গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ৭ জানুয়ারী, ২০২১

গোপেশ দে


 মুখোশ


'দিদি ! কে যেন তোর খোঁজে এসেছে ?'

'কে এলোরে ?'

'চিনিনারে ...'

'ছেলে নাকি মেয়ে ?'

'ছেলে।একটি লোক।'

রীনা এইমাত্র বাথরুম থেকে স্নান করে নিজের রুমে ঢুকল।কিছুক্ষণ হল বাইরে থেকে এসেছে।বাইরে বলতে প্রাইভেট টিউশানি।সকাল সন্ধে বাড়ি বাড়ি টিউশানি করে বেড়ায়।

একটু ভাবসা গরম তাই সে এই সন্ধায় আবার স্নান করে নিল।এখন সন্ধে সাতটা পঁচিশ।এই সময় কে এলো আবার ? রীনা তার ছোটভাই গুড্ডুকে বলেছে লোকটিকে বসতে।

তাদের ঘরটা নিতান্তই ছোট।লোকটিকে তাদের বারান্দার ঘরে বসতে দেয়া হয়েছে।রীনা ড্রেসিং টেবিলে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে আর ভাবছে কে হতে পারে ? তার কোনো বন্ধু কী ? কলেজ লাইফে অমল, শরৎ, সুখেন, বিভাস অনেক বন্ধু ছিল।এদের কেউ কি ?

শরতের সাথে দশদিন আগে দেখা হয়েছিল রীনার।অনেক কথা হয়েছিল।একটা কফিশপে বসেছিল তারা।শরৎকে তার ঠিকানাটাও দিয়েছিল।ফোন নাম্বারও দেয়া হয়েছিল।তবে কি শরৎ ? কিন্তু এলে তো পারতপক্ষে ফোন করে আসবে।রীনা একটু তাড়াতাড়ি মাথার চুল আঁচড়ালো।

সে বারান্দার ঘরে ঢুকল।না শরৎ না।যে ভদ্রলোক বসে আছেন তাঁকে রীনা চেনে।পথে ঘাটে মুখ চেনা।এ পাড়াতেই থাকেন।তবে তাদের বাড়ি থেকে বেশ দূরেই।তবে কথা হয়নি কোনোদিন।ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করলেন।

'নমস্কার, বসুন।'

লোকটি বসলেন।

রীনা ভেবে পাচ্ছে না এই লোকটি কেনই বা তার কাছে এসেছেন ? 

ভদ্রলোক চিকন ফ্রেমের চশমা চোখে দিয়ে বললেন, 'আপনি কি মিস রীনা? মানে রীনা সরকার ?'

'হ্যাঁ।'

'আমার দুটো মেয়ে আছে।একটা ক্লাশ ফোরে আরেকটা ক্লাশ টুতে পড়ে।'

রীনা এইবার নিশ্চিত হল কেন ভদ্রলোক তার কাছে এসেছেন।

রীনার এই পাড়াতে এক আধটু টিউশানির সুনাম আছে।ছোট বাচ্চাকাচ্চাদের খুব যত্ন করে পড়ায় সে।

রীনা মুচকি হাসি দিয়ে বলল, 'পড়াতে হবে বুঝি ?'

'প্লিজ দেখুন না।আমার মেয়েদুটো নিজে থেকে একফোঁটাও পড়ে না।আমার কথাও শোনে না।কেমন জেদি হয়েছে মেয়েদুটো জানেন...'

'আচ্ছা আচ্ছা।আমি পড়াব।কবে থেকে বলুন?'

'কালই আসুন না...'

'কখন ?'

'আপনি কখন পারবেন ?'

'এই ধরুন সকাল সাতটা আটটা।'

ভদ্রলোক মুখটা একটু পানসে করে বললেন, 'না মানে ওরা তো খুব সকালে উঠতে পারে না।আপনি সন্ধায় পারবেন কি ?'

রীনা লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে একটিবার না ভেবেই বলে দিল, 'হ্যাঁ পারবো।কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল মান্তু ছোটকু ওদের তো ওই সময় পড়ানো হয়।তাহলে ?'

রীনা ভেবে নিল, সে দেখা যাবে।মান্তু ছটকু ওদের সকালে শিফট করে নেবে।আর কথা বাড়াল না রীনা।ভদ্রলোক ঠিকানাটা দিয়ে, ফোন নাম্বারটা দিয়ে চলে গেলেন।

 

রীনা গতবছর বিএ পাশ করে চাকরি খুঁজছে কিন্তু পাচ্ছে না।এখনকার দিনে চাকরি জোগার করা যে কতটা কষ্টের তা একজন চাকরিপ্রার্থীই হাড়ে হাড়ে টের পায়।রীনাও কিছুটা টের পাচ্ছে।

রীনার বাবা নেই।মা, ছোটভাই আর সে।ছোটভাই সবে কলেজে উঠেছে।পুরো সংসারের খরচ রীনার হাতেই।টিউশানি করে আর বাবার জমানো ব্যাঙ্কের কিছু টাকা তুলে কোনোমতে সংসারটা চলে যায়।ছোটভাই বায়না ধরেছে মোবাইল ফোনের।রীনা সামনের মাসেই দেবে বলে ভাইকে আশ্বস্ত করে রেখেছে।কলেজে ওঠা একটা ছেলে সামান্য একটা মোবাইলের আবদার করতেই পারে।দিদি হয়ে ভাইয়ের কেন এই সামান্য অভাব পূরণ করতে পারবে না ? অভাব সামান্য হতে পারে কিন্তু টাকা সামান্য নয়।রীনা ভেবে নিল, আরেকটা টিউশানি তো পেয়েই গেল।সংসারটা আরেকটু স্বাচ্ছন্দ্যে চালানো যাবে।

 

 

রীনা ঠিক সন্ধে সাতটার মধ্যেই বাড়িটাতে পৌছে গেল।ভদ্রলোক বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন রীনার জন্য।সে এই বাড়িটি চিনে বৈকি কিন্তু এটা যে ঐ ভদ্রলোকের বাড়ি তা সে জানত না।অনেকবার এই বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেছে সে।ভদ্রলোককেও যে একেবারেই দেখেনি ব্যাপারটা তা নয়।রীনা মেয়েদুটোকে পড়াতে বসে একটা বিষয় মাথাচাড়া দিল।ওদের মাকে সে কেন দেখতে পাচ্ছে না ? বাড়িতে কি বাবা মেয়েরাই থাকে ? সে মেয়েদুটোকে ওদের মায়ের কথা বলবে বলে ভাবলো।কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল, 'না থাক।কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক না গলানোই ভালো।'

বাড়িটার বাইরেরটা যতটা না সুন্দর ভেতরটা তারচেয়ে বেশি সুন্দর ও অনেক সাজানো গোছানো।তার ছাত্রীদুটোর ঘরটা চমৎকার।একটা দারুণ সেন্টের গন্ধও আসছে ঘরময় জুড়ে।

রীনা বই খুলে ওদের পড়াতে শুরু করল।মেয়েদুটোকে বেশ শান্তই মনে হচ্ছে তার।প্রথমদিন বলেই কি শান্ত ? হতে পারে।দেখা যাবে কয়েকদিন পর মেয়েদুটো একেবারে বাঁদরে পরিণতি হয়ে গেছে।সামলানোই মুশকিল।তার বেশ কিছু স্টুডেন্টদের সাথে এরকমটি ঘটেছে।প্রথম প্রথম বেশ শান্ত।একেবারেই গোবেচারা টাইপ চেহারা।সর্বক্ষণ ভয় ভয় অনুভূতি ! পরে দেখা যায় ওরা যতটা গোবেচারা ততটাই দুরন্ত , দুষ্টু।

'নিন চা খান।'

রীনা বই থেকে পেছনে মুখ ঘোরালো।ভদ্রলোক একটা ট্রেতে করে চা, বিস্কিট, কিছু চানাচুর এনেছেন।রীনা কিছুটা বিস্মিত হল, ভদ্রলোকের স্ত্রী কোথায় তাহলে ? এসব কাজ তো মেয়েলোকের।রীনা হ্যাঁ, না কোনো কথাই বলল না।কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।একটু লজ্জাও লাগছে তার।একজন একেবারে যুবকও না আবার বৃদ্ধও না এমন মাঝবয়েসী মানুষ সাদাপাকা চুল নিয়ে তার জন্যে চা এনেছে।ব্যাপারটা রীনার কাছে একটু লজ্জারই মনে হচ্ছে।

রীনা মাথা নিচু করে ওদের পড়া বুঝিয়ে দিতে লাগল।সে চেয়ারে বসে আছে আর মেয়েদুটো বিছানায়।

লোকটি চলে গেলেন ভেতরে।কিছুক্ষণ বাদে তিনি আবার এলেন।এবার খালি গায়ে।তিনি খাটের এক কোণায় বসলেন।এবার একটু কেঁশে বললেন, 'ওরা পড়া ঠিকমতো পারে তো ?'

'হ্যাঁ পারে,' রীনা লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল।

লোকটার বুকভর্তি লোম।রীনার তাকাতে খানিকটা লজ্জা লাগছে।'লোকটা হ্যাংলার মত বসে আছে কেন কে জানে ? আর বসেই যদি থাকে তাহলে একটা গেঞ্জি অন্তত পরা উচিত ছিল।খুব বেশি গরম পড়েছে কি আজকে ?' রীনা মনে মনে ভাবল।সে লজ্জায় লোকটির দিকে চাইতে পারল না।

লোকটি রীনার ব্যাপারটা হয়ত বুঝতে পেরেই ভেতরে গিয়ে গেঞ্জি পরে এলেন মেয়েদের রুমে।রীনার মুখে একটু হাসি খেলে গেল।

এবার রীনা নিজে থেকেই প্রশ্নটি করেই বসল, 'ওদের মা বাড়িতে নেই ?'

'ওদের মা থাকলে কি আমি চা বানিয়ে আনি বলুন।ওদের মা মারা গেছে।'

রীনা লক্ষ্য করল, ভদ্রলোকের কথাটা বলতে গিয়ে গলাটা কেমন যেন ধরে এলো।চোখ মুছলেন সকলের অগোচরে।রীনার বড্ড মায়া লাগল মেয়ে দুটোর দিকে তাকিয়ে।সে আবার বলল, 'আপনার স্ত্রী মারা গেলেন কিভাবে?'

'সে অনেক কথা।আরেকদিন বলব।'উঠি।উঠি বলেও তিনি উঠলেন না।

রীনা লক্ষ্য করল মেয়ে দুটো বেশ মনোযোগে তাদের কথাবার্তা শুনছে।

রীনা মেয়েদুটোকে বলল, 'তোমরা পড়ো হ্যাঁ।এখান থেকে স্টার্ট করো।'

'ব্রেন হেমারেজ বুঝলেন।অনেক ডাক্তার ফাক্তার দেখিয়েছি কিন্তু বাঁচাতে পারলাম না কণিকাকে।'

রীনা বুঝে নিল, তার স্ত্রীর নাম কণিকা।ভদ্রলোকের চোখের কোণায় জল এসে থেমে রইল।রীনা কী বলবে ভেবে পেল না।লোকটি এবার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, 'আমি আপনাকে কি তুমি করে বলতে পারি ?'

'হ্যাঁ।শিওর।'

'থ্যাংকস।তুমি আমাকে দাদা বলেই ডেকো।কমল দা বললেই হবে।আমার নাম কমল।কমল রায়।'

রীনা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

কমল রায় এবার পড়ার রুমের পেছনে ছোট্ট ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দরজাটা ভেজিয়ে একটা সিগারেট ধরালেন।সিগারেটের গন্ধ রুমে চলে আসতেই রীনার গাটা গুলিয়ে গেল।সিগারেটের গন্ধ একদমই সহ্য হয় না তার।অথচ মেয়ে দুটো কত সুন্দরভাবে বেশ মনোযোগে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে।মেয়েদুটোর অভ্যেস হয়ে গেছে বোঝা যাচ্ছে।

রীনার পড়ানো শেষ হলে কমল রীনাকে এগিয়ে দিতে রাস্তায় নেমে এলেন।রীনা হাঁটতে হাঁটতে কমলকে আরেকটা বিয়ের কথা বলল।

'বিয়ের কথা বলছ ? বড্ড হাসি পেল।এভাবেই বেশ আছি তো।মেয়েদুটোকে নিজের মত করে মানুষ করছি।'

রীনা দেখল, কমল তাকে প্রায় ঘেঁষে ঘেঁষে হাঁটছেন।

রীনা বলল, 'তারপরেও মেয়েদুটোর জন্য মায়ের ভালোবাসা দরকার আছে।'

কমল বললেন, 'একটা বিষয় কি রীনা জানো ? বিয়ে করলে করা যায়।টাকাপয়সা, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স কোনো কিছুতেই কমতি নেই আমার কিন্তু ওদের নতুন মা যদি বাচ্চাদুটোকে ভালো চোখে না দেখে।যদি ওদের ভালো না বাসে ?'

রীনা বলল, 'সেটাও ঠিক।'

রীনা লক্ষ্য করল, কমল তার প্রায় গা ঘেঁষে ঘেঁষে হাঁটছেন।রীনা বেশ খানিকটা সরে গিয়ে বলল, 'আপনার আর আসতে হবে না।আমি একাই যেতে পারব এখন।আপনি বরং মেয়েদুটোর কাছে যান।ওরা একা একা আছে...'

'তাও অবশ্য ঠিক।আচ্ছা চলি।কাল দেখা হবে।'

কমল দ্রুত পায়ে হাঁটলেন।রীনাও দ্রুত পা চালাল তার বাড়ির দিকে।

 

রীনা সকালবেলা রাস্তায় বের হতেই তার ছোটবেলার এক বান্ধবীর সাথে দেখা হল।মেয়েটাকে রীনা একদমই পছন্দ করে না।বেশি বকবক করে।দেখা হলেই তাকে এড়িয়ে চলে রীনা।এবার এড়িয়ে যেতে পারল না।

'এই রীনা শোন।'

রীনা একটা শুকনো হাসি হেসে বলল, 'হ্যাঁ মৌমি বল কী বলবি ?'

মৌমি বলল, 'তুই নাকি কমলবাবুর মেয়েদুটোকে পড়াচ্ছিস ?'

'হ্যাঁ।তুই জানলি কি করে ?'

'না শুনলাম এক জনের কাছ থেকে।শোন তোকে একটা কথা বলি...'

রীনা বুঝতে পারল মৌমি উল্টোপাল্টা কিছু বলবে।কারণ উল্টোপাল্টা কথা বলার সময় তার গলার স্বর পরিবর্তন হয়ে যায়।শেষ কথাটা ঠিক ওরকমই শোনালো।

রীনা মুখ ঘুরিয়ে বলল, 'কী বল?'

'কমলবাবু লোকটা বেশি সুবিধের না।একটু সাবধানে থাকিস, খুব বাজে রিপোর্ট...'

রীনা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, 'ঠিক আছে, চলিরে...'

রীনা বুঝতে পারল মৌমি তার পড়ানোর হিংসে করছে।সে নিজেও টিউশানি করে।ভালো টিউশানি পাচ্ছে না বলেই কান ভাঙানো শুরু করেছে।রীনা হেঁটে হেঁটে বাস ধরার জন্য এগিয়ে যেতেই কমলের সাথে দেখা।কমল মোটরসাইকেল দাড় করিয়ে সিগারেট টানছিলেন।

'কোথায় যাচ্ছ রীনা ?'

'এইতো পড়াতে।'

'বাস ধরছো বোধহয় ?'

'হ্যাঁ।আপনি ?'

'আমি এখন বাড়িতে ঢুকব।বলছি কি চল তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।'

রীনা আপত্তি জানালেও তিনি কথা শুনলেন না।ঠিকই রীনাকে বাইকের পেছনটায় চড়তে হল।রীনার খানিকটা লজ্জা করছে।সে লজ্জায় মাথা একেবারেই নিচু করে ফেললো।লোকটা নাছোড়বান্দা টাইপ।লোকটার চেহারার কী একটা যেন আছে। কঠিনভাবে কিছু বলাও কঠিন।কী আছে লোকটার চাউনিতে ? রীনার কেমন যেন লাগে কমলের দিকে চেয়ে থাকতে।

কমলবাবু রীনাকে বাস ধরানোর নাম করে সোজা পার্কে নিয়ে এল।রীনা বেশ ভয় পেয়ে গেল।পার্কে আনল কেন ? সেতো বাসে চড়ে সেক্টর ফাইভ নামবে।

'আপনি আমাকে এখানে আনলেন কেন ? আমার তো পড়ানো আছে।' তীব্র উৎকণ্ঠা রীনার গলায় !

তিনি বললেন, 'তোমার একদিন না পড়ালে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।ফোন করে বলে দাও যে তুমি একটা কাজে আটকা পড়েছ।'

'আপনি কাজটা কিন্তু ভালো করলেন না।' রীনার একটু ঘৃণা জন্মালো লোকটির প্রতি।চায় কী লোকটা ?

'আমি এখানে এসেছি তোমাকে কিছু বলতে।'

'বলুন।'

'আমি তোমার সম্পর্কে কম বেশি অনেক কিছুই শুনেছি।তোমার ভাই আপাতত কিছু করছে না।'

'কে বলল, কিছু করছে না ? ও তো সবে কলেজে পা দিল।বিএ পাশ তো করুক।'

'না মানে চাকরিবাকরি করলে করতে পারে।তাতে তোমাদের সংসারটা ভালোমতো চলবে।'

রীনা কমলের দিকে চেয়ে রইল।

কমল আরো বললেন, 'আমার হাতে অনেক বড় বড় লোক আছে।তুমি চাইলে ভালো মাইনের চাকরি দিতে পারি তোমার ভাইকে।'

'কেন দেবেন শুনি ?' রীনা বুঝে নিল লোকটার কথার ভেতরে বেশ রহস্য আছে।

রীনা আবার নিজেই বলল, 'আপনি এই কথা বাড়িতেও বলতে পারতেন কিন্তু পার্কে কেন ?' রীনা চারপাশটা দেখল।

'তা পারতাম।কিন্তু একটা মোস্ট ইম্পরট্যান্ট কথা আছে।'

'কী ?'

'তুমি আমায় বলেছিলে না বিয়ে করার কথা ?'

'হ্যাঁ বলেছিলাম।তো...'

'তুমি কি আমাকে বিয়ে করতে চাও ?'

রীনা দেখল, লোকটি তার দিকে করুণভাবে চেয়ে আছে।

'এটা কী সম্ভব ?'

'তুমি যদি চাও তো অবশ্যই সম্ভব।বলো রীনা উইল ইউ ম্যারি মি ?'

রীনা ভেবে পেল না মাত্র দুদিনের পরিচয়েই এমন একটা প্রপোজ আসতে পারে।অবশ্য চোখের সামনে মেয়ে দুটোর ছবি ভেসে এলো।ওদের মা হওয়ার নিমন্ত্রণ দিচ্ছে লোকটা।

রীনা কি হ্যাঁ বলেই দেবে ? কিছু না ভেবে কি হ্যাঁ বলা যায় ? ওদিকে মৌমি কি একটা...

রীনার মাথাটা এলোমেলো হয়ে গেল।সে বলল, 'দেখুন আমি কোনো ডিসিশান নিতে পারছি না।একটু ভাবতে হবে যে আমায়।এভাবে অল্পকদিনের পরিচয়ে হুট করে...'

ভদ্রলোক রীনার কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, 'ঠিক আছে তুমি ভাবো।আমি বাধা দেব না।আর পরিচয় অল্প বেশিতে কিছুই এসে যায় না।তুমি আমার সম্পর্কে সবটাই জানো।'

কমল রীনাকে মোটরসাইকেলে করে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।একেবারে রীনার বাড়ির সামনে বাইক দাড় করালেন না।পাছে কেউ সন্দেহ করে কি না?

 

রীনা বাথরুমে স্নান করতে করতে পার্কের কথাগুলো ভাবতে লাগল।লোকটার বয়েস কতই বা হবে ? বড়জোর পয়তাল্লিশ।সে কোথায় যেন পড়েছে এই বয়েসী মানুষগুলোর ভালোবাসা পারফেক্ট হয়।তাছাড়া লোকটির সুঠাম শরীর।চওড়া কাঁধ।প্রশস্থ ললাট।বুকভর্তি কাঁচাপাকা লোম।বুকে লোম থাকলে নাকি মানুষের মায়া বেশি থাকে।লোকটার চেহারায়ও মাধুর্য আছে।পোশাকে সাহেবিয়ানা।সুখে থাকবে তো সে ? সে বেশিক্ষণ স্নান করতে পারল না।তাড়াতাড়ি বাথরুম থেকে বেড়িয়ে এলো।

 

 

রাতে ঘুমানোর সময় রীনা চোখের পাতা সহজে এক করতে পারল না।কমলকে কি সে বিয়ে করবে ? মাকে কি বলা যায় বিষয়টা ? গুড্ডুরও একটা গতি হবে।লোকটা কথা দিয়েছে ভাইকে একটা চাকরি দেবে।না ঘুম আজ আর বোধহয় আসবে না।রীনার ঠিক চৌদ্দ বছরের মেয়েদের মতই চোখে লাল নীল স্বপ্ন খেলে গেল।হোক না একটু বয়স্ক তাতে কি ? সালমান খান তো বিয়েই কর‍তে পারল না।আর বয়স্ক মানুষ তো করছে বিয়ে।তাছাড়া লোকটা বিপত্নীক।মা কি সায় দেবে?বুঝিয়ে বললে দেবে না কেন ? আবার মৌমি তাকে সাবধান করে দিয়েছে।রীনা মৌমিকে ছোটবেলা থেকেই দেখতে পারে না।মেয়েটা বড্ড বেশি বকবক করে।চার পাঁচটা ছেলের মাথা ভেঙে এখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।রীনার ঘুমাতে ঘুমাতে বেশ রাত হয়ে গেল।

 

রীনা প্রতিদিন পড়াতে বসলেই কমল তার সাথে গল্পজুড়ে নেন।রীনারও বেশ লাগে গল্প শুনতে।গল্প বলে আর হো হো করে হাসেন তিনি।বেশ মজা করে অনেক কথাই বলেন ইদানীং।সেদিন কমল রীনাকে একটা মোবাইলফোন গিফট করলেন।

'এটা রাখো।'

রীনা হাতে নিয়ে ব্যাগ খুলেই বুঝতে পারল একটা দামী মোবাইল ফোন।কিন্তু ওর তো মোবাইলফোন আছে।তাহলে কি ভাইয়ের জন্যে ? কিন্তু তিনি জানবেন কি করে যে ভাইয়ের ফোন দরকার।রীনা প্রথমে আমতাআমতা করলেও মোবাইলফোনটা নিয়ে নিল।

কমলবাবু রহস্যময় হাসি দিয়ে বুঝে নিলেন, মেয়ে লাইনে এসেছে।তিনি রহস্যময় ভঙ্গিতে একটা হাসি দিয়ে বললেন, 'কাল তোমার ভাইয়ের এডুকেশনাল সার্টিফিকেটের জেরক্স আমায় মনে করে দিও।মিত্তিরবাবুর সাথে আমার কথা হয়েছে।একটা কোম্পানিতে ঢুকিয়ে দেবো তোমার ভাইকে।ভালো মাইনে দেবে বলেছে।'

রীনার মনে হল, এই লোকটা তাদের সংসারের জন্য বড্ড সহায়ক।

অন্তত ভাইটি একটা ভালো চাকরি পাবে।সংসারে অভাব থাকবে না।তাছাড়া এই পাড়াতেও তাদের একটা প্রতিপত্তি বাড়বে।লোকটার ক্ষমতাও আছে।

রীনা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।মানে সে জেরক্স তাকে দেবে।রীনার মনে অনেক আনন্দ খেলে গেল।

 

প্রায় প্রতি রাতেই রীনা ঘুমাতে পারে না।কমলকে নিয়ে হাজার ভাবনা তৈরি হয়।দু একবার স্বপ্নও দেখল তাঁকে নিয়ে।পার্কে সিনেমায় পাশাপাশি বসে আছে, কখনও হাঁটছে।রীনা অদ্ভুত সব আবদার করছে।বাচ্চাদুটোকে অবশ্য দেখেনি স্বপ্নে।

কয়েকদিনের ভেতর রীনা ফোনেও কথা বলা শুরু করে দিল।সে বেশিক্ষণ ফোনে কথা বলতে পারে না।মাথা ধরে আসে।তাছাড়া কমলেরও একই কেস।তিনিও বেশিক্ষণ কথা বলেন না ফোনে।তাঁর মাথাধরা হয় কিনা কে জানে ! তাছাড়া প্রতিদিন তো দেখা হচ্ছেই, কথাও হচ্ছে পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে।

 

 

কিছুদিন বাদে গুড্ডুর চাকরির এপোয়েনমেন্ট লেটারও চলে এল।জয়েন সামনের মাসেই।সবই কমলবাবুর কৃপা।রীনার আনন্দ হলেও সে খানিকটা চিন্তিত।খানিকটা না বেশ চিন্তিত।লোকটা তাকে একটা বাজে প্রস্তাব করে বসেছেন।বিয়ের আগেই রাত কাটাতে বলছেন।

রীনা এই বিষয়গুলোকে বড্ড ঘৃণা করে।একটা ছেলের সাথে খুব অল্পবয়েসে ভালোবাসা ছিল তার।ছেলেটা ওকে এরকমই প্রস্তাব করেছিল।এই নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি অবশেষে ব্রেকআপ।ব্রেকআপ টা ছেলেই দিল।রীনা তবুও নিজেকে সংযত রেখেছিল।

রীনা কমলকে বিয়ের কথা বলতেই তিনি আশ্বাস দেন, বিয়ে তিনি রীনাকেই করবেন কিন্তু একরাত থাকলে কি এমন ক্ষতি হবে।

রীনা বুঝতে পারল, ভদ্রলোকের স্ত্রী অনেকদিন গত হওয়ায় হয়ত শরীরের চাহিদা মেটাতে চাচ্ছে।

 

সকালে ঘুম থেকে উঠে রীনার মনে হল, একটু একা একা কোথাও ঘুরে আসা যাক।সে একটা খয়েরী রঙের সালোয়ার কামিজ পরে রাস্তায় বের হল।হাঁটতে হাঁটতে চলে এল ওই পার্কটার কাছেই যেখানে কমলবাবু তাকে বাইকে নিয়ে এসেছিলেন।

রীনা মনের অজান্তেই পার্কের ভেতরটায় ঢুকল।অনেক ছেলেমেয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে আছে।লাজলজ্জার মাথা খেয়ে বসে আছে ওরা।কিছু বুড়ো লোক বেঞ্চে বসে গল্প করছে।রীনা হাঁটতে হাঁটতে ভেতর দিকে গেল।হঠাৎ সে থমকে দাঁড়াল।শুকনো ঘাসে দুজন বসে আছে।কমলবাবু না !সাথে ওই মেয়েটি কে ! চেনাচেনা লাগছে।রীনা একটু আবডালে গিয়ে দাঁড়িয়ে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করল, 'হ্যাঁ কমলবাবুই তো।ওই তো পাশে আর ওয়ান ফাইভ বাইকটা।সাথে মেয়েটা কি মৌমি ?' রীনার বুঝতে বাকী রইল না যে কমলের মৌমির সাথেও প্রণয় আছে।কমল মৌমিকে বেশ ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে ধরলেন।

রীনার ঘৃণায় গা ঘিনঘিন করে উঠল।সে মুখ বিকৃতি করে ছিঃ বলে আবডাল থেকে সরে এসে সোজা মূল রাস্তায় চলে এল।

মানুষ চিনতে এতো ভুল করল সে।রীনা বেশ খানিকক্ষণ ভাবল।তার এখন অনেক কাজ বাকী।গুড্ডুর এপোয়েনমেন্ট লেটারটা ছিঁড়ে ফেলতে হবে।মোবাইলফোনটা ফেরত দিতে হবে।আর ও বাড়িতে পড়ানো নয়।তার মুখে এখনও একরাশ ঘৃণা জমে আছে।সে বাড়ির উদ্দেশ্যে পথ হাঁটা শুরু করল।