হ্যান্টেড কাহিনী--৫৬
কিত্ কিত্ কিত্...
কিত্
কিত্ কিত্...তখনও ভোরের আলো ফোটেনি, ফুটবে ফুটবে করছিল। জীতুর কানে এসে শব্দগুলি লাগলো। কি
হল ! আজকে ছাদে কিত্ কিত্ খেলছে কে ? কালই তো খুকুমণি মরে গেল। কিছু
না, মাত্র এক দিনের জ্বরে সে মরলো।
ডাক্তার বলেছিল, ব্রেন ফিভারে মারা গেছে খুকুমণি--
এই খুকুমণির সঙ্গে জীতুর খুব ভাব ছিল। এক দিন খুকুমণি তাকে বলেছিল, চল, কিত্ কিত্ খেলবি ?
জীতু
বলেছিল, সে তো মেয়েদের খেলা ?
খুকুমণি
বলেছিল, আমরা তো বন্ধু, আমাদের মধ্যে আবার ছেলে আর মেয়ে
কি ?
কথাটা
জীতুর মনে ধরেছিল। সে ভুলে গেছিল, সত্যিই তো, ছেলে মেয়ের পার্থক্য কোথায় ? আর যেখানে এটা একটা খেলা মাত্র, তাও বন্ধুর সঙ্গে--তারপর থেকেই
কিত্ কিত্ খেলা শুরু হল--
ফ্ল্যাট
বাড়িতে কেউ কাউকে বিশেষ একটা না চিনলেও জীতুর পাশের বাড়ির মেয়ে খুকুমনির সঙ্গে
ভাব হয়ে গিয়েছিল। ওরা দুজনেই যেন খেলার সঙ্গী, অন্য ছেলেমেয়েরা খুব একটা ওদের সঙ্গে ঘেঁষত না। আগে
যে দু-একজন এসেছিল, তাদের সঙ্গে খুকুমনি ও জীতুর বন্ধুত্ব হয়ে উঠতে পারেনি। কেবল
খুকুমণি ও জীতু দুজনে একসঙ্গে খেলাধুলা করতে ভালবাসত।
ভোরে
খুকুমণি ও জীতু ছাদে উঠে যেত। ওদের প্রধান খেলা ছিল, কিত্ কিত্। লাফ দিয়ে কোট পার করে করে যেতে হত সঙ্গে বারবার ছুঁড়ে
দিতে হত চ্যাপ্টা কোন সিমেন্টের বা মাটির পাত্রের চাড়া।
কিত্
কিত্ কিত্...খুব আশ্চর্য হল জীতু, তা হলে আজ ছাদে কে কিত্ কিত্ খেলছে ? শুয়ে শুয়ে সে জানালা দিয়ে
বাইরের দিকে তাকাল। ভোর হচ্ছে, অন্ধকার ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। কৌতুহলী হল জীতু, শব্দগুলি অস্পষ্ট হলেও জীতু স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল। জীতু
ধীরে ধীরে উঠে বসল, খাট থেকে নেমে পায়ে চপ্পল গলিয়ে সে আস্তে আস্তে ছাদে গিয়ে
পৌঁছালো। তখনও আধ-অন্ধকার ছাদ, জীতু একটু এগিয়ে গেল। ছাদের এক ধারে খড়ি দিয়ে ছক কাটা আছে, কিত্কিত্ খেলার ছক। জীতু পায়ে
পায়ে আরও এগিয়ে গেলো, মনে মনে ভয় পেলেও সে কৌতুহলী ছিল। একি ! আশ্চর্য হল, জীতুর মনে হল কোট জুড়ে কেউ যেন খেলছে না ! তার
শরীর আবছা দেখা যাচ্ছে, ছায়া মত, ছায়ার মুখ থেকেই যেন কিত্ কিত্ খেলার শব্দ বেরিয়ে যাচ্ছে। তার গুটি
ফেলার শব্দ হচ্ছে। তার লাফাবার আওয়াজ হচ্ছে। কিত্ কিত্ খেলার শব্দগুলি যেন
ধ্বনিত না, প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে।
--কে? কে?? জীতু ভয় পেয়ে বলে উঠল।
কোন
উত্তর নেই, অন্যদিকে কোটে গুঁটি পড়ছে, সে সঙ্গে কিত্ কিত্ শব্দ হয়ে চলেছে।
--আমি
খুকুমণি, নাও, এবার তোমার দান--
জীতু
দেখলো, এ ত সত্যি, তার সামনে খুকুমনি দাঁড়িয়ে আছে !
চারপাশটা তখন অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে এসেছে। জীতুর সামনে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে
খুকুমণি ! খুকুমনিকে দেখে সে যেন মোহিত হয়ে গেল। কিত্ কিত্ কিত্ জীতু ও খুকুমনি
খেলে চলেছে।
অন্যদিকে
বেলা বেড়ে চলেছে। জীতুকে সকালে স্কুলে যেতে হবে কিন্তু কোথায় গেল জীতু ? খোঁজ খোঁজ খোঁজ, তারপর হঠাৎ সবার কানে এলো ছাদ
থেকে ভেসে আসছে কিত্ কিত্ খেলার শব্দ। চমকে উঠলেন জীতুর বাবা-মা। ওঁরা তাড়াতাড়ি
উঠে এলেন ছাদে। তাঁরা দেখলেন জীতু একা একা কিত্ কিত্ খেলে যাচ্ছে। ওঁরা আশ্চর্য হলেন, জীতু যেন কার সঙ্গে কথা বলছে, হাসছে। এদিকে খুকুমনির মা-বাবাও
ছাদে উঠে এসেছেন।
এক সময়
ছাদে অনেক লোক জমা হল। ওরা সবাই মোহিত হয়ে জীতু ও খুকুমণির খেলা দেখে যাচ্ছে।
খুকুমণি ও জীতুর দেহ তখন স্পষ্ট সবার সামনে প্রকট হয়ে আছে। প্রায় আধ ঘন্টা পার হয়ে গেলে খেলা থেমে গেল।
লোকরা সংবিৎ ফিরে পেয়ে দেখতে পেল, জীতু একা দাঁড়িয়ে। জীতু অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, এখানে এত লোক কেন ? একটাও কথা না বলে জীতুর মা জীতুর
হাত ধরে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে গেলেন।
এখন
জীতু দিন ভর স্বাভাবিক থাকলেও শেষ রাতে তার ঘুম ভেঙে যায়। ও শুনতে পায়, খুকুমণি ছাদে কিত্ কিত্ খেলছে। প্রচন্ড ইচ্ছে থালেও ছাদে সে
যেতে পারে না--নিজের ঘরেই সে ছুটোছুটি করে বেড়ায়। তার ঘরের দরজা বাইরে থেকে তালা
বন্ধ থাকে। পুবের সূর্য তার ঘরের জানলা দিয়ে যখন উঁকি মারে তখন সব
কিছু স্বাভাবিক হয়ে যায়--জীতু স্কুলে যায়, পড়াশুনা করে, বিকেলে খেলে বেড়ায়।
সমাপ্ত