গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ৭ জানুয়ারী, ২০২১

শান্তিময় কর

 


স্বপ্ন ভঙ্গ           


 
সুবিমলকে কোনদিন ভোলা যায় না। তাই আজও এই পনেরো ষোলটা বছর পরেও সুবিমলের কথা খুব মনে পড়ে। আমি এখন আমেরিকাতে এক বহুজাতিক সংস্থার কর্ণধার। প্রচুর অর্থের মালিক। অনেক মান, সম্মান, প্রতিপত্তি ---পরিপূর্ণ, সুপ্রতিষ্ঠিত জীবন আমার। স্ত্রী,পুত্র, কন্যাসহ সুখের সংসার। বর্তমান কালের বিচারে সুখী বলতে যা বোঝায়, আমি সেই অর্থে প্রকৃত সুখী । তবুও কোন কালে ছেড়ে আসা আমার সেই ছোট্ট গ্রামটার কথা আমি কখনও ভুলতে পারি না।
  সবুজ ধানক্ষেত, নদীর কুলকুল শব্দ, পাখীদের গান গাওয়া, সেই মাঠ, ধুধু প্রান্তর, দল বেঁধে স্কুলে যাওয়া, সাঁতার কাটা আর বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে হৈ - হুল্লোড়ে মেতে থাকা -- সব যেন আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। উদাস হয়ে মনটা আমার কোথায় কোন অজানায় হারিয়ে যায়। ভীষণ ফিরে পেতে ইচ্ছে করে সেই ফেলে আসা দিনগুলো, সেই হারিয়ে যাওয়া জীবনটা। সে সব দিনের কথা আমার মনটা কে ভারাক্রান্ত করে তোলে। ইচ্ছে করে এই যান্ত্রিক জীবন থেকে মুক্তি নিয়ে ফিরে যাই সেই জীবনে -- আনন্দে উচ্ছল, খুশীতে রঙিন। ‘স্মৃতি তুমি বেদনা’--- এ কথা আমি পুরোপুরি সমর্থন করি না, তবে স্মৃতিও যে মাঝে মাঝে মনকে গভীর ভাবে আন্দোলিত করে দেয়, তা আমি অনুভব করি নিজেকে দিয়ে ।

 
 
হ্যাঁ, যা দিয়ে শুরু করেছিলাম --- সুবিমল অর্থাৎ সুবিমল মিত্র, আমার সেই বাল্যকালের বন্ধু তথা সহপাঠী। পশ্চিমবঙ্গের অখ্যাত এক গ্রামে পাশাপাশি আমরা থাকতাম । এক সাথে স্কুলে পড়া, আড্ডা মারা, খেলাধুলো করে আমরা বড় হয়ে উঠেছি। আকস্মিক কারণে হঠাৎ যখন সুবিমলের বাবার মৃত্যু হয় তখন তার পড়াশুনা মাঝপথে। অনেকগুলো ভাই বোনের সংসারে সে সবার বড়। উপার্জনশীল আর কেউ না থাকায় পড়াশুনাকে বিদায় জানিয়ে কোমর বেঁধে সংসারের হাল ধরার জন্য তাকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছিল। সে আর পড়াশুনা চালাতে পারবে না ভেবে ভীষণ কষ্ট হয়েছিল আমাদের। সুবিমলের মনের অবস্থাটা সম্যক উপলব্ধি করতে পারছিলাম আমরা সবাই। ওর মত একটা ছেলে, যে কোনদিন কোন পরীক্ষায় প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয়নি, যে ছিল কিনা আমাদের স্কুলের গর্ব, তাকেই কিনা এই এতটুকু বয়সেই সংসার সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে হবে --- ভাবতেই সেদিন বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠেছিল। কত স্বপ্ন ছিল তার চোখে, কত উচ্চাশা পোষণ করতো সে মনের গভীরে। এমন কোন কাজ ছিল না যাতে ওর যোগদান নেই। পল্লী উন্নয়ন, সমাজ সংস্কার, মানুষের সেবা এবং দুঃখ কষ্টে মানুষের পাশে দাঁড়ানো থেকে শুরু করে সমস্ত রকমের কাজেই ছিল তার দারুন উৎসাহ। বাচ্চাদের ক্লাব, খেলাধুলা, পূজা পার্বণ সব কিছুতেই তার ছিল অসাধারণ একাগ্রতা। সুবিমল একদিন আমাকে তার মনের কথা বলেছিল ---
 
--- জানিস, আমার খুব ডাক্তার হবার ইচ্ছা ।
 
--- তুই যা-ই হতে চাস, তাতেই সফল হবি, এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
 
--- আসলে কি জানিস, গ্রামে তো একজনও ভাল ডাক্তার নাই। গ্রামের মানুষের দুর্দশা তো
   তুই নিজেই দেখছিস, বিনা চিকিৎসায় কত অসুবিধা তাদের। 
--- সে আর বলতে। সরকার ডাক্তারটা তো একটা পিশাচ -- শুধু টাকা টাকা করেই মরলো। নরকেও স্থান হবে না ওর জেনে রাখিস।
 
--- তাইতো মনে মনে ঠিক করেছি ডাক্তার হয়ে এই মানুষগুলোর সেবা করবো । ওদের অবস্থা দেখে আমার খুব কষ্ট হয়।
 
--- তবে কী তুই দাতব্য চিকিৎসালয় খুলতে চাস ? তোর টাকার দরকার নাই ?
 
--- আছে, টাকার দরকার কার থাকে না ? তবে পেট চালাতে কত টাকা দরকার ? বড় লোক হবার বাসনা আমার নাই। প্রয়জনের অতিরিক্ত পয়সার কথা মনে স্থান দিই না কখনও আমি।
 
--- কিন্তু তোর অত বড় সংসার, তার কি হবে ? তাছাড়া তোর বাবারও তো বয়স হচ্ছে এবং তাঁরও তো সীমিত আয়।
 
--- সে ঠিক চলে যাবে, উপোষী থাকবে না কেউ।
 
 
সুবিমলের সাথে যখন এই রকম কথাবার্তা হচ্ছিল, তখন ভাগ্য দেবতা অন্তরাল থেকে মুচকি হাসছিলেন। কেউ আমরা ভাবতেও পারিনি যে তার মনের সব আশা, আকাঙ্খা, স্বপ্ন, সংকল্প ভেঙ্গে চৌচির হয়ে যাবে। ডাক্তারি পাশ করে মানুষের সহায় হতে চাওয়া একজনের মনোবাসনা এইভাবে অবরুদ্ধ হয়ে যাবে। সুবিমলের সামনে যে এরকম একটা পরিস্থিতি এসে যাবে, আমরা ভাবতেও পারিনি।
 
 
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাই হল। মাস দুয়েকের মধ্যে একদিন সকালে রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ী চাপা পড়ে সুবিমলের বাবা মারা গেলেন। তিনি চলে গেলেন, পুরো সংসারটার সব ভার, দায়-দায়িত্ব
  সুবিমলের কাঁধে চেপে বসলো। জীবনের এমন একটা সন্ধিক্ষণে তার বাবার মৃত্যু হল যে তখন তার দিশেহারা অবস্থা। আমরা সহপাঠী সঙ্গীরা তাঁর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে ওদের বাড়ীতে হাজির হলাম। দৃঢ়চেতা সুবিমলের মুখের দিকে তাকিয়ে, বাবার মৃত্যু শোককে ছাপিয়ে অন্য কিছু দেখতে পেলাম যেন । মনে হল তার মনে শোকের চেয়ে হতাশা বেশী -- বিষাদের চেয়ে আশাভঙ্গের দুঃখটাই বেশী । তার কাঁধে হাত রেখে বললাম ----                           --- দুঃখ করিস না সুবিমল। এই তো প্রকৃতির নিয়ম, এইতো সর্ব জীবের গতি, সেই গতিই তো উনি প্রাপ্ত হয়েছেন। সবাইকেই একদিন চলেই যেতে হয় ।                            --- জানিরে মিহির, জানি -- আমি সব জানি। সব কিছু প্রকৃতির নিয়মেই ঘটে। বাবার তো যাবার সময় হয়নি। বিধাতা একটু সদয় হয়ে বাবাকে আরও কয়েকটা বছর বাঁচিয়ে রাখলে ভাল হত। কিন্তু যা হবার নয়, তাতো হয় না। তাই ভবিতব্যকে মেনে নেওয়া ছাড়া আর কী উপায় ? আর তাছাড়া ভগবান আমাকে যে পরীক্ষার সামনে এনে দাঁড় করিয়েছেন, এখন থেকে আমাকে সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য প্রাণপাত করতে হবে, আমি জানিরে ভাই।  
 
সুবিমলের সেদিনের ঐ কথাগুলো শুনে খুব কষ্ট হয়েছিল। মনে হয়েছিল ও বলতে চাইছে ওর বাবা যদি আরও কয়েকটা বছর বেঁচে থাকতেন তাহলে ও একটু গুছিয়ে নিতে সময় পেত। 'ভবিতব্য' মানে বলতে চাইছে যে ওর আশা, আকাঙ্খা, স্বপ্ন, সংকল্প ওর বাবার অকাল প্রয়াণের সাথে সাথে সব শেষ। ওর সামনে তখন শুধু বাঁচার লড়াই। এবং প্রকৃত পক্ষেই এরপর থেকে শুরু হল তার জীবন যুদ্ধ, বেঁচে থাকার, বাঁচিয়ে রাখার প্রাণপণ, উদয়াস্ত সংগ্রাম। এর কয়েকদিন পর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বেরোল --- সুবিমল আমাদের জেলায় সবার সেরা হয়ে প্রথম স্থান অধিকার করলো। এরপর উচ্চ শিক্ষার্থে আমার বাবা আমাকে বাইরে পাঠাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। বাইরে চলে যাবার আগে সুবিমলের সাথে দেখা করতে ওদের বাড়ী গেলাম। ওর মায়ের কাছে জানতে পারলাম ও কেমন যেন বদলে গেছে। সব সময় একা একা থাকে আর আকাশ পাতাল কি যেন ভাবে -- নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে গৃহবন্দী করে ফেলেছে। যাই হক, ওর সাথে দেখা হল, ওকে যেন চেনাই যায় না। মনে হল ও যেন অন্য গ্রহের মানুষ, ওর চোখদুটো যেন দূরের ঐ আকাশটায় কী একটা খুঁজে বেড়াচ্ছে । আলতো করে ওর কাঁধে একটা হাত রেখে আস্তে একটু চাপ দিলাম। বললাম ---
 
--- সুবিমল, আমি মিহির ।
 
--- ওহ, আয় আয় মিহির, বোস এখানে । কেমন আছিস বল ? তারপর কী করবি ঠিক করলি ?
 
--- আমি ভাল আছি, তোর কথা বল ।
 
--- আমার কথা বাদ দে না। কোথায় ভর্তি হচ্ছিস ?
 
--- সে কথাটাই তো তোকে বলতে এলাম রে ভাই। আগামী কাল আমি পুনে যাচ্ছি। ওখান থেকে গ্র্যাজুয়েশনটা করে পুনে বা মুম্বাই থেকে এম-বী-এ করার ইচ্ছে আছে, বাবারও তাই ইচ্ছে ।
 
--- খুবই ভাল কথা। শুনে খুব খুশী হলাম। যা, ভগবান তোর মঙ্গল করুন। অনেক, অনেক উন্নতি হক তোর জীবনে ।
                                                              --- আর তুই, তোর কী হবে ? শুনলাম তুই নাকি আর পড়াশুনা করবি না ? তাহলে তোর স্বপ্ন পূরণের কি হবে ? 
--- সব স্বপ্নই কি সত্যি হয়, নাকি সব স্বপ্নই পূরণ করা যায় ? আমার অদৃষ্টে যা লেখা আছে, তা খণ্ডাই কেমন করে বল ?
 
--- কী বলছিস রে তুই ? একজন কট্টর বাস্তববাদীর মুখে অদৃষ্টের কথা ?
 
--- বাস্তববাদী ঠিকই, কিন্তু আমার এই অবস্থার বাইরে গিয়ে পড়াশুনা করা বাস্তবে তো অবাস্তবই।
 
--- তবুও হাল ছেড়ে দিলে কী চলবে ? চেষ্টা তো করে দেখতে হবে, হতাশ হয়ে ভেঙ্গে পড়লে তো চলবে না ।
 
--- আমাদের সংসারের অবস্থা তো তুই ভালই জানিস মিহির। আমি যদি আরও পড়তে চাই তাহলে তো আমাকে বাড়ী ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে বাইরে যেতেই হবে। বাইরে গিয়ে পড়ার কথা ভাবতেই পারি না। এখন আমার চিন্তা শুধু একটাই -- যে কোন উপায়ে যে কোন একটা চাকরি জোগাড় করে দু পয়সা রোজগার করে সংসারটাকে বাঁচানো। আর আমি মোটেও হতাশ নই। তাইতো সংসার সমরাঙ্গনে কোমর বেঁধে লড়াই করার জন্য তৈরী হচ্ছি।
 
--- তাহলে এই তোর স্থির সিদ্ধান্ত -- আর পড়াশুনা করবি না ?
 
--- উপায় নেই দোস্ত, এইতো জীবন। সবার জন্য সব কিছু নয়।
 
--- তবুও বলি, আর একবার ভেবে দেখ।
 
--- তুই কি মনে করিস আমি ভেবে দেখিনি ? অনেক ভেবেই এই নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি। বাবার যা সামান্য রোজগার ছিল তার সাথে সামান্য জমির ফসল মিলিয়ে কোন ক্রমে চলে যাচ্ছিল সংসারটা। কিন্তু এখন তো আর কোন পথ বা বিকল্প খোলা রইল না আমার সামনে। আমার সামনে এখন লড়াই, শুধু লড়াই, লড়াই করেই বেঁচে থাকা আর বেঁচে থাকার জন্যই লড়াই।

 
অনেক সাধ্যসাধনাতেও ওকে রাজী করাতে পারলাম না। আর তাছাড়া ওর সামনে বিকল্পই বা কী আছে ? সত্যি তো, কিভাবেই বা চলবে ওদের সংসার ? তাই ও যখন
  সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে, তখন ওকে আর ফেরাবার উপায়ও নাই। ওর মত পরিবর্তন করানো সবার সাধ্যের বাইরে। কঠোর চেতা আর সিদ্ধান্তে অবিচল, ও তাই সবার থেকে আলাদা। যাই হক, বিষণ্ণ মনে ওর কাছে বিদায় নিয়ে বাড়ী ফিরে এলাম। ওর কাছ থেকে উঠে আসার সময় ও বললো "অল দি বেস্ট"। ওর ঐ 'অল দি বেস্ট' টা আমার জীবনে দি বেস্ট হয়েই এসেছে। আজ মনে হয়, ওর ঐ হার্দিক শুভেচ্ছাই আমাকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। প্রথম দিকে গ্রামের সাথে ক্ষীণ যোগাযোগের কারণে জেনেছিলাম সুবিমল কোন ক্রমে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতার একটা চাকরি জুটিয়ে আর রাতদিন গৃহশিক্ষকতা করে সংসারের জোয়াল টেনে নিয়ে চলেছে। 
                                                                                     এরপর বহুকাল আর কোন যোগাযোগ ছিল না বা বলা যায় বিরাট কর্মযজ্ঞে ব্যস্ত হয়ে পড়ার কারণে আর কিছু ভাবার বা জানার অবকাশ ছিল না আমার । তবুও হঠাৎ হঠাৎ সুবিমলের কথা খুব মনে হত আর চোখের সামনে ভেসে উঠত আমার সেই ছোট্ট গ্রামটা আর তার সৌন্দর্যভরা প্রাকৃতিক পরিবেশ। এইভাবেই কাটছিল জীবন। একদিন গাড়ী চালিয়ে অফিস থেকে ফেরার পথে পাশে তাকিয়ে দেখি একটা শপিং মলে একজন ঢুকে গেল যাকে আমার ভীষণ চেনা চেনা লাগছিল। কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না। ভাবলাম একবার তার সামনা সামনি হওয়া দরকার। যেই ভাবা, সেই কাজ-- পাশের পারকিং জোনে গাড়ীটা পার্ক করে ঢুকলাম গিয়ে ঐ মলে। আর ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ও লাফিয়ে উঠলো --- 
--- আরে, তুই মিহির না ?
 
--- তাহলে ঠিকই চিনেছি। তুই সেই শান্তনু।
 
 
আচমকা শান্তনুর সাথে এই বিদেশে দেখা হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি। তাই মনটা আনন্দে ভরে গেল। ওর মুখেই শুনলাম গত চার বছর ধরে ও আমেরিকাতেই আছে যদিও ওর স্ত্রী, ছেলে মেয়ে সবাই ভারতেই থাকে। ও যে কোম্পানিতে
  কাজ  করে, তারাই ওকে একটা প্রোজেক্টের দায়িত্ব দিয়ে এখানে পাঠিয়েছে। বছরে একবার ও দেশে যায়। এই সুন্দর সন্ধ্যাটাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ওকে  জোর করে বাড়ী নিয়ে এলাম। অনেক রাত পর্যন্ত জমিয়ে আড্ডা চললো। তারই ফাঁকে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম সুবিমলের কোন খবর তার জানা আছে কিনা। হ্যাঁ, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। সুবিমল, শান্তনু, আমি -- আমরা সবাই সহপাঠী। সুবিমলের প্রসঙ্গ ওঠায় ওর মুখটা কেমন যেন বিবর্ণ ও করুণ দেখালো। তার কাছেই জানতে পারলাম প্রাণপাত পরিশ্রম করে সুবিমল তার সংসারটাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এক এক করে বোনদের বিয়ে দিয়েছে -- তারা সুপ্রতিষ্ঠিত। ছোট ভাইটাকে লেখাপড়া শিখিয়েছে। সে আজ নামী সফটওয়্যার কম্পানীর ইঞ্জিনিয়ার। হলে কী   হয়, ভাই-বোনেরা দাদার খোঁজ নেবার সময় পায় না। তাই বলে এই নিয়ে সুবিমলের মনে কোনও ক্ষোভ নেই। সুবিমল একা, ভীষণ একা । অসুস্থ শরীরে সে নিজেকে সম্পূর্ণ গুটিয়ে নিয়ে গৃহবন্দী করে রেখেছে। শান্তনু আরও বললো --- 
--- জানিস মিহির, সুবিমলের দূর সম্পর্কের এক ভাইপো ডাক্তারি পাশ করে ঐ গ্রামেই প্র্যাকটিস করে। কিন্তু অসুস্থ কাকাকে এক বারও দেখতে যায়নি, চিকিৎসা করা তো দূরের কথা ।
 
--- তাই নাকি, তুই তো অনেক খবর রাখিস ?
 
--- ঐ ডাক্তার ভাইপোটা একটা অর্থ পিশাচ। ও ভাল করেই জানে যে গ্রামের সোজা সরল মানুষগুলোকে ঠকিয়ে পয়সা উপার্জন করা খুবই সহজ। তাই সামান্য অসুস্থ রোগীকেও মারাত্মক ব্যাধির ভয় দেখিয়ে এবং নানা রকম পরীক্ষা নিরীক্ষার নামে শুষে নিচ্ছে হত দরিদ্র মানুষগুলোকে এই সুবিমলের চোখের সামনেই। সেই সুবিমল যার সংকল্প ছিল ঐ মানুষগুলোর সেবা করা। একটা পিশাচ মানুষগুলোকে নিঃশেষ করে দিয়ে লুটেপুটে খাচ্ছে আর একজন চোখের সামনে তার আদর্শের অপমৃত্যু দেখতে দেখতে তার স্বপ্ন ভঙ্গের যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে আর গুমরে মরছে। শান্তনুর কাছে আরও জানতে পারলাম নিজের ঘরে জানালার পাশে বসে সুবিমল ঐ ডাক্তারের চেম্বারে যাতায়াত করা মানুষগুলোকে শূন্য দৃষ্টিতে দেখে আর নিভৃতে চোখের জল ফেলে। ভাবে তার ফেলে আসা দিনগুলোর কথা আর সত্যি না হয়ে ওঠা তার একান্ত আপন স্বপ্ন, আশা আর সংকল্পের কথা।