গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৩

অদিতি ভট্টাচার্য্য

চিনার

অবশেষে সোমদত্তা কাশ্মীরে। এত বছর বাদে সুযোগ হল আসার পৃথিবীর এই স্বর্গে যখন পৃথিবীতে থাকার দিন কমতির দিকে। এই বয়সে এই সময়ে কাশ্মীরে আসতে সবাই বারণ করেছিল সোমদত্তাকে। আপেলের ফলন শেষ, গাছে আর একটাও নেই, বরফ পড়তে শুরু করবে, ঠাণ্ডা হাড় কাঁপানো  - কি করতে যাবেন এখন? তার থেকে এপ্রিলের প্রথম দিকটা বেটার। বরফও পাবেন, টিউলিপও পাবেন। কিন্তু সোমদত্তা চান নি এ সুযোগ হাতছাড়া করতে, দুই মেয়ে, জামাই, তাদের ছেলেমেয়েরা যাচ্ছে, এরকম সুযোগ যদি বারে বারে না আসে। তাছাড়া এই সময়েই তো চিনারে রঙ ধরে। ঝরে যাওয়ার আগে কমলা লালের শোভায় চারদিক আলো করে রাখে। গাছে গাছে যেন তখন আগুন জ্বলে। সেও তো এক দেখার জিনিস। সেই দেখতেই তো আসা। চিনারের সঙ্গে আলাপ করতে।

        ডাল লেকের জল এখনো জমে নি। লেকের ধারের বুলেভার্ড রোডের ফুটপাথ ধরে দুপুরের রোদের ওম গায়ে মেখে হাঁটতে হাঁটতে এসবই ভাবছিলেন সোমদত্তা। মেয়েরা মার্কেটিং এ ব্যস্ত। লাল লাল চিনার গাছগুলোর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছেন আর ভাবছেন। মেয়েরা হাসে, কাশ্মীরে এসে তাদের মা শুধু চিনারের রূপেই মুগ্ধ, আর কিছুই চোখে পড়ছে না। ঠিক কত বছর পরে শ্রীনগরে এলেল সোমদত্তা? সেই দুমাসের মেয়েকে নিয়ে সোমদত্তার মা সুলতা শ্রীনগর থেকে সেই যে কলকাতায় এসেছিলেন তারপর আর ওমুখো হন নি। ওমুখো হওয়ার তো আর কিছু ছিলও না। সব কিছু চুকিয়েবুকিয়েই তো শ্রীনগর থেকে কলকাতায় ফিরে আসা।

        সুলতার সঙ্গে মিহিরের প্রথম সাক্ষাত, আলাপ সবই কলকাতায়। কখন, কিভাবে তা সোমদত্তা জানেন না, সুলতাই জানাতে চান নি। তিনি জোর করেই ওই পর্বের কথা ভুলতে চাইতেন। যাই হোক আলাপ কলকাতাতেই হয়েছিল এবং তা অনেক দূর গড়িয়েওছিল। মিহিরের নিকটজন বলতে তেমন কেউ ছিল না, এক মাসীর কথা বলত, সেও পণ্ডিচেরি না কোথায় থাকে। থাকার মধ্যে ছিল একটা ভালো চাকরি। তাই সুলতা যখন বাড়িতে মিহিরকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত জানালেন, কেউই রাজি হয় নি সঙ্গত কারণেই। মিহির কলকাতায় চাকরি করা এক উটকো ছেলে বলতে গেলে। চাকরীস্থলও যে ঠিক কলকাতায় না নয়, চাকরী সংক্রান্ত ব্যাপারেই কিছুদিনের জন্যে কলকাতায় বাস। তার সম্পর্কে বা তার আত্মীয়স্বজন সম্পর্কে কিছুই জানা নেই। এরকম অজ্ঞাতকূলশীল পাত্র কারুর না পছন্দ হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু সুলতার জেদও কম ছিল না। তিনি যে মিহিরকেই বিয়ে করবেন একথা বাড়িতে জোর দিয়ে জানিয়েছিলন। বাড়ির কারুর মত ছিল না, কয়েকজন বন্ধুর উপস্থিতিতে কোন রকম নিয়মরক্ষে করে বিয়েটা হয়েছিল। বিয়ের পরপরই মিহির চলে গেল শ্রীনগরে, সুলতাকেও নিয়ে এল। শ্রীনগরে নব দম্পতি মনের মতো করে সংসার সাজাল। মাঝে মাঝে মিহিরকে অফিসের কাজে বাইরে যেতে হত। সুলতা কলকাতায় চলে যেতেন। আর দু একদিনের ছুটি পেলে দুজনে বেরিয়ে পরতেন। কাশ্মীরের সৌন্দর্যে সুলতা তখন মুগ্ধ। বছরের একেক সময়ে তার একেক রূপ। কখনো ফুলে ফুলে ভরে যাচ্ছে উপত্যকা, কখনো ফলে, কখনো বা শুধু সাদা বরফে ঢেকে যাচ্ছে। সত্যিই ভূস্বর্গ!

        বছর দেড়েকের মাথায় সোমদত্তার আগমন। সুলতার আদরের চিনু। কিন্তু কোথায় যেন কালো মেঘ জমছিল, ঝড়ের পূর্বাভাস ছিল – সুলতা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেন নি। সোমদত্তার যখন প্রায় মাস দুয়েক বয়স তখনই উঠল সেই দমকা ঝড়। ভেঙে দিল সুলতার সাজান সংসার। এক সকালে দুজন বয়স্ক ভদ্রলোক, ভদ্রমহিলার সঙ্গে তাঁরই মতো এক তরুণী উপস্থিত হলেন। সঙ্গে দুটো ছেলেমেয়ে, ছোটোটা বড়োজোর বছর চারেক হবে। মিহিরের বাবা, মা, প্রথম স্ত্রী এবং ছেলেমেয়ে। এঁরা সবাই গ্রামে থাকতেন। এসব কথাই মিহির গোপন করেছিল। অনেকদিন ছেলে আসে না দেখে ওনাদের কিছু সন্দেহ হয়েছিল। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শ্রীনগরের ঠিকানা জোগাড় করে তাই একেবারে চলে এসেছেন। এসে সব দেখে চক্ষুস্থির তাঁদের, একই অবস্থা সুলতারও। পায়ের তলার মাটি তখন সরে গেছে, চতুর্দিক অন্ধকার।

        আর কি হয়েছিল সোমদত্তা জানেন না। শুধু এইটুকু জানেন যে সুলতা তার পরেই ওখানকার পাট চুকিয়ে মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছিলেন। ওখানে থাকার বা নিজের জোর খাটাবার বোধহয় কোনো চেষ্টাই করেন নি। নিজের বিশ্বাস চূর্ণবিচূর্ণ হওয়ার আঘাতেই তিনি জর্জরিত ছিলেন। কলকাতায় ফিরে এসে শুরু হল এক মার জীবনযুদ্ধ। নিজের এবং নিজের শিশুকন্যার সুস্থভাবে বেঁচে থাকার লড়াই। মা, বাবা আত্মীয়স্বজন সবারই তখন এক বক্তব্য – না ভেবেচিন্তে ঝোঁকের মাথায় কাজ করলে এইই হয়। সুলতা খুব কম দিনই বাবা দাদার সাহায্য নিয়েছেন। একটা স্কুলে চাকরি জুটিয়েছেন, যথাসাধ্য ভালোভাবে মেয়েকে বড়ো করেছেন। সারা জীবন মাকে যুদ্ধ করতেই দেখেছেন সোমদত্তা। তিনি অবশ্য  মামার বাড়ির আদরে বঞ্চিত হন নি।

        কলেজে পড়াকালীন কলেজ সোশ্যালে নাটক করেছিলেন সোমদত্তা। কি করে যেন এক চিত্র পরিচালকের চোখে পড়ে গেলেন। তিনি তখন নতুন মুখ খুঁজছেন। প্রস্তাব আসে সোমদত্তার কাছে। সোমদত্তা অভিনয় করতে ভালোবাসতেন, তিনি তো হাতে চাঁদ পেলেন। কিন্তু করা হল না। সুলতা বেঁকে বসলেন শোনামাত্রই। অভিনয় জগৎ অত্যন্ত পিচ্ছিল এবং সেই পিচ্ছিল পথে পা বাড়িয়ে নিজের সর্বনাশ না ডেকে আনার উপদেশই তিনি দিয়েছিলেন মেয়েকে। এমনিতেও মেয়ে কোথায় যাচ্ছে, কাদের সঙ্গে মিশছে – সব দিকে কড়া নজর থাকত তাঁর। বোধহয় নিজের অল্প বয়সে করা ভুলের জন্যেই।

        কলেজে পড়তে পড়তেই বিয়ে হয়ে গেল। সুলতা চেষ্টা অনেক আগে থেকেই শুরু করেছিলেন। কিন্তু স্বামীবিহীন কোনো মহিলার মেয়ের বিয়ে হওয়া এত সহজ নয়। অবশেষে সুলতার দাদাদের পরিচিতি আর সোমদত্তার রূপের জোরে ভালো ঘরেই বিয়ে হল। হ্যাঁ সোমদত্তাকে রূপসীই বলা চলে। সবই ভালো, অবস্থা ভালো, স্বামী ভালো চাকরি করেন, কিন্তু বড্ড যেন কাঠখোট্টা। সোমদত্তার মনে যে সুপ্ত আশা ছিল যে বিয়ের পর হয়তো তিনি অভিনয় করতে পারবেন তা পূরণ হল না। দেখা গেল স্বামীটি নিজের কাজকর্ম আর সাংসারিক কর্তব্য ছাড়া আর কিছুই বোঝেন না। সোমদত্তা হতাশ হয়েছিলেন খুবই। সুলতা তাঁকে বলেছিলেন ওসব পাগলামি মাথা থেকে তাড়িয়ে মন দিয়ে সংসার করতে। ওটাই মেয়েদের প্রধাণ কর্তব্য। তাঁর মতো মেয়েও কোনো ভুল পথে পা না বাড়ায় – এই আশঙ্কা তাঁকে ঘিরে রাখত সব সময়।

        সোমদত্তাও বাধ্য হলেন মেনে নিতে, মানিয়ে নিতে। দিন কাটতে লাগল, বছরের পর বছর ঘুরতে লাগল। কালের নিয়মে মেয়েরা বড়ো হতে লাগল, সুলতা বৃদ্ধা। মাকে শেষ বয়েসে প্রচুর সেবাযত্ন করেছিলেন সোমদত্তা। এক সময়ে জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত এই রমণীও বিদায় নিলেন। বাবা কাকে বলে কোনদিন বোঝেন নি সোমদত্তা, মার মৃত্যু তাই তাঁকে বড়ো আঘাত দিয়েছিল। দুই মেয়ের বিয়ের পর স্বামীও একদিন হঠাৎই চলে গেলেন। সোমদত্তার তখন অখণ্ড অবসর। সারা দিন কাটাই মুশকিল, একা মানুষের কি আর কাজ। সকালবেলা রোজ বাংলা খবরের কাগজটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন। কিছুটা সময় তাতে কাটত। এইভাবেই একদিন নজরে এসেছিল বিজ্ঞাপনটা। একটি সিরিয়ালে বয়স্ক মহিলার ভূমিকায় অভিনয় করার জন্যে অভিনেত্রী প্রয়োজন। বয়স্ক এবং সুন্দরী হতে হবে।

        সোমদত্তা অনেকবার বিজ্ঞাপনটা পড়লেন। তারপর কাগজটা রেখে দিয়ে দাঁড়ালেন আয়নার সামনে। ভালো করে দেখলেন নিজেকে। নাঃ আয়নায় যাকে দেখা যাচ্ছে তাকে এখনো সুন্দরী বলা চলে। এক সময়ে স্বপ্ন ছিল নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করার। সে স্বপ্ন পূর্ণ হয় নি, সময়ও চলে গেছে। কিন্তু নায়িকার মা কি শাশুড়ি তো স্বচ্ছন্দে হওয়া যায় এখনো! ভেবে খুশী হয়েছিলেন। তাহলেও অডিশন দিতে স্টুডিওতে যাওয়া সহজ হয় নি। যাব কি যাব না ভাবতে ভাবতেই একটা দিন পুরো কেটে গেছিল। সংকোচে মেয়েদেরও কিছু বলতে পারেন নি। তারা জানতও না তাদের মার অভিনয়প্রীতির কথা। অবশেষে নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে গেলেন পরের দিন।

        স্টুডিওতে ঢুকতে যাবেন এমন সময় হঠাৎ পেছন থেকে, “ওমা চিনুদি, তুই এখানে!”
        চমকে পেছনে ফিরে দেখলেন মাসতুতো বোন টুলু। সত্যিই খেয়ালই ছিল না টুলুর মেয়ের শ্বশুরবাড়ি তো কাছাকাছিই। টুলু কম অবাক নন সোমদত্তাকে এখানে দেখে। অগত্যা টুলুকেই সব খুলে বললেন।
        শুনে তো টুলু লাফিয়ে উঠলেন, “আমার মনে আছে টুলুদি, তুই কলেজ সোশ্যালে কি দারুণ নাটক করতিস। চল চল ভেতরে চল, আমিও তোর সঙ্গে যাই।”
        অতঃপর অডিশন দেওয়া এবং নির্বাচিত হওয়া। টুলুর থেকেই চিনু নামটা জানাজানি হল। পরিচালক বললেন, “সোমদত্তা নামটা কাগজে কলমে থাক। আমরা সবাই আপনাকে চিনুদি বলেই ডাকব।”
        সত্যি সোমদত্তা নেহাতই পোশাকী নাম, বরাবরই, শুধুমাত্র দরকারি কাগজপত্রেই ও নামটা সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। চিনু নামেই তিনি সর্বত্র পরিচিত। চিনুদি, চিনুমাসীমা, চিনুকাকীমা, চিনুদিদা – চিনুর প্রবল বিক্রমে সোমদত্তা কোথায় হারিয়ে গেছে। সেই দিন থেকেই পুরো ইউনিটেরও চিনুদি হয়ে গেলেন।

        প্রথম সিরিয়ালে সুন্দরী, দজ্জাল শাশুড়ির ভূমিকায় বাজিমাত করলেন। মেয়েরা খুব খুশী। শুধু তাই নয় মেয়েদের শাশুড়িরাও বাড়ি এসে তাঁর অভিনয়ের প্রশংসা করে গেলেন। সেই শুরু। এখন তো প্রতি সন্ধ্যায় তাঁকে পর্দায় দেখা যায়। তাঁকে দেখার জন্যেই অনেক মানুষ রোজ কিছুক্ষণের জন্যে টিভির সামনে থেকে নড়েন না। পর্দায় নামটা সোমদত্তা ধর দেখালেও দর্শকরাও তাঁকে নাকি চিনুদি বলেই চেনে – এটাও শুনেছেন তিনি।
        সবাই চিনুদি চিনুদি করে, চিনু নামটা এল কি করে কেউ জানে না। এটা মনে হতেই ঠোঁটের ডগায় হাসি এল।
        আর ঠিক তখনই কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, “আরে উনি উমা মানে ঝিলমিলের মা না? আরে চিনুদি, চিনুদি!”
        সোমদত্তা পেছন ফিরলেন। উমা তাঁর অভিনীত একটি চরিত্রের নাম। দেখলেন বেশ কয়েকজন নারী পুরুষের একটি দল তাঁর দিকেই এগিয়ে আসছে।
        “দেখো ঠিক বলেছি চিনুদি!” একজনের চোখমুখে চিনুদিকে আবিষ্কারের আনন্দ।
        “কাশ্মীর বেড়াতে এসে আপনাকে দেখতে পাব ভাবিনি! আপনিও কি বেড়াতে?”
        “সত্যি যা অভিনয় করেন না আপনি! একদম ন্যাচারাল।”
        “মেক আপ ছাড়াও আপনি এই বয়সে এত সুন্দর, ভাবা যায় না!”

        প্রিয় অভিনেত্রীকে সামনে পেয়ে গুণমুগ্ধদের প্রশংসা শেষই হতে চায় না। সোমদত্তাও উপভোগ করেন। একসঙ্গে ফটো তোলার আর্জি পেশ হয়। সোমদত্তা হাসিমুখে রাজি হন। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে তারা চলে যায়। সোমদত্তা হাঁটতে হাঁটতে বড়ো চিনার গাছটার তলায় আসেন। মাথা তুলে দেখেন গাছটা। লাল, কমলায় পুরো গাছ রাঙানো। তেমনই রঙিন পাতা টুপটাপ ঝরে পড়ছে সোমদত্তার মাথায়, গায়ে। চিনার এখনই সুন্দর, এখনই সে রঙিন, রূপসী। ঝরে পড়ার আগেই তার কদর, তখনই তাকে দেখতে লোকে ছুটে আসে।

        কত বছর আগে এক তরুণী মা চিনারের রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁর সদ্যোজাত মেয়ের নাম রেখেছিলেন চিনার। এক সময় তা চিনুতে গিয়ে দাঁড়ায়। এ চিনারের কদরও ঝরে যাবার আগে। লোকে তাঁকে এখন চেনে, এখন জানে, এখন তাঁর পরিচিতি – যখন চিনার সবুজ ছিল তখন কিছুই ছিল না। এ কি সুলতার দূরদর্শিতা না কি নেহাত কাকতালীয়, চিনার ভাবেন লাল কমলা চিনার পাতা দেখতে দেখতে।