গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০২১

মনোজিৎকুমার দাস

 

যৌবন সরসী নীরে                                                                                              

আমি আর ও একই সঙ্গে পড়ি। এবার বার ক্লাসে আমরা। কলেজে ভর্তি হবার দিনে ওর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা।  প্রথম দিনের দেখা থেকেই ওকে আমার ভাল লাগা। ভাল লাগা থেকে ঘনিষ্টতা, আর ক’দিন যেতে না যেতেই অন্তরঙ্গতা। ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব আজও অটুট। আমি একদিন ওকে না দেখলে আমার মনটা কেন যেন অস্থির হয়ে উঠে। ও বাপ মায়ের একমাত্র মেয়ে। তবে পিকলু নামে ওর একটা ছোট ভাই আছে। 

                                  অন্তরঙ্গতা গাঢ় হবার পর একদিন অফ পিড়িয়ডে কলেজের খেলার মাঠের পশ্চিম পাশের বকুলতলার নিরালায় বসে ও আমাকে খালি গলায় রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনিয়েছিল আর বলেছিল বাড়িতে তারা রবীন্দ্র সঙ্গীতের চর্চা করে। ওর মা ভাল রবীন্দ্রসঙ্গীত গান। মায়ের কাছে ও নিয়মিত রবীন্দ্র সঙ্গীত শেখে।

                                                                         আমিও বাড়িতে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখি , তবে মায়ের কাছ থেকে নয়। বলতে গেলে বলতে হয় নিজে নিজেই। তারপর একদিন শোভনা আমাকে ওদের বাড়িতে নিয়ে গেল ওর মায়ের কণ্ঠের রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনাতে। শোভনা তার মায়ের চেহারা পেয়েছে। সত্যিই ওর মা সুদর্শনা। সুরেলা কণ্ঠে সত্যিই তিনি মনমাতানো রবীন্দ্রসঙ্গীত গান।

 

আমি কৃষ্ণকলি, আমিও  শোভনা'র মতো বাপ মায়ের একমাত্র মেয়ে। আমারও একটা ছোট ভাই আছে। আমাকে একদিন না দেখলে শোভনাও অস্থির হয় , আমি ওর কথা থেকে বুঝতে পারি। শোভনা ও আমি পরস্পরকে ভালবাসি তা আমাদের চলনবলনে অনেকেই বুঝতে পারে। দুজন  সমবয়সী মেয়ের অন্তরঙ্গ মেলামেশা দেখতে পেয়ে  আমাদের সহপাঠী মেয়েরা আমাদের নিয়ে সমালোচনা করে শোভনা বুঝতে না পারলেও আমি বুঝতে পারি।  

 

আমরা দু'জন একই বেঞ্চে পাশাপাশি বসে আসছি সেই ক্লাস শুরুর প্রথম দিন থেকে। বার ক্লাসে উঠার পর থেকে শোভনার মাঝে কেমন যেন একটা পরিবর্তন লক্ষ করে আমার মনে নানা প্রশ্নের উদয় হয়।           মাঝেমাঝে ওকে উভ্রান্ত  দেখে আমার মনে হয়, ওর বাবা চাকুরী নিয়ে দুবছরের জন্য সিঙ্গাপুর যাওয়ায় হয়ত শোভনা এতটা মন মরা। 

 

নিয়মিত কলেজে আসছে না দেখে আমি ওকে ফোন করলে ফোন ধরলেন ওর মা। ওর মা বললেন,‘ ক্লাস নাকি হচ্ছে না, তাই তো বলে আজ ও ক্লাসে গেল না। তাছাড়া ওর শরীরটাও বেশ ক'দিন  থেকে খারাপ। বোঝোই তো মা, মেয়েদের শরীরের কথা!ও তো ফোনটা রেখে পুকুরঘাটের দিকে-----’                                                                শোভনার মা কথা শেষ করার আগেই কল কেটে গেলে আমি বুঝতে পারলাম ফোনের টাকা শেষ। আমি ভাবলাম, শোভনার মা কল ব্যাক করবেন। কিন্তু তিনি তা না করায় আমার ফোনটা রেখে দিলাম।                                                                                                     যাক সেকথা, আমার নাম কৃষ্ণকলি হলেও  রবীন্দ্রনাথের সেই কৃষ্ণকলি আমি নই কিন্তু। আমি হয়তো জীবনানন্দের সুদর্শনা কিংবা বনলতা সেনে'র মতো অনিন্দ্যসুন্দরী! 

 

কে আমার নাম  রেখেছিল কৃষ্ণকলি তা ভেবে পাই না। মনে হয়, শোভনার নাম রেখেছিলেন তার নিজের মা। তিনি নিজে সুদর্শনা তাই নিজের মেয়ের নাম শোভনা না রেখে পারেননি। সত্যিই শোভনা রূপবতী, তাই বলে আমিও কিন্তু শোভনা চেয়ে রূপেগুণে কম যাই না। আমি মাঝেমাঝে ভাবি,শুধুমাত্র নাম শুনেই কি ভ্রমর শোভনার কানের কাছে গুনগুন করে। অন্যদিকে, আমি কৃষ্ণকলি, আমার নাম শুনেই ভ্রমর ভুলেও আমার পানে দৃষ্টিপাত করে না। এ জন্যে আমার কোন অভিযোগ নেই। শোভনা যে আমাকে অন্তরঙ্গ ভাবে কাছে টানে তাতে আমার বড়ই ভাল লাগে। 

 

মোবাইল ফোনটা বাড়িতে রেখে শোভনা পুকুর ঘাটে! আমি ওর মায়ের কথা শুনেই আমার মনটা আনচান করে ওঠে,তাহলে তো নীলাঞ্জন বাড়িতে এসেছে! শোভনা কলেজে আসলেই আমাকে টানতে টানতে দোতলা কলেজ বিল্ডিংয়ের নির্জন ছাদে টেনে নিয়ে গিয়ে চিলেকোঠার উঠার রেলিং এ হেলান দিয়ে পুকুরঘাটে বেড়াতে যাবার কারণ সে নিজ মুখেই গড় গড় করে বলে যাবে। 

 

আমি জানি, মনের কথা আমাকে খুলে না বললে  শোভনার পেটের ভাত হজম হয় না। শোভনার  ছোট ভাই পিকলু সবে হাইস্কুলের নিচে ক্লাসে পড়ছে। শোভনা সব কথাই আমাকে অকপটে বলে, ভাইয়ের সাথে তার খুনশুটি,মায়ের বকুনি, বাবার প্রবাসজীবন, নারকোল গাছের কোটরে টিয়ে পাখির বাচ্চা ফেটানোর  গল্প থেকে বাড়ির আঙ্গিনার কৃষ্ণচূড়া গাছটা লাল রঙে রাঙিয়ে ওঠা, বাড়ির ছাদে টপে গোলাপ ফুল ফোটানোর গল্প, আর পুকুরে বড়শি ফেলে কৈ মাছ ধরার গল্প , পিকলু’র ঘুড়ি উড়ানোর আনন্দ উল্লাসের গল্প বলে শোভনা সাজিয়ে গুছিয়ে আমাকে। ‘আমার ছোট ভাইটা খুবই ছোট্ট, তার কথা তাকে আর কী বলব!’ শোভনা তার ভাই সম্পর্কে বলে থাকে।

 

অন্যদিকে, আমি ওর মতো রাজ্যের গল্প বলতে পারি না। আমি নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করলেও ওর সব গল্পই শুনতে হয়,যেহেতু ওর গল্প বলার টঙ আমাকে মুগ্ধ করে। কথা বলার সময় ওর দুধে আলতায় রঙে ফর্সা গালে টোল পড়ে। আমি দিদিমা কাছ থেকে শুনেছিলাম, কথা বলার সময় যে সব মেয়ের গালে টোল পড়ে তারা স্বামী সোহাগিনী হয়। দিদিমা স্বামী সোহাগিনী হয়েছিল কিনা আমি জানি না। তবে পাশের বাড়ির আশি বছর বয়সী বুড়িদি বলত,' আমার গালে টোল না পড়লেও তোদের বুড়ো দাদু কিন্তু আমাকে প্রাণ ভরে ভালবাসত। একদিন আমি শোভনাকে এই গল্পটা বলেছিলাম। আমার কথা শুনে শোভনার গোলাপী গাল আরো গোলাপী হয়ে উঠেছিল। আমি তার মুখের জাদুকরী হাসি লক্ষ করে নীলাঞ্জন নামের ছেলেটির সুন্দর মুখ আমার মানস পটে ভেসে উঠেছিল। 

 

একদিন নীলাঞ্জন শোভনাকে মোটর সাইকেলের পেছনে বসিয়ে কলেজ গেটে নামিয়ে যেতে দেখেছিলাম। শোভনা এত কথা বলে কিন্তু এতদিন ওই ছেলেটি সম্বন্ধে সে মুখ ফসকেও একটি কথা আমাকে বলেনি। আমি আগ বাড়িয়ে ছেলেটি সম্বন্ধে কোন প্রকার উৎসুক্য দেখানি।ও যখন ছেলেটিকে আমার থেকে আড়াল করতে চায় তবে আমার কিসের মাথা ব্যথা! সেটা ছিল কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তির প্রথম দিকের কথা।

 

আমার কেন যেন মনে হয়েছিল স্কুললাইফ থেকেই শোভনার সঙ্গে ছেলেটির ভাব!তখন তো আমি শোভনাকে চিনতাম না,তাই সে সময়ের কথা আমার জানার কথা নয়। তবে সেটা অবশ্যই ছিল গ্রামের বাড়িতে পড়াশোনা কালের কথা। 

 

সেকেন্ড ইয়ারে উঠার কয়েক মাস পরে শোভনা ক’দিনের মধ্যে তার মায়ের মতো লম্বা চওড়া আর লাবণ্যময়ী হয়ে উঠায় আমি একটু অবাকই হলাম। আমি একদিন শোভনাকে প্রশ্ন করলাম,‘ তুই কি টনিক খাচ্ছিস্ ? ’                                                                                                        ‘ কেন তুই আমাকে এ প্রশ্ন করছিস্ কলি? ’                                             শোভনা আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল। ‘ তোর প্রশ্নের কারণ আমি বুঝতে পেরেছি।’ 

 

 

সেদিন পর পর দুটো ক্লাস অফ থাকায় আমরা আমাদের অভ্যাস মতো কলেজের মেইন বিল্ডিংয়ের ছাদে গিয়ে বসলাম। ভাদ্রমাস, শ'তিনেক গজ দূর দিয়ে কানায় কানায় ভরা মধুমতি নদী বয়ে চলেছে। আমিই প্রথমে কথা শুরু করলাম। শোভনা যৌবনবতী মধুমতি নদীর উদ্দাম জলরাশি দিকে তাকি কী যেন ভাবছিল! আমার দিকে শোভনার চোখ আর মন ফেরানোর জন্য ওকে বললাম,' ক'দিন ধরে তোকে কী যেন ভাবতে দেখছি,কারো প্রেমেটেমে পড়ে ----’   আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে শোভনা হেসে বলে উঠলো,‘ তোর প্রেমে মজে আছি,অন্যের কথা কী আমার ভাববার সময় আছে!' কেউ কোথায় নেই দেখে নিয়ে আমি আচমকা ওর গোলাপী গালে একটা চুমু দিতেই ও লাফ দিয়ে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরল। ও আমাকে জড়িয়ে ধরলে আমি বলে উঠলাম,' ছেড়েদে আমাকে, এ অবস্থায় আমাদের কেউ দেখতে পেলে কী ভাববে, তা ছেলে হোক মেয়ে হোক যেই দেখুক না কেন।’                                                                                                  শোভনা আমাকে তার দু'বাহু থেকে মুক্ত করলে আমি বুঝতে পারলাম, ও আমার চেয়ে স্বাস্থ্যবতী।‘তুই তোর বুক দিয়ে আর একটু আমার বুক চেপে ধরে থাকলে চিড়েচেপ্টা হয়ে যেতাম।’ আমি ওকে কপট রাগ দেখিয়ে কথাটা বললে ও বলে উঠল,‘ কচিখুকি আমার! তোকে কেউ এমন করে তা ছেলে হোক মেয়ে হোক  কি জড়িয়ে ধরেছে আগে কখনো?আমাকে এমন করে জড়িয়ে ধরত দেখি,তুই পারবি না, তা আমি জানি! সাহস লাগেরে, কলি।’ বলতে ভুলেই গেছি শোভনা আমাকে কলি বলে ডাকে।                                                                             ‘ আজ তোর কী হয়েছে রে শোভনা! তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ যৌবনবতী মধুমতি নদীর মতো উন্মত্ত হয়ে উঠছিস্ কেন?’ আমার কথার প্রতিবাদ করে শোভনা বলে উঠল,‘ ন্যাকা কোথাকার!তুই প্রথমে আমার গালে চুমু দিয়ে তাতিয়ে তুললি কেন?’ আমি ওর প্রশ্নের কোন জবাব দিতে না পারলেও আমি উপলব্ধি করলাম যৌবনবতী মধুমতি নদীর মতো আমরাও যৌবনবতী হয়ে উঠেছি।’ হঠাৎ শোভনা গেয়ে উঠে- ‘যৌবনী সরসী নীরে মিলন শতদল’ । ওকে শেষটুকু গাইতে না দিয়ে আমি গেয়ে উঠলাম-‘ কোন চঞ্চল বন্যায় টলোমল টলোমল।’ ওর গেয়ে উঠল,‘ শরম রক্তরাগে তার গোপন স্বপ্ন জাগে---’

 

কিন্তু দু'পিরিয়ড পেরোনো ঘন্টা পড়তেই আমাদের প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীতটা শেষ না করেই ওখান থেকে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নেমে ক্লাসে ঢুকে পড়লাম দু'জন একসঙ্গে।