গোবিন্দ-বিজয়
অসম্ভব-অসম্ভব কথা সব মাথায় আসে গোবিন্দর ।
সেদিন ও বন্ধুদের বলে,'ভারত
থেকে এরপর কেউ মহাকাশে গেলে আমিই যাবো ।'
ওর কথা শুনে বন্ধুরা
অবাক ।
বন্ধু নিমাই বেশ বিস্ময়ের
সুরে ওকে বলল,'সে কী করে সম্ভব,শুনি ? তুই তো ঘেঁষটে-ঘেঁষটে ক্লাসে পাস করিস ।'
অন্য বন্ধুরা শুনে বেশ
জোরে হেসে উঠলো ।
বন্ধু ফটিক আবার টিটকারি
দিতে ছাড়ল না ।
সে গোবিন্দর দিকে তাকিয়ে
মুচকি-হেসে বলল,'তুই পারবি । রাকেশ শর্মা শুনেছি বেশিদূর পড়েনি ।'
গোবিন্দর মাথা বেশ ঠাণ্ডা
।
স্মিত-হেসে উত্তর দিলো,'দেখাই যাক তবে ।'
বড় গরীবের ছেলে গোবিন্দ
।
বাবা জন-মজুর । পাঁচজনের
সংসার খুব কষ্ট করে চালায় । কিন্তু সে মজা পায় গোবিন্দর কথা শুনে ।
সে হেসে ওকে বলে,'জানি
না কি হতে কি হয়ে যায় । তবে পড়াশোনায় একটু মন দেওয়া লাগে । আমি তো কষ্ট করছি ।'
গোবিন্দর মার আবার খুব
রাগ হয় ওর ওপর ।
একদিন সে বেশ রাগ করে
বলে,'বোঝা গেছে তোর দৌড় । এবার বাবার সঙ্গে কাজে লেগে পড় ।'
গোবিন্দ বাবার দিকে তাকিয়ে
বেশ সাহস পেয়ে ফিক করে হেসে উত্তর দেয়,'বাবার স্বপ্ন পূর্ণ করি আগে ।'
কি যে গোবিন্দর স্বপ্ন
বুঝে ওঠা দায় ।
অসম্ভব কথা বললেই তো
আর স্বপ্ন পূরণ হয় না । তার জন্য চেষ্টাও চালাতে হয় ।
বন্ধুরা সে কথাই ওকে
বলে পইপই করে । কিন্তু স্বপ্নালু গোবিন্দ নিজের কথা বলে বন্ধুদের কাছে হাসির খোরাক
হয়ে ওঠে । ও অবশ্য কিছুই মনে করে না তাতে ।
কিন্তু গোবিন্দ করবেটা
কী ? ঘর থেকে বাইরে সবার মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা ।
হঠাৎ জানা গেলো মহাদেবপুরের
খালের বাঁধ ভেঙে গেছে । হু-হু করে জল ঢুকছে শিবপুর গ্রামে । মুহূর্তে গোবিন্দদের গ্রাম
বন্যার জলে ভেসে গেলো প্রায় ।
ঘরের দিকে মন নেই তখন
ওর । ওর পাড়াতেই বাস করে দুখিরাম সাহা আর তার বিছানায় শয্যাশায়ী স্ত্রী । তার দুই ছেলে
থাকে ভিম গাঁয়ে । তারা আবার সংসার পেতেছে সেখানে ।
গোবিন্দকে দুজন খুব ভালোবাসে
। দিনে অন্তত একবার তাদের কাছে গোবিন্দর যাওয়া চাই ।
তাদের কথাই মনে পড়লো
আগে ওর ।
পাড়াতে কেষ্ট দাসের বাস
।
তার একটা ভ্যান আছে ।
গোবিন্দ চুপিচুপি ঘর থেকে বেরিয়ে তার বাড়িতে এসে ঢুকল । কেষ্ট দাস যখন তার পরিবার নিয়ে
ব্যতিব্যস্ত তখন গোবিন্দ তার ভ্যান বার করে আনল বাইরে । সটান ভ্যান নিয়ে গেলো দুখিরাম
সাহার বাড়িতে । উঠোনের জল ভেঙে একাই পরপর দুজনকে ভ্যানে তুলল ।
তারপর জলের মধ্যে দিয়ে
ও ভ্যান চালাল তখনও শুকনো যেখানে ।
ওদিকে গোবিন্দদের বাড়ি
জলে প্রায় ভেসে গেছে । গোবিন্দর মা খুঁজতে থাকলো ওকে ঘোর বিপদে ।
ওর বাবা দুবার চারদিকে
তাকিয়ে বলল,’গোবিন্দ আমার এমন কোথাও আছে যেখানে আরও বিপদ মানুষের । আমি আর সদানন্দ
তো আছি । এ বিপদ দুজন মিলে বিপদ পার করে দেবো ।‘
সদানন্দ গোবিন্দর ভাই
। ক্লাস নাইনে পড়ে । বেশ মেধা আছে বলে গ্রামে পরিচিত বেশ ।
ও শুনে ভয় পেয়ে বলল,’এত
জল ! আমরা কি পারবো ?’
মাও ওর কথায় সায় দিলো
।
তখন গোবিন্দর বাবা বেশ
রাগ করে বলল ওকে,’গোবিন্দ যার দাদা তাকে পারতেই হবে ।‘
সদানন্দ বাবার কথা শুনে
মনমরা হয়ে ঘরের থেকে জিনিসপত্র বার করতে শুরু করলো ।
গ্রামের একমাত্র মাঝি
ভোলার নৌকায় উঠে গোবিন্দর বাবা খানিক স্বস্তির হাসি হেসে তার পরিবারের চারজনকে নিয়ে
শুখার দিকে এগিয়ে চলল ।
নৌকায় যেতে-যেতে সহসা
গোবিন্দর বাবার চোখে পড়লো একটা ভ্যান জলের তোড়ে ভেসে যাচ্ছে । ভ্রূ-কুঞ্চিত হল তার
। সেখানে জল খানিক কম । কাউকে না বলেই সে জলে ঝাঁপ দিলো ।
সেই ভ্যানের কাছে প্রায়
পৌঁছে গিয়ে সে হতভম্ব হয়ে দেখল গোবিন্দ ভেসে চলেছে সামনের দিকে । জলে ভীষণ কারেন্ট
। সেখানে তার পক্ষে পৌঁছনো প্রায় অসম্ভব । তবু সে আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকলো ।
হঠাৎ আর এক নৌকা থেকে
তার পরিচিত হারাধন পাল চেঁচিয়ে বলে উঠলো,’আপনি মরতে যাচ্ছেন নাকি,কত্তা ? ফিরে আসতে
পারবেন ? পরিবার যে শেষ হয়ে যাবে আপনার ।‘
উপায় নেই । তাই গোবিন্দর
বাবা চোখ-ভরা জল নিয়ে সাঁতরে ভোলার নৌকায় গিয়ে উঠলো ।
প্রায় আধঘণ্টা পরে গোবিন্দর
বাবা তার পরিবার নিয়ে শিবপুর বাজারে এলো । বাড়ির কাউকে কিছু বুঝতে দেয়নি সে । বুকের
ব্যথার তুফান তার গোবিন্দকে স্মরণ করে ভুলতে চেয়েছে । গোবিন্দর সে বড় ভক্ত ।
বাজারের তার সাথে দেখা
হল দুখিরাম সাহা আর তার অসুথ স্ত্রীর । এক জায়গায় ঠাই হল দুই পরিবারের ।
দুখিরাম সাহা তৃপ্তির
হাসি হেসে গোবিন্দর বাবাকে বলল,’তোমার গোবিন্দ তো আমাদের এখানে পৌঁছে দিলো । ভ্যান
নিয়ে চলে গেছে । বলল,যার ভ্যান তাকে ফিরিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরছি । দেখা হয়নি তোমার গোবিন্দর
সাথে ?’
তার কথা শেষ হতেই হাউহাউ
করে কেঁদে উঠলো গোবিন্দর বাবা । বারবার সে বুক চাপড়াতে থাকলো । গোবিন্দর তার অবস্থা
দেখে যারপরনাই বিস্মিত ।
সে আকুল-স্বরে তাকে জিজ্ঞেস
করলো,’কী হল গো ? আমাদের গোবিন্দ নেই ?’
কান্না-ভেজা গলায় গোবিন্দর
বাবা নিচু-গলায় তাকে বলল,’গোবিন্দ আমার মহাকাশে যাত্রা করেছে গোবিন্দর পরম আশ্রয় পেতে
। তার আগে ও দুজন অসহায়কে রক্ষা করে পুণ্যি করে গেছে । আমি কি কখনও পারবো ?’
গোবিন্দর মা তখন সাগর-সাগর
কান্নায় দিশাহারা । তাই একটি কথা বেরোল না তার মুখ থেকে ।
পরে বন্যার জল নেমে গেলে
কিছুদিনের মধ্যে গোবিন্দর বাবা তার পরিবার নিয়ে আবার তার আস্তানায় ফিরে এলো । গোবিন্দ-শূন্য
আস্তানা ।
এ কথা ভেবে সে আর গোবিন্দর
মা ডুকরে কেঁদে উঠলো ।
গোবিন্দর গ্রামের সেইসব
বন্ধুরা ছুটে এসে গোবিন্দর বাবার সঙ্গে কাজে হাত লাগাল ।
সেই ফটিক কাজ করতে-করতে
সজল-চোখে বলল গোবিন্দর বাবাকে,’আমাদের গোবিন্দ অনেক ওপরের মানুষ,কাকা । এখন আমরা বুঝতে
পারছি । সবাই কি আর মহাকাশে যেতে পারে ? মহাকাশ মানেই তো ঈশ্বরের কাছে যাওয়া । ও কিন্তু
পারলো । আমরা সবাই গর্বিত ওর জন্য ।‘
‘হ্যাঁ,মহাকাশে ও আমার
পরম আরাধ্য গোবিন্দর কাছে গেছে । পরে বুঝবি তোরা । মানুষের জন্য কিছু করলে তিনি তার
বুকে স্থান দেন ।‘
তৃপ্তির হাসির মধ্যে
কান্না মিশিয়ে গোবিন্দর বাবা কথাগুলো বলে গেলো ফটিক সহ গোবিন্দর বন্ধুদের ।
শুধু কেঁদেই গেলো তখন
গোবিন্দর মা । তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা জানা নেই গোবিন্দর বাবার ।
তবে তার আর এক ছেলে সদানন্দ
আর বন্ধুরা তাকে ঘিরে ধরে সারা মুখে ফুলের মতো হাসি ফুটিয়ে তার ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ
হাসির রেখা এনে দিলো ।
আর সেই কেষ্ট দাস ? যার
ভ্যান নিয়ে চুপুচুপি পথে নেমেছিল জলের মধ্যে ।
সে কিন্তু এতটুকু রাগ
করলো না ।
বরং সে গোবিন্দর গর্বে
তৃপ্তির হাসি হেসে গোবিন্দর বাবাকে বলল,’এমন ছেলে কোথায় আছে আর ? একটা তুমি দেখাতে
পারো ? তোমার গোবিন্দর উৎসর্গে গেছে আমার ভ্যান । তিনি চাইলে আবার আমি করে নিতে পারবো
। একদম শোক কর না । তোমাদের এখন সুখের দিন । গোবিন্দ কৃপা করেছে ।‘
এরপরে আর কোন কথা হয়
না ভেবে গোবিন্দর বাবা অম্লান-হেসে আকাশের দিকে তাকিয়ে করজোড় করে বিড়বিড় করে কীসব বলতে
থাকলো । গোবিন্দর মা পরে এসে যোগ দিলো তার সঙ্গে ।