পরশুরাম
নয় ছেলে আর পাঁচ মেয়েকে নিয়ে মিতা ও তার বর পাঁচবিঘে জমির আমবাগানে
বেশ সুখেই ছিল। মিতার বর মিলিটারি বিভাগে কাজ করার সময় এক অত্যাচারী লম্পটকে মেরে জঙ্গলে
পুঁতে ফেলেছিল। কেউ জানতে পারে নি। তারপর কয়েক বছর পরে চাকরি ছেড়ে তার শখের আমবাগানে
চলে এল। একরাশ বৃষ্টিফোঁটার ঝাপটা লাগা সুখে সে মিতার সংসারে মেতে গেল। ছেলেরা ধীরে
ধীরে বড় হল। একে একে তাদের বিয়ে হল। চাকরির সন্ধানে তারা চলে গেল বাড়ি ছেড়ে। মিতার
বয়স হল। তার বর চলে গেল পরপারের ডাকে।
আমবাগানে মেজ ছেলে, ছোট ছেলে কে নিয়ে মিতা শেষ বয়সে আনন্দে ছিল। বয়স
পঁচাশির কোঠায় হল মিতার। তবু সে মুড়ি ভাজে, বাগান পরিষ্কার রাখে।
মিতা বেশ কিছুদিন ধরে তার এক টি ছেলে সনৎকে দেখতে পায় না। সব ছেলে মেয়েরা
মায়ের সঙ্গে দেখা করে কিন্তু সনৎ কেন দেখা করে না। প্রশ্ন করে মিতা সব ছেলে মেয়েদের।
কেউ বলে, মা আমি কি করে বলব তার কথা। আবার কেউ বলে, ওর ব্যাপার অই জানে, আমরা জানি
না মা।
মিতার কেমন যেন সন্দেহ হয়। সে ভাবে, ছেলেটি কি মরে গেল? আর দেখা
করে না কেন। আবার ভাবে, হয়ত রাগ হয়েছে বলে আসে না। মিতার মনে প্রশ্নগুলো ভিড় করে আসে।
ময়ুরাক্ষীর ধারে বাড়ি মিতার। ছোট থেকেই এই নদীর বুকেই তার যত অভাব অভিযোগ
ছুঁড়ে দেয়। ফাঁকা নদীর ধারে চেঁচিয়ে সে মন হাল্কা করত। আজ মিতার নদীর ধারে যাওয়ার ক্ষমতা
নেই। তাই বাড়িতে বসেই কাঁদে আর নদীকে গোপন কথা বলে।
ছোট ছেলে ছিদাম মদ খাওয়া ধরেছে দাদা মরার পর থেকে। সংসার আর তার ভাল
লাগে না। মায়ের কাছে বসে। মা তার হাতে পরা আংটি দুটি হাত দিয়ে ধরে দেখে। ছিদাম কথা
বলে না। শুধু মায়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকে। মা, তার না বলা কথা কেমন করে বুঝে যায়। মা
বলেন, ভাল করে সংসার কর। শরীরের যত্ন নিও। আর তারপরেই বলেন, হারে ছিদাম তোর দাদা সনৎ
আর দেখা করে না কেন?
ছিদাম কি করে বলবে,জানি না মা।
সে কি করে মাকে বলবে, দাদা মারা গেছে ক্যানসারে। আর এক দাদা ভুগছে রোগে।
কখন কি হয়, কেউ জানে না। আর মায়ের বয়স পঁচাশি হল কিন্তু মরার কোন লক্ষণ নেই। ছিদাম
ভাবে, কেউ চায় না মা মরুক। কিন্তু দাদারা মরার লাইনে নাম লিখিয়েছেন। ছিদামের শরীরও
ভাল নেই। মা পুত্রশোক পেলে বাঁচবেন না। আর বিছানা থেকে উঠতে পারে না মিতা। তবু কোনও
ছেলে বলে না। ছিদাম ঠিক করে নিল, আজ সে বলবে মাকে সমস্ত ঘটনা। মা মরে যায় যাবে? মরবে না
বেঁচে যাবে। সে ভাবে, রাতে হেগে মুতে বিছানায় মাখামাখি। মদ খাই বলে পরিষ্কার করতে পারি। আর
কেউ মায়ের ঘরের দিকে আসে না। বৌ, ভাইঝি,ভাইপোরা কাজ নিয়ে থাকে। আবার রাধামাধবের মন্দির
আছে। ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপার আছে। এমতাবস্থায় কাউকে দোষারোপ করা যায় না।
ছিদাম ভাবে আজ বলবেই মাকে আসল ঘটনা। বাইরে একবার বেরিয়ে এল। কোঁচর থেকে
প্লাষ্টিকের বোতল বের করে তরল পদার্থের সবটুকু গলায় ঢেলে দিল। তারপর আয়েশ করে একটা
বিড়ি ধরাল।
ঘরে ঢুকতেই মা বলল,আয় ছিদাম এখানে বোস। এঘরে ছিদামই বেশি আসে। আর ছিদামের
গায়ের গন্ধ মায়ের চেনা হয়ে গেছে। ছিদাম জানে, মা এবার প্রশ্ন করবে। ঠিক তাই। মা বললেন
, বাবা ছিদাম, তুই বল সনৎ কোথায়। সে আসে না কেন? আর কদিন
ধরে ভোলাকে দেখছি না। কি হল তাদের।
ছিদামের নেশা ধরেছে।নেশার ঝোঁকে সে বলল,আরে মা শোন আসল কথা। সনৎদা দুবছর
আগে মরে গেছে। আর ভোলাদা আজকালের মধ্যেই সেঁটে যাবে বোধহয়। তুমি বুড়ি হয়েছ বলে কেউ
বলে না। আমি বলে ফেললাম। ক্ষমা করে দিও। তবে মা, এবার তোমার মরাই ভাল। আর বেঁচে থাকলে
কষ্ট পাবে গো, বলেই ছিদাম বাইরে তালা লাগিয়ে চলে গেল।
সকাল সকাল উঠে ছিদাম মন্দিরে একটা প্রণাম করে মায়ের ঘরে তালা খুলল।গু,মুত
পরিষ্কার করবে বলে তৈরি হল।
তার আগে ছিদাম মায়ের গায়ে হাত দিল।অনুভুব করল, মায়ের দেহ ঠান্ডা হয়ে
গেছে।
সকলকে ডেকে আনল ছিদাম। মেজদা বললেন, ভাল হল বুঝলি ছিদাম। ছেলে মরার
দুঃখটাতো পেল না। নাকি বল বৌমা।
নাতি নাতনিরা ঠাকুমাকে ভালবাসত। তার ফুলের মালা দিয়ে সাজাল মিতার শেষশয্যা।
ছিদাম একবার দেখল মায়ের মুখের দিক তার মনে হল, মা তাকে যেন হেসে
বলছেন, তুই আমাকে মুক্ত করলি ছিদাম...