গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৩

অশোক কুমার লোধ

তিন্নি

            তিন্নির  মেয়েবেলাটিকে  অনায়াসে  ছেলেবেলা  বলা  যায় , কারণ  তিন্নি  কখনো  পুতুল  খেলে  নি , এক  দঙ্গল  ছেলের  সাথে  পাল্লা  দিয়ে  খেলেছে  ফুটবল , ক্রিকেট , গুলি  ডাণ্ডাও ! যে  কোনও  খেলায়  লড়াই  করে  ছেলেদের  হারিয়ে  দিতে  পারলেই  তার  আনন্দ । অমন  গেছো  মেয়ের  বাবা  মায়ের  চিন্তার  অন্ত  নেই  বলাই  বাহুল্য । তিন্নির  মেয়ে  হয়ে  ওঠার  অপেক্ষা  শেষ  লো  হঠাৎ  করে  বারো  পেরিয়ে  তেরতেই । খেলতে  খেলতে  কখন  যে  রক্তস্রোত  নেমে  এসেছে  দু-পা  গড়িয়ে ! অথচ  কোনও  ব্যথা  নেই , যন্ত্রণা  নেই , আঘাতও  লাগেনি  কোনও ! মায়ের  সমস্ত  কথা  শুনে  তিন্নি  বুঝলো সে  তার  ছেলে  বন্ধুদের  থেকে  কতটা  আলাদা , হঠাৎ  কেমন  শান্তও  হয়ে  গেলো । কিন্তু  দিনভর  কি  যে  করবে  সে ? কত  আর  পড়বে ? মা  বললেন , ছবি  আঁকো  তিন্নি – আনন্দের  ছবি , দুঃখের  ছবি , মন  খারাপের  ছবি , প্রকৃতির  ছবি - যখন  যা  মন  চায় । ছবি  আঁকার  নেশা  ধরে  গেলো  তিন্নিরও । সাথে  গল্পের  বই  পড়ার  নেশাও । এমনিতে  সে  পড়াশোনাতে  বেশ  ভালো , যত  কমই  পড়ুক  না  কেন  ক্লাসে  বরাবর  সে-ই  প্রথম । ফলে  মা  বাবারও  তিন্নিকে  অকারণ  শাসন  করতে  হয়  না । মাঠে  নেমে  আর  না  খেললেও  ছেলেদের  সাথেই  তার  বন্ধুত্ব    প্রতিযোগিতা  দুটিই  জমে  বেশী । মেয়েলী  ন্যাকামিগুলো  ওর  মোটেই  সহ্য  হয়  না । এই  লো  তিন্নি , স্বকীয়তায়  বেড়ে  ওঠা  ব্যতিক্রমী  একটি  চরিত্র ।

তিন্নি  তখন  স্কুলের  গণ্ডী  পেরিয়ে  কলেজে । শুধু  গুণ-ই  নয়  রূপেও  সে  কম  যায়  না , ব্যক্তিত্বের  সৌন্দর্যে  সে  আলো  ছড়ায়  তার  চারপাশে  সব  সময় । তবুও  তিন্নিকে  স্পর্শের  স্পর্ধা  দেখায়  না  কোনও  ছেলেই  যদিও  তার  ছোটবেলার  ছেলে  বন্ধুদের  সাথে  অকপটে  আলোচনা  করে  জীবনের  সমস্ত  কিছু  নিয়েই । ওর  বন্ধুরাও  বেশ  বুঝে  গেছে  তিন্নির  দ্বারা  আর  যাই  হোক , ন্যাকা  ন্যাকা  কথা  লে  বোকা  বোকা  প্রেমে  হাবুডুবু  খেতে  পারবে  না  কক্ষনো । একে  পড়াশোনায়  তুখোড়  তার  ওপর  ওই  দুর্বার  ব্যক্তিত্ব ! কিন্তু  তিন্নির  মধ্যেও  যে  একটা  অদ্ভুত  নরম  মনের  নারী  আছে  সেটা  কেউ  বুঝতেই  পারে  না । তিন্নি  নিজেও  মাঝে  মাঝে  খুব  একাকী  বোধ  করে , একজন  এমন  পুরুষ  সঙ্গী  সে  চায়  যার  উপর  নির্ভর  করা  যাবে  নিশ্চিন্তে , যে  তাকে  খুব  আদর  করবে , বকবে , শাসন  করবে ! কিন্তু  নাহ , মনের  এই  নরম  দিকটি  সে  সযত্নে  আড়াল  করে  রাখে  প্রতি  মুহূর্তে ।  

স্বপ্ন  পুরুষের  সাথে  তার  দেখা  লো  যখন  সে  বিশ্ববিদ্যলয়ে । জৈব  রসায়নের  মেধাবী  ছাত্র  এবং  স্কলার  তন্ময় । যেমন  সুপুরুষ  সে  চেহারায়  তেমনই  অসাধারণ  ব্যক্তিত্ব    অফুরান  রসবোধ । তিন্নি  একদম  ফিদা । তিন্নিকে  পড়াশোনার  ব্যাপারেও  গাইড  করে  আসছে  তন্ময়  সেই  প্রথম  পরিচয়ের  দিন  থেকেই । তিন্নির  মায়ের  সহকর্মীর  ছেলে  তন্ময় । মা-ই  একদিন  জানায়  তন্ময়ের  পরিচয় , যে  কোনও  রকম  অসুবিধেয়  পড়লে  যেন  তন্ময়কে  জানাতে  দ্বিধা  না  করে  সে । না  তিন্নি  তখনও  চিনতই  না  তন্ময়কে , তন্ময়-ই  একদিন  যেচে  পরিচয়  করে  যায়  তিন্নির  সাথে । দারুণ  বন্ধু-সুলভ  আচরণ  তন্ময়ের । তারপর  থেকেই  তিন্নি  বিভিন্ন  সমস্যায়  ছুটে  গেছে  তন্ময়ের  কাছে  বারবার , হাসিমুখে  সব  সমস্যার  সমাধান  করেছে  সে  প্রতিবারই । কিন্তু  কখনই  কোনও  বাড়াবাড়ি  নেই  তার  আচরণে , নেই  তিন্নিকে  অকারণ  স্পর্শের  অভিপ্রায় , নেই  কোনও  আত্ম  অহংকার । তিন্নি  ঠিক  ভাবে  বুঝে  উঠতেই  পারে  না  তন্ময়ের  মনের  কথা । তিন্নি  চাইছে  তন্ময়  নিজে  থেকেই  জানাক  যে  সে  তিন্নিকে  ভালবেসে  ফেলেছে , তিন্নিকে  তার  চাই  আজীবনের  সঙ্গী  হিসেবে । এমনিতে  তন্ময়  তিন্নিকে  যে  বেশ  পছন্দ  করে  আর  সুযোগ  পেলে  গল্পের  জাহাজ  ভাসায়  অলীক  সমুদ্রে  সেটা  তিন্নি  বেশ  বুঝতে  পারে । তবু  মন  চায়  আরও  বেশী  কিছু । তন্ময়  তবুও  তেমন  রে  কিছুই  বলে  না , তিন্নিরও  আর  তর  সয়  না , অবশেষে  তিন্নি  নিজেই  তন্ময়কে  সরাসরি  বিয়ের  প্রস্তাব  দিয়ে  ফেলে  একদিন । তন্ময়কে  এতো  বোকা  আর  আন-স্মার্ট  হতে  আগে  কখনো  দেখে  নি ।  তন্ময়  হঠাৎ  যেন  পালাতে  চাইছে  তিন্নির  কাছ  থেকে ! তিন্নি  তো  অবাক ! তিন্নি  এও  জানে  যে  তন্ময়ের  সাথে  কোনও  মেয়ের  কোনোদিন  কোনও  প্রেমের  সম্পর্ক  ছিল  না  আর  এখনো  নেই , তবুও  কেন  এত  অস্বাভাবিক  হয়ে  উঠছে  তন্ময় ?


ছোট  থেকেই  তিন্নির  অদম্য  জেদ , সে  যখন  মনে  প্রাণে  তন্ময়কে  ভালোবেসেছে  তখন  সে  তন্ময়কেই  বিয়ে  করবে  নচেৎ  বিয়েই  করবে  না , জানিয়ে  দিয়েছে  তার  মা  কেও । তিন্নির  এবং  তন্ময়ের  বাড়ীর  সকলেই  তিন্নির  এই  সিদ্ধান্ত  জেনে  খুব  খুশী  কিন্তু  তন্ময়ের  দিক  থেকে  তেমন  কোনও  উৎসাহ  নেই  কেন  সেটাই  বুঝে  উঠতে  পারছে  না  কোনও  পক্ষই । আর  তাঁদের  কোনও  ভূমিকাও  তো  নেই  এই  দুটি  সম্পূর্ণ  পরিণত  নারী  পুরুষের  সম্পর্ক  গড়ে  ওঠার  ক্ষেত্রে । তিন্নি  বারবার  ছুটে  যায়  তন্ময়ের  কাছে  এবং  বেশ  বুঝতে  পারে  তন্ময়  নিজেও  খুব  কষ্ট  পাচ্ছে । অবশেষে  কোনও  ভাবেই  তিন্নিকে  ফেরাতে  না  পেরে  তন্ময়  জানায়  যে  সে  আসলে  অক্ষম  পুরুষ , দাম্পত্য  জীবন  তার  জন্যে  নয় । তন্ময়  তিন্নিকে  অনেক  বোঝানোর  চেষ্টা  করেও  শেষে  হার  মানতে  বাধ্য  হয়  তিন্নির  কাছে । যৌনতা  ছাড়াও  দুটি  মানুষের  জীবনে  সম্পর্কের  রসায়ন  আরও  অনেক  কিছু  তিন্নি  বুঝিয়ে  ছাড়ে  তন্ময়কে । যে  মেয়েটি  জীবনে  কখনো  পুতুল  খেলে  নি , সেই  মেয়েই  পুতুলের  সংসার  সাজাতে  বদ্ধপরিকর  তন্ময়কে  সঙ্গী  করেই , না  কি  এই  সিদ্ধান্তের  পিছনেও  কাজ  করছে  তার  অবচেতনে  আজন্ম  লালিত  পুরুষ  বিদ্বেষ ? নাকি  নিজের  সাথে  নিজেরই  লড়াই , তার  মধ্যে  বেঁচে  থাকা  নরম  মনের  রমণীয়  নারী  স্বত্বাটিকে  সম্পূর্ণ  পরাজিত  করে  ফেলছে  আর  একটি  অনন্য  নারীর  অপরাজেয়  প্রতিবাদী  স্বত্বা ।।