গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৩

সহেলী ভট্টাচার্য

একদিন প্রতিদিন

অ্যালার্ম ঘড়িতে ভোর পাঁচটা বাজার সাথে সাথেই করুণ স্বরে স্ত্রী পরমা বললো- "বুবাইকে ঘুম থেকে তোলো, অসম্ভব মাথার যন্ত্রণায় চোখ খুলতেই পারছি না, কিন্তু তা নাহলে এবারে স্কুলে লেট-ফাইন..."

ভোরবেলার ঠান্ডা আমেজে তখন সবে পাশ ফিরে শুতে যাচ্ছি, অনিচ্ছাসত্ত্বেয় উঠতেই হল| স্কুল বাস মিস করার থেকে একদিন ঘুম কামাই করা ভালো|
তবে, বুবাইকে ঘুম থেকে তোলা, এবং তারপরে তাকে প্রস্তুত করা যে এতো ভয়ঙ্কর দুঃসাধ্য ব্যাপার, তা আমার স্বপ্নেয় জানা ছিল না| উফফ্‌... বসিয়ে দিলে শুয়ে পড়ে, বাথরুমে দাঁড়িয়ে ঘুমোয়, জামার বোতামটা অবধি নিজে এখনো আটকাতে শেখেনি| শেষে হাফ গ্লাস দুধ মেঝেতে ফেলে তবে তিনি তৈরী হলেন|
ওদিকে বাসের হর্ণ শুনে, কোনোক্রমে জুতোর ফিতেটা বেঁধে ছুটলাম কোলে নিয়ে.. গাড়িতে তুলে, হাত নেড়ে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো|
ঘড়ি বলছে সবে সাড়ে-ছয়টা, বাড়ি ফিরে আর একটু ঘুমোনো যায় কিনা ভাবছি, সহৃদয় প্রতিবেশী বন্ধু সুখবর দিলেন- "পাম্প খারাপ, দুপুরের আগে জল উঠবে না..." হা ঈশ্বর... নীচের রিজার্ভার থেকে কয়েক বালতি জল তুলে সবে একটু বসেছি, পরমার মোবাইলে ফোন- বিন্দুমাসীর শরীর খারাপ, আজ কাজে আসতে পারবে না| গেলো, সব গেলো... এবারে অফিসটা ঠিক মতো পৌঁছোতে পারলে হয়...

ঘরের দু-একটা কাজ সেরে, স্ত্রীর বিছানা পাশে জল ওষুধ রেখে, একটা আপেল পকেটে পুরে বাড়ি থেকে যখন বেরোলাম, দশটার ক্যাবটাও মিস করেছি|
সারাদিন প্রায় না খাওয়া, ওয়ার্ক-প্রেশার, বসের অকারণ ভোকাল টনিক, খানিক বিরক্ত-ক্লান্ত শরীরে সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে দেখি- সারা ঘর অগোছালো, লন্ড-ভন্ড অবস্থা.. খেলনা কাগজ শুক্‌নো মুড়ি ছড়িয়ে চারিপাশে, আর এই সবের মূলে আমার একমাত্র সবেধন নীলমণি তোজোবাবু নিশ্চিন্ত মনে বসে রঙ মাখাচ্ছেন কার্পেটে| সোফার পিছনে অফিসের দু-একটি দরকারি কাগজপত্রও চোখে পড়লো...

শোবার ঘরে এসে দেখি, পরমা বিছানায় আধ-শোয়া, চোখ বন্ধ, গতিক সুবিধের বলে মনে হল না... দুরু-দুরু বুকে জানতে চাইলাম- "কি গো, কেমন আছো এখন?" পরমা বললো- "প্রায় এক ই রকম, মাথা ব্যাথা সারেনি| রান্না-বাজার কিছুই করতে পারিনি, ডিনারটাও তুমি ই বানিও| লন্ড্রি ব্যাগে কিছু জামা আর সিঙ্কে কিছু বাসন আছে, ধুয়ে নিও ..."
ধৈর্যের বাঁধ অনেক্ষণই ভেঙেছিল, এসে থেকে এক কাপ চা তো দূর, এক গ্লাস জলের কথাও কেউ জিঞ্জাসা করেনি| মেজাজ হারিয়ে চিৎকার করে জানতে চাইলাম- "তোমার হল কি? ডাক্তারের কাছে যাওনি কেন? একা আমি কত দিক সামলাবো? অসম্ভব..."

হাল্কা হেসে উত্তর দিল পরমা- "কালকে যে বললে, সারাদিন আমি বাড়িতে বসে কি করি, তা তুমি ভেবেই পাও না.. তাই তোমাকে ভাবতে একটু সাহায্য করলাম মাত্র.. ফ্রেশ হয়ে নাও, গরম-গরম টিফিন তৈরী..."
মূর্খ আমি, হতবাক বিমূঢ়... তিনশ পঁয়ষট্টি দিন, বিনা বেতনে, হাসি মুখে সংসারের যাবতীয় ঝামেলা সামলে নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন যাঁরা, তাঁদের কাজের হিসেব কষবে কে? তুমি? নাকি আমি?