গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০২১

গোপেশ দে

 


সমাধান

সন্ধের একটু পর  মাঠের মধ্যে চারজন লোক বসে আছে।

উত্তুরে হাওয়া শীতের জানান দিচ্ছে।লোকগুলো বসে এই সময় গল্প করে।একটা, দুটো বিড়ি ধরিয়ে ভাগ করে খায়।

নগেন বিড়িতে কয়েকটান দিয়ে নান্টুর দিকে বাড়িয়ে দিল, একটা গান চালা।

নান্টু বলল, কী গান?

ধুম ধারাক্কা টাইপের চালা।

নান্টু মোবাইলে একটা গান চালিয়ে দিল।তাদের চারজনের মধ্যে নান্টুরই মোবাইল আছে। গানও শোনা যায়।চিপ বসানো আছে মোবাইলে।

হেমন্ত, পাইকার উঠে দাঁড়িয়েছে।

হেমন্ত হাত বাড়িয়ে দিয়েছে নগেন আর নান্টুর দিকে।মানে ওদেরও উঠতে হবে।ওরা উঠল এবং নাচ শুরু করল।

চারজনেই এই মাঠটাতে গানের সাথে প্রায়ই নাচে।যেদিন মন খুব ভালো থাকে সেদিন ওরা নাচে।

মাঠের পাশে দুটো ল্যাম্পপোস্টের আলো

মাঠটাকে পুরোপুরি অন্ধকার হতে দেয় না।সেই আলোতে মাঠের মানুষদের রাস্তা থেকেও দেখা যায়।তবে পরিস্কার মুখ দেখা যায় না।তবে যারা এই রাস্তা দিয়ে তাদের নাচের সময় যায় অর্থাৎ যারা এই গ্রামেরই বাসিন্দা তারা ওদের দূর থেকেই চেনে।কেউ দু'চারবার তাকিয়ে নাচ দেখে।কেউ দূর থেকে তাদের নিয়ে হাসি তামাসাও করে।কেউ বলে পাগল, কেউ বলে ছাগল, কেউ ভদ্রভাষায় বলে অপদার্থ।বয়স্ক কেউ আবার গালিগালাজও তাদের পারে।ওই নাচের মধ্যে যে তারা কী পায় সেটাই কেউ বোঝে না।

তাদের বয়েস চল্লিশ ছুঁই ছুঁই।বিয়ে করেছে দু'জন।বাকী দু'জনের একজনের বউ চলে গেছে।বউটা অন্য একজনের সাথে বিয়ে বসেছে।ডিভোর্স দেওয়ার প্রয়োজন পড়েনি।আরেকজন বিয়েই করেনি।

এদের জগৎ সংসারে কোন নির্দিষ্ট কাজ নেই।পেটে বিদ্যে নেই কারুরই।শুধু নান্টু ছাড়া।নান্টু সেকেন্ড ডিভিশন মাধ্যমিকে।

নান্টু আগে সবজি বিক্রি করত একটা ভ্যান গাড়িতে।এখন সেটাও ঠিক মত করছে না।সপ্তাহে দু'চারদিন সবজি নিয়ে বের হয়।শৌখিন সবজি বিক্রেতা।

নান্টুর সংসার ঠিকমত চলে না।বাড়িতে অনেকগুলো পেট।ঘরে মা আছে, আধপাগলা বাবা, বউ, দুটো মেয়ে একটি ছেলে।ছেলেটা বড়।ছেলেটা এবার মাধ্যমিক দিয়েছে।টেনেটুনে পাশ।

নগেন চুরি ছ্যাঁচরোমো করে চলে।পাশের বাড়ির বউদের দিকে মাঝেমধ্যে জুলুজুলু করে তাকায়।তবে তাকানো পর্যন্তই।এর বেশী কিছু না।

নগেনের মা সামান্য কিছু পেনশন পায়।নগেনের বাবা রেলের হোমগার্ডে ছিল।তার বাবা মারা গেছে বছর দশেক হয়েছে।দুটো বোন আছে।দুজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে।কোনো ভাই নেই।

পেনসনের টাকায় দুজনেরই সংসার চলে যায় ভালোভাবে।সেই জন্য গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ায় সে।পড়াশুনায় সরেস।মাধ্যমিকে তিনবার ডাব্বা।এরপর আর জেনেশুনে কেই বা লেখাপড়া করে ? নগেন অবিবাহিত।আসলে পাড়ায় ওর যা বৈশিষ্ট্য তাতে কেই বা সম্বন্ধ আনবে ! আত্মীয় স্বজনের মধ্যে দু'চারজন এনেছিলেন বটে।তবে গাঁয়ের লোকের পেছন নিন্দায় কনেপক্ষ সটকে গেছে।মেয়ের পরিবারগুলো বেঁচেই গেছে বোধহয়।

নগেনের মা নগেনকে আগে অনেক গালিগালাজ করত।এখন কিছুই বলে না।তবে মায়ের কাছে টাকা চাইতে গেলে তখন তো কথা শুনতেই হবে।

নগেনের মায়ের প্রথম গালিটা শুরু হয় শুয়োর দিয়ে।শেষও হয় শুয়োর দিয়ে।তাই নগেনের পকেট মানির জন্য চুরি, ছ্যাচরামো করতেই হয়।না হলে চলবে কীভাবে? কাজ করে দু'পয়সা রোজগারের মুরদ তো আর নেই।

ধার বাকী চোদ্দ পনেরও টা দোকানে।মারও খায় দোকানীর হাতে মাঝেমধ্যে।

হেমন্তটা হাবাগোবা টাইপ।ছোটবেলা থেকেই বোকা।ছোটবেলায় কারণে অকারণে দাঁত বের করে হাসত।এখনও হাসে।

এর বউ চলে গেছে বিয়ের প্রথম বছরের মাথায়।বউ বুঝেছে, হাবাগোবা নিয়ে সংসার হয় না।তবে এখন একটু চালাক চতুর হয়েছে হেমন্ত।বাড়িতে মা, বাবা আছে।তিনভাই হেমন্তরা।সে মেঝ।ভাই বা দাদা কারো সাথেই সম্পর্ক নেই।তার দাদা আর ছোটভাই বিয়ে করে ব্যবসা বানিজ্য নিয়ে দিব্যি আছে।যার যার ভিন্ন সংসার।তবে দাদার সংসারে খাওয়া মিলে হেমন্তর।সেটা দু'বেলা।দুপুর আর রাত।সকালবেলা একপ্রকার না খেয়েই থাকে সে।খাওয়ার সময় প্রতিদিনই কথা শুনতে হয় তার।কখনও দাদা, কখনও বউদি, কখনও মা খোঁচা মেরে কথা শুনিয়ে দেয়।বাবা কিছু বলে না।

কথা শোনানোর সময় দাঁত বের করে হেসে হেমন্ত হাবাগোবা সাজ নেয়।অর্থাৎ তার এভাবেই দিন যাবে।তোমরা একটু দয়া করে তাকে খাবার দিও।তোমাদের খোঁচা কথায় হেমন্তর কিছুই যায় আসে না।

যার যার বাড়ির অংশের ভাগ তারা করে নিয়েছে।বাড়িটা পাঁচ কাঠার মত।হেমন্ত থাকে ছোট্ট একটা ছাপড়া ঘরে।তার বাবা তার সাথে ঘুমায় এখন।মা বাবার খাওয়া-দাওয়া দাদা আর ছোটভাইয়ের ঘরে।সেটা রুটিন করে।

পাইকারের বউ আছে।কোনো ছেলেপুলে নেই।বউ দু'বছর ধরে বাপের বাড়ি।আসবে কিনা তার ঠিক নেই।পাইকারও খুব আগ্রহ দেখায় না।সে অলস প্রকৃতির।সংসার চালানোর জন্য স্থায়ী কোন কাজ করেনি।অনেক রকম কাজ করেছে আবার ছেড়েছে।কোনটাই ঠিকমত জুত করতে পারেনি।বউ বাপের বাড়ি গেলে সহজে আসতে চায় না।বাবা মা কেউ বেঁচে নেই পাইকারের।সে বর্তমানে একা বাড়িতে থাকে।

 

হিন্দী গানের সঙ্গে নেচেই চলেছে তারা।নাচ দেখলে যে কারুরই হাসি পাবে।নাচ বলতে শুধু হাত পা ছোঁড়াছুড়ি।বাইরের কেউ এভাবে নাচতে দেখলে ভাববে পাগল ছাড়া কেউ নয় এরা।পোশাকও যাচ্ছেতাই রকমের।সব সময় তারা লুঙ্গি পরে থাকে।গরমের দিনে সবাই খালিগায় থাকে বড় জোর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে।শীতের দিনে পরনে থাকে বহু পুরোনো সোয়েটার বা চাদর।

এই সময়টায় ওরা নাচানাচি করে বড় আনন্দ পায়।তারপর ক্লান্ত হয়ে মাঠে গড়াগড়ি খায়।গা দিয়ে ঘাম ছুটে সবার।তারপর বাড়ি গিয়ে দুটো খেয়েই ঘুম।অনেক সমস্যার মধ্যেও দুশ্চিন্তাহীন জীবন।অবশ্য দুশ্চিন্তা থাকলে কাজকর্ম ফেলে কেউ এভাবে আধবুড়ো বয়েসে নাচতে পারে না।

এখন ক্লান্ত হয়ে চারজনই মাঠে শুয়ে আছে।বড় বড় শ্বাস ফেলছে সবাই।

বুকের ওপর হাত রেখে নগেন বলে, কতদিন মাল খাই না বলত ?

কে খাওয়াবে? পাইকার জিজ্ঞেস করে।

আজ হেমু খাওয়াবে, নান্টু বলে।

আসলে হেমন্ত আজ অব্দি ওদের মদ খাওয়াইনি।সবাই মোটামুটি ধার, দেনা, চুরি ছ্যাচরামো করে খাওয়ালেও খাইয়েছে কিন্তু হেমন্ত খাওয়ায় নি।

আমার কাছে টাকা নেই। হে হে হে।হেমন্ত হেসে বলে।

নগেন ধমক দিয়ে উঠে, ওসব আঁতেল মার্কা কথা ছাড়।কিভাবে খাওয়াবি ভাব ?

হেমন্ত দাঁত বের করে তবুও হাসে অর্থাৎ সে খাওয়াবে না।

পাইকার বেজায় ধমক দিয়ে বলে, এই হাসছিস কেন ছাগল, বাঞ্চোত, চোদনা কোথাকার ! না খাওয়ালে তোকে ন্যাংটো করে বাড়ি পাঠাব।

ন্যাংটো হওয়া দোষের কী? হেমন্ত হাসে।

বলে কি ছাগলে ? পাইকার বলে।

নান্টুর সত্যি রাগ চরে গেল।পাইকারের বদলে সে উঠে গিয়ে একটানে লুঙ্গি খুলে ফেলল হেমন্তর।

হেমন্ত উদোম হয়ে শুয়ে আছে।ভাবখানা এমন, বন্ধুদের কাছে লজ্জা কী? 

ঠিক সেই সময় মাঠের মধ্যে চলে আসেন প্রমথেশ।প্রমথেশ বেশ বয়েসী লোক।ষাটের ওপর বয়েস।একটা ছোটখাট ভুরি আছে।ধুতি পরেন কোঁচা মেরে।বেশ অর্থকড়িও আছে।মুখে সবসময় সবজান্তা ভাব।গল্পের আড্ডায় যে কোনো বিষয়ে উনি নাক গলাবেন।কখনও বলবেন না এটা জানি না, আজ জানলাম।সব কিছুই জেনে বসে আছেন।লোকজন অবশ্য তাকে জ্ঞানীই ভাবে।আড্ডাও হয় তবে মুখ্যসুখ্য মানুষদের সাথেই কিনা।তাছাড়া তিনি মেট্রিক পাশ সত্তরের দশকের।তবে লোকটার চেহারায় একটা বিষণ্ণ ভাব আছে।কিন্তু নান্টুদের সামনা সামনি হলে উনি বেশ রাগী গলায় কথা বলেন।এমনিতে লোকটা নিরীহ।এলাকার লোক পেছনে ওঁকে নিয়ে কটুক্তি করে।

প্রমথেশ হেমন্তর দিকে তাকাতেই লজ্জা পেয়ে গেলেন।

নান্টুর দিকে তাকিয়ে বললেন, এই সব কী হচ্ছে অ্যাঁ।চাবকে পিঠের চামড়া তুলে দেব।ছি! ছি! ছি! এই হেমু, তোর লজ্জা করে না উদোম হতে।পাগলের বংশ কোথাকার ! 

হেমন্ত হি হি করে হেসে বলে, এখানে কি মেয়েছেলে আছে যে লজ্জা করবে ! লজ্জা মেয়েছেলের।ব্যাটাছেলের আবার লজ্জা কী।

শুয়োর কোথাকার।এই নান্টু তুই ওর লুঙ্গি খুললি কেন ?

নান্টুর বেজায় নেশা চেপেছে।তার মদ এখন চাইই চাই।তাই সে একটা বদবুদ্ধি খাটাল।উপস্থিত বুদ্ধিতে নান্টু খুব পাকা।

নান্টু উলটো প্যাঁচ দিল প্রমথেশকে, আপনি তো আচ্ছা লোক মশাই।আমরা যা করি না করি আপনি এখানে এলেন কেন ? আর এসেছেন ভালো কথা।হেমন্তকে উদোম করলেন কেন ? আপনার লজ্জা নেই ! ছি ছি ছি!

যেন তাঁর কথাটাই তাঁকে ফিরিয়ে দিল।

প্রমথেশ ধমক দিয়ে উঠলেন, আমি এখানে আসতেই পারি।এটা কি তোদের জায়গা ? আর আমি লুঙ্গি খুলেছি হারামজাদারা ?

নগেন হেসে বলল, এটা কি আপনার জায়গা ? এখানে আমরা উদোম হতেই পারি।পেচ্ছাপ করতে পারি, হাগব, মুতব যা খুশি করব।আপনি বলার কে ?

আমি এই এলাকার একজন গন্যমান্য লোক।সবাই আমার দাম দেয়।আমার আলাদা একটা প্রেস্টিজ আছে।এই হেমুকে লুঙ্গি দে নান্টু।এসব আমি বরদাস্ত করব না কিন্তু।

নান্টু বেশ গম্ভীর স্বরে বলল, আপনার বাড়িতে গিয়ে জানাতে হবে।আপনি হেমন্তকে উদোম হতে বলেছেন।বলেছেন উদোম হলে একশ টাকা পাবি।তখন দেখব আপনার প্রেস্টিজ যায় কোথায়!

প্রমথেশ মিইয়ে গেল খানিকটা।গলার স্বর পালটে বললেন, কী যা তা বলছিস ?

ঠিকই বলেছি।আমরা সবাই সাক্ষী দেব।আপনার স্ত্রী, ছেলে, বউমা জানুক আপনি কতটা অসভ্য।

প্রমথেশ মনে মনে বললেন, এই সেরেছে।কাদের পাল্লায় পড়লাম গো।

ঠিক আছে তোরা যা খুশি কর।আমি বাড়ি গেলাম।

যাচ্ছেন কোথায় কাকু? আপনি বাড়ি গেলে কিন্তু খবরটা পৌঁছে যাবে।

তোরা সত্যি করে বলত আমাকে মিথ্যে ফাঁসানোর মতলবটা কী ?

নান্টু ফাজিলমার্কা হাসি দিয়ে বলে, একশ টাকা দিন না কাকু?

নান্টু প্রমথেশের দিকে হাত পেতে আছে।

প্রমথেশ একশ টাকার একটা নোট নান্টুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে গজগজ করে চলে যেতে লাগল।মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, এদের সামনে আর না।যা খুশি করুক।শুধু শুধু অর্থদন্ড।

এই যে প্রমথেশ মিথ্যে ফাঁকা বুলিতে ভয় পেল।এর পেছনে একটা কাহিনি আছে।

প্রমথেশের বাড়িতে অনেক বছর আগে একটা কাজের মেয়ে ছিল।মেয়েটার নাম বুল্টি।তাঁর বাড়িতেই থাকত।বুল্টির আসলে দেখার মত কেউ ছিল না।বুল্টি ছিল তাঁর বউয়ের বাপের বাড়ির এলাকার।তিনকূলে কেউই ছিল না মেয়েটার।প্রমথেশের তখন সদ্য বিবাহিত জীবন।

একদিন বুল্টি স্নান করছিল একপ্রকার উদোম হয়েই।স্নান ঘরটা ছাপড়া মত, হোগলাপাতার বেড়া।বাইরে থেকে ভিতরে কিছুই দেখা যায় না।কিন্তু ছাপড়ার একপাশের হোগলাপাতা ম্যারম্যারে হয়ে ভেঙে পড়েছিল খানিকটা।সেখান থেকে কেউ চোখ পাতলে ভিতরের কিছুটা দেখা যায়।পেছন দিকটা একটু জঙ্গলের মত।সেদিকটায় কোনো বাড়ি ঘরও নেই।আর কেউ যায়ও না।

প্রমথেশ আপন খেয়ালে সেখানে গিয়েছিলেন।সেখানে হোগলাপাতার ভাঙা অংশটার গায়ে একটা জল ঢোরা সাপ দেখতে পাচ্ছিলেন।সাপটা এদিক ওদিক চাইছিল।তিনি সাপে ভয় খুব একটা ভয় পান না।তবে হঠাৎ দেখায় একটু ভয় পেয়েছিলেন অবশ্য।তবে হাত পা ঠান্ডা হবার মত ভয় নয়।সাপটা জিভ বের করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল।তিনি ভাবলেন, ওখানে সাপে কোনো ডেরা করেছে কিনা কে জানে।সেটা অনুসন্ধানের জন্য তিনি সেখানে গিয়ে দাঁড়ালেন।তিনি তো আর জানেন না মেয়েটা স্নান করছে।চোখ পড়েছিল তাঁর বুল্টির ওপর।বুল্টিরও চোখ পড়েছিল তাঁর ওপর।মানে দুজনেরই একই সাথে চোখ পড়া।বুল্টি কোনোক্রমে শাড়িটাকে পেঁচিয়ে চেচিয়ে উঠল।রান্নাঘরেই ছিলেন তাঁর স্ত্রী।তিনিও এলেন এবং প্রমথেশকে দেখলেন।প্রমথেশ কোনোভাবেই বোঝাতে পারেন নি তাঁর বউকে যে তিনি মেয়েটিকে দেখার উদ্দেশ্যে যাননি। তিনি যানতেনও না বুল্টি স্নান করছিল তখন।তিনি গিয়েছিলেন সাপ দেখার উদ্দেশ্যে।

বউ তাঁকে বলেছিলেন, চোরেরা ওরমই বলে।

এই ঘটনা নিয়ে বসল সালিশ।

বুল্টিই বিচার সালিশ বসালো।তাঁর বউ সাক্ষীও দিলেন।কারণ বউ ভেবেই নিয়েছিলেন, প্রমথেশ ইচ্ছে করেই সেখানে গেছেন এবং তিনি চরিত্রহীন।

সেই বিচারে বুল্টির জিৎ হল।কারণ প্রমথেশের সাপ দেখার গল্পটা সালিশের লোকদের কাছে নিছকই বানানো মনে হয়েছিল।কারণ সাপ দেখলে সবাই হিম হয়ে যায়।চিৎকার দিয়ে ওঠে।কিংবা সেখান থেকে কেটে পড়ে।কিন্তু প্রমথেশ তো তা করেননি।তিনি করেছিলেন এক্সপেরিমেন্ট।সেই এক্সপেরিমেন্টের মর্মটা বুঝবে কে ?

সেই সালিশে প্রমথেশের শাস্তি স্বরূপ বুল্টির দাবি ছিল এরকম।তাকে বিয়ে দেয়ার দায়িত্ব প্রমথেশের।বিয়েতে পাত্রপক্ষ যা চাইবে সেটাও দিতে হবে।পাত্র পছন্দ করবে বুল্টিই।অর্থাৎ তার পাত্র পছন্দ হলে পাত্রপক্ষর সঙ্গে দেনাপাওনা যা হবে সেটা প্রমথেশকে দিতে হবে।বিয়ের পুরো দায়িত্বটাই তাঁর।

তিনি কথা রক্ষা করেছিলেন।না করে উপায়ও ছিল না।বুল্টির বিয়ে নিজের টাকাতেই দিলেন।

বুল্টির বিয়ের পর তাঁর বউ বলেছিলেন, পাপের প্রায়শ্চিত্ত হল তোমার।

এখনো বউকে তিনি সেদিনের ঘটনা বিশ্বাস করাতে পারেননি।এমনকি বউটা এখনও তাঁকে কথা শোনান।সেই পুরোনো কাসন্দি ঘেঁটে আনেন কথায় কথায়।মাঝেমধ্যে এতজোরে সেই সব কাহিনি বলেন যে, প্রমথেশের ছেলে বউও সেটা এখন জানে।এবং বউমা তাঁকে ভাল চোখে দেখে না।ছেলেটাও না।প্রমথেশের একটা মেয়ে আছে সেও না।প্রমথেশ একা এবং অসহায়ের মত নিজের বাড়িতেই থাকেন।এই তাঁর দুঃখ।

প্রমথেশ বাড়িতে একেবারে মেনিমুখো হয়ে থাকেন।অথচ তাঁর সেদিন যে সত্যি কোনো দোষ ছিল না।সেটা কেইবা বুঝবে ? প্রমথেশের এই অতীত কাহিনি গ্রামের সবাই কমবেশী জানে।নান্টুরাও জানে।তাইতো নান্টু ঠিক তাঁর দূর্বল জায়গায় আঘাত হেনে একশ টাকা কবজা করল।সেদিনের সেই ঘটনা এখনো মনে এলে বড় কষ্ট হয় তাঁর।বউকে ভীষণ ভয় পান তিনি।এমনিতে রাস্তাঘাটে ছেলে ছোকরার সাথে মাঝেমধ্যেই ধমক দিয়ে কথা বলেন বটে কিন্তু বাড়িতে তিনি একেবারেই অসহায়।

নান্টু যদি সত্যি তাঁর বউকে বানিয়ে বানিয়ে বলে দেয় তবেই সেরেছে।তিনি হয়ে যাবেন একেবারেই অসহায়।তারচেয়ে একশ টাকা গচ্চাই ভাল।

প্রমথেশ সেই ঘটনার পর থেকে খানিকটা বিরাগী।তখন থেকেই প্রচুর বই পড়া শুরু করলেন।বই পড়ে অনেক জ্ঞান অর্জন হয়েছেও বটে।সেগুলো গ্রামের বয়স্ক মানুষের সাথে আড্ডায় বড্ড উপকার হয়।মানুষজন সেই থেকে একটু সমীহ করে।কিন্তু সেই অতীতের মিথ্যে কলংককে মুছতে পারেন না।একটা কথা আছে যার টাকা যায় তার কিছুই যায় না।যার চরিত্র যায় তার সবটাই যায়।

কিন্তু তাঁর তো চরিত্র খারাপ না।কিন্তু নিজের বউই তো সেটা মানেননি।বাইরের লোক আর কী মানবে।

 

আচ্ছা এই লোকগুলো দিয়ে সত্যিটা বের করানো যায় না কি? তাঁর বউ জানুক, তিনি মোটেই সেদিন ইচ্ছে করে যাননি স্নানঘরের কাছে।জানুক তিনি চরিত্রবান।

বুল্টির পাশের গ্রামেই বিয়ে হয়েছে।এখন তো একপ্রকার বুড়ি হয়ে গেছে।

তিনি পরপর দু'বার গিয়েছিলেন বুল্টির বাড়িতে। সেটা বছর পাঁচেক আগে।

প্রথম দিন মেয়েটিকে বলেছিলেন, দ্যাখ।তুই তো আমার বোনের মতই।আমার মনে কোনো রাগ নেই।তোর বিয়েতে যা খরচা করার তা আমি করেওছি।তুই সত্যিটা বলল না বোন ?তোকে নিজের বোনের নজরেই দেখি।

আমি কী করে বুঝব আপনি সত্যি বলেছেন?

তাও ঠিক।আচ্ছা আমাকে আগে কখনো স্নান ঘরের আশেপাশে দেখেছিলিস বল।

তুমি লুকিয়ে দেখলে আমি জানব কী করে?

প্রমথেশ বেশ কোমল গলায় বললেন, তাও ঠিক।আচ্ছা আমি তোকে কখনও বাজে নজরে দেখেছি?

না সেটা দ্যাখোনি।

তবে?

বুল্টি এখন কিছুটা বোঝে, প্রমথেশ লোক ভালো।ইচ্ছে করে যাননি তিনি।সেখানে যাওয়াটা ছিল অপ্রত্যাশিত।কিন্তু এতদিন বাদে এই প্রসঙ্গ কেন? এটা ভেবেই বুল্টি জিজ্ঞেস করল, এদ্দিন বাদে এই প্রসঙ্গ?

আমার বউ মানে তোর দিদিতো আমাকে সেই ঘটনার পর থেকে ভালো চোখে দেখে না।ছেলে বউমাও দেখে না।তুই একটু বললে এই বুড়ো বয়েসে বউয়ের কাছে একটু দাম পেতাম।চরিত্রহীন বোঝাটা ঘাড় থেকে নামত।অনেক লাঞ্চনা গঞ্জনার ভিতর দিয়ে যাচ্ছি আমি।

বুল্টি বলল, পাঁচশ টাকা দিন।একদিন গিয়ে বলব।

তিনি পাঁচশ টাকা দিয়েও ছিলেন।

কিন্তু বুল্টি যায়নি।

অগত্যা তিনি আবার আরেকদিন গেলেন।বুল্টি আবার টাকা চাইল।তিনি দিলেনও দোনামনা করে আরেকবার।

 

বুল্টি এরপর গিয়েছিল ঠিকই প্রমথেশের বউয়ের কাছে।কিন্তু তা না বলে বলেছিল, আপনার স্বামী আমার কাছে নিত্যি নিত্যি আসে কেন ?

ব্যাস! এরপরে আর কী হতে পারে !

যাওয়া নিয়ে উস্তুম কুস্তুম ঝামেলা হল প্রমথেশের তাঁর বউয়ের সাথে।বউ ভেবেছিলেন গোপনে বুঝি প্রেমের টানে গেছেন।

প্রমথেশের বউ বাপের বাড়ি চলে গেলেন।অনেক কষ্টে সৃষ্টে তাঁকে নিয়ে এলেন সেখান থেকে।বউকে নিয়ে তার ভারী দুঃখ।নিজের মানুষটাকে এখনও চিনলেন না।ভারী দুঃখ প্রমথেশের।

 

প্রমথেশ মাঠের কাছে এসে দেখলেন, হারামজাদাগুলো সেখানে নেই।তিনি জানেন ওরা কোথায় আছে।টাকা পেয়ে মদের ঠেকে গেছে।এখান থেকে বেশ কিছুটা দূরেই একটা জঙ্গলঘেরা বাড়িতে মদের ঠেক আছে।দেশী মদ।সেখানে গেছে নিশ্চিত।একশ টাকায় দেশী ছাড়া আর কীই বা হবে। 

প্রমথেশের এই ঠেকের কাছে আসতেও বড্ড সংকোচ হচ্ছিল।তাঁর বউ জানতে পারলে রক্ষে নেই।গ্রামে নিন্দুকের অভাব নেই।বউয়ের কানে দেয়ার লোক অনেকই আছে বৈকি।তবুও তিনি গেলেন সেখানটায়।তবে ভিতরে ঢুকলেন না।

বাইরে দাঁড়িয়ে ফাঁকা আওয়াজ ছাড়লেন, নান্টু আছিস ? নগেন...

ওরা সবাই বেরিয়ে এল।সবার চোখ লাল।এবং নেশাচ্ছন্ন।তবে জ্ঞানের নাড়ি টনটনে।অর্থাৎ বোধগম্য জ্ঞান আছে।

সবাই প্রায় একসাথেই বলল, প্রমথেশ কাকু।

কিছু কথা আছে তোদের সাথে।তোদেরই লাভ।

বল কাকু।

এখানে না।ওই ফাঁকা জায়গাটায় চল।

ওরা সবাই নিজেদের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।তারপর নগেন বলল, কী লাভ হবে ?

তিনি বেশ আস্তে আস্তে বললেন, কাজটা যদি করে দিতে পারিস তবে এক হাজার টাকা পাবি।

ওদের সবার চোখ চকচক করে উঠল।পাইকার বলল, মানে চারজনে দুশ পঞ্চাশ করে।

নান্টুর একটু ঘাড় ব্যাঁকা। সে বলল, কাজ কঠিন হলে বেশী লাগবে।

প্রমথেশ বললেন, ঠিক আছে আগে কাজটা মনোযোগে শোন তোরা।

বলুন।

এখানে না ওই জঙ্গলটার কাছে চল।

 

প্রমথেশ সবটাই খুলে বললেন ওদের।বুল্টির ঠিকানা দিয়ে বললেন, পারবি তো ?

নান্টু বলল, কাজটা কঠিন না।তবে টাকা একটু বেশী লাগবে।

প্রমথেশ ধমক দিয়ে উঠলেন, কত?

দুহাজার।

ঠিক আছে পাবি।তা ঠিকমত পারবি তো।

নগেন মাতাল গলায় মুখ খুলল, অবশ্যই পারব কাকু।এ আর এমন কী ?

প্রমথেশ বললেন, মেয়েটা কিন্তু ত্যাদড় আছে।অনেক বাহানা।সহজে সত্যিটা বলবে না।

নগেন মিচকে হাসি দিয়ে বলল, ওসব মেয়েকে টাইট দেয়া আমাদের কাছে নস্যি।হয়ে যাবে কাকু।

তাহলেই কালকে নেমে পর অপারেশনে।

হেমন্ত বলল, কার অপারেশন ? হে  হে হে...

প্রমথেশ বিরক্ত হলেন, এই এটাকে নিস না।

নান্টু বলল, ও নিয়ে আপনি ভাববে না।এই ছাগল কোনো বেফাঁস কথা বলবে না।তারপর হেমন্তর দিকে তাকিয়ে বলল, এই হেমু, যদি উল্টোপাল্টা বলিস।টাকা কিন্তু পাবি না।লুঙ্গি আবার খুলব কিন্তু।

প্রমথেশ চলে যাচ্ছিলেন।

পাইকার ডাকল, কাকু এডভান্স ?

কাজের পর দিলে অসুবিধা আছে?

নান্টু কিছুক্ষণ ভেবে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে।তাই দিন।

আসলে ওরাও মনে মনে খুশি।একটা কাজ হাতে পেল।রোমাঞ্চকর একটা কাজ।

 

সুযোগ বুঝে ওরা চারজন বুল্টির বাড়িতে ঢুকল দুপুরের দিকে।এখন আর রীতিমত বুল্টি মেয়ে নয় মহিলা এবং পয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশের মহিলা।বাড়িতে একাই ছিল সে।স্বামী এই সময় বাড়িতে থাকে না।

ওরাও সেই সুযোগ নিয়েই ওত পেতে ছিল বাড়ির আশেপাশে।

বুল্টি ওদের চেনে না।তাই এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, কাউকে খুঁজছেন ?

একটু কথা ছিল।বারান্দায় বসতে পারি ? ভয় নেই ঘরে বসব না।

বুল্টির তেজী গলায় জিজ্ঞেস করল, কেন ? বারান্দায় কেন ?

নান্টু বলল, আপনার স্বামীর ব্যাপারে...

আমার স্বামীর ব্যাপারে কী?

আপনার স্বামীর আমরা বন্ধু।উনি কিছু টাকা পেতেন আমাদের কাছে।

কত ?

পঞ্চাশ হাজার।

পঞ্চাশ হাজার ! কী বলেন এইসব।আমার স্বামীতো এসব কিছুই বলেনি।

সব কথা কি আর মনে থাকে।ব্যবসায়ী মানুষ নানান তালে থাকে।তাই বলছিলাম টাকাটা এখানে দেখা ঠিক না।কেউ দেখে ফেলবে।

বুল্টি চিন্তিত গলায় বলল, আপনাদের কেমন বিশ্বাস হচ্ছে না।

নগেন বলল, আমাদের কি আপনাদের খারাপ মানুষ বলে মনে হয়?

সেটা কিভাবে বলি ?

আচ্ছা আপনার ঘরে তো বসতে চাইছি না।বারান্দায়ই তো।খোলা বারান্দা তার ওপর।

বুল্টি দোনামোনা করে বলল, ঠিক আছে আসুন।

নান্টুরা বসল একটা তেল চিটচিটে কাথা দেয়া খাটে।

নান্টু খুব মিষ্টি সুরে বলল, আপনি বসুন না?

বুল্টি একটা চেয়ার টেনে বসল।

পাইকার এবার পকেটে হাত দিল।ভাবখানা এমন টাকা বের করবে কিন্তু বের করল একটা খেলনা পিস্তল।অবিকল সত্যি পিস্তলের মত দেখতে।পিস্তলটা বের করে ঠিক ওনার সামনে গিয়ে দাড়াল পাইকার।

বুল্টি বেশ ভয় পেয়ে গেল, আপনারা কারা? ডাকাত...

চুপ ! গুলি করে দেব কিন্তু, পাইকার ধমক দিয়ে উঠল।

বুল্টি চুপ হয়ে গেল।

পাইকার বলল, ঘরে চলুন।কথা আছে।

বুল্টি ঘরে ঢুকল কলের পুতুলের মত।

এবার বুল্টিকে খাটে বসতে বলল তারা।সে ভয়ে ভয়ে খাটে বসল।সে বুঝতে পারছে না এসব কী হতে চলেছে।

বুল্টি কান্না করে বলে উঠল, আপনারা কী চান ?

হেমন্ত বলল, কিছু চাই না।হে হে হে...

নান্টু ধমক দিয়ে উঠল হেমন্তকে, এই ছাগল, চুপ।গুলি করে দেব কিন্তু।

নান্টু এনার বুল্টির দিকে তাকিয়ে বলল, ম্যাডাম ভয় নেই।আমরা আপনার সাথে একটা ডিল করতে এসেছি।

বুঝলাম না ঠিক।

প্রমথেশ কাকুকে তো আপনারা চেনেন।

হুম।

সত্যি কি কাকু আপনার সাথে অসভ্যতামী করেছিল কোনোদিন?

এতদিন পর এই কথা?

যা বলছি উত্তর দিন।মিথ্যে বলবেন না কিন্তু।

না।তবে বেড়ার ফাঁক দিয়ে...

নান্টু বলল, আচ্ছা আপনার কী মনে হয় উনি ইচ্ছে করেই ওসব করেছিল।

জানি না।

উনি এরপর আর কোনো অসভ্যতামী করেছেন?

না।

ধরুন উনি ইচ্ছে করেই করেছেন।কিন্তু মানুষের বদ স্বভাব কিন্তু সহজে যায় না।সেটা তো জানেন?

জানি।

তাহলে উনি যদি ইচ্ছে করেই করবেন তাহলে এরপরে আর খারাপ নজর দেয়নি কেন আপনাকে বা অন্য কোনো মেয়েকে?

বুল্টি চুপ।

উনি ইচ্ছে করে করেননি।সেটা আপনিও জানতেন।এগুলো হয় ভুল বশত।হতেই পারে।কিন্তু আপনি ইনিয়ে বিনিয়ে বিচার সালিশে ওনাকে বড্ড হেনস্তা করেছিলেন।উনি তবুও আপনার কথা রেখেছিলেন।আপনার বিয়ের ভার নিয়েছিলেন।

হ্যাঁ।লোকটা খুব ভালো।

এখন ভালো? তাহলে উনি আপনার কাছে যখন এসেছিলেন ব্যাপারটা সমাধান করতে আপনি পরপর দুবার টাকা নিয়ে ওঁঁর বউকে সমাধান তো দূরের কথা উল্টোপাল্টা বলেছিলেন কেন ?

বুল্টি কাঁদছে।

কাঁদবেন না।ওই অসহায় লোকটিকে নিয়ে ওরকম করাটা আপনার কি ঠিক হয়েছে ?

ক্ষমা চাইছি।

আহা ক্ষমা এখানে চেয়ে কী হবে।ক্ষমার প্রসঙ্গ ছাড়ুন।বলছি কাকু এখানে এসে আপনাকে বোন বলেও ডেকেছিলেন।তখন কি ওঁকে দাদা ভাবতে পারেননি একবারের জন্যও।আপনাকে নিজের বোনের নজরেই দেখেন সেটা বোঝেন?

হ্যাঁ।বুঝি।

তাহলে ওঁর সাথে ওরকম করছেন কেন ?

আমি আসলে মজা করেছি।

এই আধবুড়ো বয়েসে মজা।হে হে হে।

এবারের হাসিটা নান্টুর।নান্টু একাই কথা বলছে বুল্টির সাথে।

নান্টু হাসতে হাসতে ওদের দিকে একবার তাকাল।পাইকার রোবটের মত পিস্তল তাক করে আছে।নগেন আর হেমন্ত গুঁজগুঁজ করে হাবিজাবি গল্প করছে।অর্থাৎ হেমন্ত যাতে বোকার মত কথা না বলে তাই নগেনের গল্পে মনোযোগ দেয়া।

এখন আমার কী করতে হবে ?

শুনুন ম্যাডাম আপনি প্রমথেশ কাকুর বাড়িতে যাবেন এবং বলবেন সেদিন সত্যি উনি অসভ্যতামী করার জন্য যাননি।উনি সাপ দেখতেই গিয়েছিলেন।সাপটা আপনিও দেখেছেন।

আমিতো সাপ দেখিনি।

আহা দেখেননি।এখন বলবেন দেখেছেন।উনি আপনাকে কিন্তু নিজের বোনের নজরেই দেখেন।কী পারবেন না ?

পারব।কিন্তু এবার তো আমি খারাপ হয়ে যাব ওদের কাছে।

আপনি খারাপ হলে কীই বা হবে।আপনি তো আর সংসার করতে যাচ্ছেন না সেখানে।এখানেই থাকবেন।আর তাছাড়া কাকু এতদিন খারাপ ছিলেন বউয়ের কাছে এবার না হয় আপনি হলেন।

তবুও...

ভেবে দেখুন আপনি খারাপ হলে কিছুই এসে যাবে না কিন্তু কাকু তো একটু ভালো থাকলেন বউটার কাছে।বুড়ো মানুষ।

ঠিক আছে পারব।

নান্টু মহিলাটির আঁচলটা ধরে একটু জড়িয়ে ধরার ভঙ্গি করল।

নগেন সেকেন্ডের মধ্যে একটা ছবি তুলে ফেলল মোবাইলে।নগেন মোবাইল নিয়ে রেডী হয়েই ছিল।প্ল্যানমাফিক কাজ।

বুল্টি বেশ ভয় পেয়ে গেল, আরে আরে এসব কী? কী করছেন এসব? বাড়িতে একা আছি সেই সুযোগে অসভ্যতামি।আপনাদের ভদ্র ভাবতাম...

নান্টু বলল, মোবাইলে ছবি তুলে রাখলাম।যদি না বলেন তবে এই ছবিটা আপনার স্বামীকে আর আপনার বিবাহিত মেয়েকে দেখাব।স্বামীর ঘর আর করতে হবে না।

বুল্টি কথা বলার কোনো ভাষা খুঁজে পেল না।বেশ ভয়ে ভয়ে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, আমি বলব।

ঠিক আছে।ভয় নেই ছবিটা দেখাব না।ডিলেট করে দেব।তবে কাজের পর।আপনি কাকুকে ভালো মানুষ বানাবেন ওঁর স্ত্রীর কাছে।ওঁর স্ত্রী একটা গবেট।গবেট না হলে সামান্য ভুলবশত কাকুর চাউনিটাকে কেউ এত বড় করে দেখে !

এবার পাইকার বলল, সেই সুযোগটা আপনি নিয়ে কাকুর মাথা ভেঙে বিয়ে করলেন।সেও না হয় ঠিক আছে।তবুও নিজেকে শোধরাতে পারতেন।

নান্টু বলল, আজই বিকেলে যাবেন।চলি।

পাইকার বুল্টির দিকে তাকিয়ে মিচকে হাসি দিয়ে বলল, এটা খেলনা পিস্তল।তারপর হেমন্তর দিকে তাকিয়ে বলল, এই ছাগল।একটু হাস তো হা হা করে।অনেকক্ষণ হাসিস না।

 

বুল্টি বিকেলবেলা প্রমথেশের বাড়িতে এসে নান্টুদের শেখানো কথাগুলো বলে গেছে প্রমথেশের বউকে।এও বলে গেছে প্রমথেশ তাকে নিজের বোনের নজরেই দেখেন।

প্রমথেশ এখন বেজায় সুখী।সবচেয়ে সুখের ব্যাপার হল তিনি যে চরিত্রহীন না, কোনো বদ স্বভাব নেই তাঁর সেটাই প্রমানিত হল তাঁর স্ত্রীর কাছে এতদিন বাদে।

তিনি এখন মাঠের দিকে যাবেন ওদেরকে টাকাটা দিতে।একটা পাঞ্জাবী পরলেন আজ।এমনি দিন হাওয়াই শার্ট পরেন।দুহাজার টাকা পাঞ্জাবীর পকেটে রাখলেন।

প্রমথেশের স্ত্রী প্রমথেশের কাছে এসে দাঁড়ালেন, কোথাও যাচ্ছ ?

প্রমথেশ একটু চমকে উঠলেন, হ্যাঁ।

বসো একটু। এত ভয় পাও কেন আমাকে ?

প্রমথেশ বললেন, ভয় !কই নাতো?

তুমি লোক ভালো।তোমার মেয়েদের প্রতি কোনো কুদৃষ্টি নেই সেটা আমি জানি।এতদিন সংসার করলাম আর এটা জানব না ? তবে সেদিন সত্যি আমি তোমায় ভুল বুঝেছিলাম।আমার উচিত ছিল তোমাকে সাপোর্ট করা।অন্য বউরা হলে তাই করত।

প্রমথেশের বলবে বলে ভাবল, তুমি এগুলো আগে বললে না কেন ? তাহলে দুহাজার টাকা ওদের দিতে হত না।এখন প্রমাণ পেয়েছ তাই ভালো সাজার চেষ্টা।

কিন্তু তিনি সেটা না বলে সংক্ষেপে বললেন, ও আচ্ছা।

প্রমথেশের আজ বড়ই আনন্দের দিন।তাঁর বউ তাঁর সাথে এত নরম সুরে কথা বলছে যে তাঁর আবেগে চোখের কোণে জল এসে যাবে বোধহয়।শরীরটাও যেন কাঁপছে।এ কাঁপা আবেগের কাঁপা।

প্রমথেশ যতটা হাসিমুখ করা যায় ততটা হাসিমুখ করে ঘর থেকে বেরিয়ে মাঠের দিকে এগুলেন।ওরা যে উপকারটা করল সে আর ভুলবার নয়।

#