সম্পর্ক
জায়গাটা ভারী নির্জন। উত্তর শহরতলীর রেলস্টেশনের লাগোয়া এই এলাকায় রেলগাড়ীর ঝমাঝম শব্দটাই যা মাঝেমধ্যে নীরবতাকে
ভেঙে বৈচিত্র্য আনে । ছোট একটা কচুরীপানা ভরা ডোবা, পাশে
পুরসভার বানানো জঞ্জাল ফেলার বড় সিমেন্টের ডাষ্টবিন, যেখানে খনিক দূরবর্তী বাজার,হাউসিং,নার্সিংহোম,আর টয়
ফ্যাক্টরীর আবর্জনা গাদা হয়ে থাকে বছরভোর।অনতিদূরে বন্ধ হয়ে যাওয়া জুটমিলের
ভাঙাচোরা ধাঁচাটা অনেকখানি জায়গা জুড়ে ধুঁকছে। আগাছার জঙ্গলে ঢাকা। লোকজনের
যাতায়াত বিশেষ নেই। কুকুর ভবঘুরেদের আড্ডা। অসামাজিক কাজকর্মেরও অভাব নেই বলেই
জনশ্রুতি। সাধারন লোকজন তাই যাতায়াতের সময় জায়গাটা এড়িয়েই চলে। একটু ঘুরপথ হলেও
রেললাইনের পাশের ইঁটের রাস্তাটাই লোক টানে বেশী।
আজ হঠাৎই নিস্তরঙ্গ নৈশব্দে বাঁধা পড়েছে এক সদ্যোজাতার কান্নায়। একটা ছোট্ট পুরানো কাপড়ের
পুঁটলীটার মধ্যে থেকে হাত পা ছুঁড়ে চিৎকার করছে বাচ্চাটা। নোংরার ওপর যত্ন করে
কাপড়ে মুড়ে কেউ একান্তে রেখে গেছে। ছেড়ে গেছে। ডাস্টবিনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা
বাদামী নেড়ি কুকুরের দৃষ্টি সেদিকেই। চোয়াল থেকে নোংরা লালা গড়িয়ে পড়ছে জিভ বেয়ে।
কাছেই ডাষ্টবিনের সিমেন্টের দেওয়ালে বসা, কি
পাশের কৃষ্ণচূড়াগাছের ডালে বসা, ইতস্তত
ওড়া কাকগুলো লোভী দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। সাহসী একটা কাক উড়ে এসে বসে বাচ্চাটার
কাছে। ঘেউ ঘেউ করে এগিয়ে আসে কুকুরটা। যেন খাবারের ভাগ কাউকেই দিতে রাজি নয়।
বাচ্চাটার চোখে মুখে এসে বসছে পোকা মাছি,লাল
পিঁপড়ে। তারস্বরে চিৎকার করছে শিশুটি।। হয়তো ঠাণ্ডাও লাগছে তার। মাতৃগর্ভের ওম
থেকে বেড়িয়ে সে পায়নি নরম কাঁথা আর মায়ের কোমল স্নেহের উষ্ণতা। তার অভিমান তীক্ষ্ণ
চিৎকার হয়ে চীরে দিচ্ছে ভোরের শান্ত নীরবতা। দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে সে প্রতিবাদ
করছে গলে পচে যাওয়া এই সমাজ ব্যবস্থার। যেখানে একজন মা তার সন্তানকে লোকলজ্জায় কি
অন্য কোন চাপে ফেলে যেতে বাধ্য হয়।
একটা কিশোর কন্ঠ শোনা যায়।
-
‘বাঘু, এই বাঘু। কোথায় গেলি?’
সাথে আরেকটি
মিহি গলা তাল মেলায়।
বাচ্চাটার পাশে বসে থাকা কুকুরটা উঠে দাঁড়ায়। জিভ দিয়ে মুখ চাটতে চাটতে লেজ নাড়ায়।
হাই তোলে কিন্তু দৃষ্টি সরায় না। একটু পরে ভৌ ভৌ করে ডেকে ওঠে। ডাষ্টবিনের অন্য
সাইড দিয়ে এগিয়ে আসে দুই মূর্তি। বড় ছেলেটির মেরে কেটে বছর বারো, অন্য ছেলেটির আরো কম। স্টেশনে ভিক্ষে চাওয়া দুই পথশিশু।
কোমরে দড়ি বাঁধা ছেঁড়া ময়লা হাফপ্যান্ট।একজনের হাতে একটা বাসী পাউরুটি, আজকের রোজগার। অন্যজনের হাতে কয়েকটা শাপলা,আধপচা দাগধরা কয়েকটা বেগুন। আজকের দুপুরের খ্যাঁটের
উপাদান। কুকুরটা আবার ডাকতে ডাকতে দৌড়ে গিয়ে বড় ছেলেটির মলিন হাফপ্যান্টের প্রান্ত
দাঁতে কামড়ে ধরে অকুস্থলের দিকে টানতে থাকে। হাবভাবে বোঝা যায় এরাই বাঘু অর্থাৎ
কুকুরটির মালিক।
শরীর এখনো অশক্ত। কলেজ বন্ধ, মা বাবার সাথে
কসবার বাড়ীতেও নেই পৃথা ।
দক্ষিণেশ্বরের কাছেই ওর
ছোটপিসির বাড়ীতে আছে আজ
মাস ছ’য়েক।
আসল কারন কেউ জানে না। পাশ ফিরে শোয় পৃথা। দুচোখে জলের ধারা থামেনা তার। সাতটা দিন
কেটে গেছে,
এখনও বাচ্চাটার কথা ভেবে প্রতি
রাতে কাঁদে সে। কিছুতেই ভুলতে পারেনা নিজের ভুলের কথা। ভালবেসে নিজের সর্বস্ব
দিয়েও ঠকে যাবার কথা। চরম মানসিক আঘাত পাবার কথা। বাড়ীতে শারীরিক অসুবিধা জানাজানি
হবার পর ওর চরম আপত্তি স্বত্তেও গাইনোকলোজিস্টকে দেখিয়ে অ্যাবরেসনের কথা বলা
হয়েছিল। কিন্তু সমস্যা ছিল পৃথার একান্ত শারীরিক যার অনিবার্য ফল স্বরূপ পৃথার সন্তানের জন্ম, এরপর লোক লজ্জার ভয়ে হাসপাতাল থেকেই সেই সন্তানকে সরিয়ে
দেওয়া। ওকে অবশ্য বলা হয়েছিল যে ওর মৃত সন্তান হয়েছে। কিন্তু হাসপাতালের একজন
নার্স পরে কেন জানিনা ওকে আসল ঘটনা বলে দেয়। বলে দেয় যে, কাছেই কোন এক নির্জন এলাকায় সেই সদ্যজাতা বাচ্চাটিকে
রেখে আসা হয়েছে,
যদি কারও দয়া হয়, যদি কোন নিঃসন্তান দম্পতি তুলে নিয়ে যান বাচ্চাটাকে।
যদিও এর পরের খবর কেউই জানেনা। তবুও
ওর মনে একটাই আশা, সে যেখানেই থাকুক ,ভালো থাকুক, বেঁচে
থাকুক, সুস্থ থাকুক।
ফাগুনমাস। রেললাইনের ওপর খোলা
নীলাকাশটা পড়ন্ত বিকালে
মলিন লাগছে। নীল পটভুমিকায় থোকায় থোকায় ফুটে আছে লাল কৃষ্ণচূড়া।
আকাশে কয়েকটা কাক চক্রাকারে উড়ছে।রেললাইনের অনতিদূরে ভাঙা পরিত্যক্ত জুটমিলের
পাশের রাস্তাটা যেখানে ডোবার পাশে পুরসভার বড় ভ্যাটটার পাশে হঠাৎ যেন থমকে গেছে
সেখানে রাস্তার ধারে ঢালু জায়গাটা ঘেঁষে ইতস্তত জলজ আগাছা আর বুনো ঝোপঝাড়ের ভীড়।
একটা ঝোপের পাশে রক্তমাখা একটা বস্তা। চটের বস্তা। সেখান থেকে একটা হাত বার হয়ে
আছে। কয়েক মুহুর্ত তাকালে বোঝা যেতে পারে হাতটি হয়তো কখনো ছটফটে একটি শিশুর ছিলো।
ওই যে মনে হচ্ছে তার ছোট ছোট দুই পা যেন বস্তায় ঢেকে আছে। মুখের একটা পাশও বস্তা
থেকে বার হওয়া হয়ত রক্তের গন্ধ পেয়ে কুকুরগুলোই বস্তা কামড়ে ছিঁড়ে নিয়েছে তারপর
কোন নামানুষের এই পাশবিক কুকীর্তি দেখে পশু হয়েও লজ্জা পেয়ে সরে গিয়ে খানিকদূরে
থাবা গেড়ে বসে পাহাড়া দিচ্ছে। ছোট্ট একটা মাথা, একমাথা
চুল আলুথালু। একটা লাল ফিতে প্রায় খুলে গিয়েও কিছুতেই যেন মায়া ছেড়ে সরে যেতে
চাইছেনা । আকাশের দিকে খোলা দুই চোখ। নি:সীম শূণ্যতা মাখা। চোখগুলোয় কোন ভয় নেই, কান্না নেই। কোন প্রশ্নও নেই। শুধু অবিশ্বাস আর কেমন
যেন এক থমকে যাওয়া নিস্পাপ সারল্য, থমকে
গেছে কাকেরাও। তাদের কর্কশ কণ্ঠের কোন আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। ঠুকরে দেবার ইচ্ছে
জাগছে না তাদের। তারা নেমে আসছে না। শুধু চক্রাকারে উড়ছে। অন্ধকার নামবে, গুনগুন করে কাঁদছে কয়েকজন জমায়েত স্টেশনবাসী ,কেউ মেয়েটার কাকা, কাকী, মামা মামী,মেসো
মাসী, দাদা দিদি,রক্তের
নয় কিন্তু তবু গাঢ় ভালবাসার , পারস্পরিক
নির্ভরতার সম্পর্ক ওদের। ওরা বসে আছে পুলিশের জন্য আর মেয়েটার দুই দাদার জন্য। দু’জনই ট্রেনে হকারী করে। খবর গেছে তাদের কাছে। বছর দশেক
আগে এই আবর্জনার গাদায় ফেলে যাওয়া এক সদ্যোজাতাকে নিয়ে দুই কিশোর বালক যে
সম্পর্কের বাঁধন গড়ে তুলেছিল তা ভেঙে চুরমার হওয়ার মুহূর্তটা যে কতটা বেদনার তা
বুঝছে বলেই একে একে সব স্টেশনবাসীরা জড় হচ্ছে ওদের সামাল দিতে। ওদের ভরসাতেই ছোট্ট
একরত্তি বোনটাকে রেখে রোজগারে যেত দু’ভাই।
কখন যে মেয়েটা নজর এড়িয়ে একলা হয়ে গেল, কখন
যে দূরে সরে গেল সুরক্ষিত এলাকা ছেড়ে, কখন
যে এক নরপশুর আদিম প্রবৃত্তি জেগে উঠলো এই একরত্তি মেয়ের মধ্যে নারীত্ব আবিস্কার
করে, কে জানে।
পৃথা নামের সেই নিতান্ত অবুঝ কিশোরীপ্রায় তরুণীটা আজ দশটি বসন্ত পেরিয়ে আজ একটি নামজাদা
সংবাদ প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টার। ভালোভাবে বলতে গেলে ক্রাইম রিপোর্টার।।
সংসার-সন্তান-সম্মান সব-ই আছে তার।তারপরও কোন কোন দিন বিকেল বেলার অবসন্ন সময়ে
তার মনে পড়ে যায়, মন দিয়ে মন নেবার ছলনার
কথা। এক সুঠাম যুবকের মিথ্যে প্রতিশ্রুতির কথা। সে তো হারিয়ে গেছে পৃথার জীবনের
পাতা থেকে। ছিল এক রক্তের দাগ। সময়ের ভাঁজে সেও আর মনে পড়ে কই! তবুও কেন এ
প্রতীক্ষা,
এই মন খারাপ, এই সব পেয়েও না পাবার দুঃখ? এর উত্তর সে জানেনা।
পুলিশ এসে ধর্ষিতা বালিকার নিথর
শব তুলে নিয়ে গেছে অনেক আগে, বড় ভাইটি শক্তমুখে
চুপ করে থাকলেও
ছোট ভাইটি শাপশাপান্ত
করে গালি দিয়ে কেঁদে ভাসিয়েছে । কেঁদেছে ঐ মেয়ের বয়সী সন্তানদের মা বাবারা, অজানিত আশঙ্কায়, অসহায় ক্রোধে, কেঁদেছে মেয়েটার সমবয়সী
খেলুড়েরা, যাদের সাথে
সকালেও কথা বলেছে খুশী
নামের মেয়েটা।খবরের ছোট্ট হেডলাইন বানাতে
এসে কেমন যেন বিহ্বল হয়ে পড়েছে পৃথা। কেন জানি না ওর দু'চোখ
ভিজে ওঠে,ওর বাচ্চাটা বেঁচে থাকলে এই রকম বড়ই হতো এখন। দশ বছর।ওর
বাচ্চাটা থাকলে আজকে হয়তো অন্যরকম জীবন হত পৃথার। কিন্তু তার যদি এইরকম ভবিতব্য
হোত? ভাবতেই বুকটা ব্যাথায় মুচড়ে ওঠে ওর। কষ্ট লুকাতে অন্য
কিছু ভাবতে চেষ্টা করে সে। না কোন অমঙ্গল যেন না হয় তার। সে যেখানেই থাকুক ,ভালো থাকুক, বেঁচে
থাকুক, সুস্থ থাকুক।