খবরটা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে শামসুদ্দিনের। মিল ঘরে তো আছেই চাতালেও
প্রায় একশ মন ধান। পুরো সিজন এখন। সারা বছর এই সময়টার জন্য অপেক্ষায় থাকে শামসুদ্দিন।
এই সময়টায় দিনরাত ব্যস্ত থাকে সে এবং মিলঘরের সবগুলো মানুষ। রোজ কামলাও নিতে হয় তখন।
কলমাকান্দা বাজার ছাড়া আর কোন রাইস মিল নাই আশে পাশে। এই পলাশহাটিতে তো নয়ই। যোগাযোগ
ব্যবস্থাও ভয়াবহ রকমের খারাপ। আশপাশের সবকটা গ্রামের ধান গম ভাঙ্গা হয় এই মিলে। গত
কয়েকটা মাস জুড়ে দেখা স্বপ্নে ধ্বস নামে শামসুদ্দিনের। একটু আগেই মিলঘর থেকে বাড়িতে
এসেছে। সামনের পুকুরটা একটু সংস্কার করাতে হচ্ছে। বেশ কজন নারী পুরুষ কাজ করছে ওখানটায়।
একটা চেয়ার নিয়ে একপাশে বসে কাজ দেখছিল ও। এ সময়ই হাঁপাতে হাঁপাতে এসে খবর দিলো নূর
মোহাম্মদ। মিলের লাইন কেটে দিয়েছ পল্লী বিদ্যুতের লোকেরা।
দিন কয়েক আগে মিলের পিছনের পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিলো শামসুদ্দিন। হঠাৎই বিদ্যুৎ লাইনের
দিকে চোখ পড়ে ওর। সেখান থেকে ওর মিলে বিদ্যুৎ এর লাইন ঢুকেছে ঠিক ঐ খুঁটিতে তিনটা ট্রান্সফরমার।
প্রত্যেকটার সাথে চিনেমাটির অদ্ভুত একটা করে জিনিষ। যার নাম ‘বুশ’ বলেই জানে শামসুদ্দিন।
ওর নজরে আসে একটা বুশ কাত হয়ে আছে।কানেকশন ঠিকই আছে। কিন্তু তার মনে হলো কলমানান্দার
বিদ্যুৎ অফিসে ব্যাপারটা জানানো দরকার। আবার কোথা থেকে কি হয় কে জানে। ঐ দিন বিকেলেই
কলমাকান্দার পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে গিয়ে ব্যাপারটা জানিয়ে আসে। পরদিন
সকালে লাইনম্যান নজরুল আসে ওর সাগরেদ মোয়াজ্জেমসহ। নজরুলের অনেক বদনাম এলাকায়। পয়সা
ছাড়া নাকি ও কিছুই করে না। উল্টো লোকজনকে নানান ফাঁদে ফেলে ও। আর মোয়াজ্জেম তো লোকাল
টাউট। খুব কায়দা করে মেইন লাইন, ট্রান্সফরমার, মিটার এসব দেখে নজরুল। নীচু গলায় মোয়াজ্জেম
এর সাথে কি যেনো আলাপ করে। তারপর দুজন মিলের অফিসে এসে বসে।
: ভাইজান ব্যাপারটা কি?
: কিসের ব্যাপার? নজরুলের কথার মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝে না শামসুদ্দিন।
: ব্যাপার বুঝেন নাই। মিটার বাইপাশ করে বিদ্যুৎ নিয়ে মিল চালাইতাছেন আর কিছুই বুঝেন
নাই।
এবার আকাশ থেকে পড়ে শামসুদ্দিন।
: কি বল্লেন? আমি তো কোথাও হাতই দেই নাই। মিটার বাইপাশ করলাম কি ভাবে? আপনারা যে ভাবে
কানেকশন দিয়ে গেছেন সে ভাবেই তো সব আছে। কি বলতেছেন আপনি?
: কিছুই বলতেছি না। নেত্রকোনায় রিপোর্ট করি তারপর বুঝবেন। নাকিরে মোয়াজ্জেম?
শামসুদ্দিন বুঝে একটা ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে নজরুল। ও নিজে কখনো বাজে ধান্দায় থাকে
না। আল্লাহ ওদের যেটুকু দিয়েছেন সেটুকু নিয়েই চলে যায়। ধান্দাবাজির প্রয়োজন হয় না।
আর বিদ্যুৎ চুরির তো প্রশ্নই আসে না। নিজেও বিদ্যুতের কাজ জানে না। কোন সমস্যা হলে
কলমাকান্দার পল্লী বিদ্যুতে ট্রেনিং নেয়া ইলেকট্রিশিয়ান দিয়ে কাজ করায়। একটা মিথ্যায়
জড়াতে চাইছে নজরুল। ভেতরে রাগ জমে শামসুদ্দিনের।
: ভাইজান আমার একটা প্রস্তাব আছে। মুখ খুলে টাউট মোয়াজ্জেম।
কামসুদ্দিন ঘৃনা নিয়ে তাকায় মোয়াজ্জেম এর দিকে।
: আপনি তো ঝামেলা পাকিয়ে ফেলেছেন। এখন উপায় একটা আছে। নজরুল ভাই ম্যানেজ করে দেবে।
আপনি নজরুল ভাইকে ম্যানেজ করেন।
নজরুল জানালা দিয়ে পলাশ হাটির আকাশ দেখে প্রকৃতি দেখে। শামসুদ্দিন ভাবে কি চমৎকার ফাঁদে
ফেলে টাকা নেবার ধান্দা। ওর রক্ত মাথায় চড়তে থাকে।
: এর মানে কি? চুরি না করেও চোর হয়ে গেলাম। চুরি না করেও চুরি করেছি এটা স্বীকার করে
নিতে হবে? নজরুল মিয়া আর মোয়াজ্জেম সাব একটা কথা বলি আমি শুনেন। দুনম্বরী আমার চৌদ্দ-গোষ্ঠির
কেউ কখনো করেনি আমিও করতে পারবো না। আপনারা রাস্তা দেখতে পারেন।
মুখ কালো করে নজরুল আর মোয়াজ্জেম পলাশহাটি বাজারের দিকে হাঁটা শুরু করেছিলো
সেদিন।
আজ নজরুল তার কাজ করে দেখালো। এদেশের সব কিছু পঁচে গেছে। পঁচবে নাই বা কেনো। মাথায়
যেখানে ভয়াবহ পচন সেখানে শরীরের পচনটাই তো স্বাভাবিক। নূর মোহাম্মদকে বিদায় দিয়ে ঝিম
ধরে বসে থাকে শামসুদ্দিন। চাতালের ধান, ভিতরের ধান আর প্রতিদিনের এলাকার ধান তো আছেই।
ঝামেলাটা অনেক দূর গড়াবে মনে হয়। মনে মনে ভাবে শামসুদ্দিন নজরুলের মতো টাউটের কাছে
হারবে না ও । শ্যালোতে আপাতত কাজ চালাতে হবে। কাল মজিবর মাষ্টারকে নিয়ে নেত্রকোনা পল্লী
বিদ্যুৎ অফিসে যেতে হবে। দেখা যাক কোথাকার জল কোথায় গড়ায়। অনেক কিছুই মাথায় আসে শামসুদ্দিনের।
তার এ মিলকে অনেকেই পছন্দ করে না। তারাও কি জড়িয়ে আছে এর সাথে? জানে না শামসুদ্দিন।
দুপুরের খাবার খেতে আর ইচ্ছে করে না শামসুদ্দিনের। শার্টটা পড়ে মিলের দিকে হাঁটতে থাকে।
নূর মোহাম্মদকে শ্যালো চালাতে বলে মুজিবরের স্কুলের দিকে হাঁটে শামসুদ্দিন। ঘটনা শুনে
মুজিবর ও আকাশ থেকে পড়ে। দুজনে পরদিনই নেত্রকোনা যাবার সিদ্ধান্ত নেয়।
মুজিবর সহ খুব ভোরে রওনা দিয়ে রাস্তার সমস্ত দুর্গতি সয়ে নেত্রকোনা পৌঁছতে সকাল প্রায়
এগারোটা বেজে যায় শামসুদ্দিনের। বিদ্যুৎ অফিসে এসে এজিএমকেও পেয়ে যায় ওরা। কিন্তু আলাপের
শুরুতেই ধাক্কা খায়।
: কোন রিপোর্ট তো পাইনি। ঠিক আছে আমি খোঁজ নেবো আপনারা আগামীকাল আসেন।
নিয়মিত বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করে শামসুদ্দিন। সাধারনত গৃহস্থালী কাজের মিটার নয় তার।
সে জানে অন্তত অফিসের নির্দেশ ছাড়া মিল কারখানার লাইন কাঁটা সম্ভব না। একজন সাধারন
লাইনম্যান মিলের লাইন কেঁটে দিলো অথচ অফিস জানে না। তাহলে কি পুরোটাই একটা চক্রের কাজ।
যে যে ভাবে পারছে লুটে নিচ্ছে। নেত্রকোনায় রাতটা থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেয় শামসুদ্দিন।
রাতে ঢাকায় মজিবর ওর বড় ভাই শাহজাহানকে ফোন করে বিস্তারিত জানায়। পল্লী বিদ্যুৎ সদর
দপ্তর এর পাশেই থাকে শাহজাহান ভাই। যদি নেত্রকোনা থেকে কোন সহযোগিতা না পায় তবে ঢাকা
যাবে শামসুদ্দিন তবুও বিদ্যুৎ চুরির অপবাদ নেবে না ঘাড়ে।
পরদিন ওরা সকাল নটায় পৌঁছায় অফিসে। এজিএম এর রুমে ঢুকে এজিএমকে পেয়ে যায় ওরা। ওদের
দেখেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে এজিএম।
: কি মিয়া মিটার বাইপাস করে মিল চালাচ্ছেন। এবার বিদ্যুৎ আইনে মামলা হয়ে যাবে আপনার
বিরুদ্ধে।
: স্যার আপনি কি কথাটা জেনে বলছেন?
: জানি জানি আমার লোকরা ভুল রিপোর্ট দেয় না। যান বাড়ি যান। কয়েকদিনের মধ্যেই চিঠি পাবেন।
: স্যার আমার কথাটা শুনুন। আমি একজন টিচার। শামসুদ্দিন আমার প্রতিবেশী। সে সৎ মানুষ।
আপনার লাইনম্যান নজরুল ওর কাছে টাকা চেয়েছিল। ও দেয়নি বলেই প্রতিশোধ নিয়েছে সে। স্যার
আপনি আমাদের সাথে চলুন নিজ চোখে দেখুন। আগের বিল বর্তমান বিল যাচাই করুন তারপর ব্যবস্থা
নিন। একজন নিরপরাধ লোককে চোর বানিয়ে .... । মুজিবর এর মুখের কথা কেড়ে নেয় এজিএম-
: মাষ্টার সাব আমি আপনার ছাত্র না। আমার কাছে লেকচার দেওয়ার দরকার নাই। আপনারা যান।
ক্ষোভে অপমানে স্থব্ধ হয়ে যায় মুজিবর। শামসুদ্দিনের হাত ধরে বাইরে আসে। দুজনেই বুঝে
লোভে অন্ধ হয়ে গেছে এই চক্রটি। কানসাটে কেনো আগুন লেগেছিলো বুঝে নেয় ওর। মজিবর, শামসুদ্দিন
বুঝে নেয় ওদেরকেও এবার যুদ্ধে নামতে হবে। দুজনে প্রতিজ্ঞা করে এর শেষ দেখবে ওরা।
পরের ঘটনাগলো খুব দ্রুত ঘটে। ঐদিনই মজিবরসহ শামসুদ্দিন ঢাকা চলে আসে। শাহজাহান ভাইকে
নিয়ে পরদিন পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের হেডঅফিসে যায়। পরিচিত একজন এর সাথে পুরো বিষয়
আলাপ করে উনার সাজেশন অনুযায়ী বিস্তারিত জানিয়ে একটি পত্র লিখে চেয়ারম্যান বরাবর। সদ্য
নিয়োগ প্রাপ্ত চেয়ারম্যান মহোদয় এর সাথে দেখা করারও ব্যবস্থা করে দেন ঐ ভদ্রলোক। দীর্ঘ
সময় ধরে তাদের অভিযোগ তিনি শুনেন। শামসুদ্দিন খুব আবেগ তাড়িত হয়ে যায়। কথা বলতে বলতে
এক সময় কেঁদে ফেলে ও। চেয়ারম্যান মহোদয়কে সম্ভবত ব্যাপারটা স্পর্শ করে। তিনি উঠে এসে
শামসুদ্দিনকে শান্তনা দেন এবং বাড়ি ফিরে যেতে বলেন। শামসুদ্দিন-মজিবর বুঝে এবার কিছু
একটা হবে। ওরা পরদিনই পলাশহাঁটি ফিরে আসে।
ঠিক এক সপ্তাহ পর পলাশহাঁটির লোকজন দেখে হটষ্টিক, ক্লাইম্বার সহ নানা যন্ত্রপাতি নিয়ে
পল্লী বিদ্যুতের দুটো মোটর সাইকেল শামসুদ্দিন রাইস এন্ড গ্রাইন্ডিং মিল এর চত্তরে এসে
থামে। নিরবেই লাইনম্যানরা খুঁটিতে চড়ে। ট্রান্সফরমার ব্যাংকের বুশ ঠিক করে। নূতন তার
টেনে মিটার বোর্ডের সাথে সংযুক্ত করে। সব কিছুর শেষে নিরবেই সবাই প্রস্থান করে।
ঐ দিনের পর থেকে নেত্রকোনা পাবিস এবং এর আশেপাশে এজিএমকে, কলমাকান্দা অভিযোগ কেন্দ্র
এবং এর পাশ্ববর্তী গ্রাম সমূহে লাইনম্যান নজরুলকে আর দেখা যায়নি। টাউট মোয়াজ্জেম এখন
মানুষের বাড়িতে মজুরি খাটে। তার চেহারায় এখন আর সেই জৌলুস নেই।