গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০২১

সুধাংশু চক্রবর্তী

 

ভাসছি আতঙ্কের স্রোতে

 

দেশ জুড়ে লকডাউন চলছে । আমি একজন সামান্য ব্যবসায়ী । ছোটোখাটো খেলনার দোকান চালাই । পড়াশোনা করেও একটা চাকরী জোটাতে পারিনি । স্ত্রী ঋতমার বড় হয়ে ওঠা এবং পড়াশোনা সবই এলাহাবাদে । সেখান থেকেই হিন্দিতে এম এ করেছে । ছোটখাটো  দোকানের সামান্য আয়ে সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে দেখে ঋতমা স্বেচ্ছায় বেশ কিছু ছাত্রছাত্রীকে হিন্দি ভাষার কোচিং দিতে শুরু করে । ছাত্রছাত্রীদের ভাগে ভাগে শেখায় । এক একটা ভাগকে সপ্তাহে তিন দিন সময় দেয় । এতে উপার্যন ভালোই হচ্ছিলো । কিন্তু লকডাউন যে তাতেও থাবা বসিয়েছে । 

 

ঋতমা এখনো অনলাইনে ক্লাস নিলেও ছাত্রছাত্রীরা এসে দিয়ে যেতে পারছে না তাদের মাসমাহিনা । অনেক অভিভাবকই বলেছেন ব্যাঙ্ক মারফৎ পাঠিয়ে দেবেন । কিন্তু সেই আশাও যে দুরাশায় এসে ঠেকেছে । এদিকে লকডাউনের দরুন আমার কারবার বন্ধ । অগত্যা জমানো টাকার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে আমাদের । 

 

বাজার, মুদীখানা এবং ওষুধের দোকান খোলা রয়েছে । প্রতিবেশীরা যে যতটা পেরেছে সর্বপ্রকার রসদ মজুত করে রেখেছে নিজেদের বাড়িতে । আমিও বাদ নই । এই কেনাকাটার সুবাদে পকেট প্রায় খালি হয়ে এসেছে । তবু খানিকটা নিশ্চিন্ত রয়েছি এই ভেবে যে, আর কিছু না হোক কিছুদিন অন্তত ডাল ভাত খেয়ে বেঁচে থাকতে পারবো । কিন্তু ভাত-ডালই তো সবকিছু নয় । 

 

লকডাউনের দরুন গোঁদের ওপর বিষফোঁড়ের মতো জামাকাপড়ের হালও যে বেহাল হয়ে চলেছে । কেভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাবার তাগিদে প্রতিদিন আছড়েপিছড়ে সাবানকাচা করলে জামাকাপড়ের অবস্থা যে দফারফা হবে সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না । এদিকে নতুন জামাকাপড় কিনে আনবো সেই উপায়ও নেই । কাপড়চোপড়ের দোকানগুলোর অবস্থাও আমার দোকানেরই মতো । বন্ধ রয়েছে । এভাবে আরও কিছুকাল চললে আমাদের যে অর্ধউলঙ্গ হয়ে ঘরে বসে থাকতে হবে ।

 

আমরা দুই ভাই এক বাড়িতে থাকলেও হাঁড়ি আলাদা । ভাই বিল্লো চাকরী করে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে । ওকে মাঝেমাঝেই কোম্পানীর কাজে বাইরে যেতে হয় । এবার গিয়েছে অসমের ডিব্রুগড়ে । আচমকা লকডাউন ঘোষিত হওয়ায় বিল্লো এখন ওখানেই আটকে গেছে । কবে ফিরতে পারবে জানি না । সময় কারও জন্য বসে থাকে না । আমাদের জন্যও নয় । 

 

বিল্লোর ছয় বছরের পুত্র দীপু বাবাকে কাছে না পেয়ে দিনরাত ‘বাবা-বাবা’ বলে কেঁদেই চলেছে । বিল্লোর ফোন এলে হুড়মুড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে, ‘তুমি কবে আসবে বাবা ? এবার এলে তোমাকে আর কোথাও যেতে দেবো না আমি ।’ দীপুর এই কথায় ফোনের ওপর প্রান্তে নামে অশ্রুধারা । বিল্লো নিজেও জানে না আর কতদিন স্ত্রী-পুত্রের বিচ্ছেদ বেদনা সইতে হবে ওকে । দীপুর কথায় আমার বুকের ভিতরটায় মোচড় দিয়ে ওঠে । আহা রে, ছেলেটা কীকরে জানবে লকডাউন কাকে বলে ।

 

প্রতিবেশী লাহাবাবুর ছেলে অচিন্ত কর্মসূত্রে মহারাষ্ট্রে থাকে । পুনের উপকণ্ঠেই ছোটোখাটো একটা পাইস হোটেলে খাবার সার্ভ করে খদ্দেরদের টেবিলে টেবিলে । সেই সুবাদে মাসমাহিনার সাথে টিপসের সৌজন্যে কিছু বাড়তি টাকাও হাতে আসে । মাঝেসাঝে ফোনে কথা হয় লাহাবাবুর সঙ্গে । লকডাউনের দরুন সেই হোটেল এখন বন্ধ হয়ে গেছে । বেকার অচিন্তকে ওখানেই থেকে যেতে হয়েছে । চাইলেও ঘরে ফিরে আসার উপায় নেই যে । 

 

পুনেতেই রয়েছে । গুটিকতক বঙ্গসন্তানের সঙ্গে একটা বাড়ি ভাড়া করে । ওর হাতের টাকাও প্রায় ফুরিয়ে এসেছে । কোনোমতে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটছে ওদের । এর মাঝেই আরও এক বিপত্তি । বাড়িওয়ালা নাকি বাড়ি ছেড়ে দেবার জন্য জোর তাগাদা দিচ্ছে । খামোখা না খেয়ে শুকিয়ে মরার চেয়ে বাড়িতে ফিরে আসাই ভালো হবে ভেবে অচিন্তরা মনঃস্থ করেছে, পায়ে হেঁটে কিম্বা মালবাহী ট্রাক ধরে - যে কোনো উপায় দেশে ফিরে আসবে ।

 

এসবই প্রায় দিন দশেক আগেকার কথা । আজ সকালে কান্নার রোল উঠতে লাহাবাবুর বাড়ি গিয়ে শুনলাম, ছত্তিশগড় থেকে হাইওয়ে পেট্রোল পুলিশ ফোন করেছিলো । ফোন মারফৎ লাহাবাবুরা জেনেছে অচিন্ত এবং ওর কিছু সঙ্গী নাকি একটা ট্রাক ভাড়া করে দেশে ফিরছিলো । গত বিকেলে ছত্তিসগড়ে রায়পুরের অদূরে হাইওয়ের ধারে ট্রাক থামিয়ে যখন চা খাচ্ছিলো, একটা ভারী মালবাহী ট্রাক তখনই আচমকা এসে ওদের পিষে মেরে ফেলেছে । দুর্ঘটনা ঘটার আগের মুহূর্তে ওদেরই এক জন গিয়েছিলো চায়ের দাম মিটিয়ে দিতে । একমাত্র সেই যুবকই প্রাণে বেঁচেছে । 

 

পুলিস তার কাছ থেকে মৃতদের বাড়ির ফোন নম্বর নিয়ে প্রতিটি পরিবারকে ফোন করে দুর্ঘটনার সংবাদ দিচ্ছে । শোনা ইস্তক ভয়ে আমার বুক কাঁপছে । হা ঈশ্বর, জানি না এরপর আরও কি কি দেখতে এবং শুনতে হবে আমাদের 

 

দেড় মাসের ওপর হলো লকডাউন চলছে । কিছু কিছু পরিযায়ী শ্রমিককে অন্য প্রদেশ থেকে ট্রেনে করে দেশে ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু হয়েছে । এদিকে আমাদের দানাপানির ভাঁড়ারও প্রায় শূন্যতে এসে ঠেকেছে । চিন্তায় চিন্তায়  রাতের ঘুম উধাও হয়েছে । দোকান খোলার অনুমতি দিচ্ছে না । শুনেছি মৃন্ময় আজকাল আলু পেঁয়াজ বেচে বাড়ির সামনে বসে । আমার দোকানের পাশেই ওর ইলেকট্রিক সরঞ্জামের দোকান । আমার মন সায় দেয় না ওতে । যতদিন সম্ভব ঘটির জল গড়িয়ে খেয়ে যাই তো । তারপর দেখা যাবে । ততদিনে লকডাউন নিশ্চয়ই উঠে যাবে ।       

 

এই লকডাউনের মাঝেই ধেয়ে এলো দুর্নিবার তুফান আমফান । দু’দিন আগে গোটা দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে বেজায় তাণ্ডব চালালো বিকেল থেকে গোটা রাত । সেই রাতেই ভোরের দিকে যাদবপুর থেকে ঋতমার দিদির ফোন এলো । ওর জামাইবাবুর নাকি হার্ট অ্যাটাক হয়েছে । দিদির বড় ছেলে মলয় লকডাউনের তোয়াক্কা না করে ওই দুর্যোগের মাঝেই অনেক ছোটাছুটি করেও জামাইবাবুকে ধরে রাখতে পারেনি । একটু অক্সিজেন এবং কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধের অভাবে জামাইবাবু মারা গেলেন ভোরের দিকে । 

 

শোনা ইস্তক ঋতমা খুব কান্নাকাটি করেছে । জামাইবাবুকে শেষ দেখা দেখতে পেলো না যে । এমন দুর্দিনে হালিশহর থেকে যাদবপুর যাওয়া কি চাট্টিখানি কথা ? ট্রেন-বাস চলছে না । ভাড়ার গাড়ীও যেতে চাইবে না পুলিশি ঝামেলায় জড়াতে চায় না বলে । অগত্যা অনেক কষ্টে ঋতমাকে শান্ত করতে হলো ।

 

আজ বিকেলে চায়ের কাপ হাতে এগিয়ে দিতে দিতে ঋতমা জানালো, চায়ের পাতা ফুরিয়েছে । পাড়ার মুদীখানা খোলা থাকলেও... কখনো ধারে  কিছু কিনিনি । ধার চাইতে লজ্জা পাই । গিয়ে বলতেও পারছি না ধারে দাও । অথচ দিনে অন্তত চার কাপ চা না হলে আমার আবার মন ভরে না । ঋতমাই একটা উপায় বাতলে দিলো, তোমার বন্ধুর থেকে চেয়ে নিয়ে এসো । পরে ফেরত দিলেই হবে ।

 

অগত্যা রাতের অন্ধকারে চায়ের খালি পাত্র নিয়ে গুটিগুটি পায়ে হাঁটা দিলাম বন্ধু রমেনের বাড়ির দিকে । আমফানের কৃপায় গোটা শহর অন্ধকার হয়ে আছে । এতো গাছপালা উপড়ে দিয়ে গেছে যে, সেসব কেটে পরিষ্কার করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করাটাই এক বিশাল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে । এর সাথে এসে জুটেছে তার সমেত বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে যাওয়ার ঘটনা । 

 

এতোকিছু কাটাছাঁটা, মেরামতির পর বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে কিছুটা সময় তো লাগবেই । মানুষগুলো দিনরাত খেটে মরছে যাতে যত দ্রুত সম্ভব বিদ্যুতের অব্যবস্থাটাকে বাগে আনতে পারে । বাড়িতে ইনভার্টার আছে । ব্যবহার করছি খুবই হিসেব করে । তাই তিন দিন ধরে অন্তত একটা ঘরে আলো জ্বালাতে পারছি । টিভিতে সংবাদ দেখতে পাচ্ছি ।    

 

যাই হোক, অন্ধকারে পথ হাতড়ে এগোচ্ছি রমেনের বাড়ির দিকে । সহসা কারও সঙ্গে ধাক্কা লেগে যাওয়ায় চায়ের পাত্রটা হাত থেকে পড়ে গেল ‘ঠং’ করে শব্দ তুলে । কিন্তু একটার বদলে দুটো শব্দ হলো কেন ! আমি তো একটা কৌটো নিয়ে ! সহসা অন্ধকারেই রমেনের গলা বেজে উঠলো, সুধীর নাকি ?

- রমেন তুমি ?

- জানোই তো লকডাউন চলছে । এদিকে পকেটও খালি হয়ে গেছে ।   

- আমারও তাই । 

- আজ চায়ের পাতাও ফুরিয়েছে ।

- আমারও ।

- তাই যাচ্ছিলাম...

- আমিও তো...

- মুদির দোকানে নিশ্চয়ই ? ঝটপট নিয়ে এসো ভাই । প্রাণটা বেজায় চা-চা করছে । এই ক’দিনে অনেক ধারদেনা হয়ে গেছে ভাই । লজ্জায় আর ধারে চা’পাতা দেবার কথা বলতে পারছি না দোকানীকে ।

 

কি বলবো ভেবে পাচ্ছি না যখন রমেনের ছেলে টুবলাই তখনই ছুটে এলো, তাড়াতাড়ি বাড়ি চলো বাবা । পিসি ফোন করেছেন । 

- রুমকীর ফোন ! কি বললেন তোর পিসি ?

- জানি না । বাড়ি গিয়ে মায়ের মুখে শুনো ।

 

টুবলাই এতোটা বলে অন্ধকারেই ছুটলো বাড়ির দিকে । রমেনও চায়ের কথা ভুলে দ্রুত অনুসরণ করলো ছেলেকে । আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অনেক ভেবেচিন্তে অবশেষে লাজলজ্জা ভুলে হাঁটা দিলাম মুদীখানার দিকে । স্বস্তি হবে না ? হাতের টাকা প্রায় ফুরিয়ে এসেছে । এই অসময়ে ছেলেবেলার বন্ধু রমেন কিছু চাইলে আমি যে না দিয়ে থাকতে পারবো না । অথচ আমার হালও যে খুব একটা ভালো নয় সেকথাও বলতে পারবো না ওকে ।   

 

রাত্রে চায়ের কাপ হাতে অন্ধকার ঘরে টিভি খুলে সংবাদ চ্যানেলে চোখ রেখে দৃশ্যটা দেখেই বুকের ভিতরটায় বেদম মোচড় দিয়ে উঠলো । নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, ‘আহা রে’ । ঋতমা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো । সংবাদ পাঠক কত কিছু বলে চলেছেন সেসব আর কানে ঢুকছে না । বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি টিভিতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাতে থাকা মর্মান্তিক ফুটেজটার দিকে । 

 

বছর দেড়েকের একটা কচি শিশু কোন একটা স্টেশন চত্বরে ঘুমন্ত মায়ের আঁচলের তলায় বারংবার ঢুকছে আর বেরোচ্ছে । পতারপরই আবার বেরিয়ে এসে ঘুরঘুর করছে ঘুমন্ত মায়ের চারপাশে । টিভিতে ফুটে আছে হাইলাইট করে দেওয়া মোটা অক্ষরের দুটো শব্দ, ‘মায়ের মৃতদেহ’ ।