গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৩

রিয়া দাশগুপ্তা

এক অমর প্রেমের গল্প

অর্ফিয়াস ছিলেন দেবতা অ্যাপোলোর ছেলে। অর্ফিয়াসের মা ছিলেন ক্যালিওপ, যিনি ছিলেন পিরাস এর মেয়ে। অর্ফিয়াস বাস করতেন পিম্পলিয়ায়। যেখানে তিনি তাঁর শৈশব, তাঁর মা এবং বোনদের সাথে কাটিয়েছেন। দেবতা অ্যাপোলো অর্ফিয়াসকে খুব ভালবাসতেন এবং তিনিই প্রথম অর্ফিয়াসকে লাইর বাজানো শেখান। এটা গ্রীক পুরানের অসাধারণ এক প্রেমগাথা । অর্ফিয়াস এবং ইউরিডিস এর প্রেম গাথা। অর্ফিয়াস এর কাহিনী প্রায় একটি মহাকাব্য। পুরান অনুসারে অর্ফিয়াস ছিলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানব সুর স্রষ্টা। দেবতাদের পরে মরণশীল দের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম সুরের জাদুকর এই অর্ফিয়াস। মুলত তিনি ছিলেন একজন বাঁশি বাদক, যেটার নাম ছিল লাইর। দেবতা হারমিসের তৈরি এ বাঁশির পূর্ণতা পেয়েছে অর্ফিয়াসের কাছে। কথিত আছে ,তাঁর সুর শুনে প্রাণীকুল থেমে যেতো , নদীর গতিপথ বদলে যেতো। গাছপালা তার শিকড় ছিঁড়ে সামনে এগিয়ে যেতো ,পাথর থেকে ঝরে পড়তো কান্না। এমনও হয়েছে যে অর্ফিয়াসের সুর শুনে দেবতাদের যুদ্ধ থেমে গেছে।,ঝরে যাওয়া ফুলগুলো আবার হেসেছে । অর্ফিয়াসের এই জাদুর সংগীত একবার গ্রীক অভিযাত্রিকদের নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছিলো ।

গ্রিক অভিযাত্রি জেসন অর্ফিয়াসের সাহায্য নিয়েছিলো সাইরেন দ্বীপ পার হবার জন্য । সাইরেন দ্বীপ ছিল নাবিকদের জন্য এক ভয়ংকর দ্বীপ । সাইরেনবাসীরা ছিল অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক পাখি । তাদের গানের গলা এতই চমৎকার ছিল যে সেই গান নাবিকদের কানে পৌঁছালে নাবিকরা দ্বীপের দিকেই সম্মোহিত হয়ে এগিয়ে যেত। ফলে জাহাজ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে মৃত্যু হতো সবার । জেসনের দল যখন সাইরেন দ্বীপের পাশ থেকে যাচ্ছিলো , তখন অর্ফিয়াস তার বাঁশি বাজানো শুরু করলেন । তাঁর সুর সাইরেনদের সুরকে ছাপিয়ে গেলো । নাবিকরা নিরাপদে দ্বীপ পার হতে পারলো । গ্রিসে ফেরত আসার পর অর্ফিয়াস এক অসম্ভব সুন্দরী মেয়ের প্রেমে পড়লেন । তার নাম ইউরিডিস । ইউরিডিস কে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে যায় অর্ফিয়াসের । প্রেমে মত্ত হয়ে অর্ফিয়াস ইউরিডিসকে তার ভালোবাসার কথা জানালেন । কোন কুমারীর পক্ষে তাঁর সুরের মায়াকে প্রত্যাখান করার ক্ষমতা সত্যিই ছিল না । ইউরিডিস অর্ফিয়াসকে নিরাশ করেনি । তাঁর পবিত্র ভালোবাসা ইউরিডিস সাদরেই গ্রহন করে । অল্প কিছুদিনের মাঝেই তাঁরা বিয়ে করেন । কিন্তু দুর্ভাগ্য তাঁদের সুখকে স্থায়ী করেনি । বিয়ের দিনই ইউরিডিস তার সখীদের সাথে নিয়ে বাগানে হাঁটছিল । অ্যারিস্টাসের চোখ পড়ে ইউরিডিস এর উপর । অ্যারিস্টাস কর্তৃক ধৃত হয়ে ইউরিডিস এক ভয়ঙ্কর বিষাক্ত সাপের উপরে পা ফেলে । বিষাক্ত সাপ তার ছোবল বসাতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব করেনি ।

সাপের দংশনে তীব্র বিষে নীল হয়ে ইউরিডিস সাথে সাথেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে । ইউরিডিসের মৃত্যুতে অর্ফিয়াস শোকে পাগলপ্রায় হয়ে পড়েন । তাঁর বিষণ্ণ সুরে দেবতারাও কেঁদে ফেলেন । অর্ফিয়াস দুঃসাহসী হয়ে ওঠে । তিনি পাতালপুরীতে গিয়ে ইউরিডিসকে ফেরত আনার সংকল্প করেন । তবে এই পথ ছিল খুবই বিপদসংকুল । পথ চলতে চলতে তিনি পৌঁছান আকেরুসিয়া নামের এমন এক উপত্যকাতে যেখান থেকে পথ গভীর হতে হতে পাতালপুরীর দিকেই নেমে গেছে । সেখানে অর্ফিয়াস এমন এক মায়ার সুর উঠালেন তাঁর বীণায় , যে সমস্ত পাতালপুরী স্তব্ধ হয়ে গেলো তাঁর সেই সুরে । মৃত্যুপুরীর দরজায় পাহারা থাকা কুকুর সারবেরাস থমকে গেলো। সিসিফাস তাঁর কাজ ফেলে বসে রইলেন বিশ্রামে , ইকসায়নের অগ্নিচক্র স্থির হল , ট্যান্টালাস ভুলে গেলেন তাঁর তৃষ্ণার কথা , ভয়ঙ্কর ফিউরি দেবীদের চোখ থেকে প্রথমবারের মত অশ্রু ঝরল ।

হেডিসের রাজা ও রানী মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই সুর শুনলেন , এবং অবশেষে ইউরিডিসকে অর্ফিয়াস এর সাথে যেতে দিতে রাজি হলেন । তবে শর্ত একটাই ছিল যে মৃত্যুপুরী থেকে বের হবার আগে অর্ফিয়াস ইউরিডিসকে দেখতে পারবেন না , যদি তিনি দেখেন ,তবে ইউরিডিস চিরদিনের জন্য আবার হারিয়ে যাবে । অর্ফিয়াস এ প্রস্তাব গ্রহন করেন । তিনি তাঁর বাঁশি বাজিয়ে পথ অতিক্রম করছিলেন , পিছে ছিল ইউরিডিস । তিনি জানতেন তাঁর পিছে থাকবে ইউরিডিস , কিন্তু তবু তাকে এক পলক দেখার জন্য তাঁর হৃদয় আকুল হয়ে উঠলো । যখন পথ আর বেশি বাকি নেই , অন্ধকার মিলিয়ে মর্ত্যলোকের আলো দেখা যাচ্ছে , ঠিক এসময় দেবতাদের সতর্ক বানী অগ্রাহ্য করে অর্ফিয়াস পিছে তাকালেন। তিনি তাঁর হাত বাড়ালেন ইউরিডিসকে আলিঙ্গনের জন্য ,কিন্তু ইউরিডিস দেখতে দেখতে হারিয়ে গেলো । শোকে বিহব্বল অর্ফিয়াস মৃত্যুপুরীর দরজায় এসে তাঁর ইউরিডিসকে হারালেন। পাগলপ্রায় হয়ে তিনি আবার মৃত্যুপুরীতে ফেরত যেতে চাইলেন। কিন্তু জীবন্ত কাউকে মৃত্যুপুরীতে দেবতারা দ্বিতীয়বার ঢুকতে দিতে পারেন না। অর্ফিয়াসকে একাই মর্ত্যলোকে ফিরে যেতে হল । বিষণ্ণতায় ডুবে গিয়ে অর্ফিয়াস মানুষের সাহচর্য ত্যাগ করলেন। তাঁর সুরই হল তাঁর একমাত্র সঙ্গী। একা একা তিনি ঘুরে বেড়াতেন থ্রেসের দুর্গম সব অঞ্চলে। তাঁর সুরের একমাত্র শ্রোতা ছিল প্রকৃতি ,গাছপালা ,পর্বতমালা। নিঃস্ব ,একাকী অর্ফিয়াস এভাবেই ঘুরে বেড়াতে থাকেন দিনের পর দিন। অবশেষে একদিন থ্রেসিয়ান মেইনাডরা তাঁকে আক্রমন করলো তাদের দেবতাকে অবমাননার জন্য। তারা হত্যা করলো মায়ার সুরের জাদুকরকে। তারা তাঁকে হত্যার পর তাঁর দ্বিখণ্ডিত মাথাকে নিক্ষেপ করলো হিব্রুস নামের এক নদীতে , যা লেসবস উপকুলে গিয়ে মিশেছে। অবশেষে মিউজরা অলিম্পিয়াসের পাদদেশে তাঁর দেহাংশ কে সমাধিস্থ করে । যে সমাধিক্ষেত্রে মধুর গান গেয়েই চলে নাইটেংগেল পাখিরা । তাঁর বাঁশি অর্থাৎ লাইর খানা কে তারাদের মাঝে স্থান দেয়া হয় । অর্ফিয়াস মৃত্যুর মাধ্যমে মিলিত হন তার প্রিয়তমা ইউরিডিস এর সাথে । তাঁর দীর্ঘ অপেক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটে এভাবেই ।।

আমার গল্পটি ফুরালো নটে গাছটি মুড়োলো