ লাগে?
--তরে দেইখলে আমার মনডা খুশিতে ভইরা যায়। বারবার তরে দেইখতে ইচ্ছা করে রে !
--কিন্তু আমার চরিত্তির ভাল নয়--জানস তো?
--আমি তোরে বিয়া করতে চাই,ঝুমি !
--না লবুন,তা হয় না--তুই জানিস না,আমার ইজ্জত গেছে? ...আমার...,আর কথা সরে না ঝুমির মুখ থেকে,ও চুপ মেরে যায়।  ঝুমির চোখের সামনে ছায়া ছায়া সে দৃশ্যগুলি ভেসে ওঠে...
সে দিন ভোরের আলো তখনও ফুটে উঠতে পারে নি। চারিদিক ঘন অন্ধকারে ঢাকা। এমনটাই হয়--ভোর হবার প্রাক কালে পৃথিবী আঁধারে ডুবে যায়। চাঁদ যেমনটাই হোক--দ্বিতীয়ার হোক আর  পূর্ণিমার,সে  পাহারা শেষ করে দূর দিগন্তে ডুব মারে। সূর্যের তখনও ঘুম ভাঙে না--বিছানায় শুয়ে তখনও সে হয় তো আড়মোড়া ভাঙে।

ঝুমি তার নিত্য সাথী বোরা কাঁধে ফেলে পথ চলতে থাকে। এ সময়টায় সে বের হয় না--কিন্তু আজ তাড়নায়--সামান্য বেশী পয়সা পাবার তাড়নায় সে প্রদোষের পথেই বেরিয়ে পরেছে।কাল দীপাবলি--নিজেদের পেট ভরাবার পর ছোট ভাই,বোনের জন্যে একটু মিঠাই কেনার পয়সার যদি যোগার হয়ে যায় !
কাজ তো ওই--রাস্তার ডাস্টবিন কিম্বা ময়লার স্তূপ ঘেঁটে তার মধ্যে যেটুকু উচ্ছিষ্ট পাওয়া যায় তাই কুড়িয়ে পিঠের বোরায় ভরে নেওয়া।

পথ ঘাট সব চেনা। নখদর্পণে বলা যায়। তের,চোদ্দ বছর ধরে সে এমনি পিঠে বস্তা ফেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে--সেই চার,পাঁচ বছর বয়স থেকে। ছোট বেলায় মা,কিম্বা বাবার সঙ্গে বের হতে হত। এখন ঝুমি স্বাবলম্বী--ঘর চালাবার বেশীর ভাগটাই সে রোজগার করে যে ! 
হে হে হে,হা হা হা:,রকম ফের হাসির শব্দ ঝুমির কানে এলো। থমকে দাঁড়ালো সে--কি ব্যাপার ? তো সেই বখাটে ছোকরাগুলির হাসি ! তাড়াতাড়ি ডান হাতে চোখ কচলে নিয়ে আশপাশ দেখার চেষ্টা করল সে। হ্যাঁ,কয়েকজনের ছায়া যেন তাকে ঘিরে ধরেছে। এবার স্পষ্টঝুমি-ই...ই...,বলে সুর টানতে টানতে কেউ যেন ডাক পাড়ল,সেই সঙ্গে,হা হা,হি হি হাসির আওয়াজ। 
-কে ! কে ? আচমকা চীৎকার করে উঠলো ঝুমি। আর সাথে সাথেই সে বুঝতে পারল,ছেলেগুলি তার হাত,কোমর,কাঁধ জাপটে ধরে নিচ্ছে।
চীৎকার দিল ঝুমি,সে শব্দ তার মুখ থেকে ভাল ভাবে বের হতে পারল না। একটা সক্ত হাত এসে তার মুখ চেপে ধরল। 
--ঝুমু,ঝুমু,ঝুমু...আমার ঝুমু...স্তব্ধতা ভেঙে ঝুমুর গোঙানির শব্দ আর ছেলেদের পৈশাচিক হল্লার মাঝে এক সময় উত্তপ্ততা শান্ত হয়ে গেল।
তখন ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। দূরে রোদের রক্তাভ আলো আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। ঝুমির জ্ঞান ফিরল--ধীরে ধীরে সে চোখ মেলল--চারি দিকে গুঞ্জন--তাকে ঘিরে বেশ কিছু লোক দাঁড়িয়ে ছিল। 

সে দিন ধর্ষিতা হয়ে ছিল ঝুমি। তারপর থেকে লোকে তাকে দেখে হাসত। বড় ছেলেরা বিশ্রী ইঙ্গিত করত।  তাকায় নি ঝুমি,চোখ ফিরিয়ে অন্য পথে চলে গেছে। কত দিন কাজের কামাইয়ে পেটের খাওয়ায় কম পরে গিয়েছিল। মা,বাপ তার গায়ে হাত তুলেছে, তাকে গালি গালাজ করেছে। ভাল ভাবে খেতে পর্যন্ত দেয় নি। ভাই,বোন কথা বলা বন্ধ করে দিয়ে ছিল--দূর থেকে ওরা অসহায় চোখে দিদিকে দেখে যেত। 
কিন্তু ঝুমির কি দোষ ! সে তো ধর্ষিতা--সে তো অমন কাজে মন থেকে কোন দিন সায় দেয় নি !
সময় আড়াল করে নেয় অনেক কিছু। শরীরের ঘা ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়। তবে গভীর ঘায়ের দাগ শুকায় না। ঝুমির যে আজীবনের দাগ রেখে যাওয়া ক্ষত !

ঝুমিদের সমাজে মান ইজ্জতের তত ঢাক পিটানো নেইউঁচু সমাজের মতই এখানেও আড়ালে আবডালে সব কিছু ঘটে চলে।  এখানেও ধরা পরো তো চোর--ধরা পরো তো ডাকাত!
ঝুমি ধরা পরেছে,তাই সে চোর। শুধু চোর নয়,সে যে ব্যভিচারিণী !
এর পর একটা বছর কেটে গেছে। ঝুমি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তার মাঝেই লবুনের সাথে তার বেশ কবার দেখা হয়েছে। লবুনও পিঠে বস্তা নিয়ে ময়লাদানী থেকে উচ্ছিষ্ট কুড়িয়ে বেড়ায়।
লবুন ঝুমিদের বস্তিরই ছেলে। ওর ঝুমিকে ভাল  লেগেছে। ঝুমির সঙ্গে দেখা হলে ও কথা বলে,গল্প করে,হাসে,আবার কখনো দুপুরে ওরা এক সঙ্গে বসে কুড়নো খাবার ভাগ করে খায়। তখন ওরা আকাশ দেখে,ক্লান্ত পাখীদের উড়ে যাওয়া দেখে। গাছের ফাঁক ফোঁকর গলিয়ে আসা ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরের ঝিকির মিকির খেলা দেখে। 

এমনি এক দিনের কথা--সে দিন ছিল দেওয়ালি। লবুন বলে ওঠে,ঝুমি তরে আমি ভালবাসি রে !
ঝুমি যেন আঁতকে ওঠে। সেই ধর্ষকাম ভঙ্গুর স্মৃতি তার মনে পড়ে যায়, বলে,আমারে তর ভাল্ লাগে ? আমার যে চরিত্তির নাই রে লবুন !
লবুন এত কিছু বুঝতে চায় না--সে জানে ঝুমি ভাল মাইয়া। ওরে জোর কইরা কিছু নষ্ট ছেলে ইজ্জত নিয়ে ছিল। কিন্তু ইজ্জত কি?
--কি রে লবুন,এহন চুপ মেইরে গেলি কেন ? উত্তেজিত ঝুমি বলে ওঠে। 
লবুন যেন আপন মনে বলে যেতে থাকে--না রে তর চরিত্তির ভালা--আমি জানি তর মন খুব ভালা--ওরা জোর কইরে তোর ইজ্জত নিছে--তর মন তো নিতে পারে নাই--তাই তো তুই তর দেহ মন থেইকা দেস নাই ! তাইলে তোর ইজ্জত গেল কি কইরে ?
সূর্য দেব পাটে বসছে। গাছের নিচে এখনও ঝুমি,লবুন চুপ করে বসে আছে। ঝুমির হাত লবুনের হাতে ধরা। 

হঠাৎ ওদের চোখের সামনে ঝলসে উঠলো সহস্র আলো। ওরা অবাক হয়ে তাকাল সেই ঝলমল আলোর দিকে। কখন যেন সন্ধ্যে পার হয়ে গেছে ! দীপাবলির আলোক ছটা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। 
ওরা ঘাড়ের বোঝা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আর পা পা এগিয়ে চলল আলোক উৎসের দিকে।