গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০২১

ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী

 


বিশু খুড়ো  

আজ বিশু খুড়ো কে খুব মনে পড়ছে l আজ ওনার জন্মদিন l ওনার পুরো নাম বিশ্বভূষণ ভট্টাচার্জী l আমরা বিশু খুড়ো বলেই ডাকি l বিশু খুড়ো বিপত্নীক l বয়েস 78 হল এখন চোখে ভালো দেখতে পারেন না l তাই  মেজাজটা সর্বদা খিট খিটে l অবসরের পরে আরো খিট খিটে হয়ে গিয়েছেন l ঘরে মানুষ জন বলতে উনি আর ওনার এক নাতি l সে মাঝে মধ্যে দাদুর কাছে আসে কিন্তু পরক্ষনেই ফিরে যায় নিজ গৃহে l

 

 বিশু খুড়ো মানুষটা ভালো l কোলকাতা পোর্ট ট্রাস্টে চাকরি করতেন l একাউন্টস অফিসার হয়ে রিটায়ার করেন l রিটায়ারমেন্টের পর কলকাতায় একটা ছোট টু  রুমের ফ্ল্যাট কিনে সেখানেই থাকেন l পেনশনের টাকায় ভালোই চলে উপরন্তু  অবসর সময়ে সাহিত্য চর্চা চুটিয়ে করেন l অনেক ভালো ভালো কবিতা উনি উপহার দিয়েছেন সংগে রাজনৈতিক পর্যালোচনা, নাট্য সমালোচনা,গল্প উপন্যাস ইত্যাদি অনেক লেখা পরিবেষণ করে সুনাম অর্জন করেছেন  l সুদূর বাংলাদেশ থেকে ওনার ডাক পড়ে সাহিত্য সমারোহে  তা ছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ওনাকে বিশেষ অতিথী করে নিমন্ত্রণ করা হয় l বিশু খুড়ো কিন্তু অত্যন্ত সাদা মাটা মানুষ এবং নিরঅহংকার ও বটে l  একটা পুরোনো মোবাইল তাও রাবার ব্যান্ড দিয়ে আটকানো তার কভার l আমাদের বলেন কি হবে ঐ স্মার্ট ফোন নিয়ে?

আবাসনের অন্য লোকেদের সংগে সম্পর্ক ভালো l সবাই বিশু খুড়ো বলেই ডাকেন l  পাড়ার ছেলে ছোকরারা বিশু খুড়ো কে কোনদিন মন্দিরে যেতে দেখেন নি l উনি কট্টর বাম পন্থী l মন্দিরে যাওয়াটা নাকি অশিক্ষিতের লক্ষণ l  তাই শ্রাবণ মাসে শিবের মাথায় জল ঢালাটা ওনার মতে  হাস্যকর এবং অযুক্তিকর l

  ঐ আবাসনের বয় জ্যেষ্ঠ সেক্রেটারি মহাশয়,নীলকণ্ঠ সমাদ্দার বলেন শ্রাবণ মাস মানেই শিবের আরাধনার মাস l  শ্রাবণ মাসের প্রতি সোমবার শিবের মাথায় জল ঢালেন অনেকেই ৷ নিজের সংসার, সন্তানের মঙ্গল কামনায় শিবের পুজো চলে শ্রাবণ মাসভর ৷ কথায় বলে দেবাদিদেব মহাদেব ৷ অর্থাৎ সব ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ  শিব ! তিনি মহা যোগী, মহেশ্বর l

সেই ঈশ্বরের পুজোয় সব মনস্কামনা পূরণ হবে ৷ শান্তি প্রাপ্তি হবে জীবনে এবং সংসারে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে ৷

পুরাণ মতে এই শ্রাবণ মাসেই বিষ পান করেছিলেন মহাদেব ৷ বিষ পানের ফলে তাঁর সারা শরীর নীল হয়ে যায় ৷ সেই কারণেই তাঁর মাথায় জল বা দুধ ঢেলে পুজো করা হয় ৷ শ্রাবণ মাসের প্রতিদিনই এই আচার পালন করা হয় ৷ তবে যে হেতু সোমবার শিবের বার বলেই পরিচিত, তাই সোমবারেই বিশেষ পুজো হয় ৷ শ্রাবণ মাসের ৪টি বা ৫টি সোমবার ধূমধাম করে পুজো করা হয় ৷ প্রচলিত বিশ্বাস শিবের পুজোয় দূর হয় জীবনের সব সমস্যা ৷

বিশু খুড়ো এই যুক্তি শুনে হেঁসে গড়িয়ে যান বলেন মূর্খের দলকে কি বলে বোঝাবো l ওরে শিব বিষ খেয়েছিলেন বলে কোন পুরাণে আছে ? শিব পুরণে! ও ওগুলো কিছু ব্রাহ্মণ নিজেদের রোজগারের জন্য অন্ধ ভক্তদের মগজ ধোলাই করে মগজে বিষ ঢেলেছেন l কাজ কম্ম কিছু নেই রাস্তায় লম্বা লাইনে জল নিয়ে গাড়ি মোটর বন্ধ করে ধর্ম অর্জন l লজ্যা করেনা l

 

চাকরি করেছেন বটে তবে প্রায় নাকি খটা খটি লাগতো উপরিস্থ হাকিমের সংগে l 

 কথাটা শোনা তাই বিশেষ গুরুত্ব দিই না ঐ কথার ওপর l নিন্দুকেদের কিছু একটা রটালেই হল l

একদিন শীতের সকালে বিশুদার বাড়ির কাজের মাসি বেল বাজিয়েই যাচ্ছেন কিন্তু দরজা আর খোলেনা l বেলা 10 টা বাজলো তবুও দরজা খোলে না l কাজের মাসি সিকিউরিটি কে ডাকেন l সে এসে দর্জা ধাক্কায় কিন্তু কোন শব্দ হয়না l আবাসনের লোক জন জড়ো হতে আরম্ভ করেন l আমাদের আবাসনের সোসাইটির  সেক্রেটারি  নীলকণ্ঠ সমাদ্দার মহাশয় আসেন l দরজা ভেঙে ঢোকা হয়  l  সবাই দেখে অবাক বিশু খুড়ো অচৈতনি অবস্থায় বিছানায় পড়ে আছেন l গায়ে জ্বর l উনি মেয়ের বাড়িতে একটা ফোন পর্যন্ত করতে পারেন নি বোধ  হয় l তা  নাহলে ওনার নাতি নিশ্চই চলে আসতো তার দাদুকে দেখতে l

নীলকণ্ঠ বাবু ধার্মিক মানুষ l সংগে সংগে এম্বুলেন্স ডেকে বিশু খুড়ো কে হাঁসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন এবং ওনার  মেয়ের বাড়িতে  ফোন করেন l নীলকণ্ঠ বাবু প্রত্যেকের সংগে আন্তরিক সম্পর্ক রাখেন এবং আপদে বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েন l এটাই ওনার মহানতা l তাই ওনেকেই সোসাইটির সেক্রেটারি করেন সবাই l

যাইহোক ভগবানের দয়ায় বিশু  খুড়োর করোনা টেস্টে নেগেটিভ দেখায় পরে ডাক্তারি  চিকিৎসায় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ঘরে ফেরেন l

ওনার মেয়ে নাকি বাবা তারকনাথের কাছে  মানত করেছিলেন বাবার সুস্থতা কামনা করে l বাবা তারকনাথ  শুনেছেন মেয়ের ডাক তাই বিশু খুড়ো সুস্থ হয়ে ঘরে ফেরেন l এই কথা কিন্তু কিছুতেই মানতে নারাজ আমাদের বিশু খুড়ো l বলেন ওরে ঠাকুর যদি বাঁচাতেন তবে ডাক্তাররা আছেন কি করতে?

মেয়ে বলে না বাবা ডাক্তাররাও মানেন এক ঐশ্বরিক শক্তি কাজ করে তাই তাঁরাও ভগবানকে ডাকেন অপারেশন করার আগে l পেসেন্টকে আশ্বাস দেন ভগবানের ওপর বিশ্বাস রাখুন আপনার রোগী নিশ্চই ভালো হয়ে যাবেন l আজ ঐ নীলকণ্ঠ জেঠু তোমার ফ্ল্যাটের দরজা না ভাঙলে তোমাকে আমরা বাঁচাতে  পারতামনা, সে খেয়াল আছে! উনি ঈশ্বর বিশ্বাসী তাই তোমাকে ঈশ্বর ই বাঁচিয়েছেন এটা মাথায় রেখো l তিনি সর্ব শক্তিমান তাঁর ওপরে কেউ নেই l এখন থেকে একটু ঠাকুর পুজো কর l ব্রাহ্মণ সন্তান হয়ে গলায় পৈতে নেই তোমার, লোকে আমাকে যা তা  বলে l

বিশু খুড়ো মেয়ের মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকেন আর তাঁর স্ত্রীর কথা মনে করেন... ঐ এক ই কথা তাঁর স্ত্রী বলতেন তাঁকে l বয়েস হয়েছে মেয়ের কথা শোনা উচিৎ মনে মনে ভাবেন কিন্তু না ঐ পৈতে ধারণ অসম্ভব l ওটা নতুন করে করা সম্ভব নয় ওনার কাছে l হ্যাঁ ঈশ্বর তিনি মানেন তবে তাঁকে আকারে সীমাবদ্ধ করতে নারাজ l তিনি নিরাকার পরম ব্রহ্ম  l এটাই তাঁর বিশ্বাস