গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৩

অরবিন্দ দত্ত

অংশু আখ্যান


তিন বছর পর ‘ভাবনা’ তাদের নতুন নাটক মঞ্চস্থ করতে চলেছে। পাড়ার একটা ক্লাবে তারই রিহার্সাল চলছে।রিহার্সালের মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য বিরতি। বছর বার- তেরোর একটি ছেলে চা নিয়ে এল। ছেলেটি একহাতে চায়ের কেটলি অন্য হাতে কিছু কাগজের কাপ নিয়ে ঢুকতেই সুদীপার নজরে পড়লো। সুদীপা একটু গম্ভীর গলায় বলল-‘অ্যাই তুই কে রে?  কোত্থেকে  চা নিয়ে এলি’? সুদীপার জেরায় থতমত খেয়ে ছেলেটি বলল – ‘আমি অংশু।মামা  তোমাদের  চা দিয়ে আসতে বলল তাই...’ ছেলেটির কথা শেষ না হতেই সুদীপা জিজ্ঞেস করলো – ‘কে তোর মামা’? ছেলেটি বলল – ‘ঐ যে সামনের  চায়ের দোকানদার, উনি আমার মামা’। রঞ্জন বলল-‘তারমানে নিবারণদা তোর মামা। ঠিক আছে, সবাইকে চা  দিয়ে দে’।  অংশু ধীরে ধীরে কাগজের কাপে  সবাইকে চা দিতে শুরু করলো।  সুদীপা চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে একদৃষ্টে অংশুকে দেখতে লাগল। মাঝারি গড়ন। গায়ের রঙ ফর্সা না হলেও কালো বলা যায় না। ওর  চোখ দুটোর দিকে চেয়ে সুদীপা চমকে উঠলো। একি! এতো সেই চোখ। চোখ দুটো যেন সুদীপাকে অনেক কিছু বলতে চাইছে। অংশু চা দেওয়া শেষ করে সুদীপার দিকে তাকিয়ে ‘আসি মাসি’ বলে খালি কেটলিটা হাতে নিয়ে রিহার্সাল রুম থকে বেড়িয়ে  গেল। সুদীপা ওর চলে যাবার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকলো।

আজ প্রায় দুই সপ্তাহ হল সুদীপার নাটকের গ্রুপ ‘ভাবনা’র প্রযোজনায় নতুন নাটক ‘আশা আকাঙ্ক্ষা’- র  রিহার্সাল শুরু করেছে। সুদীপা মনে করে তার নাট্য পরিচালনার কালে এই নাটকটা  হয়তো একটা মাইলস্টোন হতে পারে। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের নাট্য জগতের ক্ষেত্রে। যেখানে অর্থ আর পেশাদারিত্বের অভাবটা প্রতি পদক্ষেপে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।  অবশ্য একা সুদীপার ক্ষেত্রে এতবড় একটা ঝুঁকি নেওয়া কখনই সম্ভব হতোনা, যদি সে তার স্বামী দীপক এবং ‘ভাবনা’-র সকল কলাকুশলীদের সহযোগিতা না পেত।এলাকারই একটা ক্লাব ঘর  অল্প টাকায় ভারা নিয়ে নাটকের রিহার্সাল শুরু করে দিয়েছে। সকল কলাকুশলীদের যাতায়াতের খরচ, টিফিন ইত্যাদির প্রতি সে সজাগ দৃষ্টি রেখেছে। প্রতিদিনের টিফিন আর চায়ের দায়িত্বটা সে সামনের চায়ের দোকানদার নিবারণকে দিয়েছে। নিবারণ প্রতিদিন রিহার্সাল চলাকালীন সময়মত চা আর টিফিন সাপ্লাই করে।

সবার চা খাওয়া হয়ে যাবার পর রঞ্জন লক্ষ করে, সুদীপা তখনো চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বসে কি যেন ভাবছে। সে সুদীপার কাছে এসে বলল- ‘সুদীপাদি, চা তো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে খাবেনা’? রঞ্জনের কথায় সুদীপা চমকে উঠে বলে –‘হ্যাঁ, খাচ্ছি’। সুদীপা ঠাণ্ডা চা-টাই গলাধঃকরণ করে রঞ্জনকে বলে –‘তোরা রিহার্সালটা শুরু করে দে। আমি একটু আসছি’ বলে সুদীপা রিহার্সাল রুমের বাইরে এসেধীরে ধীরে নিবারণের চায়ের  দোকানের সামনে এসে দাড়ায়। দোকানে খুব একটা ভীর ছিল না। দু-তিন জন বসে চা খাচ্ছে। সুদীপা কে দেখতে পেয়ে নিবারণ বলল-‘কিছু লাগবে দিদি? অংশু তো আপনাদের চা দিয়ে এসেছে’।  সুদীপা বলল-‘হ্যাঁ জানি। তোমার সাথে  অংশুর ব্যপারে কিছু কথা বলতে চাই’। কেন, ও কিছু করেছে? নিবারণ একটু ঘাবড়ে  গিয়ে সুদীপাকে জিজ্ঞেস করলো।
না না কিছু করেনি। আমি এমনি জানতে চাইছি। অংশু এখন কোথায়?
ওকে একটু বাড়ীতে  পাঠিয়েছি। ওর সম্বন্ধে বোলতে গেলে তো অনেক  কথা বলতে হয়। তা কি জানতে চান বলুন? নিবারণ বলল। সুদীপা বলল-‘এখানে এভাবে হবে না। তুমি তো রবিবারে বিকেল তিনটে পর্যন্ত দোকান খোলা রাখ। আমদেরও রবিবারে তিনটে পর্যন্ত রিহার্সাল চলে। তারপর না হয় তোমাকে ডেকে নেব। আর একটা কথা তুমি প্রতিদিন অংশুকে দিয়ে আমাদের ওখানে চা পাঠাবে’।

নিবারণ হাসতে হাসতে বলল -‘সে আর বলতে হবেনা দিদি। আজ যখন জানতে পেরেছে যে, ঐ ক্লাব ঘরে আপনারা নাটকের রিহার্সাল করছেন। তখন নিজেই বলল, আমি নাটকের রিহার্সাল দেখতে যাব, মামা। আমি বললাম, ঠিক আছে তুই চা নিয়ে যাস। তখন ওনাদের রিহার্সাল দেখতে পারবি।ওদের চা-টিফিন প্রতিদিন আমার দোকান থেকেই যায়। শুনে খুব খুশী হয়েছে ছেলেটা’। নিবারণ সুদীপার সাথে কথা বলছিল আর খদ্দেরও সামলাচ্ছিল। নিবারণের অসুবিধে হচ্ছে দেখে সুদীপা বলল -‘এখন আসি নিবারণ । তুমি দোকানদারি করো’।সুদীপা রিহার্সাল রুমে ফিরে যায়। সুদীপাকে দেখে রঞ্জন বলল –‘কোথায় গিয়েছিলে সুদীপাদি? আমরা তোমার জন্য বসে আছি’।
তোদের  রিহার্সাল শেষ হয়েছে? সুদীপা রঞ্জনকে বলল। রঞ্জন বলল –‘আজকে যতটুকু করার কথা ছিল, করেছি’।

বাড়ি ফিরে দীপক সুদীপাকে বেশ গম্ভীর  মুখে বসে থাকতে দেখে বলল-‘কি ব্যাপার, আজ তোমার মুড অফ দেখছি? রিহার্সাল ঠিকমত হয়েছে তো’? দীপক জানে সুদিপা এই নাটকটাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। এর জন্য ও প্রচুর পরিশ্রম করছে। দিন-রাত প্রায় এক করে দিয়েছে। রিহার্সাল নিয়মিত ভাবে চালানো, নাটকের সব চরিত্র অনুযায়ী শিল্পী খোঁজা,এ সবই সুদীপাকে একা সামলাতে হচ্ছে। অবশ্য ‘মঞ্চ’ বুকিং থেকে শুরু করে নাটকের জন্য মঞ্চসজ্জা, সব কিছুই সে রঞ্জনের উপর ছেড়ে দিয়েছে। রঞ্জন এ ব্যাপারে খুবই পারদর্শী। সুদীপার কাছ থেকে কোন সাড়া না পেয়ে দীপক ওর হাতের উপর হাত রাখতেই সুদীপা তাকালো। দীপক দেখল, ওর দু’চোখে জল।তোমার চোখে জল কেন? কি হয়েছে? দীপক প্রশ্ন করতেই সুদীপা বলল –‘জানো, সেই চোখ দুটোকে আমি আজ আবার দেখলাম। এতদিন ধরে যে চোখ দুটো আমাকে ঘুমের মধ্যে ডাকতো। আমার কাছে  আসতে চাইতো। অনেকদিন পরে দীপক  সুদীপার মুখে এই কথাটা শুনল। স্কুলে যাবার পথে এক পথ দুর্ঘটনায় তাদের একমাত্র সন্তান ক্লাস এইটে পড়া ‘শঙ্খ’ কে হারাবার পর থেকেই  সুদীপা মানসিক ভাবে ভীষণ রকম ভেঙে পড়েছিল। দীপক ভেবেছিল ছেলে হারানোর শোকে সুদীপা হয়তো পাগল হয়ে যাবে।

সেদিন শঙ্খ কিছুতেই স্কুলে যেতে চাইছিল না। বলেছিল –‘মা, আমি আজ স্কুলে যাব না। তোমার নাটকের রিহার্সাল দেখতে যাব’। সুদীপা ছেলেকে বলেছিল –‘আজ যাও, আগামী কাল তোমার স্কুল ছুটি আছে।  তুমি  আগামীকাল আমার সাথে রিহার্সাল দেখতে যাবে’। কিন্তু সেই ‘আগামী কাল’ শঙ্খ আর দেখতে পারেনি।  স্কুলে যাবার পথেই একটি ট্রাক যমদূতের মতো এসে ওকে  মাটির সাথে পিষে দিয়েছিল।  খবর পেয়ে দীপক আর সুদীপা ঘটনাস্থলে  পৌঁছে দেখে জায়গাটা লোকে লোকারণ্য হয়ে আছে। ভীর ঠেলে সুদীপা আগে এগিয়ে গিয়ে দেখে তার আদরের শঙ্খ একেবারে মাটির সাথে  পিষে গেছে। চারিদিকের মাটি রক্তে লাল।শুধু মাথা থেকে বুক পর্যন্ত অক্ষত আছে। চোখ দুটো তাকানো। সমস্ত মুখটাতে কোথাও কোন যন্ত্রণার প্রকাশ নেই। চোখ দুটো যেনযেন আবদার করে বলছে –‘মা, আমাকে তোমার রিহার্সাল  দেখতে নিয়ে যাবে না’? সুদীপা তার একমাত্র ছেলের ওরকম মর্মান্তিক অবস্থা দেখতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে যায়। কিন্তু দীপক, সে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না।একবার তার শঙ্খের  রক্তাক্ত নিথর  দেহ দেখছে আর একবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে  থাকা সুদীপাকে দেখছে।

এই  দূর্ঘটনাটা ছিল  দীপক –সুদীপার জীবনে একটা  বিধ্বংসী ঝড়ের মতো। ওদের জীবনটাই ওলট-পালট করে দিয়েছে। সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর প্রায় দু বছরের বেশী সময় অতিক্রান্ত হয়েছে।  দীপক অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিলেও সুদীপা এখনো সন্তান হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। প্রায় রাতেই  হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে বোসে কাঁদেআর বলে, ‘শঙ্খ আমাকে ডাকছে। ওর চোখ দুটো আমার কাছে আসতে চাইছে’। দীপক অনেক বুঝিয়ে  ওকে শান্ত করে। দীপক সুদীপাকে ওর এই শোক বিহ্বল পরিস্থিতি থেকে বেরকরে নিয়ে নিয়ে আসার জন্য চেষ্টার কোন  ত্রুটি রাখেনি। শেষে এক  মনোবিদের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল দীপককে। ওনারই  কথামত সে সুদীপাকে আবার নাটকের মধ্যে টেনে এনেছিল। কারন দীপক চেয়েছিল সুদীপা যেন সর্বক্ষণ কাজ নিয়ে ব্যাস্ত  থাকে। অবশ্য এ  ব্যাপারে রঞ্জন সহ ‘ভাবনা’-র  অন্যান্য শিল্পীরা তাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। ওরা না থাকলে হয়তো দীপক সুদীপাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে  আনতে পারতোনা। যাবতীয় অর্থের  ব্যাবস্থা দীপকই করেদিয়েছিল। বেশ চলছিল।কিন্তু এতদিন বাদে সুদীপার মুখে সেই একই কথা শুনতে পেয়ে দীপক বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লো। সে সুদীপাকে বলল-‘আজ রিহার্সালে ঠিক কি হয়েছে, তুমি আমাকে খুলে বল’।  সুদীপা দীপককে অংশু র কথা বলে – ওকে প্রথম দেখেই আমি চমকে উঠেছিলাম। ওর চোখ দুটো  ঠিক যেন আমাদের শঙ্খর চোখ। ও যখন আমার দিকে তাকাল, আমার মনে হল যেন শঙ্খ বলছে, ‘মা আমি তোমার  নাটকের রিহার্সাল দেখবো’। বলে সুদীপা  দীপকের কোলে মাথা রেখে কাঁদতে লাগলো।
(২)

           আগেই বর্ষা শেষ হয়েছে।শরৎ হেমন্তের হাত ধরে ধীরে ধীরে শীতের আগমন ঘটছে। এই সময় ভোরবেলায় একটু শীতের অনুভূতি হয়। প্রতিদিনের মতো আজও  দীপক ও সুদীপা প্রাতঃভ্রমণ শেষে মহানন্দা ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার শ্বেত ধবল  শৃঙ্গের সৌন্দর্য উপভোগ করছে।আজ সূর্যদেব,তার দিনের প্রথম আলোকচ্ছটার কিছু অংশ সেই  শ্বেত শুভ্র পর্বত শৃঙ্গের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে তাকে আরও  নয়নাভিরাম করে তুলেছে। ওরা তাই প্রত্যক্ষ করছে।কেউ কোন কথা বলছে না।   নীরবতা  ভেঙে  এক সময় দীপক সুদীপাকে বলল,  অংশুর খবর কি? দীপক দেখল, কথাটা শোনার সাথে সাথেই সুদীপার  সমগ্র মুখমণ্ডলখুশিতে ভরে উঠলো।  সে বলল – ‘জানতো, অংশু আমার একটা বিরাট সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে’।
দীপক বলল, কি রকম?
যে চরিত্রটার জন্য আমি একটা ১৩-১৪ বছরের ছেলের খোঁজ করছিলাম সেটা অংশু কে দিয়ে করাবো। সুদীপা বলল।
অংশু নাটক করতে রাজি হয়েছে? দীপক সুদীপার দিকে তাকিয়ে অবাক চোখে  প্রশ্ন করলো।
সুদীপা বলল- ‘রাজি কি বলছ তুমি? আমি যখন ওর মামা নিবারণের সামনে ওকে বললাম, তুই আমাদের সাথে নাটক করবি? সঙ্গে সঙ্গে ও রাজি হয়ে গেল। তারপর কি করলো জান, আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল - তুমি আমাকে শিখিয়ে দেবে? যেমনটি করে শঙ্খ আমাকে বলত’। সুদীপা আনমনা হয়ে পড়লো।
দীপক বলল – ‘কিন্তু ওকি পারবে’?
‘ও পারবে। অভিনয় যে ওর রক্তে রয়েছে’। সুদীপা বলল।
তার মানে?  দীপক বলল।
সুদীপা  নিবারণের কাছ থেকে শোনা  ‘অংশু আখ্যান’ দীপককে শোনাল-

(৩)

জলজ্যান্ত মানুষটা হঠাৎ করে যে এভাবে  পুত্র কন্যা সহ শ্রীময়ীকে সংসার সাগরে একা ছেড়ে পরপারে চলে যাবে তা শ্রীময়ী কোন ভাবেই বুঝতে পারে নি।  ছেলে নিবারণ আর মেয়ে  সুজাতা কে নিয়ে দিব্যি চলে যাচ্ছিল দয়াল আর শ্রীময়ীর সংসারটা। মানুষটা সারাদিন শান্তিপুরের বাজারে ঘুরে ঘুরে গামছা লুঙ্গি বিক্রি করতো। সন্ধের আগে ঘরে এসে কোনমতে  একটু মুড়ি আর চা খেয়ে চলে যেত গ্রামের  বটতলায় যাত্রার মহড়া দিতে। মেয়ে সুজাতা বাবার যাত্রা দেখতে ভালবাসত।  মাঝমধ্যে মেয়ের বায়না মেটাবার জন্য দয়াল তাকে নিয়ে যাত্রার মহড়ায় যেত। শ্রীময়ী প্রায় দিন তার স্বামীকে বলতো-‘সারাদিন এতো খাটুনির পর সন্ধেবেলাটা একটু বিশ্রাম নিলেইতো পার। আগেতো তোমার শরীর তারপর যাত্রা’। স্ত্রীর  কথায় হেঁসে দয়াল বলতো–‘তুমি ভেবনা। আমি ঠিক আছি। যাত্রা ছাড়া আমি বাঁচবো না। আমার মনের ভেতরে জমে থাকা কথা গুলোকে জুড়েইতো আমি যাত্রার সংলাপ তৈরী করি। দেখলে না গতবার দূর্গা পুজার সময় আমাদের বিডিও সাহেব আমার যাত্রা দেখে  কত প্রশংসা করেছিলেন। বলেছিলেন, দয়াল তুমি একদিন বড় শিল্পী হবে’।
না, দয়াল আর বড় শিল্পী হতে পারেনি।যাত্রা ছেড়ে তাকে বেঁচে থাকতেও হয়নি। অভিনয় চলাকালীন  হঠাৎ রক্ত চাপ বেড়েগিয়ে যাত্রামঞ্চেই সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিল। সে বছরই নিবারণ  মাধ্যমিকটা পাশ করেছিল। আর সুজাতা পড়ছিল অষ্টম  শ্রেণীতে। স্বামীর মৃত্যুর পর  শ্রীময়ী একেবারে অথৈ জলে পড়ল। ঘটিবাটি বেচে কোনমতে বছর তিনেক চলার পর  শেষে এক আত্মীয়ের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিষয়-আসায় যা কিছু ছিল তা বিক্রি করে দিয়ে  শ্রীময়ী ছেলে মেয়ের হাত ধরে শিলিগুড়িতে চলে আসে।ছেলে-মেয়ে দুজনকেই পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে দিয়ে কিছু রোজগারের দিকে মন দিতে হয়। এরই মধ্যে একদিন সুজাতার সাথে  অনিরুদ্ধ বলে একটি ছেলের আলাপ হয়।  সুজাতা জানতে পারে  অনিরুদ্ধ একটি বেসকারি সংস্থায় চাকুরী করে এবং একটি  সমাজসেবী সংস্থার সাথে যুক্ত। এই সমাজসেবী সংস্থাটার কাজ হল, গ্রামে গ্রামে গিয়ে বিভিন্ন কু-সংস্কার, নিরক্ষরতা, মাদক সেবন ইত্যাদির সম্পর্কে মানুষকে  সচেতন করা। আর সেটা এরা করে কখনো ঘরে ঘরে গিয়ে আবার কখনো মুক্ত মঞ্চে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। অনিরুদ্ধই সুজাতাকে নিয়ে গিয়ে এই সংস্থায় কাজ পাইয়ে দেয়। হাত খরচ হিসেবে কিছু মাসোহারার ব্যবস্থাও করে দেয়।  সুজাতা এও জানতে পারে যে, অনিরুদ্ধ একটি গ্রুপ থিয়েটারের সাথে যুক্ত এবং নিয়মিত মঞ্চে অভিনয় করে। সুজাতার থিয়েটারের প্রতি আগ্রহ দেখে অনিরুদ্ধ তাকে সেই গ্রুপে সামিল করে নেয়। আর নিবারণ, সে কিছুদিন একটা কাপড়ের দোকানে কাজ করার পর রাস্তার পাশে একজনের একটি দোকানঘর ভাড়া নিয়ে চা-জল খবারের দোকান দেয়।এদিকে প্রকৃতির নিয়মে বোয়ে চলা সময়ের সাথে সাথে অনিরুদ্ধ আর সুজাতা একে অপরের অনেকটা কাছাকাছি এসে গেল। শ্রীময়ী মেয়ের মনের ইচ্ছেটাকে বাস্তবায়িত করতে, এক শুভক্ষণে ওদের চার হাত এক করে দিল। সুজাতা অনিরুদ্ধের সাথে তার চির আখাঙ্কিত বিবাহিত জীবনের পথে পা বাড়াল। অনিরুদ্ধ সুজাতাকে নিয়ে শিলিগুড়ি  শহর থেকে কিছুটা  দূরে  শিবমন্দিরে তার নিজের বাড়ীতে ওঠে। সুজাতার বিয়ের প্রায় বছর দুয়েক পর, কালের নিয়মে একদিন শ্রীময়ীকেও এই জগৎ সংসার ছেড়ে চলে যেতে হয়। অবশ্য যাবার আগে তিনি ছেলের বৌ এর মুখ দেখে গিয়েছিলেন।
সময় যেমন চলমান, তেমনি পরিবর্তনশীল। আর এই পরিবর্তিত সময়কে সাথে নিয়ে প্রতিটি মানুষকে তার  জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়। অনিরুদ্ধ সুজাতা তাদের জীবন সংগ্রামটাও ঠিক একই ভাবে চালিয়ে যাচ্ছিল।  সুজাতার একটি ছেলে হয়েছে।  সুজাতার ইচ্ছে ছেলে বড় হয়ে তাদের  মতোই মানুষের জন্য কাজ করবে এবং একদিন বড় মঞ্চ অভিনেতা হবে।  সে সেই সব মানুষদের এক নতুন পথেরআলো দেখাবে। তাই সখ করে ছেলের নাম রেখেছিল অংশু। দেখতে দেখতে অংশু বড় হতে লাগলো। সে এখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে।এই সময়েই ছেলেকে নিয়ে ওদের  এই আশাটা-আকাঙ্ক্ষাটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। ওরা জানতে পারলো অংশু হার্টের সমস্যায় ভুগছে। ডাক্তার অনিরুদ্ধ আর সুজাতাকে সাবধান করে দিয়ে বললেন, ওর হার্টের অপারেশন করাটা জরুরী। যত দেরী করবেন তত বিপদ বাড়বে। তবে একটা কথা, দেখবেন ও যেন কখনই বেশী উত্তেজিত না হয় এবং বেশী দৌড়াদৌড়ি না করে। তাতে ওর হার্টফেল করার সম্ভাবনা আছে। সুজাতারা বিধাতার এই সিধান্তকে মেনে নিয়ে  যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অংশুর  চিকিৎসার ব্যাবস্থা  করতে লাগলো। অংশুর  অসুখের কথা বলে স্কুলের অনুমতি নিয়ে বাড়ীতেই পড়াশোনার ব্যাবস্থা করেছিল।শুধু পরীক্ষার সময় স্কুলে গিয়ে পরীক্ষা দেবে। অংশু তার বাবা মায়ের  কাছ থেকে তাদের কাজের  বিষয়ে অনেক গল্প শুনছিল। কীভাবে  বিভিন্ন গ্রামে খোলা আকাশের নীচে  অভিনয়ের মধ্যদিয়ে  মানুষকে ভালকাজ করার জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়,  সে ব্যাপারেও অনেক কথা শুনেছিল অংশু।  কথায় কথায় একদিন অংশু সুজাতাকে বলেছিল – ‘মা, আমাকে তোমাদের নাটক দেখাতে নিয়ে যাবে’?
হ্যাঁ বাবা, নিয়ে যাব। আগে তুমি সুস্থ হও।
বড় হয়ে আমিও তোমাদের মতো নাটকে অভিনয় করবো, মা। সুজাতা ছেলের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেছিল –‘হ্যাঁ, তুমি তাই করবে’।

কথায় আছে না – মানুষ যা চায় তা পায় না।  সুজাতা আর অনিরুদ্ধ  যা চেয়েছিল তা পায় নি। বরঞ্চ যা পেল তা ওরা স্বপ্নেও ভাবেনি। যেখানে বিভিন্ন  রাজনৈতিক দল শুধুমাত্র ক্ষমতা দখলের স্বার্থে ধর্মকে ভোট যুদ্ধের হাতিয়ার করেছে। ধর্ম, সংস্কারের নামে তারা  বিভিন্ন কু-সংস্কারগুলোকেআরও বেশী করে ওইসব গ্রাম্য নিরীহ মানুষগুলোর কাছে পৌঁছে দিয়েছে। সেখানে সেই সব মানুষ গুলোকে কু-সংস্কার মুক্ত করাটা যে সহজ কাজ হবে না, তা অনিরুদ্ধ ও সুজাতা বেশ ভালভাবেই টের পেয়েছিল। তারা এটাও বুঝতেপেরেছিল যে,  শুধুমাত্র ভোটের স্বার্থ বা ব্যাক্তি  স্বার্থের জন্য এই  সব রাজনৈতিক দলগুলো বা মানুষগুলো কখনই চাইবে না সমাজটা পুরোপুরি কু-সংস্কার মুক্ত হোক। যখনি তাদের এই প্রতিষ্ঠিত স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটবে তখনি তারা ভয়ংকর হয়ে উঠবে। এরকমই এক ভয়ংকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল অনিরুদ্ধ ও সুজাতাকে।প্রথম প্রথম ফোনে ওরা হুমকি পেলেও ব্যাপারটাকে অতটা গুরুত্ব দেয়নি। ওরা একটা হাতে লেখা চিঠি পেয়েছিল তাতে লেখা ছিল – ‘ফোনে সাবধান করা সত্বেও আপনারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এখুনি কাজ বন্ধ করুন। তা না হলে ফল মারাত্মক হবে’।  চিঠিটা পাওয়ার পর  সংস্থার  পক্ষ থেকে পুলিশ কে জানানো হয়েছিল। পুলিশ ব্যাপারটা দেখবে বলে আশ্বাসও দিয়েছিল। পুলিশের আশ্বাসটা যে কতটা গালভরা  আশ্বাস ছিল তা বোঝা গেল এই ঘটনার ঠিক তিন দিন পড়ে। ওরা যে গ্রামে কাজ করছিল, সেই গ্রামেরই এক পরিত্যক্ত স্কুল ঘরে যখন অনিরুদ্ধ আর সুজাতার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া গেল। খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে নিবারণ পৌঁছে যায় শিবমন্দিরে।  পুলিশ মর্গে গিয়ে সেখান থেকে  অনিরুদ্ধ আর সুজাতার মৃতদেহ নিবারণ বাড়ীতে নিয়ে আসে। বাবা মায়ের ভয়ংকর পরিণতি সহ্য করতে না পেরে অংশু জ্ঞান হারায়। তাকে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে এসে শিলিগুড়ি হাসপাতালে ভর্তি  করে দেয়। নিবারণ তার একমাত্র বোন আর ভগ্নীপতিকে দাহ করে, এক সপ্তাহ পর অংশুকে নিয়ে শিলিগুড়িতে চলে আসে। দুই মাস ধরে নিবারণ আর তার বৌ এর  সেবা যত্নে অংশু মোটামুটি সুস্থ হয়ে ওঠে। ঘরে থকতে মন চায় না বলে মাঝে মধ্যে মামার দোকানে এসে বসে।
সুদীপা তার কথা শেষকরে  দীপককের দিকে তাকিয়ে বলল –‘আমি ভাবছি অংশুকে আমাদের কাছে নিয়ে রাখবো। অন্ততঃ নাটকের দিন পর্যন্ত। ওর একটু ভালো চিকিৎসারও দরকার’।      
‘তুমি যে বললে ওকে দিয়ে অভিনয় করাবে’? দীপক প্রশ্ন করলো।
সুদীপা বলল –‘ঠিকই বলেছি। তবে সেটা সম্পূর্ণ ডাক্তারের মতামতের উপরনির্ভর করছে’।
(৪)
ইতিমধ্যে  ভাবনার নাটকের তারিখ ঠিক হয়ে গিয়েছে। ২৫ শে ডিসেম্বর। মঞ্চ বুকিংও হয়ে গিয়েছে। হাতে মাত্র দুমাস সময়। সুদীপাদেররিহার্সাল পূর্ণ গতিতে চলছে।এরমধ্যে একদিন সুদীপা  নিবারণকে সাথে নিয়ে অংশুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল।  ডাক্তার অংশুকে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করে বললেন –‘যত তাড়াতাড়ি পারেন অপারেশনটা করিয়ে নিলে ভাল হয়। আর মঞ্চে অভিনয়ের কথা বলছেন, দেখবেন ও যেন বেশী দৌড়ঝাঁপ না করে। আর বেশী উত্তেজিতও না হয়। আমি একটা ওষুধ লিখে দিচ্ছি। এটা নিয়মিত খাওয়ান’।

যদিও যে চরিত্রটা  সুদীপা অংশুকে দিয়ে করাতে চাইছে, তাতে কোন দৌড়ঝাঁপের ব্যাপার নেই। তবে একটু উত্তেজিত হবার সম্ভাবনা আছে। তাই সুদিপা কোন ঝুঁকি না নিয়ে ঠিক করল অংশুকে দিয়ে অভিনয়টা করাবেনা। ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেড়িয়ে সুদীপা নিবারণকে বলল – ‘তোমার যদি আপত্তি না থকে তবে আজ থেকে আমি অংশুকে আমার কাছে রাখতে পারি? ওর চিকিৎসার যাবতীয় দায়িত্ব আমি নিচ্ছি’।

‘না না আমার কোন আপত্তি নেই। ও আপনার কাছে ভালো থাকবে। যেদিন থেকে ও জানতে পেরেছে যে, আপনি ওকে মঞ্চে অভিনয় করাবেন, সেইদিন থেকে ওর কি আনন্দ! ওর বাব-মা মাড়া যাবার পর কেমন যেন মনমরা হয়ে গেছিল। আমি কতদিন পরে ওকে এরকম আনন্দ করতে দেখলাম’।

সুদীপা বলল- ‘তুমিতো ডাক্তারবাবুর কথা সব শুনলে নিবারণ। আমি এতো ঝুঁকি নিয়ে  ওকে মঞ্চে অভিনয় করাতে পারবোনা। যদি কোন অঘটন ঘটে’। পাশেই অংশু দাঁড়িয়েছিল। সুদীপার কথাটা শোনামাত্র সে নিবারণকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। সুদীপা এগিয়ে এসে ওকে বোঝতে লাগল। বলল- ‘আর কিছুদিন পরেইতো তুই সুস্থ হয়ে যাবি। তারপর তুই যত খুশী মঞ্চে অভিনয় করিস’। কিন্তু অংশু সুদীপার কথায় কর্ণপাত না করে সমানে কাঁদতে লাগলো।নিবারণ বলল-‘আপনি ওকে দিয়ে অভিনয় করান দিদি। তাহলেই ও  বাঁচবে। আর অঘটনের কথা বলছেন, ওর এই ছোট্ট জীবনে যে অঘটন ঘটে গেছে তারচেয়ে  বড় অঘটন আর কি ঘটতে পারে। বড়জোর ওর বাবা-মা র পথ অনুসরণ করবে’। সুদীপা মনে মনে বলল – ‘তোমাকে কি করে বোঝাবো নিবারণ, আমি যে দ্বিতীয়বার আমার শঙ্খকে হারাতে চাই না’। ‘মাসি আমি মঞ্চে অভিনয় করবো না’? অংশুর কথা শুনে সুদীপা ওকে কাছে টেনে নিয়ে পরম স্নেহে ওর চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল-‘হ্যা, করবি। এখন বাড়ি চল’। সুদীপা আর অংশু একটা রিক্সায় উঠলো। নিবারণ  অশ্রুসিক্ত চোখেদেখল, সুজাতা যেন তার অংশুকে নিয়ে বাড়ি যাবে বলে রিক্সায় উঠলো।চোখের জল মুছে নিবারণ তার বাড়ীর পথে হাঁটা দিল। 
(৫)
আজ ২৫ শে ডিসেম্বর। সুদীপার আখাঙ্কিত সেই দিন। দীপক আর রঞ্জন মিলে  আয়োজনের কোন ফাঁক রাখেনি। আমন্ত্রিত অতিথি  হিসেবে শহরের  বিশিষ্ট  নাট্য ব্যাক্তিত্ব থেকে শুরু করে সাংবাদিক এবং বিশিষ্ট মানুষজন উপস্থিত হয়েছেন। দর্শক আসন কানায় কানায় পূর্ণ।সুদীপার দেওয়া আমন্ত্রণ পত্র নিয়ে নিবারণও তার বউকে নাটক দেখতে এসেছে। এর আগে নিবারণ কোনদিন এতোবড় মঞ্চে নাটক দেখেনি। তাছাড়া অংশুও বলেছিল, মামা তুমি আর মামি আমার নাটক দেখতে আসবে কিন্তু।  নাটক শুরুর আগে  ভাবনার পক্ষ থকে দশ মিনিটের  সংক্ষিপ্ত একটা প্রেস-মিটের ব্যবস্থা  করেছিল সুদীপা।  যেহেতু সুদীপা নিজেই এই নাটকের একজন অভিনেত্রী তাই দীপক আর রঞ্জন এই প্রেস-মিট এ্যাটেন্ড করল।প্রেস-মিট শেষ হওয়ার পর মূল অনুষ্ঠান  অর্থাৎ ‘ভাবনা’ প্রযোজনায় নতুন নাটক ‘আশা-আকাঙ্খা’ শুরু হল।
       
নাটকের বিরতিতে  অধিকাংশ দর্শক অংশুর অভিনয়ের প্রশংসা করছে দেখে নিবারণের মন খুশিতে ভরে গেল। সীটে বসেই সুজাতার উদ্দেশ্যে ওপর দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, দেখ সুজাতা তোর অংশু তোর ইচ্ছেটা পুরোন করেছে। আজ সবাই ওর অভিনয়ের কতো  প্রশংসা করছে।
       
নাটকের শেষ দৃশ্যের অভিনয় চলছে – ‘কিশোর মাধব মা – মা বলে ডাকতে ডাকতে এসে দেখে, বাড়ীর উঠনে তার মায়ের রক্তাক্ত দেহ পড়ে রয়েছে। সে বুঝতে পারে গ্রামের জমিদার তাদের জমির লোভে গুণ্ডা লাগিয়ে তার মাকে খুন করেছে। মাধব চিৎকার করে বলল, তোমরা আজ শুধু আমার মাকে খুন করনি। আমার সব আশা-আকাঙ্খাকে খুন করেছো’। নাটকের স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী মাধব রূপী অংশুর এখানে থামার কথা ছিল। কিন্তু সে না থেমে বলতে লাগলো –‘কেন তোমরা আমার মাকে মেরে ফেললে। আমার মা- তো শুধু নাটকে অভিনয় করত। তোমরাতো আমার বাবাকেও মেরে ফেলেছ। আমি এখন কার কাছে থাকবো’। এই বলে সে মা-মা বলে চিৎকার  করে দৌড়ে গিয়ে বিধবা মায়ের বেশে শুয়ে থাকা রক্তাক্ত সুদিপার বুকের ওপর আছড়ে পড়ে জ্ঞান হারাল। মঞ্চের আলো ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হল। পর্দা পড়লো। দর্শক আসনের সকল দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানাল। 
কিছুক্ষণ পর আবার মঞ্চের পর্দা উঠল।  দর্শকরা দেখল  সুদীপার কোলে মাথা রেখে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে অংশু। যেন সে এতদিন পর তার মায়ের কোল ফিরে পেয়েছে। সকল কলাকুশলীরা নীরবে চোখের জল ফেলছে। সুদীপার চোখে আজ এক ফোঁটাও জল নেই। শুধু নীরবে অংশুর বোজা চোখ দুটোর ওপর হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে নিবারণ মঞ্চে উঠে অংশুর পায়ের কাছে দাঁড়াল।

অংশু চলে গেল। কিন্তু অংশুর মৃত্যুএক  নাটকের জন্ম দিল। বলা ভাল একটা আন্দোলনের জন্মদিল। যাঅংশু আখ্যানহয়ে  প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবে।