তিন্নি
তিন্নির মেয়েবেলাটিকে অনায়াসে ছেলেবেলা বলা যায় , কারণ তিন্নি কখনো পুতুল খেলে নি , এক দঙ্গল ছেলের সাথে পাল্লা দিয়ে খেলেছে ফুটবল , ক্রিকেট
, গুলি ডাণ্ডাও
! যে কোনও খেলায় লড়াই করে ছেলেদের হারিয়ে দিতে পারলেই তার আনন্দ
। অমন
গেছো মেয়ের বাবা মায়ের চিন্তার অন্ত নেই বলাই বাহুল্য
। তিন্নির
মেয়ে হয়ে ওঠার অপেক্ষা শেষ হ’লো হঠাৎ করে বারো পেরিয়ে তেরতেই । খেলতে খেলতে কখন যে রক্তস্রোত নেমে এসেছে দু-পা গড়িয়ে
! অথচ
কোনও ব্যথা নেই , যন্ত্রণা নেই , আঘাতও লাগেনি কোনও ! মায়ের সমস্ত কথা শুনে তিন্নি বুঝলো , সে তার ছেলে বন্ধুদের থেকে কতটা আলাদা , হঠাৎ কেমন শান্তও হয়ে গেলো
। কিন্তু
দিনভর কি যে করবে সে ? কত আর পড়বে ? মা বললেন , ছবি আঁকো তিন্নি – আনন্দের ছবি , দুঃখের ছবি , মন খারাপের ছবি , প্রকৃতির ছবি - যখন যা মন চায় । ছবি আঁকার নেশা ধরে গেলো তিন্নিরও । সাথে গল্পের বই পড়ার নেশাও
। এমনিতে
সে পড়াশোনাতে বেশ ভালো , যত কমই পড়ুক না কেন ক্লাসে বরাবর সে-ই প্রথম । ফলে মা বাবারও তিন্নিকে অকারণ শাসন করতে হয় না । মাঠে নেমে আর না খেললেও ছেলেদের সাথেই তার বন্ধুত্ব ও প্রতিযোগিতা দুটিই জমে বেশী
। মেয়েলী
ন্যাকামিগুলো ওর মোটেই সহ্য হয় না । এই হ’লো তিন্নি , স্বকীয়তায় বেড়ে ওঠা ব্যতিক্রমী একটি চরিত্র
।
তিন্নি তখন স্কুলের গণ্ডী পেরিয়ে কলেজে । শুধু গুণ-ই
নয় রূপেও সে কম যায় না , ব্যক্তিত্বের সৌন্দর্যে সে আলো ছড়ায় তার চারপাশে সব সময় ।
তবুও
তিন্নিকে স্পর্শের স্পর্ধা দেখায় না কোনও ছেলেই যদিও তার ছোটবেলার ছেলে বন্ধুদের সাথে অকপটে আলোচনা করে জীবনের সমস্ত কিছু নিয়েই । ওর বন্ধুরাও বেশ বুঝে গেছে তিন্নির দ্বারা আর যাই হোক , ন্যাকা ন্যাকা কথা ব’লে বোকা বোকা প্রেমে হাবুডুবু খেতে পারবে না কক্ষনো । একে পড়াশোনায় তুখোড় তার ওপর ওই দুর্বার ব্যক্তিত্ব ! কিন্তু তিন্নির মধ্যেও যে একটা অদ্ভুত নরম মনের নারী আছে সেটা কেউ বুঝতেই পারে না ।
তিন্নি
নিজেও মাঝে মাঝে খুব একাকী বোধ করে , একজন এমন পুরুষ সঙ্গী সে চায় যার উপর নির্ভর করা যাবে নিশ্চিন্তে , যে তাকে খুব আদর করবে , বকবে , শাসন করবে ! কিন্তু নাহ , মনের এই নরম দিকটি সে সযত্নে আড়াল করে রাখে প্রতি মুহূর্তে ।
স্বপ্ন পুরুষের সাথে তার দেখা হ’লো যখন সে বিশ্ববিদ্যলয়ে । জৈব রসায়নের মেধাবী ছাত্র এবং স্কলার তন্ময় । যেমন সুপুরুষ সে চেহারায় তেমনই অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও অফুরান রসবোধ । তিন্নি একদম ফিদা
। তিন্নিকে
পড়াশোনার ব্যাপারেও গাইড করে আসছে তন্ময় সেই প্রথম পরিচয়ের দিন থেকেই
। তিন্নির
মায়ের সহকর্মীর ছেলে তন্ময়
। মা-ই
একদিন জানায় তন্ময়ের পরিচয় , যে কোনও রকম অসুবিধেয় পড়লে যেন তন্ময়কে জানাতে দ্বিধা না করে সে । না তিন্নি তখনও চিনতই না তন্ময়কে , তন্ময়-ই একদিন যেচে পরিচয় করে যায় তিন্নির সাথে । দারুণ বন্ধু-সুলভ আচরণ তন্ময়ের
। তারপর
থেকেই তিন্নি বিভিন্ন সমস্যায় ছুটে গেছে তন্ময়ের কাছে বারবার
, হাসিমুখে সব সমস্যার সমাধান করেছে সে প্রতিবারই । কিন্তু কখনই কোনও বাড়াবাড়ি নেই তার আচরণে , নেই তিন্নিকে অকারণ স্পর্শের অভিপ্রায় , নেই কোনও আত্ম অহংকার । তিন্নি ঠিক ভাবে বুঝে উঠতেই পারে না তন্ময়ের মনের কথা ।
তিন্নি
চাইছে তন্ময় নিজে থেকেই জানাক যে সে তিন্নিকে ভালবেসে ফেলেছে
, তিন্নিকে তার চাই আজীবনের সঙ্গী হিসেবে
। এমনিতে
তন্ময় তিন্নিকে যে বেশ পছন্দ করে আর সুযোগ পেলে গল্পের জাহাজ ভাসায় অলীক সমুদ্রে সেটা তিন্নি বেশ বুঝতে পারে । তবু মন চায় আরও বেশী কিছু । তন্ময় তবুও তেমন ক’রে কিছুই বলে না , তিন্নিরও আর তর সয় না , অবশেষে তিন্নি নিজেই তন্ময়কে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ফেলে একদিন । তন্ময়কে এতো বোকা আর আন-স্মার্ট হতে আগে কখনো দেখে নি । তন্ময় হঠাৎ যেন পালাতে চাইছে তিন্নির কাছ থেকে
! তিন্নি
তো অবাক ! তিন্নি এও জানে যে তন্ময়ের সাথে কোনও মেয়ের কোনোদিন কোনও প্রেমের সম্পর্ক ছিল না আর এখনো নেই , তবুও কেন এত অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে তন্ময় ?
ছোট থেকেই তিন্নির অদম্য জেদ , সে যখন মনে প্রাণে তন্ময়কে ভালোবেসেছে তখন সে তন্ময়কেই বিয়ে করবে নচেৎ বিয়েই করবে না , জানিয়ে দিয়েছে তার মা কেও ।
তিন্নির
এবং তন্ময়ের বাড়ীর সকলেই তিন্নির এই সিদ্ধান্ত জেনে খুব খুশী কিন্তু তন্ময়ের দিক থেকে তেমন কোনও উৎসাহ নেই কেন সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না কোনও পক্ষই
। আর
তাঁদের কোনও ভূমিকাও তো নেই এই দুটি সম্পূর্ণ পরিণত নারী পুরুষের সম্পর্ক গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে
। তিন্নি
বারবার ছুটে যায় তন্ময়ের কাছে এবং বেশ বুঝতে পারে তন্ময় নিজেও খুব কষ্ট পাচ্ছে
। অবশেষে
কোনও ভাবেই তিন্নিকে ফেরাতে না পেরে তন্ময় জানায় যে সে আসলে অক্ষম পুরুষ , দাম্পত্য জীবন তার জন্যে নয় ।
তন্ময়
তিন্নিকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেও শেষে হার মানতে বাধ্য হয় তিন্নির কাছে । যৌনতা ছাড়াও দুটি মানুষের জীবনে সম্পর্কের রসায়ন আরও অনেক কিছু তিন্নি বুঝিয়ে ছাড়ে তন্ময়কে । যে মেয়েটি জীবনে কখনো পুতুল খেলে নি , সেই মেয়েই পুতুলের সংসার সাজাতে বদ্ধপরিকর তন্ময়কে সঙ্গী করেই , না কি এই সিদ্ধান্তের পিছনেও কাজ করছে তার অবচেতনে আজন্ম লালিত পুরুষ বিদ্বেষ ? নাকি নিজের সাথে নিজেরই লড়াই , তার মধ্যে বেঁচে থাকা নরম মনের রমণীয় নারী স্বত্বাটিকে সম্পূর্ণ পরাজিত করে ফেলছে আর একটি অনন্য নারীর অপরাজেয় প্রতিবাদী স্বত্বা ।।